রংধনু-৬ষ্ঠ পর্ব

0
1867

রংধনু-৬ষ্ঠ পর্ব
#লেখনীতে_শাহরিয়ার

গাড়ি দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। আমার খোলা চুল গুলো বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে। আর কোলে ঘুমিয়ে রয়েছে নিশাদ। আমি চেয়ে আছি আজাদের দিকে। এর চেয়ে সুন্দর মুহুর্ত আর কি হতে পারে?

আজাদ: তুমি কি কিছু ভাবছো?

কই কিছু না।

আজাদ: এভাবে আমার দিকে চেয়ে রয়েছো কেন?

আপনি কি করে বুঝলেন আমি আপনার দিকে চেয়ে রয়েছি?

আজাদ: পাশে বসে আমার দিকে চেয়ে রয়েছো এটা বুঝতে পারা কোন কঠিন কাজ না।

তাহলে কঠিন কাজ কি?

আজাদ: পৃথিবীতে অনেক কঠিন কঠিন কাজ রয়েছে যা তুমি আমি অনেক চেষ্টা করলেও পারবো না। কারণ সব কাজ সবাইকে দিয়ে হয়না।

হুম এটা ঠিক বলেছেন। দু’জন কথা বলছি আর গাড়ি এগিয়ে চলছে শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে। দুপুরে একটা বড় হোটেলের সামনে গাড়ি পার্কিং করা হলো। আমরা তিনজন গাড়ি থেকে নেমে হোটেলে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। সেখানে কিছুটা সময় রেস্ট নিয়ে আমরা আবার রওনা হলাম গ্রামের পথে।

নিশাদ: আচ্ছা আম্মু গ্রাম দেখতে কেমন?

গ্রাম দেখতে অনেক সুন্দর। তুমি কখনো গ্রামে যাওনি?

নিশাদ: না আমি কখনো গ্রামে যাইনি।

আচ্ছা বাবা তোমাকে নিয়ে এবার গ্রামে আমি অনেক ঘুরবো।

নিশাদ: বাবাকে সাথে নিবা না?

তোমার বাবার যদি ইচ্ছে হয় তবে আমাদের সাথে ঘুরবে। সেতো ছোট মানুষ নয় তাইনা?

এভাবেই তিনজন গল্প করতে করতে বিকেলের ভিতর আমার চিরচেনা গ্রামে চলে আসলাম। কি পরিমান ভালো লাগছিলো বলে বুঝাতে পারবো না। মামা মামী সবাই বেশ খুশি হলো। মামাকে আমার শাশুড়ি আগেই ফোন দিয়ে আমাদের আসার কথা জানিয়ে দিয়েছিলো। মামা আর মামী নানান আয়োজন করেছে বেশ কয়েক রকমের পিঠা বানিয়েছে মামী।

কলেজ শেষ করে বাসায় এসে ঝুমা আর রিফাত আমাদেরকে দেখে কি পরিমাণ আনন্দিত হয়েছে তা বলে বুঝাতে পারবো না। ঝুমা জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। ছোট বেলা থেকেই ওদের দুই ভাই বোনকে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছি এতো সহজে না ওরা আমাকে ভুলতে পারবে আর না আমি ওদের ভুলতে পারবো।

পাঁচজন এক সাথে বসে নাস্তা করছি, সাথে গল্পের আসর ও বেশ জমে উঠেছে। গল্পে গল্পে নাস্তা করছি আর মামী রান্না করছে। আমি ওদের রেখে রান্না ঘরে চলে আসলাম মামীকে সাহায্য করার জন্য। আমাকে দেখে মামী বলে উঠলো কিরে মা তুই নতুন জামাই রেখে এখানে কেন আসছিস?

তোমাকে রান্নায় সাহায্য করতে এসেছি। আর তোমার সাথে আসার পর কোন রকম কথায় হলো না।

মামী: কথা বলার কি সময় শেষ হয়ে গিয়েছে? যা এখন যেয়ে জামাইকে সময় দে।

তাকে সময় দেবার জন্যও তো সারা জীবন পরে রয়েছে।

মামী: তোর সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি যদি পারিস তো ক্ষমা করে দিস। কথাটা বলার সময় মামীর কণ্ঠটা ভারী হয়ে আসলো। চোখের কোনে পানি জমে গিয়েছে।

মামীর হাতটা শক্ত করে ধরে কি বলছো তুমি এসব। তুমি অন্যায় কেন করবে, মায়ের আদরে বড় করেছো। মাকেতো জন্মের পর থেকে পাইনি। তুমিইতো আমার মা। মা হয়ে মেয়েকে শাষণ করেছো তাতে অন্যায়ের কি আছে?

