রংধনু-৭ম পর্ব
#লেখনীতে_শাহরিয়ার
আমি বেশ লজ্জায় পরে গেলাম আজাদ কে ডাক দিয়ে। আজাদ এক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রয়েছে। আমি মাথা নিচু করে বললাম আমি ঠিকমত শাড়ির কুচি ঠিক করতে পারিনা।
আজাদ: আমার বেশ কিছুটা কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পরলো। আমার চোখে চোখ রেখে এভাবে শাড়ির কুচি ঠিক করতে হয়। লজ্জায় মরার অবস্থা হয়েছে আর আমাকে শাড়ির কুচি ঠিক করা দেখতে বলে। হাসবো নাকি কাঁদবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। আচ্ছা সে আমার স্বামী তার কাছে এতোটা লজ্জা পাবার কি আছে। ভাবতে ভাবতেই সে শাড়ির কুচি আমার কোমড়ে গুজে দিতেই আমার সমস্ত শরীরে বিজলে চমকানোর মত চমকে উঠলো। আমার একটা হাত শক্ত করে তার কাঁধ চেপে ধরলাম। সেদিকে তার খেয়াল নেই, সে উঠে দাঁড়ানোর সময় আমি দ্রুত হাত সরিয়ে নিলাম।
আজাদ: তোমার অধিকার আছে আমার কাঁধে হাত রাখার। ভয় পাবার বা চমকে উঠার কিছু নেই।
লজ্জায় মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে প্রশ্ন করলাম। আমার আর কি কি অধিকার রয়েছে?
আজাদ: আমার দিকে তাকিয়ে সময়ের সাথে সাথে সবটাই জেনে যাবে।
কথাটা বলেই ব্যাগ থেকে পাঞ্জাবী বের করে পরতে শুরু করলো আকাশী রঙের পাঞ্জাবী। শরীর থেকে শার্টটা খুলে ফেলতেই উনার লোম ভর্তি খোলা বুক আমার সামনে উন্মুক্ত হলো। এই প্রথম মানুষটাকে আমি খালি গায়ে দেখলাম। নিজের মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললাম তাড়াতাড়ি করেন সকলে অপেক্ষা করছে।
আজাদ: চলো বের হও।
কথাটা বলেই হাঁটা শুরু করলো। আমি উনার পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করলাম ঘর থেকে বের হয়ে উঠানে আসতেই দেখি সবাই দাঁড়িয়ে রয়েছে। সবাই রেডি শুধু মামী বাদে আমি মামীকে বললাম তুমি যাবে না?
মামী: খুব আস্তে করে কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে। তুই কি পাগল হইলি? বাড়িতে নতুন জামাই এসেছে রান্না বান্না কত কাজ সে সব বাদ দিয়ে বেড়াতে যাবার সময় আছে? তোরা যা ঘুরে আয়। আর শোন তাড়াতাড়ি আসবি। দুপুরে সকলে এক সাথে খাবো।
আমি মাথা নেড়ে মামীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সকলে মিলে বের হলাম ঘুরার উদ্দেশ্যে। নিশাদ দারুণ উল্লাসিত গ্রামের মেঠো পথ, বড় বড় গাছ পাখির কিচিরমিচির শব্দ ছোট ছোট পুকের ফুটে থাকা শাপলা ফুল। বিশাল সবুজ মাঠ সব কিছুই আমাদের মুগ্ধ করে চলেছে। নিশাদ নানান রকম প্রশ্ন করে চলেছে আর তার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে রিফাত আর ঝুমা। ওরা হয়তো আসলে আমাকে আর আজাদকে আলাদা ভাবে সময় কাটানোর ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।
আমি আজাদের দিকে তাকিয়ে আপনার ভালো লাগছে না তাই না?
আজাদ: আমি তো তোমাকে বলিনি আমার ভালো লাগছে না।
না মানে আপনার তো গ্রাম পছন্দ না।
আজাদ: এটা ঠিক না, গ্রামে আসা হয়না এই পর্যন্তই গ্রাম সকলেরই ভালো লাগে। তোমাকে শাড়িটায় বেশ মানিয়েছে।
আজাদের মুখ থেকে প্রশংসা শুনে কিছুটা লজ্জা পেলাম। মুখ ফুসকে বের হয়ে আসলো পাঞ্জাবীতে আপনাকেও বেশ লাগছে।
আজাদ: হয়তো লাগে।
গল্প করছি আর এগিয়ে চলছি। বেশ কিছুটা পথ হাঁটার পর কবরস্থানের সামনে চলে আসলাম। আমি কিছুটা সময়ের জন্য দাঁড়িয়ে পরলাম। আজাদ এসে প্রশ্ন করলো কি হলো দাঁড়ালে কেন?
