চৌধুরি_বাড়ি-১ম পর্ব

0
2100

রাত গভীর থেকে গভীর হচ্ছে, এদিকে আকাশে একটু পর পর মেঘ গর্জে উঠছে। হাসপাতালের নিজের টেবিলে একাই বসে আছি। আকাশের অবস্থা ভালো না দেখে হাসপাতাল থেকেও বের হচ্ছি না। আজ চারদিন হলো এই হাসপাতলে জয়েন করেছি। আমার স্ত্রী সোহা এখনো এখানে আসেনি। সে আরও দুই দিন পর আসবে তাই বাড়ি যাবার তেমন জলদিও নেই। হাসপাতালের সব রোগীই কমবেশী এখন ঘুমাচ্ছে। দুই একজন নার্স ছাড়া আর তেমন কেউ জেগে নেই। সব ডাক্তার রাও অনেক আগেই চলে গিয়েছে। হাসপাতালে একমাত্র ডাক্তার হিসেবে আমিই রয়ে গিয়েছি। ঘড়ির কাটার টংটং শব্দে সেদিকে তাকিয়ে দেখি রাত বারোটা বেজে গেছে। মেঘের গর্জন বেড়েই চলছে, আজ রাতে আর বাড়িতে ফেরা হবে না। বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছি। এখন বের হলে কোন রিক্সাও পাওয়া যাবে না।

এমন সময় টেবিলের উপর থাকা টেলিফোনটা বেজে উঠলো। এতো রাতে কে ফোন করতে পারে ভাবতে ভাবতে টেলিফোনের রিসিভারটা হাতে তুলে নিলাম। অপর প্রান্ত থেকে একটা মেয়েলি কণ্ঠ স্বর বলে উঠলো। আপনি কি ডাক্তার বলছিলেন।

হাসপাতালে ফোন দিয়ে কেউ যদি প্রশ্ন করে আপনি কি ডাক্তার তখন কতটা বিরক্ত লাগতে পারে তা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। তাও যদি রাত বারোটার পর হয়। তবুও নিজের রাগকে কন্ট্রোল করে বললাম জ্বি আমি ডাক্তার সিয়াম বলছি বলুন আপনাকে কি ভাবে সাহায্য করতে পারি?

“দেখুন আমার মা খুবি অসুস্থ আপনাকে একটু শান্তিপুর আসতে হবে ইমার্জেন্সি ভাবে।”

দেখুন রাত অনেক হয়েছে এতো রাতে কি করে বের হবো? আর আকাশের অবস্থাও ভালো নয়। যদি রোগীর সিরিয়াস অবস্থা না হয় তবে আমি কাল সকালে আসি। আর আমি হাসপাতলে নতুন জয়েন করেছি, ঠিকমত এখনো কোন জায়গাও চিনি না।

“না না আপনাকে এখুনি আসতে হবে নয়তো অনেক বড় সমস্যা হয়ে যাবে।”

আচ্ছা ঠিক আছে আমি দেখছি, আপনি ঠিকমত ঠিকানাটা বলুন আমি আসার চেষ্টা করবো। এেপর ঠিকানাটা নোট করে নিয়ে ফোনটা রেখে দিলাম। আমি ডাক্তার আর রোগীর কাছে ছুটে যাওয়াই আমার প্রধান ধর্ম। বাবা চেয়েছিলেন আমি ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবো। বাবা মারা গিয়েছেন। তার স্বপ্ন সফল করার জন্যই আমাকে ডাক্তার হওয়া। তাই বাবার স্বপ্ন বিফলে যেতে দিতে পারবো না। ভেবেই চেম্বার ছেড়ে বের হলাম।

বের হতেই একজন নার্সের সাথে দেখা হলো তাকে প্রশ্ন কাছে জানতে চাইলাম শান্তিপুর গ্রামটা কোথায়? সে জানালো প্রায় ঘন্টা খানিক লাগবে রিক্সা বা ভ্যানে যেতে। কিন্তু কেন?

আমি তাকে বললাম ঐখান থেকে একটা ফোন এসেছে রোগীর অবস্থা সিরিয়াস।

নার্স, কিন্তু স্যার রাত অনেক হয়েছে আর বৃষ্টিও হচ্ছে গুড়িগুড়ি, যে কোন সময় মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হতে পারে। এসময় কোন কিছু পাওয়া সম্ভব বলে আমার মনে হয় না।

আমি নার্সের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিচে সিঁড়ি ধরে নিচে নামতে শুরু করলাম। যদি ভাগ্য ভালো হয় তবে কোন না কোন একটা ব্যবস্থা ঠিকই হবে।

হাসপাতালের বাহিরে আসতেই চোখে পড়লো একটা রিক্সা দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি তাকে বললাম যাবেন শান্তিপুর?