আমার কথা শুনে মামী এবার কেঁদেই দিলো। মামীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। আমি এখন বুঝতে পারছি অভাবের কারণে মামী একটা সময় এমন করেছে। আর মামী যে সব সময় আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে তাও না। জীবনের বাস্তবতা এটাই আপন মানুষ দূরে গেলে তার গুরুত্ব বুঝা যায়। গত দুই দিন আমি বুঝেছি কতটা আপন ছিলো মানুষ গুলো। প্রতিটা মুহুর্ত আমি সবাইকে মনে করেছি।

মামী: এখন যা জামাইকে সময় দে।

উহু তুমি যাও। আমি রান্না করছি যেয়ে কথা বলো।

মামী: আমি কি কথা বলবো। আচ্ছা ওদের পরিবার কেমন তোকে কি কোন রকম কষ্ট দেয়?

না মামী তারা খুবই ভালো। আমার কোন রকম অসুবিদা হচ্ছে না সেখানে। বরং বেশ ভালো সুখেই রয়েছি।

মামী: যাক আল্লাহ তোর উপর মুখ তুলে চেয়েছে। দোয়া করি আল্লাহ সারা জীবন তোকে সুখ শান্তীতে রাখুক।

দু’জন গল্প করতে করতে রান্না শেষ করলাম। রান্না শেষে ফিরে এসে দেখি তখনো তারা গল্প করছে। আমি নিশাদকে কোলে নিতে নিতে বললাম গল্প করে সারা রাত পার করবে নাকি তোমরা।

আজাদ: মন্দ হয় না যদি গল্প করে রাত কাটিয়ে দেয়া যায়।

তারপর সারাদিন ঘুমাবেন তাইতো? তাহলে গ্রামে এসে লাভ কি বলুনতো। যদি গ্রামের সুন্দর্য উপভোগ করা না গেলো।

আজাদ: সারাদিন ঘুমাবো কেন? মানুষ রাত জাগলেই যে দিনে ঘুমাবে এমনতো কোন কথা নেই।

গল্প করতে করতে মামা চলে আসলো। মামাও এসে আমাদের সাথে গল্পে যোগ দিলো। বেশ কিছু সময় পর মামী সব কিছু রেডি করে সকলকে ডাক দিলো। সবাই এক সাথে রাতের খাবার খেতে বসলাম। বাহিরে প্রচণ্ড বাতাস শুরু হলো। তাতে বিদুৎ চলে গেলে মামী হারিকেন জ্বালালো। খাবার শেষ হতে হতেই খুব বৃষ্টি শুরু হলো। রিফাত নিশাদকে কোলে নিয়ে বললো ও আমার সাথেই থাকবে। তুমি আর দুলাভাই তোমার রুমে যেয়ে থাকবে বলে নিশাদকে নিয়ে চলে গেলো।

ঝুম বৃষ্টি টিনের চালে তার শব্দ হচ্ছে আমি জানালা গ্রীলের ফাকা দিয়ে বাহিরে হাত বাড়িয়ে রেখেছি। টপটপ করে বৃষ্টির পানি আমার হাতে পরছে। আজাদ একটু ঐখান থেকে সরে দাঁড়াবে।

আমি বুঝতে পেরেছি কেন সরে দাঁড়াতে বলেছে। আমি কোন রকম কথা না বলে সরে আসলাম। আজাদ জানালার সামনে যেয়ে সিগারেট জ্বালালো। দীর্ঘ সময় কারো মুখে কোন কথা নেই। সব নিরবতা ভেঙে আমিই বলে উঠলাম আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে আর রাতে ঘুমাতেও বেশ কষ্ট হবে তাই না?

আজাদ: না কষ্ট হচ্ছে না, আর রাতে ঘুমাতেই বা কেন কষ্ট হবে?

বিশাল বড় বাড়ি বিশাল রুম রেখে এই টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ ছোট বিছানা এসবেতো কষ্ট হবারই কথা তাই না।

আজাদ: না সমস্যা নেই। আমি সকল পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে পারি।

আমি না হয় মাটিতে বিছানা করর থাকি।

আজাদ: মানে তুমি কেন মাটিতে বিছানা করে থাকবে?