এই কবরস্থানে আমার বাবা মায়ের কবর রয়েছে। তারা চিরতরে ঘুমিয়ে রয়েছে এখানে।
আজাদ রিফাতকে ডাক দিয়ে আমাকে আর ঝুমাকে বাহিরে থাকতে বলে নিশাদকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে পরলো। আমি আর ঝুমা কবরস্থানের বাহিরে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারা কবর জিয়ারত করার জন্য ভিতরে গিয়েছে। সত্যিই মানুষটা বাহিরে যতটা শক্ত ভিতরে ঠিক ততটাই নরম।
তিনজন বের হয়ে আসার পর আমরা আবার হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে নদীর ঘাটে চলে আসলাম। সেখানে সারিবদ্ধ ভাবে বহু নৌকা ঘাটে বাঁধা। নিশাদ বললো সে কখনো নৌকাউ উঠেনি।
ঝুমা: তুমি কি নৌকায় উঠবে খুব মজা।
নিশাদ: হ্যাঁ উঠবো।
সবাই মিলে একটা নৌকায় উঠলাম। আমাদের নৌকার কোন গন্তব্য নেই। আজাদ বললো আমাদের কিছুটা সময় ঘুরিয়ে নিয়ে আসুন। সবাই নৌকায় বসে রইলাম। নদীর বুকে নৌকা ভাসতে শুরু করলো। আমি আজাদের পাশে বসলাম। রিফাতের কোলে বসলো নিশাদ তার পাশেই ঝুমা। নৌকা ভেসে বেড়াচ্ছে মাঝে মাঝে ইঞ্জিন চালিত ইস্টিমার গুলো যখন দ্রুত গতিতে যাচ্ছে তখন নৌকা দোল খাচ্ছে। তাতে বেশ আনন্দ পাচ্ছে নিশাদ। সে আনন্দে মাঝে মাঝে মজা মজা বলে চিৎকার করে উঠছে। তা দেখে মাঝে মাঝেই আজাদ মুচকি হাসি দিচ্ছে সত্যিই মানুষটার হাসিতে অনেক মায়া অনেক সুন্দর্য রয়েছে। আমি মুগ্ধ নয়নে চেয়ে তা দেখছি। প্রায় ঘন্টা খানিক নৌকায় ঘুরে ঘাটে চলে আসি। নৌকা থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করি। দুপুর হয়ে আসছে।
সবাই মিলে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করি। ঝুমা রিফাত আর নিশাদ সামনে আমি আর আজাদ তাদের পিছু পিছু। আপনার হাসি কিন্তু খুব সুন্দর।
আজাদ: হয়তো।
হয়তো হ্যাঁ এখন থেকে সব সময় হাসি খুশি থাকবেন। বেশ লাগে আপনাকে হাসি মুখে।
আজাদ: একটু হাসি ফৃটিয়ে মুখে চেষ্টা করবো।
ইহু চেষ্টা করলে হবে না। হাসতে হবে সবাইকে হাসাতে হবে।
গল্প করতে করতে পুরো গ্রাম ঘুরে সকলে বাড়িতে চলে আসলো। দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই যার যার রুমে চলে আসলো রেস্ট নেবার জন্য। বিছানায় শুয়ে নিশাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নিশাদ এক সময় ঘুমিয়ে গেলো। সাথে আমার ও দু’চোখ বন্ধ হয়ে আসলো। বিকালে বজ্রপাতের শব্দে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠলাম। আজাদ এক পাশে শুয়ে ছিলো আমাকে এভাবে লাফিয়ে উঠতে দেখে প্রশ্ন করলো ভয় পেয়েছি কিনা।
হ্যাঁ বজ্রপাতের শব্দে আমার ভয় লাগে।
আজাদ: এতো বড় হয়েছো তাও ভয় পাও?
হুম ছোট বেলা থেকেই আমি এসব শব্দে ভয় পাই।
আজাদ: শব্দ করে হেসে দিলো, তার হাসির সাথে সাথে আবার ও বজ্রপাতের শব্দ হলো আমি ভয়ে দু’হাতে কান চেপে ধরলাম। আজাদ এবার বলে উঠলো তুমি কি সত্যিই খুব ভয় পাও? আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ।
আজাদ নিশাদেকে কোলে নিয়ে বিছানার এক পাশে রেখে আমার হাত শক্ত করে চেঁপে ধরলো।
আজাদ: ভয় পাবার কিছু নেই। আমি আছি তোমার পাশে।
সারা জীবন থাকবেনতো আমার পাশে?
