অপূর্ব সমাপ্তি পর্ব-২৭

0
323

#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব-২৭

“তুমি এখন থেকে এখানে থাকবে?”

“জ্বি।”

“একেবারে?”

“হ্যাঁ।”

“তোমার মা বাবা আসতে দিলো?”

“আমার মা মারা গেছেন।”

“ওহ ভুলে গেছিলাম। বাবা কিছু বলল না?”

“না।”

“শুনলাম কলেজের টিচার হয়েছ?”

“হ্যাঁ।”

“কী আর বলব তোমায়! বোকা মেয়ে! সম্মানের চাকরি পেয়েছ। দেখেশুনে অন্য কোথাও বিয়ে করে নিলে সুখী হতে পারতে!”

“তা ঠিক বলেছেন।”

“তবুও ফিরে এলে কেন?”

“তাকে কথা দিয়েছিলাম ফিরব।”

“সে তোমার সাথে থাকতে চায়?”

“হ্যাঁ।”

“ও তো কিছুদিন পরই পুরানো জিনিস ভালো লাগে না। তোমাকে এখনো এত পছন্দ করে কী করে সেটা বিরাট রহস্য!” শ্বাশুড়ি মা মুখ হাঁড়ি করে পায়ের ওপর পা তুলে সোফায় বসে আছেন। দেখে মনে হচ্ছে কেউ যত্ন করে ফরসা মুখে কালি মেখে দিয়েছে। চিন্তার ঘোরে আমায় কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। আমার হাসি পাচ্ছে।

আমি বসে আছি আমার শ্বশুরবাড়ির ড্রইংরুমে। সে বিনা নোটিশে হুট করে আমায় একেবারে তুলে নিয়ে এসেছে। এসেই কোথায় যেন গায়েব হয়ে গেছে। আমায় রেখে গেছে এই মূর্তিমান বিভীষিকার কাছে। যদিও তাকে আগের মতো ভয় পাই না। ভক্তিও করি না। উল্টে করুণা হচ্ছে। মহিলা সারাজীবন তার ছেলেটিকে নিজের মতো চালাতে চেয়েও পারেনি৷ সে ছেলে জীবনের প্রতিটা সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েছে। মাকে কষ্ট দিয়েছে। আবার নিজের দেয়া ক্ষত নিজেই সারিয়ে তুলেছে। সমানে বসা মহিলাটির অবস্থাও একপ্রকার আমার মতোই। তবে আমি উনার কষ্টটা বুঝতে পারলেও উনি আমারটা বুঝতে পারেন না, এটাই সমস্যা।

শ্বাশুড়ি মা পা নামিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে বলল, “থাকতে চাইলে থাকো, নিজের ভালো পাগলেও বোঝে। আমার তো বুঝে কাজ হলো না। তুমি না বুঝেই বসে থাকো।”

সে ঘরে ঢুকলো তখন। আমার পাশে বসে হাসিমুখে বলল, “মা ওকে নিয়ে এসেছি। এখন থেকে আর একা থাকলাম না।”

শ্বাশুড়ি মা মুখ বাঁকিয়ে বললেন, “ভালো করেছ৷”

সে এবার মায়ের কাছে গিয়ে তার কোলে মাথা রেখে বলল, “দেখো মা, সব ঠিক চলবে এখন থেকে। তোমার ওকে আগে পছন্দ ছিল না, এখন হয়েছে তো? ও কলেজে চাকরি করে। স্মার্টলি কথা বলতে পারে। তুমি যেমন চাইতে ঠিক তেমন।”

শ্বাশুড়ি মা থমথমে গলায় বললেন, “হ্যাঁ দেখেছি।”

“গুড। মিলেমিশে থেকো তোমরা। আর আমি এই সপ্তাহে অফিসে জয়েন করছি। সো তোমার থেকে দূরে যাওয়ার চান্স নেই। ফর দ্যাট, য়্যু শুড থ্যাংক সমাপ্তি।”

মা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “সমাপ্তিটা কে?”

“এইযে তোমার বউমা। এই নামেই তো লেখালেখি করে!”

শ্বাশুড়ি মা আমার দিকে বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। সম্ভবত আমার লেখা পড়েছেন। কিন্তু জানতেন না আমি লিখেছি। আর ও সারপ্রাইজ দেয়ার আনন্দে ঝলমল করছে। মা বিষ্ময় কাটিয়ে উঠতে পারলেন না। নিজেই উঠে দাঁড়ালেন। আমার কাছে এসে মাথায় হত রেখে বললেন, “অনেক ভালো লেখো তুমি মা, আমি পড়েছি। সবসময় এভাবে লিখতে থেকো। দেখবে একদিন সবাই তোমাকে এক নামে চিনবে।”

আমি তার মুহূর্তেই পরিবর্তিত রুপ দেখে বহুকষ্টে হাসি চেপে রাখলাম। শেষ হলো শ্বশুরবাড়িতে ফিরে আসার ঘটনার সমাপ্তি। যতটা নাটক হবে ভেবেছিলাম ততটা হলো না দেখে একটু কষ্ট পেলাম। প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলাম যে!

