বিবর্ণ-৪র্থ পর্ব
#লেখনীতে_শাহরিয়ার
ওযু করে নামাজ পড়ে বাবা মায়ের সাথে এসে বসে বসে টিভি দেখতে লাগলাম। রাতের খাবার শেষ করে এক সময় সবাই যার যার নিজের রুমে চলে আসলাম। মনটা কেমন ছটফট করছে। রাত এগারোটার দিকে রুম থেকে বের হলাম সকলের রুমের দরজা লক। আমি চুপি চুপি ছাদে উঠে আসলাম।
আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ নেই, অতিরিক্ত কোন আলোও নেই। আছে মেঘের মাঝে তারাদের লোকচুরির খেলা। আমি ছাদের সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে দেখছি জাহাঙ্গীর তার বাড়ির ছাদের শেষ কর্ণারের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি খুব আস্তে ধীরে একপা দু’পা ফেলে এগিয়ে যেতে থাকলাম। ছাদের শেষ প্রান্তে এসে রেলিং ধরে দাঁড়াতেই জাহাঙ্গীর ঘুরে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো তাহলে সত্যি সত্যি চলে আসলেন?
কেন না আসলে কি খুশি হতেন?
জাহাঙ্গীর: আরে না না তা কেন হবো? মেয়ে মানুষ নাও আসতে পারেন। এতো রাতে একটা ছেলে আসতে বলেছে ভয়ে না আসাটা অস্বাভাবিক কিছুতো নয়।
ভয় পাবার কিছু নেই, আপনি না বাঘ না ভাল্লুক যে আপনাকে ভয় পেতে যাবো? সব চেয়ে বড় কথা নিয়ে ভয় পাবো বলেন? একজন ডিভোর্সি মেয়ে লোক লজ্জার ভয় আর কি পাবো? আমারতো মনে হয় এই যে আপনি আমার সাথে কথা বলছেন সময় কাটাচ্ছেন আসলে ভয় আপনার পাওয়া উচিৎ।
জাহাঙ্গীর: কেন কেন আমি ভয় কেন পেতে যাবো?
আপনি ভুতনি না শাঁকচুুন্নি?
জাহাঙ্গীরের কথা শুনে হেসে দিলাম। আসলে হয়তো মানুষজন এমনই মনে করে যে নারীর স্বামীর সংসার করা হয় না। আর কতজন কত রকম লোভার্ত চোখে চেয়ে থাকে হিংস্র শকুনের মত সুযোগ পেলেই খাবলে খেতে চাইবে এই দেহটাকে। আর সমাজের লোকজন সুযোগের অপেক্ষা করে কখন কার নামে বদনাম ছড়ানো যায় তার।
জাহাঙ্গীর: হাতের পাঁচটা আঙ্গুল যেমন সমান নয়। তেমনি পৃথিবীর সব মানুষও সমান হয়না। আমি পৃথিবীতে সব মানুষকেই সম্মান করি। আর যদি মেয়েদের কথা বলেন, তবে তাদের আমি আরও বেশী সম্মান করি। মেয়ে মানেই আমার কাছে অত্যাদিক সম্মানিত একজন নারী। যে কিনা একজন মা। একজন বোন কিংবা একজন অর্ধাঙ্গিনি। তাই তাদের সম্মান আমার কাছে বরাবরই সকলের উপরে। একজন নারী কতটা সংগ্রাম করে একটা সন্তান জন্মদিতে তা যদি একটা পুরুষ মানুষ বুঝতে পারতো। তাহলে কখনো কোন নারীর শরীরে হাত তুলতে পারতো না। কখনো কোন নারীর দিকে চোখ রাঙ্গীয়ে কথা বলতে পারতো না। কোন কোন নারীর দিকে খারাপ দৃষ্টি নিয়ে তাকাতে পারতো না। কারণ সে যে এতো বড় রক্ত মাংসের একজন মানুষ হয়েছে, তা শুধুই একজন নারীর জন্য সম্ভব হয়েছে। যে নারী নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে তাকে এই পৃথিবীতে নিয়ে এসেছে। হাজার ঝড় তুফানের মাঝেও নিজের বুক থেকে আলাদা করেনি তিনি একজন নারী।
