#অনুতপ্ত ২য় পর্ব
#সাদমান_হাসিব
দুনিয়ায় সব কিছু ছাড়া যায় গর্ভধারিনী মাকে ছাড়া যায় না, আর আমার মাকে সারা তো অসম্ভব। যে মানুষটা নিজের জীবনের সকল শখ আহ্লাদ বাদ দিয়ে আমার জীবনটা সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছেন, সে মাকে আমি কখনো ছাড়তে পারিনা কখনোই না।
আমার চোখের কোনে পানি জমা হয়েছে, হাত দিয়ে পানি গুলো মুছে একটা প্ল্যান করে ফেললাম প্ল্যানটা কাজে লাগতে পারি কি না দেখি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত তিনটা, রুবাইয়া ও আমার ছেলে ঘুমাচ্ছে। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম তুই কি বড় হয়ে তোর মাকে ছাড়তে পারবি? তোর মা তোর দাদিকে সহ্য করতে পারেনা। তোর বউ যদি এমন করে তুই কি করবি? বল বাবা তুই আমাকে আমার প্রশ্নের উত্তর দে। ফজরের আজান হচ্ছে আর কিছুক্ষণ পর ভোরের আলো ফুটবে, আমার চোখটা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করতে হবে। চোখ বন্ধ করতেই সারারাতের ক্লান্তি আমাকে ঘিরে ধরল, ঘুমিয়ে গেলাম।
বাবু এই বাবু তুমি এখনো ঘুমাচ্ছো, এত ঘুম তোমার, ওঠো তারাতাড়ি সকাল 9 টা বাজে ব্রেকফাস্ট রেডি, আপু রওনা দিয়েছে এগারোটার মধ্যে এসে পড়বে।
ঠিক আছে তুমি যাও আমি উঠছি, সিরাত কোথায়?
সিরাতকে তার নানা ভাই নিয়ে ঘুরতে গেছে, সিরাতকে আব্বু বলেছে নানুভাই ঘুরতে যাবে, সিরাত মাথা নাড়িয়ে সায় দিছে, সে অনেক খুশি তার নানা ভাইয়ের কোলে উঠে। আব্বু সিরাতকে নিয়ে তার এক বন্ধুর বাসায় গেছে সকাল সাতটার সময়।
কি বল সকাল সাতটায় গিয়েছে সে তো কান্না করবে, আব্বুকে তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে বল।
ঠিক আছে আমি বলছি আব্বুকে তারাতাড়ি নিয়ে আসতে।
আমি ব্রেকফাস্ট করে আবার এসে শুয়ে পড়লাম। ভাবছি আমি যে প্ল্যান করেছি সেটা কি কাজে দিবে, তবু দেখি চেষ্টা করে অবাধ্য রুবাইয়াকে বাধ্য করা যায় কিনা।
রুবাইয়ার বোন রিমি এসেছে, কিছুক্ষণ দুই বোন গলা জড়াজড়ি করে শান্ত হলো।
রিমি আপু রুবাইয়াকে বলছে, কিরে শুনলাম নাকি তুই রাগ করে এখানে আসছিস, শাশুড়ির সাথে ঝগড়া করে আসিস নাকি?
আপু তুমি যে কি বল, আমি কি ঝগড়া করার মানুষ, বাবু তার মাকে ছাড়া কিছুই বুঝেনা, আমাকে একটুও ভালোবাসে না। আমি তার স্ত্রী এতে তার কোন আসে যায় না আমার প্রতি বাবুর কোন দায়িত্ব কর্তব্য নেই। ওই সংসারে আমার কোন মূল্য নেই, কি করব সেখানে থেকে যেখানে আমার কথার কোন দাম নেই।
কেন কি বলেছিলি বাবুকে, সে তোর কোন কথা রাখেনি?
