রংধনু-২য় পর্ব
#লেখনীতে_শাহরিয়ার
মানুষটা একবারের জন্যও আমার দিকে তাকাচ্ছে না। এমন অদ্ভুত কেন মানুষটা আমি বুঝতে পারছি না। রাস্তার দুই পাশে বড় বড় গাছ গুলোকে পেছনে ফেলে গাড়ি এগিয়ে চলছে খুব দ্রুত। জোৎস্নার আলো এসে মাঝে মাঝে মানুষটার মুখে পরছে। ফর্সা মুখটা বেশ সুন্দর লাগছে। কিন্তু উনি ভাবলেশহীন হয়েই বসে রয়েছেন। আমি যে উনার দিকে চেয়ে রয়েছি উনি কি তা বুঝতে পারছেন?
গাড়ি এক সময় ঢাকা শহরে চলে আসলো। এখন আর গাছ দেখা যাচ্ছে না। বড় বড় দালানের আড়ালে ঢাকা পরেছে জোৎস্নার আলোও। ল্যাম্পপোষ্টের কৃত্রিম আলোয় আমি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছি মানুষটার দিকে। এক সময় বড় একটা বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামলো। দারোয়ান গেট খুলে দিয়ে লম্বা একটা সালাম দিলো। গাড়ি বাড়ির ভিতরে ঢুকে পরলো।
আমি ভেবেছিলাম বাড়িটা হয়তো বেশ সুন্দর করে নানান রকম মরিচা বাতিতে সাজানো থাকবে। আমার সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। সবচেয়ে বেশী আশ্চর্য হলাম যখন আজাদ গাড়ি থেকে নেমে একাই বাড়ির ভিতর ঢুকে পরলো। আমি গাড়ি থেকে নামবো নাকি বসে রবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
হঠাৎই মেয়েলি একটা কণ্ঠ বলে উঠলো ভাবী নেমে আসো। আমি গাড়ির দরজা খুলে মেয়েটার দিকে তাকালাম। আমার সম বয়সী হবে সে। অপূর্ব সুন্দরি বলতে যেমন বোঝায় মেয়েটা ঠিক তেমনি। আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেয়েটা আরেক বার বলে উঠলো ভাবী নামো। আমি তার কথা মত গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালাম। সে আমার হাত ধরে বললো ভিতরে চলো।
আমি ওর হাত ধরে বাড়ির ভিতর ঢুকতে শুরু করলাম। দরজা খুলে যখন ভিতরে ঢুকলাম, চারিদিকে শুধু আলো আর আলো। এসির বাতাসে পুরো হিম শীতল হয়ে রয়েছে সব কিছু। আমার সমস্ত শরীর মুহুর্তেই ঠাণ্ডা হয়ে এলো।
আমার চোখ আটকে যাচ্ছে চারিদিকের পরিবেশ দেখে। আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখে চলছি। এতো সুন্দর বাড়ি আর দামী দামী জিনিস পত্র আমি এর আগে শুধু টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছি। আমাকে নিয়ে দু’তলায় একটা ঘরে আসলো। আমি যেমনটা ছবিতে দেখেছি। বেশ সুন্দর করে বাসর ঘর সাজানো থাকে তেমন কিছুই নেই সে ঘরে। তবে ঘরটা বেশ সুন্দর করে সাজানো। আমাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে মেয়েটা বলে উঠলো। সরি ভাবী আসলে হুট করেই তোমাদের বিয়েটা হয়েছে তাই ঘর সাজাতে পারিনি।
আমি না না ঠিক আছে।
ও তোমাকেতো আমার পরিচয় দেয়া হয়নি, আমি আরিশা তোমার একমাত্র ননদিনি। বলেই মিষ্টি করে হাসলো।
আমি মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলাম আরিশার দিকে দেখতে যেমন সুন্দর ঠিক তেমনি সুন্দর ও হাসিটাও। আমি ওকে প্রশ্ন করলাম তুমি কি আমার নাম জানো?