জাহাঙ্গীর এক নিঃশ্বাসে কথা বলে যাচ্ছে, আমি মুগ্ধ হয়ে ওর বলা কথা গুলো শুনে চলছি। কত সুন্দর চিন্তা ভাবনা। সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে এতো ভালো চিন্তা ভাবনা এখনো কারো মনে আছে? এই ছেলে যে মেয়ের ভাগ্যে রয়েছে তার চেয়ে ভাগ্যবতী আর কোন মেয়ে হতেই পারে না। কেননা প্রতিটা নারীই চায় তার স্বামী এমন কেয়ারিং হবে, একে অপরকে সম্মান করবে। দু’জন দু’জনকে নিজেদের মত করে বুঝবে। আসলেই খুব ভাগ্যবতী হবে যে জাহাঙ্গীরের মত এমন সুন্দর মনের মানুষের জীবন সঙ্গীনি হতে পারবে।
জাহাঙ্গীর: জানেন ইদানিং টিভি, ফেসবুক, নিউজ পেপার, যেখানেই চোখ বুলাবেন শুধু ধর্ষণ আর ধর্ষণের খবর চোখের সামনে ভেসে আসবে। আর এসব হচ্ছে তার প্রধান কারণ আমরা ছেলেরা মেয়েদের সম্মান করিনা বলে। আমার মানুষ থেকে অমানুষে পরিণত হচ্ছি বলে। মা বোনকে সম্মান করছি না বলে বাহিরে নারী দেখলে নিজেদের কন্ট্রোল করতে পারি না। আচ্ছা অনেক কথা বলে ফেললাম সরি।
না না ঠিক আছে আসলে আপনি খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলেন। আর আপনার সব কথাই সত্যি। কিন্তু আপনি যতটা সহজ সরল মনে এসব চিন্তা করছেন পৃথিবীটা তত সহজ নয়। এই যে আমরা এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি কেউ দেখলেই নানান রকম বাজে কথা বলে বেড়াবে। হয়তো এটাও বলতে পারে আমার সাথে আপনার অবৈদ অনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। নয়তো এতো রাতে কেন আমরা ছাদের উপর একে অপরের পাশাপাশি থাকবো। হয়তো আরও বাজে ভাবেই এই বিষয়টাকে উপস্থাপন করতেও পারে।
জাহাঙ্গীর: ঐসবে আমি ভয় পাই না। আমার সঠিক পথে থাকলে আমার আল্লাহ নিশ্চই আমার পাশেই থাকবে। তাছাড়া লোকের মন্দ কথায় আমার কিছু আসে যায় না।
একজন ডিভোর্সি নারীর সাথে কথা বলাটা মানুষ ভালো চোখে দেখে না।
জাহাঙ্গীর: যার চোখের সমস্যা সে সব কিছুতেই খারাপ কিছু খুঁজবে এটাইতো বাস্তবতা। এই আজ দু’দিন আমরা কথা বলছি কই আমরাতো কোন রকম বাজে কথা বলিনি। কোন রকম খারাপ উদ্দেশ্য আমাদের মাঝে নেই। আমি মনে করি যদি কারো সাথে কথা বলে আমার ভালো লাগে, যদি কারো সাথে মনের কথা গুলো শেয়ার করা যায় তবে নিশ্চই মনের কষ্টটা অনেক অনেক গুণ হালকা হয়ে যায়। আর আমাদের উচিৎ কারো খরাপ সময়ে তাকে সাপোর্ট করা। তাকে কষ্ট দিয়ে কথা না বলা। তবেই পৃথিবীর চিত্রপথ পালটে যাবে। মানুষে মানুষের মাঝে কোন ভেদাবেদ সৃষ্টি হবে না। কে ডিভোর্সি কে স্বামী সংসার করছে, কে কালো কে সুন্দর এসবের কোন প্রার্থক্য থাকবে না। কারো চরিত্রে তখন কোন দাগ লাগবে না। আসলে তখন আর কেউ খারাপ থাকবে না। যখন মানুষ মানুষের বিপদের সময় বন্ধুর মত পাশে দাঁড়াবে। যখন একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে বুঝবে। তখন সত্যি সত্যিই পৃথিবীটা পাল্টে যাবে।
এমনটা কি সত্যি সত্যি কখনো হবে?
