বিবর্ণ-৫ম পর্ব
#লেখনীতে_শাহরিয়ার
দুপুরের খাবার টেবিলে আমি মায়ের কাছে জাহাঙ্গীরের কথা বললাম। মা আমার কথা শুনে কিছুটা সময় চুপ হয়ে রইলো।
মা: ছেলেটাকে কি তুই ভালো মত চিনিস? হুট করে কারো সাথে কোথাও যাওয়া কি ঠিক হবে?
কিছু মানুষের সাথে সারা জীবন থেকেও হয়তো তাকে চেনা যায় না। আর কিছু মানুষকে অল্প পরিচয়েও চেনা যায়। জাহাঙ্গীর তেমনি একজন। আমি বিশ্বাস করি জাহাঙ্গীর অবশ্যই ভালো ছেলে।
মা: বেশতো তবে মোবাইল অন রাখবি আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরে আসবি। আর যদি মনে করিস কোন রকম সমস্যা হতে পারে তবে সাথে সাথে আমাকে ফোন দিয়ে জানাবি।
মায়ের অনুমতি পেয়ে এতো খুশি লাগছিলো বলে বুঝানোর মত না। আমিতো ভেবেছিলাম মা আমাকে অনুমতি দিবে না। কিন্তু আমার ধারণা মা ভুল প্রমাণিত করে দিলো। দ্রুত খাওয়া শেষ করে নিজের রুমে চলে আসলাম। আলমারি খুলে আকাশি রঙের শাড়িটা বের করে নিলাম। বহুদিন শাড়ি পরা হয়না। বিয়ের পর নতুন নতুন কয়েকদিন পরলেও পরবর্তিতে আর তেমন পরা হয়নি। আমার সুন্দর্য আমি যতই সেজে গুজে থাকি না কেন তার কোন কিছুই শাকিলকে আকৃষ্ট করতে পারিনি।
শাড়ি পরে চুল গুলো খুলে দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ঠোঁটে হালকা গোলাপি রঙের লিপিস্টিক সাথে চোখে হালকা কাজল নিলাম। কতদিন নিজের মত করে সাজা হয়না। আচ্ছা হাতে কাঁচের চুড়ি পরলে কেমন হয়? খারাপ হয়না ভাবতে ভাবতে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে প্রিয় নীল রঙের চুড়ি গুলো হাতে পরে নিলাম।
নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলাম কেন এতো সেজে চলেছিস আজ তুই? মন উত্তর দেয় মুক্তির আনন্দে। বন্দি জীবন থেকে মুক্ত হবার আনন্দে। নিজের মত করে বাঁচতে পারার আনন্দে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে নিজেকে দেখেই নিজে কিছুটা সময় হেসে নিলাম। আচ্ছা আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? হলেও কি কারো কোন ক্ষতি আছে? নানান রকম উদ্ভট সব চিন্তা ভাবনা মাথায় এসে জমা পরছে। আর তা নিয়ে আয়নার সামনে বসে নিজেকে দেখছি আর হাসছি। এমনি করে বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে যাবার পর রুম থেকে বের হয়ে আসলাম। ড্রয়িংরুমের সামনে আসতেই মায়ের সাথে দেখা।
মা: সাবধানে যাস আর কোন সমস্যা হলে সাথে সাথেই ফোন দিবি।
হাসি মুখে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসলাম। গেটের সামনে আসতেই রাস্তার অপর প্রান্তে নীল পাঞ্জাবী পরে জাহাঙ্গীরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। আমি হেঁটে রাস্তার অপরপ্রান্তে চলে আসলাম।
আপনাকে কি অনেক সময় ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছি আমি?
জাহাঙ্গীর: না একটুও না। আমাদেরতো কোন নির্দিষ্ট সময়ে এক জায়গায় হবার কথা ছিলো না। তার জন্য বরং আমি দুঃখিত আমার আপনাকে আগেই বলা দরকার ছিলো আমাদের কখন দেখা হচ্ছে।
না না সমস্যা নেই ভুলতো দু’জনের হয়েছে। আচ্ছা তাহলে আমরা কোথায় যাচ্ছি?
জাহাঙ্গীর: যেখানে যাবো আগে থেকে ঠিক আপনাকে বলা যাবে না। এটা না হয় সারপ্রাইজ থাকুক।
আমরা কি হেঁটে যাবো?
জাহাঙ্গীর: না হেঁটে যাবো না। রিক্সা নিবো তবে আর কিছুপা পথ হেঁটে ঐ মোড়ে যাবার পর। আপনার কি হাঁটতে কিংবা পরবর্তিতে আমার সাথে রিক্সায় যেতে কোন আপত্তি রয়েছে?