আরিশা: আরেকবার সেই সুন্দর ভুবণ ভুলানো হাসি দিয়ে বললো হ্যাঁ ভাবী জানি তোমার নাম প্রিয়া। খুব মিষ্টি একটা মেয়ে তুমি। তোমাকে আজ সকালেই আমি ছবিতে দেখেছি, আর দেখেই আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।
তুমি কি জানো আরিশা, আমি আজ পর্যন্ত যত মানুষের হাসি দেখেছি, সব চেয়ে সুন্দর হাসি তোমার।
আমার কথা শুনে আরিশা আরও বেশ কিছুটা সময় হেসে নিলো। তারপর বললো কি যে বলো ভাবী। সবাই বলে ভাইয়া হাসি দিলে নাকি পুরো পৃথিবী তার মায়ায় পরে যায়। সেখানে তুমি আমার হাসির প্রশংসা করছো শুনলে লোকে বেশ মজা পাবে।
তোমার ভাইয়া কি সত্যিই হাসতে জানে? আমিতো পুরো রাস্তায় তার সাথে আসার সময় বরং গম্ভীর মুখে আকাশের দিকে চেয়ে থাকতে দেখলাম। হয়তো তোমার ভাইয়ার আমাকে পছন্দ হয়নি। নয়তো তার মনের মাঝে অন্য কেউ আছে।
আমার কথা শুনে আরিশা কিছুটা হকচকিয়ে গেলো। তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে ঐসব কিছু না। আরও কিছু বলতে যাবে এমন সময় ঘরের দরজায় টোকা পরলো। আরিশা বললো ভাইয়া এসেছে তুমি বসো আমি যাচ্ছি পরে তোমার সাথে কথা বলবো। বলেই একটু হাসার চেষ্টা করলো। তবে এই হাসিটায় আগের মত আর প্রাণ খুঁজে পেলাম না আমি। সম্পূর্ণ কৃত্রিম হাসি। আরিশা দরজা খুলে বের হয়ে যেতেই আজাদ ঘরের ভিতর ঢুকলো। ততক্ষণে আমি শাড়ির আঁচল দিয়ে আমার মুখ ঢেকে নিয়েছি। ঘর ফুলে ফুলে সাজানো না হোক তবুও আজ আমার বাসর রাত। কিন্তু আজাদ আমার সাথে কোন কথা না বলে সোজা চলে গেলো ব্যালকনিতে। আমি তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলাম শুধু।
মানুষটা সত্যিই আজব! ব্যালকনির দরজা দিয়ে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সে সিগারেট জ্বালিয়েছে। আমি সবচেয়ে বেশী অপছন্দ করি সিগারেট খাওয়া মানুষ আর শেষে কিনা আমার কপালেই এমন বর জুটছে। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে নিজের কাছেই। একে একে সব স্বপ্নই ভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে আমার। প্রতিটা মেয়েরই বাসর রাত নিয়ে অনেক রকম স্বপ্ন থাকে আমারও ছিলো। তার কোনটাই পূর্ণতা পেলো না।
চোখ বেয়ে একাই পানি পরতে শুরু করলো। কোথায় আসলাম, মামা আমাকে কোথায় বিয়ে দিলো। জেল খানা না হবার পরেও নিজেকে বন্দিনি মনে হচ্ছে। এই কষ্ট দেখানোর মত আপন কেউ নেই আমার এ শহরে।
একা একাই সব ভেবে চলেছি রাত কয়টা বাজে তাও জানি না। হঠাৎ করেই আজাদ রুমের ভিতর ঢুকে আসলো। আমি কিছুটা চেপে এক কর্ণারে যেয়ে বসলাম।
আজাদ: তুমি শাড়িটা চেঞ্জ করে নাও। এতো ভারী শাড়ি গহনা পরে থাকতে তোমার কষ্ট হচ্ছে না।
এই প্রথম মানুষটা কথা বললো, আমি তার কথার কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলাম। আজাদ আবার বলে উঠলো তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো না?
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম জ্বি শুনেছি।
আজাদ: তাহলে নামছো না কেন?