আজাদ: যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন থাকবো।
তাতেই হবে আমরা কেউ চিরদিন বেঁচে থাকবো না।
বৃষ্টি বেড়েই চলছে, দরজার অপরপ্রান্ত থেকে ঝুমা নক করে বলতে থাকলো ভিতরে কি আসতে পারি?
ঝুমার কণ্ঠ শুনে আজাদ আমার হাত ছেড়ে দিলো। আয় ভিতরে আয়।
ঝুমা: ট্রে হাতে ভিতরে ঢুকে এই নাও এ বৃষ্টির দিনে চায়ের সাথে ঝুড়ি পিঠা খেতে বেশ মজা লাগবে।
আজাদ: ঝুমার দিকে তাকিয়ে তুমিও আমাদের সাথে বসে খাও।
ঝুমা: না না আমার অনেক কাজ আছে আপনারাই খেয়ে নিন।
তোকে বসতে বলছে। আর আমি জানি তোর কোন কাজ নেই। ঝুমা এভার বেশ বিপদেই পরে গেলো আমার কথা শুনে। আর কোন কথা না বলে আমাদের সাথেই বিছানায় বসে পরলো। এমন সময় বাহির থেকে রিফাতের কণ্ঠ শুনে তাকেও ভিতরে আসতে বললাম। সেও ভিতরে আসলে চারজন মিলে গল্প করতে করতে চা নাস্তা খেয়ে নিলাম। রাত হয়ে এসেছে অথচ বৃষ্টি থামার কোন নাম নেই। এদিকে বিদুৎ ও নেই।
ঝুমা: তোমরা বসো আমি যেয়ে দেখি আম্মুর রান্না হলো কিনা।
তুই বসে গল্প কর আমি যেয়ে দেখছি। বলেই সেখান থেকে উঠে রান্না ঘরে চলে আসলাম। মামীর সব রান্না হয়ে গিয়েছে। মামীর সাথে সব খাবার টেবিলে নিয়ে আসতে সহযোগীতা করলাম।
মামী: যা সবাইকে নিয়ে আয়, খেতে বসবি।
আমি রুমে এসে সবাইকে খাবার টেবিলে আসতে বললাম। ঝুমা আর রিফাত আজাদকে সঙে নিয়ে খাবার টেবিলে চলে আসলো। আমি নিশাদকে কোলে নিয়ে ওদের পিছু পিছু রওনা হলাম।
সবাই এক সাথে খেয়ে নিলাম। বৃষ্টি থামার কোন নামই নেই। রিফাত নিশাদ কে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। আমি আর আজাদ চলে আসলাম আমাদের রুমে। চা খাবেন?
আজাদ: হলে মন্দ হয়না। কিন্তু এ ঝড় বৃষ্টির ভিতর কষ্ট করার দরকার নেই।
আমি হাসি দিয়ে এ আর এমন কি কষ্ট। আপনি বসে রেস্ট নিন আমি বানিয়ে নিয়ে আসছি।
রুম থেকে বের হয়ে রান্না ঘরে চলে আসলাম। পানি গরম দিতেই মামী চলে আসলো রান্না ঘরে।
মামী: তুই আসলি কেন? আমাকে বললেইতো হতো।
তাতে কি হয়েছে বসো গল্প করি। দু’জন গল্প করতে করতে চায়ের পানি গরম হয়ে গেলো। আমি চা বানিয়ে মামীর হাতে দিয়ে নিয়ে যেতে বললাম আর দুই কাপ নিয়ে আমি নিজের রুমে চলে আসলাম। চায়ের কাপ আজাদের দিকে এগিয়ে দিলাম।
আজাদ: মুখে হাসি ফুটিয়ে ধন্যবাদ।
কিসের ধন্যবাদ? এটা আমার দায়িত্ব।
আজাদ কিছু না বলে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আমার দিকে চেয়ে রইলো। আমিও আজাদের দিকে মনোমুগ্ধের মত চেয়ে রইলাম। মানুষটাকে যতই দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। ততই তাকে ভালোবেসে ফেলছি আচ্ছা মানুষটার মনের মাঝে কি কখনো আমার জায়গা হবে না? সে কি সব কিছুর শেষে আমাকে ভালোবাসতে পারে না?
#চলবে…