সে মাথা নেড়ে রিক্সায় উঠতে বললো। আমি আর কথা না বাড়িয়ে রিক্সায় উঠে বসলাম। এই ঝড় বৃষ্টির রাতে রিক্সা পাবো ভাবতেই পারিনি। লোকটার সমস্ত শরীর চাদর দিয়ে প্যাঁচানো। হয়তো বাতাসে আর গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে ঠাণ্ডা লাগছে তাই এভাবে চাদর প্যাঁচিয়ে রেখেছে।

চারিদিকে শুনসান নীরব, শুধু বাতাসে গাছের পাতা থেকে বৃষ্টি ঝড়ে পরার শব্দ হচ্ছে। বাতাসে কিছুটা শীত শীতও লাগছে। কিছুটা ভয় ভয়ও লাগছে। মাঝে মাঝেই খুব চারিদিক আলো করে বিজলি চমকাচ্ছে। কিছুটা ভয় নিয়েই বসে রয়েছি রিক্সায়।

এক সময় রিক্সা এসে একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে আমাকে বললো নেমে যান চলে এসেছি।
আমি রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া দেবার জন্য মানি ব্যাগ বের করতে করতে লোকটা রিক্সা চালিয়ে চলে যেতে শুরু করলো। আমি পেছন থেকে বেশ কয়েকবার ডাকার পরেও সে রিক্সা না থামিয়ে চলে গেলো। আমি অবাক হয়ে কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে রইলাম।

বাড়ির গেটে বড় করেই লেখা রয়েছে চৌধুরি বাড়ি, তারমানে লোকটা আমাকে সঠিক জায়গাতেই নিয়ে এসেছে। কিন্তু আমিতো লোকটাকে বলিনি আমি এ বাড়িতে আসবো। তবে লোকটা কি করে জানলো? মনের ভিতর অনেক প্রশ্ন জাগলেও সব কিছু দূরে সরিয়ে দিলাম। আমাকে রোগী দেখতে হবে। গেটে টোকা দিতেই এক বৃদ্ধ গেট খুলে দিলো। আমি কিছু বলার আগেই সে বৃদ্ধ বলে উঠলো ভিতরে চলে যান দরজা খোলায় রয়েছে।

তারমানে বৃদ্ধ আগে থেকেই জানতো আমি আসবো। আমি বাড়ির ভিতর দিয়ে সোজা রুমের ভিতর ঢুকে পরলাম। ভিতরে ঢুকতেই একজন আমাকে বললো মা উপরে রয়েছে আমার সাথে আসুন।

আমি তার কথা মত সিঁড়ি ধরে উপরে উঠতে লাগলাম। বাড়িটা বেশ পুরনো, তবে বেশ পরিপাটি করে সাজানো। দু’তলায় উঠে রোগীর রুমে ঢুকলাম। পঁয়ষট্টি থেকে সত্তর বছর বয়সী বৃদ্ধ মহিলাকে দেখিয়ে বললো আমার মা। উনিই আপনার রোগী। পাশে আরও দু’জন মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। রোগীর যে তিন কন্যা সকলেই বেশ সুন্দরি।

আমি তাকে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলাম। তেমন কোন বড় রকমের সমস্যা হয়নি। উনি নিশ্চই ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করেন না?

একজন বলে উঠলো, আজ সারাদিন তেমন কিছুই খায়নি।

সমস্যা নেই আমি কিছু ঔষধ লেখে দিচ্ছি এগুলা সকালে নিয়ে এসে খায়িয়ে দিবেন। দেখবেন সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। মুখেও রুচি ফিরে আসবে। আচ্ছা আপনাদের বাড়িতে কোন পুরুষ মানুষ দেখতে পাচ্ছি না।

বড় মেয়েটা বলে উঠলো। আমাদের বাড়িতে শুধু দারোয়ান ছাড়া আর কোন পুরুষ মানুষ নেই। বাবা মারা গিয়েছেন। আমি, রুম্পা, ও রূপা, আর সবার ছোট জনের দিকে তাকিয়ে ওর নাম রূপালি।

আচ্ছা ঠিক আছে আজ তাহলে আমি আসছি।

রুম্পা: এতো রাতে যেতে পারবেন না, কাল সকালেই না হয় চলে যাবেন।

না না কোন সমস্যা নেই আমি যেতে পারবো।

রুম্পা: বেশতো রূপালি উনাকে এগিয়ে দিয়ে আয়।

থাক তার আর দরকার হবে না আমি যেতে পারবো। কথাটা বলে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে শুরু করলাম। এক সময় বাড়ির গেটের সামনে আসতেই দারোয়ান গেট খুলে দিলো। আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে পরলাম।

বৃষ্টি কিছুটা বেড়ে গিয়েছে, আমি এদিক সেদিক তাকালাম কোথাও কোন কিছু দেখতে পাচ্ছি না। এক’পা দু’পা করে হাঁটছি আর মনে মনে ভাবছি বড় ভুল করে ফেলেছি। রাতটা চৌধুরি বাড়িতে কাটালেই ভালো হতো। হঠাৎ করেই অন্ধকারের ভিতর বিজলি চমকে উঠলো, আর আমার সামনে রিক্সা নিয়ে সেই চালককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ চমকে উঠলাম।

সেই সাথে ভয়ে আমার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো। তারপর রিক্সায় উঠতে উঠতে বললাম আপনি ভাড়া না নিয়ে চলে গেলেন কেন?