রাগে আমার সমস্ত শরীরে আগুন জ্বলে উঠছে। ইচ্ছে করছে উনার মাথার চুল টেনে ছিড়ে ফেলতে। কিন্তু সে সাহস আমার নাই। তাই বাধ্য মেয়ের মত খাট থেকে নেমে আমি লাগেজ খুলে একটা জামা নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে পরলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করলাম। কিন্তু আমার মুখ দিয়ে কোন রকম আওয়াজ বের হলো না। চিৎকার ঠিকই করেছি তবে তা নিজের ভিতর চেপে রেখেই। কেমন মানুষের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। যে কিনা এখন পর্যন্ত একটা বারের জন্যও আমাকে স্পর্শ করে দেখলো না।
শুনেছি মানুষ নাকি বাসর ঘরে খুব রোমান্টিক রোমান্টিক কথা বলে। মেয়েরা ভয়ে থাকে স্বামী তার ভয় ভাঙায়। কিন্তু আমার জীবনে সব উল্টো হচ্ছে। এমন ঘটনা কি জীবনে আর কোন মেয়ের সাথে ঘটেছে কিনা আমার তা জানা নেই। কোন রকমে শাড়িটা চেঞ্জ করে বের হয়ে এসে দেখি আজাদ আবারও ব্যালকনিতে গিয়ে সিগারেট জ্বালিয়েছে। ইচ্ছে করছে যেয়ে একটা ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলি। আচ্ছা এর আগে কি কেউ বাসর ঘরে নিজের স্বামীকে হত্যা করেছে? সবচেয়ে বড় কথা দু’তলা থেকে পরলে কি সে মারা যাবে? দুনিয়ার যত বাজে চিন্তা আছে সব মাথায় এসে জড়ো হচ্ছে এই মানুষটার এমন ব্যবহারে। এই মানুষটা এতো নিষ্ঠুর কেন? কেনই বা আমার সাথে এমন করছে? সে কি আমার সাথে একটু ভালো করে কথা বলতে পারে না। আমার অপরাধটাই বা কি? উনারাই পছন্দ করে আমাকে বউ বানিয়ে নিয়ে এসেছে। তাহলে কেন আমাকে এই ভাবে অবহেলা করছে।
একেতো লম্বা একটা পথ জার্নি করে এসেছি, তার উপর এতো এতো অবহেলা। দু’চোখে ঘুম চেপে বসেছে, আমি বিছানায় উঠে কিছুটা সময় বসে রইলাম। না আর পারছি না, আমার পক্ষে আর বসে থাকা সম্ভব নয়। আমি বিছানায় শুয়ে পরলাম। ব্যালকনিকে দাঁড়িয়ে থাকা আজাদের দিকে তাকালাম। মানুষটা সেই আগের মতই সিগারেট টেনে যাচ্ছে। এক সময় আমার দু’চোখ বন্ধ হয়ে গেলো।
সকালে আরিশার ডাকে চোখ মেলে তাকিয়ে পাশে বা ঘরের ভিতর আজাদকে দেখতে পেলাম না। শুধু নিজের শরীরের উপর পাতলা একটা চাদর দেখতে পেলাম। তার মানে চাদরটা আজাদ আমার শরীরে তুলে দিয়েছে। কিন্তু সে সারা রাত এই বিছানায় আসেনি। তবে কি সারা রাত ব্যালকনিতেই কাটিয়ে দিয়েছে নাকি অন্য কোথাও ছিলো। ভাবতে ভাবতে যেয়ে দরজাটা খুলে দিতেই আরিশা ঘরের ভিতর ঢুকলো।
আরিশা: ভাবী নাস্তা করবে না? সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
তোমার ভাইয়া কোথায়?
আরিশা: ভাইয়াতো নিচে নাস্তার টেবিলে।
আমি খুব অবাক হয়ে গেলাম।
আরিশা: কেন ভাইয়া কি সারা রাত তোমার সাথে ছিলো না? তোমাকে সকালে ডেকে যায়নি?
আরিশার এমন প্রশ্নের কোন উত্তর আমার কাছে নেই। আমি নির্বিকার হয়ে তার দিকে চেয়ে রইলাম শুধু।
আরিশা: বুঝতে পেরেছি আচ্ছা তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও আমি বসছি।
আমি আর কিছু না বলে ফ্রেশ হয়ে আরিশাকে সাথে নিয়ে নিচে নামতে শুরু করলাম। সিঁড়ির একদম শেষের দিকে আসতেই ছোট একটা ছেলে মা মা বলে ছুটে আসতে থাকলো আমাদের দিকে। আমি ভীষণ অবাক হয়ে আরিশার দিকে তাকালাম। আরিশা বিবাহিত তাতো আমাকে বলেনি। কিন্তু অবাক করে দিয়ে বাচ্চাটা আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
#চলবে…