কি আর বলবো, বলেছিলাম তোমার মা যখন আমাকে সহ্য করতে পারেনা তাহলে তাকে অন্য কোথাও রেখে আসো, এখন তো ভালো ভালো বৃদ্ধাশ্রম আছে মাস শেষে টাকা পাঠিয়ে দিলে তোমার মা ভালো থাকবে। এই কথা শোনার পর সে আমার গায়ে হাত তুলেছে, এত জোরে চড় মেরেছে আমি খাটের ওপর পড়ে গিয়ে খাটের কোনায় লেগে আমার ঠোঁট কেটে গেছে, দেখো কতটা কেটেছে।
কি বলিস বাবু তোর উপর হাত তুলেছে, দাঁড়া আমি দেখছি কি করা যায়, তুমি আবার কি করবে। থাক কিছু বলতে হবেনা, বাবু রাজি হয়েছে তার মাকে অন্য কোথাও রাখবে। তাই আমাকে নিতে এসেছে, তার মাকে অন্য কোথাও রাখবে এই শর্তে আমিও যেতে রাজি হয়েছি না হলে যেতে রাজি হতাম না।
কিন্তু রুবাইয়া আমি তোকে একটা কথা বলি বৃদ্ধাশ্রমে না পাঠিয়ে দরকার হয় আলাদা রান্নাবান্না করে খা, তোর শাশুড়ির রান্না শাশুড়ি করে খাবে, তোরটা তুই করে খাবি, কিন্তু এভাবে যদি তোর শাশুড়িকে বাসা থেকে বের করে দিস কেমন খারাপ দেখা যায়, একটু ভেবে দেখ।
আপু তুমি আমাকে এই বিষয়ে বলবে না কিছু, আমি আমার যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটাই হবে, এর বাইরে যেতে কোন পরামর্শ দিওনা আমাকে সে পরামর্শ আমি রাখবো না সরি। আমার একটাই জিদ বাবু আমার থেকে তার মাকে বেশি ভালোবাসে, হয় তার মাকে নয় আমাকে দুজন থেকে একজনকে বেছে নিতে হবে।
ঠিক আছে তোমার যা ভালো মনে হয় কর, তবে একটা কথা মনে রাখিস সময় কিন্তু সবারই আসে, দেখ আমি কিন্তু আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি নিয়ে একসঙ্গে আছি।
আপু চুপ কর, তোমার স্বামী আর আমার স্বামীর মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে, তোমার স্বামী তার মাকে বেশি ভালোবাসে না, তোমার প্রতি দুলাভাইয়ের ভালোবাসা বেশী। আর আমার স্বামী আমাকে একটুও ভালোবাসে না, এখন নিতে এসেছে কি কারণে নিতে এসেছে জানো? শুধু তার ছেলের জন্য, যদি সিরাত না থাকতো সে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিত, আমি তাকে চিনি তার মা ছাড়া এই দুনিয়ায় আর কিছু বোঝেনা সে, ছেলেকে ভালোবাসে, ছেলের ভালবাসার জন্য আমাকে তার প্রয়োজন।
আচ্ছা বোন তুই যা ভালো মনে করিস কর, আম্মু আব্বু তোকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তুলে ফেলেছে তাই আমার ভালো কথা তোর শুনতে খারাপ লাগবে।
আমি রুবাইয়া আর রিমি আপুর কথাগুলো শুনে বুঝতে পারলাম কিছুটা হলেও জ্ঞান বুদ্ধি আছে রিমি আপুর, যা রুবাইয়ার মা-বাবার ভেতরে নেই, যদি থাকত তাহলে মেয়েকে বুঝিয়ে বলতো, আরো মেয়েকে প্রশ্রয় দেয় তারা।
দুপুরে সবাই একসঙ্গে লাঞ্চ করা হলো, লাঞ্চের পরে আমি রুবাইয়াকে বললাম যাও তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। রুবাইয়া ঘন্টাখানেক পর রেডি হয়ে আসলো আমরা বিদায় নিয়ে বাসায় রওনা দিলাম।
শ্বশুরবাড়ি থেকে আমার বাসা দেড় ঘণ্টার পথ, বাসায় এসে দেখি আম্মু অনেক কিছু রান্না করে রেখে দিয়েছে, রুবাইয়া ফিরবে শুনে আম্মু খুশি হয়েছে। আসার আগে আম্মুকে ফোন দিয়ে বলে ছিলাম আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসতেছি, তাই আম্মুর এতকিছু রান্না।রুবাইয়াকে দেখে আম্মু কাছে এসে বলল, বৌমা তুমি যে কেন শুধু শুধু রাগ করে চলে গেলে, দেখো আমি তো তোমাকে কিছুই বলি না সারাদিন চুপচাপ থাকি, তিন বেলা খাই নামাজ কালাম পড়ি মাঝে মাঝে দাদুভাইকে কোলে নিয়ে সময় পার করি। তুমি কি আমায় চাওনা আমি তোমাদের সাথে থাকি, বল আমি কোথায় যাব আমার তো কেউ নেই একটা মাত্র ছেলে আমার।
রুবাইয়া আম্মুর কথায় কোন উত্তর দিল না হনহন করে রুমে চলে গেল।
আম্মুকে বললাম তাকে তোমার নত হয়ে বলতে হবে না, আম্মু বলল আমার দাদুভাইকে এনে দে আমি কোলে নেবো কয়দিন ধরে দাদুভাইকে কোলে নেই না।
আমি রুমে গিয়ে রুবাইয়ার কাছ থেকে সিরাতকে এনে আম্মুর কোলে দিলাম, সিরাতকে নিয়ে আম্মু ছাদে চলে গেল।