জাহাঙ্গীর: মানুষের চিন্তা ভাবনা পাল্টে গেলেই সম্ভব। তার জন্য সর্বপ্রথম নিজেকে নিজের জায়গা থেকে শক্ত মন মানুষিকতার হতে হবে অল্পতে ভেঙ্গে পরলে চলবে না। জীবনটা খুব ছোট, তবে চাইলেি আমরা আমাদের কর্মের মাধ্যমে তা বিশাল করতে পারি। একে অপরের প্রতি সহনশীল হয়ে। মানুষের বিপদে বন্ধুর মত পাশে দাঁড়িয়ে। বিশ্বাসের হাত বাড়িয়ে দিয়ে।
আমি যতই জাহাঙ্গীরের কথা শুনছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি রাত বেড়ে চলছে। আকাশের মেঘ সব কেটে ঝকঝক করছে তারা গুলো। আজ খুব সুন্দর লাগছে চারপাশ। এতোদিন কেন আমি এই সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করিনি এটাই ভেবে চলছি।
জাহাঙ্গীর: জানেন আমার যখন খুব খারাপ লাগে তখন ঐ হলুদ ল্যাম্পপোষ্ট গুলোর নিচে নয়তো খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ একটা সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদ তারাদের খেলা দেখি। কখন যে মন ভালো হয়ে যায় তা বুঝতে পারি না। পৃথিবীতে মন ভালো করার জন্য খুব বেশী কিছু প্রয়োজন হয় না। আমাদের ছোট ছোট ভালো কাজই আমাদের মন ভালো করে দিতে পারে। কাল কি ফ্রী আছেন দুপুরের পর।
হ্যাঁ আমিতো সব সময় ফ্রী কেন বলুনতো?
জাহাঙ্গীর: বাড়ি থেকে বের হতে পারবেন? আপনাকে নিয়ে একটু হেঁটে আসবো।
হুম পরবো। তবে আমাদের দেখাটা কিছুটা দূরে হলে ভালো হবে। কারণ মানুষজন নয়তো অনেক রকম কানাঘুষা করবে।
জাহাঙ্গীর: তাতে আমার কিছু যায় আসে না। বন্ধুত্ব কিংবা ভালোবাসা জিনিসটা প্রকাশ্য করতে হয়। মানে ভালো কাজ গুলো প্রকাশ্য করতে হয় যেনো আপনাকে আমাকে দেখে আরেক জন উৎসাহিত হয়। আর খারাপ কাজ ঝগড়া এসব লুকিয়ে করা উচিৎ কেননা সে সকল কাজ মানুষ দেখে তা শিখলে খারাপ ছাড়া ভালো কিছুই আমরা পাবো না।
রাত গভীর থেকে গভীর হচ্ছে অথচ জাহাঙ্গীরের কথায় আমি আলোর মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি চাচ্ছি সময়টা থমকে থাকুক আরও অনেক সময় আমি গল্প করতে চাই এই মানুষটার সাথে।
জাহাঙ্গীর: আজ তবে চলুন নামা যাক কাল বিকেলে দেখা হচ্ছে আপনার বাড়ির সামনে।
দু’জন দুজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিচে নিজের রুমে চলে আসলাম। সত্যিই পৃথিবীর সব মানুষ খারাপ হয়না আজ তা আরেক বার প্রমাণিত হলো। আমি নতুন করে জীবন নিয়ে ভাবতে ভাবতে একটা সময় ঘুমিয়ে পরলাম।
বেশ ভালো একটা ঘুম দিয়ে সকালে ফজরের আজানের সময় জেগে উঠে নামাজ পড়ে। সকলের জন্য নাস্তা বানাতে রুম থেকে বের হয়ে রান্না ঘরে আসতেই দেখি মা নাস্তা বানাচ্ছে। আমরা সত্যিই কখনো ভাবতে চাইনা মা বাবারা আমাদের জন্য কত পরিশ্রম করে। মা আমাকে দেখে হয়তো বেশ অবাক হলো। আমি হাসি মুখে মাকে জড়িয়ে ধরলাম।
মা: তুই এতো সকালে?
তুমিতো অনেক কষ্ট করো আর আমি সারাদিন শুয়ে বসে কাটাই আমারতো উচিৎ কিছু একটা করা।
মা অবাক হয়ে গেলো কেন জানি মনে হচ্ছে মায়ের চোখের কোনে পানি জমে এসেছে। আমি আরও শক্ত করে মাকে জড়িয়ে ধরলাম।
নাস্তা করে বাবা বাসা থেকে বের হয়ে গেলো, রুমন ও বাবার পিছু পিছু বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। আজ কেন জানি সময় এগিয়ে চলছে না আজ খুব করে চাচ্ছি সময়টা খুব দ্রুত গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসুক।
#চলবে…
[গত পর্বে নামের একটু টাইপিং মিস্টেক হয়েছিলো তার জন্য দুঃখিত। আজাদের জায়গায় জাহাঙ্গীর হবে। ধন্যবাদ সবাইকে]