.
প্রথম তিনটা সপ্তাহ ঝুম ঝুম বৃষ্টির মতো ভালোবাসা ঝরে পড়ল চারদিকে। চতুর্থ সপ্তাহে ঈশান কোণে কালো মেঘের ছায়া দেখতে পেলাম। সেদিন ভোরে উঠে দেখি সে রেডি হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, “এত সকালে যাচ্ছো কোথায়?”

সে টাই বাঁধতে বাঁধতে বলল, “একটা জরুরি কাজ আছে।”

“তাই বলে এত সকালে?”

“এক ক্লায়েন্টের বাড়িতে যাব। খুব করে ধরেছে। পদ্মার পাড়ে তার বিরাট বাড়ি। বাউন্ডারির ভেতর মাছ ধরার পুকুর, খেলার মাঠ, গরু, ছাগল, মুরগির খামার, সুইমিং পুল পর্যন্ত আছে। সেখান থেকে এসে দুটোয় মিটিং ধরতে হবে। তাই একেবারে বেরিয়ে যাচ্ছি।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “সেটা আগে বললে না কেন?”

“মনে ছিল না বলতে।”

“আজই কেন যাবে? অন্যদিন যেও, সারাদিন থেকে এসো।”

এবার সে রাগত স্বরে বলল, “আমারটা আমাকে বুঝতে দাও। নিজের মতামত চাপিয়ে দেবে না। আমার পছন্দ নয়।”

এই অতি সামান্য কথাটুকুর জন্য বের হওয়ার আগে আর আমার সাথে একটা কথাও বলল না। সোজা চলে গেল। এমন আগেও হয়েছে। তখন আমি নিজে তাকে সরি বললে তারপর কথা বলেছে। আর না বললে তার রাগ কমার জন্য বহু সময় কথাবার্তা বন্ধ রেখে তারপর স্বাভাবিক হয়েছে।

আমি ভেবেছিলাম হয়তো এবার ঠিক হবে, হলো না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে পড়লাম। তবে ভেঙে পড়লাম না এবার। কিছু করার দরকার। মোবাইলের গ্যালারিতে ঢুকলেই মানসিক ডাক্তারের ঠিকানাটা চোখে পড়ে। একবার যাওয়া খুবই দরকার। আজ বুধবার। তার বসার কথা।

.
ডাক্তারের চেম্বারটা দেখে বেশ মজা লাগলো। পুরোটা গোলাপী৷ জানালার পর্দা, দেয়ালের রঙ, সোফার কুশন সব হালকা গোলাপী রঙের। গোলাপীর মাঝে জানালা গলে আসা দিনের আলোতে মনে হচ্ছে ঘরের বাতাস পর্যন্ত এই রঙ ধারন করেছে। ডাক্তারের বয়স পঞ্চাশের আশেপাশে। হাসিখুশি অত্যন্ত সুদর্শন চেহারা। কণ্ঠ পর্যন্ত চমৎকার। আমাকে প্রথমেই বলে নিলেন, “ছোট মেয়ে, তোমাকে তুমি বললে অসুবিধা নেই তো?”

আমার ঘটনা উনি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তারপর মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি চাচ্ছো তোমার স্বামীর রোগ সেরে যাক?”

“হ্যাঁ।”

“শোনো” উনি এমনভাবে বলতে শুরু করলেন, যেন বাচ্চা মেয়েকে বোঝাচ্ছেন, “যে মানসিক রোগ কোনো ট্রমা বা অন্য কোনো কারনে হয়, সুস্থ মানুষ হঠাৎ রোগী হয়ে যায় সেটা ঠিক করার চেষ্টা করাই যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সফলতাও ধরা দেয়। কিন্তু জন্মগত আর বিশেষ করে আচরনগত সমস্যার প্রতিকার মুশকিল! তোমার মতে সে কখনো কখনো খুবই ভালো, আবার কখনো খারাপ। তার মানে সে পরিষ্কার চিন্তা করতে পারে। তবে তার চিন্তাগুলো অন্য সবার থেকে আলাদা। আর তার ভুলগুলো সে নিজের মতো সুন্দর ব্যাখ্যা করতে পারে। তাই না?”

আমি মাথা ঝাঁকালাম।

উনি বললেন, “তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার জগতটা অন্যরকম। একটু একটু করে সে সেখানে বেড়ে উঠেছে। তুমি চাইলেই তাকে সেখান থেকে টেনে অন্য একটা জগতে নিয়ে আসতে পারবে না। ব্যাপারটা অসম্ভবের কাছাকাছি। আমার ধারনা সে ভালো মানুষ। সে যা করে, নিজের চিন্তা অনুযায়ী সেটাই সঠিক। তাই তাকে ভুল ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টাতে সে রেগে যায়। আর সে তার মাকে যেমন ভালোবাসে, ততটাই তোমাকেও বাসে। তাই তোমাকে সে ছাড়তে পারছে না। সে তোমার সাথে যা করেছে তার হিসেবে উপায় না পেয়েই করেছে।”

আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল তার অফিসের ঘটনাটা। সেদিন সে ফ্লোরে বসে পড়ে বলেছিল, “সীতাকে যখন বনবাসে পাঠিয়ে দিল তখন রামের কিছু করার ছিল না।”

আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম, “এখন আমি কী করতে পারি?”

