চৌধুরি_বাড়ি- শেষ পর্ব
#লেখনীতে_শাহরিয়ার
এক সময় আমি ছেচড়াতে ছেচড়াতে এসে পৌছালাম স্টেশনে। কোন রকমে হাঁপাতে হাঁপাতে একটা বেঞ্চি ধরে উঠে সেখানে বসলাম। আমি জানতাম না আমার জন্য আরও ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছে। আমার ক্লান্ত শরীর আর চোখ দু’টো বন্ধ হয়ে আসতে চাচ্ছে। নিজেরই ইচ্ছে করছে দু’হাত দিয়ে চোখ দু’টো টেনে খুলে রাখি। কিন্তু পেরে উঠছিলাম না। এক সময় অল্প কয়েক সেকেন্ডের জন্য আবারও আমার চোখ দু’টো বন্ধ হয়ে আসলো।
হঠাৎ করেই মেঘের গর্জনে আমি চোখ মেলে তাকালাম। এরপর যা দেখলাম তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমার সামনে ছয়টি খাটিয়া পরে রয়েছে। যার পাঁচটিতেই রয়েছে মৃত দেহ আর একটি খাটিয়া সম্পূর্ণ ফাঁকা। সেই পাঁচটি খাটিয়া থেকে একে একে সেই পাঁচজন মানুষ উঠে বসলো। এরা সেই পাঁচজন যাদের আমি চৌধুরি বাড়িতে দেখেছিলাম। সকলের শরীরে কাফনের কাপড় পরানো।
তারা আমার দিকে তাকিয়ে বিশ্রী হাসি হেসে এগিয়ে আসতে শুরু করলো। আমি বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দৌঁড়াতে শুরু করলাম। তারাও আমি পিছু ছুটছে আর হাসছে। মৃত্যুকে সেই মুহুর্তে আমার ভীষণ কাছে মনে হচ্ছিলো।
আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো, আমার শৈশবের স্মৃতি। আমার ভালোবাসার মানুষ সোহার মুখটা। তিন বছর রিলেশনের পর যাকে বিয়ে করেছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম আমার মৃত্যুর খবরটাও হয়তো সে পাবে না। সোহা জানতেই পারবে না কতটা ভয়ংকর আর নৃশংস ভাবে আমি মারা গিয়েছি। হয়তো কখনো আমার লাশটাও সে দেখতে পাবে না। সে হয়তো ভাববে আমি তাকে ঠকিয়েছি। তার সাথে প্রতারণা করে পালিয়ে গিয়েছি অন্য কারো সাথে। কিন্তু আমি যে তাকে কতটা ভালোবাসি তা সে হয়তো একটা সময় ভুলেই যাবে।
বাবার কত স্বপ্ন সব অপূর্ণই থেকে যাবে। আমি নাম করা ডাক্তার হবো। গরীব অসহায় মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করবো। সব স্বপ্ন এখন শুধু স্বপ্নই হয়ে রয়ে যাবে। আমারওতো অনেক স্বপ্ন ছিলো তাদের নিয়ে। বাবার নামে একটা হাসপাতাল খুলবো বাবা যেমন চেয়েছিলো ঠিক তেমনই করবো সে হাসপাতালে বিনা পয়সায় গরীব মানুষদের চিকিৎসা করা হবে। তাদের মুখে হাসি ফুটে উঠবে। তারা চিকিৎসা শেষে খুশি মনে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরবে আজ তা শুধুই স্বপ্ন হয়ে রয়ে যাবে। আমি কোন দ্বায়িত্বই ঠিক মত পালন করতে পারলাম না। ব্যর্থতা নিয়েই আমাকে এই পৃথিবী ছেড়ে যেতে হবে।
মৃত্যু যে পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম সত্য তা যেন আমি চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছিলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে আমি যখন দেখতে পেলাম আমার শরীর আর চলতে পারছে না। সমস্ত শরীর অবস হয়ে গিয়েছে। আমি আর পারছি না। অথচ পেছন থেকে ছুটে আসছে ভয়ংকর কিছু মুখ, কিছু হাত। এমন নির্মম মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে কেন আমাকে? কি আমার অপরাধ তার কোন কিছুই না জেনে আমাকে এই পৃথিবী ছাড়তে হবে। এটাই আমার সব চেয়ে বড় আফসোস হয়ে রইবে। কত স্মৃতি কত মায়া সব পেছনে ফেলে আমি ছুটে চলছি। একটু বেশী সময় বাঁচার আশা নিয়ে।