রিক্সা চালক: আমি জানি আপনি আবার ফিরে যাবেন তাই তখন ভাড়া নেই নি।

আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম আপনি কি করে জানেন?

রিক্সা চালক: কিছুটা রহস্য জনক হাসি দিয়ে আপনিতো আর এ বাড়িতে থাকার জন্য আসেননি।

আমি আর কিছু না বলে চুপ করে বসে রইলাম। একটু পর খুব জোড়ে বৃষ্টি শুরু হলো। সেই সাথে একটু পর পর বিজলী চমকে চলছে। বাতাসে গাছের শোঁ শোঁ শব্দে এক প্রকার ভয় লাগছে। বার বার মনে হচ্ছে পেছনে পেছনে কেউ ছুটে আসছে। রাত অনেক হয়েছে বুঝতে পারছি। তবে কয়টা বাজতে পারে তা বুঝতে পারছি না। আমি এদিক সেদিক তাকাচ্ছি হঠাৎ বিজলি চমকে উঠাতে আমি স্পষ্ট কিছুটা দূরে শ্যাওড়া গাছের নিচে সাদা কাপড় পরিহিত কাউকে শুয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠলাম।

রিক্সা চালককে বললাম রিক্সা থামান ঐখানে কেউ পরে রয়েছে।

রিক্সা চালক: কেউ নেই ওখানে আপনি ভুল দেখেছেন। চুপ করে বসে থাকেন।

আবারও বিজলি চমকে উঠতে আমি দেখতে পেলাম সত্যিই সেখানে কেউ পরে রয়েছে। আমি জোড় করে রিক্সা থামিয়ে লাফ দিয়ে নিচে নেমে পরলাম। দৌঁড়ে সেদিকে যেতে শুরু করলাম। যতই আমি তার কাছে যাচ্ছি ঠিক ততই তার মুখের উপর থেকে সাদা কাপড়টা সরে যেতে শুরু করলো। একটা সময় যখন আমি তার কাছে গেলাম তখন খুব জোড়ে গর্জন করে বিজলি চমকে উঠলো।

সাথে সাথেই আমি দেখতে পেলাম কিছু সময় আগে চৌধুরি বাড়িতে যে বৃদ্ধাকে দেখার জন্য গিয়েছিলাম তার লাশটা পরে রয়েছে। ভয়ে আমার সমস্ত শরীর হিম শীতল হয়ে আসছিলো। এটা কি করে সম্ভব। আর কে এখানে উনার লাশ নিয়ে এসে ফেলে যাবে। আমি বুঝতে পারলাম আমার সাথে ভয়ংকর খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে।

আমি ভয়ে চিৎকার করতে করতে সেখান থেকে দৌঁড়ে রিক্সার কাছে আসলাম। কিন্তু যেখানে রিক্সা থেকে নেমে ছিলাম সেখানে আর রিক্সা পেলাম না। আমি দৌঁড়াতে শুরু করলাম। এতো বাতাস হচ্ছিলো যে দৌঁড়াতেও খুব সমস্যা হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো বাতাস বার বার আমাকে পেছনে নিয়ে যাচ্ছে। শরীর থেকে জামাটা খুলে যাবে বাতাসে। চারিদিকে এতোই অন্ধকার যে দু’চোখে কিছুই দেখতে পারছিলাম না।

ভয়ে আমার সমস্ত শরীর অবস হয়ে আসছিলো। হঠাৎ অন্ধকারে কোন কিছুর সাথে পা লেগে আমি মাটিতে লুটিয়ে পরলাম। আমি চিৎকার করে পূর্ণরায় উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই চারিদিক আলো করে বিজলি চমকে উঠতেই দেখতে পেলাম আমি একজন মৃত মানুষের দেহের উপর পরে রয়েছি। আর যার দেহের উপর আমি পরে রয়েছি সে মানুষটাই কিছু সময় আগে আমাকে চৌধুরি বাড়ির গেট খুলে দিয়েছিলো। মানে সেই বৃদ্ধ দারোয়ানটা।

আমি চিৎকার করে উঠে দাঁড়িয়ে আবারো দৌঁড়াতে শুরু করলাম। কোথায় যাচ্ছি আমার জানা নেই। শুধু বুঝতে পারছি পেছন থেকে আমাকে তাড়া করে দৌঁড়ে আসছে কেউ। যার হাত থেকে বাঁচার জন্য আমাকে নিরাপদ কোথাও যেতে হবে। আমাকে বাঁচতে যে কোন উপায়ে আমাকে বাঁচতে হবে।

#চলবে…

#চৌধুরি_বাড়ি-১ম পর্ব
#লেখনীতে_শাহরিয়ার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here