না তা হলেতো আসতাম না।
জাহাঙ্গীর: শাড়িতে আপনাকে বেশ সুন্দর লাগছে।
হেসে দিয়ে আপনাকেও কিন্তু বেশ লাগছে পাঞ্জাবীতে।
জাহাঙ্গীর: ধন্যবাদ।
কথা বলতে বলতে রাস্তার শেষ প্রান্তে চলে আসলাম। বেশ কিছু রিক্সা সেখানে দাঁড়িয়ে জাহাঙ্গীর একটা রিক্সা ডাক দিয়ে আমাকে উঠতে বললো। আমি উঠার পর পর জাহাঙ্গীর উঠে বসলো। রিক্সা চলতে শুরু করলো। আমাদের গন্তব্য কোথায় আমি এখনো জানি না। পাশাপাশি রিক্সায় বসে আছি অথচ কারো মুখে কোন কথা নেই। বেশ কিছুটা পথ এভাবেই নিরবে চলতে থাকার পর হঠাৎ করেই জাহাঙ্গীর রিক্সা থামাতে বললো। রিক্সা থামতেই জাহাঙ্গীর আমাকে বসে থাকতে বলে রিক্সা থেকে নেমে পরলো। একটা দোকানের ভিতর ঢুকে অল্প সময়ের ভিতর বেশ কিছু চিপস আর চকলেট নিয়ে পূর্ণরায় রিক্সায় উঠে বসলো। এতো কিছু কেন কিনলো তাও বুঝতে পারলাম না। তবে আমার জন্য নয় এটা বেশ বুঝতে পারলাম। রিক্সা কিছু সময় চলার পর একটা ফুলের দোকানের সামনে আসতে আবার রিক্সা থামিয়ে সে রিক্সা থেকে নেমে গেলো। আমার এখন বেশ বিরক্ত লাগছে। জাহাঙ্গীরের এমন অদ্ভুত ব্যবহারে। কি হচ্ছে এসব নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করল্ম। রিক্সাচালকও বেশ বিরক্ত হচ্ছে তা উনার মুখের দিকে তাকালেই বুঝা যাচ্ছে। অল্প সময়ের ভিতর সে আবার রিক্সায় উঠে এসে আমার দিকে তাকিয়ে সরি সরি আর থামবো না।
আমি তাকিয়ে দেখছি একটা গোলাপের তোড়া আর একটা বেলী ফুলের মালা কিনে নিয়ে এসেছে জাহাঙ্গীর। আচ্ছা জাহাঙ্গীর কি তার বিশেষ কোন মানুষের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে? যদি এমনই হয় তবে আমাকে কেন সাথে নিয়ে যাচ্ছে?
জাহাঙ্গীর: চুপ করে রয়েছেন কেন?
কই এমনি আপনিওতো কোন কথা বলছেন না।
জাহাঙ্গীর: আসলে খোলা আকাশের নিচে ঘুরে বেড়াতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। আমি মাঝে মাঝেই রিক্সা নিয়ে এভাবে একা একা আগে ঘুরে বেড়াতাম। আজ আপনি আমার সঙ্গী হয়েছেন।
তা আজ কি আমাদের কোন গন্তব্য রয়েছে নাকি গন্তব্য বিহীন ঘুরে বেড়াবো?
জাহাঙ্গীর: ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে অবশ্যই গন্তব্য রয়েছে। আর একটু অপেক্ষা করুণ দেখতে পাবেন।
এরপর আর কোন কথা হলো না। দু’জন চুপ করে পাশাপাশি বসে রইলাম মিনিট দশেক। একটা বিশাল বিল্ডিং এর সামনে এসে রিক্সা থামাতে বললো জাহাঙ্গীর। ভাড়ার চেয়ে আরও বিশ টাকা বেশী রিক্সাওয়ালাকে দিতেই তার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
আমরা হেঁটে বিল্ডিং এর পেছনে যেতে শুরু করলাম। এই মুহুর্তে আমার প্রচণ্ড ভয় লাগছে। কেননা জানি না কি হতে চলছে আর কোথায় যাচ্ছি আমরা। বিশাল এক বস্তির সামনে এসে দাঁড়ালাম।
জাহাঙ্গীর: আপনি একটু এখানে দাঁড়ান আমি ভিতর থেকে আসছি।
কথাটা বলেই জাহাঙ্গীর হনহন করে বস্তির ভিতর ঢুকে পরলো। ভয়ে আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। জাহাঙ্গীর কি দলবল নিয়ে একটু পর আমার উপর হামলে পরতে পারে? আচ্ছা আমি এতো বাজে চিন্তা কেন করছি? জাহাঙ্গীরকে দেখেতো এই দু’দিন আমার এমন মনে হয়নি তবে আজ কেন এতো বাজে চিন্তা মাথায় আসছে?