“তার সাথেই যদি থাকতে চাও, মানিয়ে নিতে হবে এভাবেই। তাকে স্পেস দিতে হবে। তর্ক করা যাবে না। সে যা বলবে, সেটা যদি অন্যায়ও হয়, মেনে নিতে হবে। তাছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”

আমি চুপ করে রইলাম দেখে একটু পর উনি বললেন, “এটা পৃথিবীর কোনো স্ত্রীর পক্ষে সম্ভব না।” বলেই হো হো করে হেসে ফেললেন। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, “সরি ডিয়ার, তোমার কষ্টে হাসা উচিত হয়নি। আমি অবশ্য তোমার ব্যাপারে না, নিজের কথা মনে করে হেসেছি। আমি আমার স্ত্রীকে বেশি সময় দেই না, নিজের মতো থাকি, এই অপরাধে সে আমায় ছেড়ে চলে গেছে।”

ডাক্তারকে খানিকটা মুষরে পড়তে দেখে কথা ঘোরাতে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা আপনার ঘরের সব গোলাপী কেন?”

উনি হেসে একটা ছবির ফ্রেম আমার দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। দুই ঝুটি করে ভীষণ সুন্দর একটা বাচ্চা মেয়ে। হাসিতে উজ্জ্বল মুখ। সামনের দুটো দাঁত নেই। পরনে গোলাপী জামা।

ডাক্তার বললেন, “আমার মেয়ে যখন আমার সাথে থাকতো, তখন জেদ ধরে পুরো বাড়ি গেলাপী রঙ করিয়েছিল। তার প্রিয় রঙ। সে চলে যাওয়ার পর আমি অন্য রঙটা বদলাতে পারিনি। তার চয়েস যদিও এখন বদলে গেছ, অনেক বড় হয়ে গেছে মেয়েটা।”

ডাক্তারকে আমার খুব ভালো মনের মানুষ মনে হলো। তবে মানুষটা একাকী, বিষন্ন। আচ্ছা, ওকে ছেড়ে চলে গেলে ও ও কি এমন হয়ে যাবে? খুব কষ্ট পাবে? আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি ওকে ছেড়ে যাব না কোথাও। যেমন আছি, তেমনি থাকব।”

.
ভাবা আর করা দুটো এক নয়। একটা মাস আমি ভালোই রইলাম। তার সাথে মানিয়ে চললাম। সেও ভালো। হঠাৎ একদিন ছোট্ট বিষয় নিয়ে আবার ঝগড়া। আমিও রাগ সামলাতে পারলাম না। তার অনেকগুলো কথার কাটা কাটা জবাব দিয়ে দিলাম। সে এক পর্যায়ে আমায় সজোরে থাপ্পড় মারলো। আমি এতটা আশা করিনি। সেও সাথে সাথে ভু্ল বুঝতে পেরে মুখটা করুণ করে ফেলল। আমার হাত ধরে বলল, “আমি ইচ্ছে করে করিনি….সরি…রাগ করো না প্লিজ…”

সে রাতে আমি তার সাথে কথা বললাম না। সে অনুতপ্ত হয়ে রইল। কথা দিল আর করব না। এক সময় ক্ষমা করে দিলাম। কিন্তু আমি ভাবিনি গায়ে হাত তোলাটা তার নেশায় পরিণত হয়ে যাবে। এটা শুধু তার ক্ষেত্রে না, বহু পুরুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যে একবার স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার মজাটা বুঝে যায়, সে সহজে সেটা ছাড়তে পারে না।

এরপর কথায় কথায় চড়- থাপ্পড় দিতে শুরু করল। একদিন এত জোরে ধাক্কা দিল যে আমি খাটের কোথায় মাথায় বাড়ি খেয়ে নিচে পড়ে গেলাম। মাথা ফেটে রক্তে ভেসে গেল জায়গাটা।

সে দ্রুত ছুটে এল। আদর করে আমায় তুলে খাটে বসালো। মুখে সরি বলেই যাচ্ছে। আমার আর সহ্য হলো না৷ তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে আমি বেরিয়ে গেলাম ঘর থেকে। চিৎকার করে বললাম, “আর কোনেদিন আমার কাছে আসবে না! তুমি জানোয়ার হয়ে গেছ। আমি আর থাকতে পারব না তোমার সাথে। এই বাড়িতে আর কোনোদিন ফিরে আসব না। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে ফেলেছ তুমি!”
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here