হঠাৎ করেই কিছু সময়ের জন্য সব নিরব হয়ে গেলো। ঝড় বৃষ্টি সব থেমে পরিবেশটা ভীষণ রকম গম্ভীর রূপ ধারণ করলো। আমি পেছনে তাকিয়ে অন্ধাকারে কোন কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আমি দাঁড়িয়ে পরলাম, ভালো করে পেছনে দেখার চেষ্টা করলাম। না সত্যিই কোন কিছু নেই।
ভয় কিছুটা কেটে যেতে সামনে ঘুরতেই সেই মানুষ গুলো এক সাথে চিৎকার করে উঠলো। আমি ভয়ে কয়েক পা পেছনে পরে গেলাম। তারা দৌঁড়ে আমাকে ধরে ফেললো। আমি চিৎকার করার আপ্রণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি কিন্তু আমার মুখ দিয়ে এক বিন্দু পরিমাণ শব্দ বের হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কেউ আমার গলা চেপে ধরে রয়েছে। সকলে মিলে আমাকে টেনে ছেচড়ে নিয়ে যেতে লাগলো। আমি সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে আটকে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তাদের শক্তির কাছে আমার শক্তি কিছুই নয়। আমি যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকের মত মাটিতে পরে রইলাম। তারা আমাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকলো সেই খাটিয়ার দিকে। মনে হচ্ছিলো আমার শরীর থেকে মাংস ছিড়ে ছিড়ে পরে যাচ্ছে। অথচ আমি একটা শব্দও মুখ থেকে বের করতে পারছিলাম না। তারা যখন ভয়ংকর রকম হাসিতে আমাকে খাটিয়ার উপর তুলবে ঠিক সেই মুহুর্তে সকলের পেছনে আমি আমার বাবার মুখটা দেখতে পাই। যে কিনা তাদের সবাইকে টেনে ধরে রেখেছে। এরপর আর আমি চেয়ে থাকতে পারিনি। দু’চোখ বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর সকালে নাকি মানুষজন ট্রেন ধরতে এসে আমাকে পরে থাকতে দেখে স্টেশনে, প্রথমে মৃত ভেবে কেউ কাছে আসতে চায়নি। এরপর কেউ একজন কাছে এসে বুঝতে পারে বেঁচে আছি। সে লোকজন ডেকে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে।
এরপর টানা ছয় দিন হাসপাতলে অচেতন অবস্থায় থাকি। অবশেষে ছয়দিন পর যখন চোখ মেলে তাকাই তখন আমার সামনে দেখতে পাই আমার স্ত্রী সোহা, এবং হাসপাতালের ডাক্তার নার্সদের। আমি বেঁচে আছি এটাই প্রথমে বিশ্বাস হতে কষ্ট হচ্ছিলো। আমার চোখ মেলে তাকানো দেখে সোহা আমাকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মত কান্না করতে থাকে। সব ডাক্তার আর নার্সরাও অবিশ্বাসের চোখে তাকাচ্ছিলো।
সেই নার্স আমাকে বললো স্যার আপনি যেতে চাইলেন শান্তিপুর গ্রামে কিন্তু আপনি রেলস্টেশনে কেন গিয়েছিলেন?
সে অনেক কথা আমি অন্য এক সময় আপনাদেরকে সব খুলে বলবো।
ডাক্তার আর নার্সরা আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।
সোহা: অভিমানের সুরে তোমাকে এতো রাতে রোগী দেখার জন্য কেন যেতে হবে?
দেখো আমি ডাক্তার আর রোগী দেখা আমার কর্তব্য হোক সেটা দিনের বেলা কিংবা গভীর রাত।
সোহা: কি হয়েছিলো সে রাতে আমাকে বলবে কি সত্যি করে?