কথা গুলো ভাবতে ভাবতেই অনেক গুলো ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে জাহাঙ্গীর বের হয়ে আসলো। আমার সব বাজে চিন্তা মুহুর্তেই কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো। ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠলো হাসির রেখা। বাচ্চা গুলো জাহাঙ্গীরের সাথে হাসতে হাসতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি অবাক হয়ে বাচ্চা গুলোকে দেখছি ওদের হাতে চিপসের প্যাকেট গুলো আর মুখে অফুরন্ত রাজ্য জয়ের হাসি। ওরা সকলে আমার কাছে এসে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরলো।
জাহাঙ্গীর: ওরা সকলেই সুবিধা বঞ্চিত পথ শিশু, এখানে অনেকের মা বাবা আছে অনেকের নেই। ওদের কেউ কেউ রাস্তার টোকাই, কেউ কেউ হোটেলে কাজ করে কেউ কেউ অন্য পেশায় আছে। আমি সপ্তাহে একদিন ওদের পড়াশোনা করাই। আমার খুব ভালো লাগে ওদের সাথে সময় কাটাতে তাই আজ আপনাকে নিয়ে আসলাম।
আনন্দে কেন জানি চোখের কোনে পানি চলে আসছিলো। একটা মানুষ এতোটা ভালো কি করে হতে পারে। যতই দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। সত্যিই অসাধারণ একজন মানুষ জাহাঙ্গীর।
জাহাঙ্গীর: এ কি আপনি কান্না করছেন কেন?
ওহ কিছু না চোখে পোকা পরেছে। সত্যিই আমি সারপ্রাইজড হয়েছি। আপনি অসাধারণ কাজ করছেন।
জাহাঙ্গীর: সব আল্লাহর ইচ্ছে। কেননা আল্লাহ আমাকে এই কাজ করার তৌফিক দান করেছেন। তাইতো করতে পেরেছি। একদিন হয়তো এরাই পড়ালেখা শিখে অনেক বড় হবে। বড় বড় চাকরি করবে। নিজের বাড়ি ঘর থাকবে। নিজেদের মত করে সাজাবে। ওদের স্বপ্ন গুলো পূর্ণতা পাবে। তখন হয়তো কারো কারো হুট করেই আমার কথা মনে পরবে। হয়তো কেউ কেউ অনেক বড় কোন কনফারেন্সে অকপটে বলে উঠবে জাহাঙ্গীর নামক কেউ একজন। খুব ছোট বেলায় আমার হাতে বই তুলে দিয়েছিলো, তাইতো আজ এতোদূর পর্যন্ত আসতে পেরেছি। কেউ কেউ হয়তো বৃদ্ধ বয়সে আমায় দেখতে ছুটে আসবে বহুদূর থেকে। ঐটাই আমার জীবনের প্রাপ্তী হয়ে থাকবে। আমার মুখে হাসি ফুটাবে।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে রয়েছি জাহাঙ্গীরের দিকে। যতই দেখছি, যতই শুনছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। একটা মানুষের চিন্তা ভাবনা কতটা সুন্দর হলে, মন কতটা পরিষ্কার হলে মানুষ এসব কাজ করার কথা চিন্তা করতে পারে। আর আমি কিনা একজন প্রতারকের জন্য নিজের জীবন নষ্ট করে দিচ্ছিলাম।
জাহাঙ্গীর: এভাবে এতো মনোযোগ দিয়ে কি ভাবছেন?
তেমন কিছু না ভাবছি আপনার মন মানুষিকতা নিয়ে। কতটা ছচ্ছ চিন্তা ভাবনা আপনার।
জাহাঙ্গীর: জীবনটা খুব কঠিন একটা জায়গা এখানে যদি আপনি একটু ধৈর্যশীল না হোন, একটু কঠিন না হোন তবে বেঁচে থাকাটা খুবই কষ্টকর হয়ে উঠবে। আপনাকে বেঁচে থাকতে হলে শক্ত মন মানুষিকতার হতে হবে। তবেই সব কিছু আপনার জন্য সহজ হয়ে যাবে। আর যখন সব কিছু সহজ হয়ে যাবে তখন আপনি আনন্দ খুঁজে পেতে শুরু করবেন। সব কিছু থেকেই। ভালো কাজ গুলো তখন আপনা আপনি হতে থাকবে আপনার দ্বারা।
চমৎকার ভাবে কথা মানুষটার কথার পিঠে আমি কোন কথা বললাম না। শুধু শুনে চলেছি তার বলা কথা গুলো। আর একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে অপেক্ষা করছি পরবর্তি কথা শোনার জন্য।
#চলবে…