না যদি আপনার কষ্ট হয় তাই বলছিলাম।

আজাদ: আমি একবার ও বলিনি আমার কোন রকম কষ্ট হচ্ছে। অযথাই এসব নিয়ে কোন রকম টেনশন করার দরকার নেই।

রাত বেড়ে চলছে আমি বিছানার এক পাশে শুয়ে রয়েছি আজাদ জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রয়েছে ঘরে হারিকেনের আলো জ্বলছে। গ্রামে এটা একটা সমস্যা একটু ঝড় বৃষ্টি হলেই বিদুৎ চলে যায়। এসব ভাবতে ভাবতে দু’চোখ লেগে আসলো।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে তাকিয়ে দেখি আজাদ পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে। আমি উঠে বিছানার পাশে থাকা টেবিলের উপর থেকে চাদরটা নিয়ে উনার গায়ের উপর দিয়ে দিলাম। ঘুমন্ত অবস্থায় হারিকেনের আলোয় ভীষণ মায়াবী লাগছে মানুষটার মুখ ইচ্ছে করছে হাত বাড়িয়ে ছুয়ে দিতে। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও কখনো কখনো তা পূর্ণ করা সম্ভব হয়না। আমি পাশে শুয়ে শরীরের উপর কিছুটা চাদর টেনে নিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পরলাম।

সকালে দরজার কড়া নাড়ার শব্দে চোখ মেলে তাকালাম। সূর্যের আলো তখন উঁকি দিচ্ছে ঘরের ভিতর। রাতের বৃষ্টি হয়তো অনেক আগেই থেমে গেছে। উঠে দরজা খুলতেই ঝুমা দরজায় দাঁড়িয়ে বললো এখনো উঠোনি। তাড়াতাড়ি উঠো মা নাস্তা বানিয়ে অপেক্ষা করছে বাবা আবার কাজে বের হয়ে যাবে।

তুই যা আমরা আসছি। বলে ভিতরে এসে জানালার পর্দা সরিয়ে দিলাম। সূর্যের আলো এসে সরাসরি আজাদের চোখে পরতেই সে কিছুটা নড়ে চরে উঠলো। আমি পাশে দাঁড়িয়ে এই যে শুনছেন? বেশ কয়েকবার ডাক দেয়ার পরও যখন সে উঠলো না তখন হাত বাড়িয়ে তার হাত নাড়া দিতেই সে চোখ মেলে তাকালো।

আজাদ: চোখ মেলে তাকিয়ে কিছু বলবে?

একটু তাড়াতাড়ি উঠুন না, সবাই নাস্তার টেবিলে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। আসলে গ্রামে মানুষ এতো লম্বা সময় ঘুমায় না। আর আপনি না কাল বললেন সারা রাত না ঘুমালেও সারা দিন জেগে থাকতে পারবেন।

আজাদ: সেটা না ঘুমিয়ে আর ঘুমিয়ে পরলে উঠতেতো একটু দেরী হবেই।

আমার সাথে চলুন ফ্রেশ হয়ে নিবেন।

আজাদ আর কথা না বলে বিছানা ছেড়ে উঠে পরলো। দু’জন ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে আসলাম। সেখানে আগে থেকেই সকলে উপস্থিত ছিলো। নিশাদ আমাদের দেখে বলে উঠলো আজ আমি তোমাদের আগে উঠেছি। তোমরা আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরী করে ফেলেছো। আমরা ওর কথায় শুধু হাসলাম কিছু বললাম না। সকলে এক সাথে নাস্তা করে নিলাম। মামা নাস্তা শেষ করে বের হয়ে গেলো আজাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে।

আমরাও সকলে নাস্তা শেষ করে নিলাম। ঝুমা বললো এখন তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আসো আমরা সবাই এক সাথে ঘুরতে যাবো। আমি নিশাদকে নিয়ে ঘরে চলে আসলাম। নিশাদকে রেডি করাতে করাতে আজাদ চলে আসলো। নিশাদকে রেডি করে বললাম তোমার ঝুমা আন্টির রুমে যাও নিশাদ দৌঁড়ে বের হয়ে গেলো। আমার খুব লজ্জা লাগছিলো আজাদের সামনে শাড়ি চেঞ্জ করতে। তাই শাড়ি হাতে দাঁড়িয়ে রইলাম। আজাদ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমি অন্যদিকে ঘুরে আছি তুমি তৈরি হয়ে নাও। এমন কথা শুনে আমার খুব লজ্জা লাগছিলো। কোন রকমে শাড়ি পরার চেষ্টা করছি কিন্তু কোন ভাবেই ঠিক করতে পারছি না। কি একটা অবস্থায় পরেছি। বাধ্য হয়েই আজাদ কে ডাক দিতেই সে আমার দিকে ঘুরে তাকালো।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here