রুমে গিয়ে রুবাইয়াকে বললাম, আমার আম্মু তোমাকে সিরাতকে কত ভালোবাসে তুমি কেন আম্মুর সাথে এমন করতেছ।
বাবু শোনো তুমি আমাকে যা বলে নিয়ে আসছো তাই করবে আমি আর কোন কথা শুনতে চাই না, তুমি দেখো তোমার মাকে কোথায় রাখবে জায়গা দেখে দুই-একদিনের মধ্যে দিয়ে আসো। কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে রাখো, না হলে আমি আমার ছেলেকে নিয়ে আবার চলে যাব।
কিছু আর বললাম না রাতে আম্মুর রান্না করা খাবার খেলাম, রুবাইয়া দেখলাম ডিম ভাজি করে ভাত খাচ্ছে, আম্মুর রান্না করা তরকারি সে নিলোনা। আম্মুর চোখটা ভিজে আসলো রুবাইয়ার এই কান্ড দেখে, আম্মুকে বললাম তুমি তার ব্যবহারে কিছু মনে নিওনা এমন একটা মেয়েকে আমি ভালোবেসেছিলাম যার মধ্যে মানবতাবোধ শিক্ষাদিক্ষা কিছু নেই। শিক্ষিত মেয়ে হয়ে কিভাবে পারে কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজকারবার করতে, আমি ভুল করেছি এমন মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করে। সত্যি আমি জানতাম না রুবাইয়ার মন-মানসিকতার এত নিচ। যদি জানতাম কখনো তাকে বিয়ে করতাম না। যে আমার মায়ের সাথে হিংসা করবে তাকে চক্ষুশূল মনে করবে এমন মেয়েকে বিয়ে করা অসম্ভব ছিল, যতই ভালোবাসি সেই ভালোবাসা কবর দিয়ে দিতাম।
আম্মু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল বাবা চুপ থাক ভাগ্যে যা আছে তাই তো হবে, তোর ভাগ্যে রুবাইয়া স্ত্রী হিসেবে ছিল তাই সে তোর স্ত্রী হয়েছে। আল্লাহ তোর সাথে তার বন্ধন মিলিয়েছে। এখন চুপচাপ রুমে গিয়ে ঘুমা, বৌমা যদি শুনে আমাদের কথাবার্তা আবার অশান্তি শুরু করবে।
আমি আম্মুকে বললাম, আম্মু তোমার সাথে আমার কথা আছে, কাল ভোরে তোমাকে নিয়ে বাইরে হাঁটতে যাব যখন রুবাইয়া ঘুমিয়ে থাকবে।
কি কথা বাবা?
সেটা কাল সকালে শুনবে এখন আমি যাই।
আম্মু আমার কপালে চুমু দিয়ে বলল, আল্লাহ আমার ছেলেকে অনেক বছর হায়াত দারাজ করুক। আমিও আম্মু মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, আমার আম্মু অনেক বছর আমার সাথে থাকুক আমি আল্লাহর কাছে এটাই চাই।
রুমে গিয়ে দরজা লক করে দিয়ে খাটে বসলাম, রুবাইয়া মোবাইলের গান শুনছিল, গান অফ করে জানতে চাইল এতক্ষন কী করলাম।
আম্মুর রুমে ছিলাম তার সাথে কথা বলতে, কিন্তু পারলাম না, দেখি কাল সকালে তাকে বুঝিয়ে বলতে পারি কিনা।
এত বুঝিয়ে বলার কী আছে, তোমার আম্মু ছোট মানুষ নাকি, সে কি বুঝে না আমি চাই না সে আমার সাথে থাকুক, এখন বলে দিলে তো হত এত ভনিতা করার কি আছে।
রুবাইয়া চুপ করো, আমার যখন মনে হবে বলার ঠিক সময় তখনই বলবো।
তোমার সময় আর এ জনমে হবে না।
হবে কাল সকালে বলবো, এখন চুপচাপ ঘুমাও।
আমি শুয়ে পরলাম, রুবাইয়া আমার বুকের কাছে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরতে চাইলো, আমি তার হাত সরিয়ে দিলাম। কি হলো হাত সরিয়ে দিলে কেন আমাকে আর ভালো লাগেনা, একটুও ভালোবাসো না আমাকে, জানি তো সব ভালোবাসা তোমার মায়ের প্রতি। শুধু আমাকে নিয়ে আসলে তোমার ছেলের কারণে, না হলে তোমার মাকে নিয়েই তুমি ভালো থাকতে।
উঠে গেলাম রুবাইয়া পাশ থেকে, ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে টানছি। সচরাচর আমি স্মোক করিনা, যখন খুব টেনশনে থাকি তখন একটু আকটু সিগারেট টান দেই। রাতের আকাশ খুব স্তব্ধ কয়েকটি তারা দেখা যাচ্ছে দূরের আকাশে, আকাশের পানে তাকিয়ে চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে কষ্টের বৃষ্টি। একজন স্ত্রী দিতে পারে স্বামীকে অনাবিল সুখ, আবার একজন স্ত্রী পারে স্বামীর জীবনটাকে নরক বানিয়ে দিতে। জীবনের কঠিন জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে আছি আমি, বাট আমার কাছে সবকিছুর ঊর্ধ্বে আমার মা যা কিছুই হোক আমার মাকে আমি কখনো কষ্ট দেবো না।
চলবে,,,