আমি সোহাকে সব খুলে বলতে শুরু করলাম। আমার কথা শেষ হতে সোহা আমাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগলো।
সোহা: আমার হাত ধরে বললো আর কখনো এমনটা করবে না আমাকে কথা দাও।
আমি সোহাকে কথা দিলাম আর কখনো এমনটা হবে না। এরপর আরও পনের দিনের মত লাগলো আমাকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে। সুস্থ হবার পর আমি সোহাকে সঙ্গে নিয়ে শান্তিপুর বেড়াতে যাই, সোহাকে চৌধুরি বাড়ির সামনে নিয়ে যাই। বাড়িটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পরে রয়েছে। আমি খুব ভালো করে বাড়িটার বাহির থেকে ঘুরে ফিরে দেখি। তারপর সোহাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসি।
এর কিছু দিন পর একদিন আমি আবার চৌধুরি বাড়ির উদ্দেশ্যে যাই। যেয়ে খোঁজ নিতে থাকি ঐ বাড়ির সম্পর্কে। একজন বয়স্ক লোকের কাছে জানতে পারি সে বাড়ির সব তথ্য। তার ভাষ্যমতে ,
সে বাড়ির বড় মেয়ের সাথে কোন এক ডাক্তারের সম্পর্ক হয়। এক সময় মেয়েটা অন্তঃস্বত্ত্বা হলে, ডাক্তার তাকে বিয়ের কথা বলে, কিন্তু বিয়ে না করে পুরো পরিবারকে খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে খায়িয়ে মেরে বাড়ি থেকে নগদ অর্থ আর স্বর্ণ গহনা নিয়ে পালিয়ে যায়। তারা মারা যাবার বেশ কিছুদিন পর তাদের লাশ উদ্দার করে এলাকার লোক জন। এরপর থেকেই বাড়িটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পরে রয়েছে। মাঝে মাঝেই নাকি গভীর রাতে সে বাড়ি থেকে মেয়ে মানুষের চিৎকারের শব্দ ভেসে আসে। কেউ ভুলেও কোন দিন রাতে সে বাড়ির আশপাশ দিয়ে চলাচল করে না। এভাবেই পরিত্যক্ত হয়ে দুই যুগেরও বেশী সময় বাড়িটা পরে রয়েছে।
আমি বৃদ্ধ লোকটার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসি। আর এটা বেশ ভালো করে বুঝতে পারি, কেনই বা এতো রাতে আমাকে ফোন দিয়ে সে বাড়িতে নেয়া হয়েছিলো। কারণ আমিও একজন ডাক্তার। এরপর আরও পাঁচটি বছর আমি সদর হাসপাতালে কাটালেও কখনো রাতে হাসপাতালে থাকি নাই। আর কখনোই আমি শান্তিপুর চৌধুরি বাড়িতে গিয়েছি। কোন রকম সমস্যা ছাড়াই এ পাঁচটি বছর আমি এখানে কাটিয়ে আজ নতুন শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছি। যেই আসুন আমার জায়গায় সাবধানে থাকবেন রাত করে হাসপাতালে থাকবেন না। আর থাকলেও কেউ শান্তিপুর চৌধুরি বাড়ির দিকে যাবেন না ভুল করেও। তাই আমি এই ডায়েরীটা লেখে রেখে গেলাম। ইতি ডাক্তার সিয়াম।
ডায়েরীটা পড়তে পড়তে কখন যে রাত বারোটা বেজে গেছে সেদিকে খেয়ালই করেনি ডাক্তার আসিফ। ঘড়ির টং টং শব্দ সেদিকে তাকিয়েই বুঝতে পারলো রাত ঠিক বারোটা বেজে গেছে। ডাক্তার আসিফ আর দেরী না করে উঠে দাঁড়াতেই প্রচণ্ড ঝড় বাতাস শুরু হলো। মনের ভিতর কিছুটা ভয় লাগতে শুরু করেছে ডাক্তার আসিফের কেননা হাসপাতালে দুই চারজন নার্স ছাড়া আর কোন ডাক্তার নেই। সবচেয়ে বড় কথা আজ একটা বিষ খাওয়া মেয়ে মারা গিয়েছে। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই টেলিফোনটা বেজে উঠলো। সাথে সাথে ভয়ে আসিফের হাতে থাকা ডায়েরীটা ফ্লোরে পরে গেলো। আসিফের হলা শুকিয়ে আসলেও সে ভয়ে ভয়ে ফোনটা রিসিভ করলো ঘটনার সত্যতা যাচাই করার জন্য।
ফোন রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে একটা মেয়েলি কণ্ঠ বলে উঠলো এটা কি সদর হাসপাতাল?
জ্বি বলুন আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?
মেয়েটি বলতে শুরু করলো দেখুন আমার মা খুবি অসুস্থ আপনাকে এখুনি একটু শান্তিপুর চৌধুরি বাড়িতে আসতে হবে।
মেয়েটির কথা শুনে আসিফের পায়ের নিচ থেকে জেনো মাটি সরে যাচ্ছিলো। তার মানে ডাক্তার সিয়ামের লেখা প্রতিটা কথাই সত্যি। সে মনে মনে ডাক্তার সিয়ামকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোনের লাইনটা কেটে রিসিভারটা নিচে নামিয়ে রাখলো। আর মনে মনে বললো আজ থেকে অফিস শেষ করে চলে যাবার সময় এমনি করেই টেলিফোনের রিসিভার নিচে নামিয়ে রাখবে। ডায়েরিটা হাতে নিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে দু’চোখ বন্ধ করে নিলো। কারণ বাহিরে প্রচণ্ড রকম ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়েছে এতো রাতে তার আর বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়।
#সমাপ্ত।