রংধনু-৫ম পর্ব
#লেখনীতে_শাহরিয়ার
রাতে সবাই এক সাথে খেতে বসেছি। এমন সময় মা আজাদের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো। যে তোরা কাল সকালেই প্রিয়ার গ্রামের বাড়ির পথে রওনা হয়ে যা।
আজাদ: আমার অনেক কাজ আছে অফিসে আমি যেতে পারবো না।
মা: অফিসের কাজ দুই দিন পরে করলেও কোন সমস্যা হবে না। প্রিয়ার মামার শরীর খুব একটা ভালো না। আমি উনাকে কথা দিয়েছি তোরা কাল সকালেই রওনা হয়ে যাবি।
আজাদ: হুট করে কথা দিয়ে দিলেই হলো? সব দিকেইতো দেখতে হবে তাই না মা?
মা: আমি সব কিছু বিবেচনা করেই বলেছি। তোর ও একটু রিফ্রেশমেন্ট এর প্রয়োজন রয়েছে। গ্রামে গেলে আশা করি তোর ভালো লাগবে।
আজাদ আর কিছু বললো না। চুপচাপ খেয়ে নিশাদকে নিয়ে উপরে উঠে গেলো। আমি আরিশা আর মা খাওয়া শেষ করে সব কিছু গুছিয়ে বেশ কিছুটা সময় গল্প করে কাটালাম। তারপর মা বললো দুই মগ কফি বানিয়ে উপরে নিয়ে যাবার জন্য। আজাদের কফি খুব পছন্দ। আমি মাকে বললাম আমি কফি বানাতে পারি না।
আরিশা: চলো ভাবী আমি তোমাকে কফি বানাতে সাহায্য করছি।
আমি আরিশাকে সাথে নিয়ে কিচেনে চলে আসলাম। গল্প করতে করতে দু’জন মিলে কফি বানালাম। কফি নিয়ে দু’তলায় আসতেই দেখি আজাদ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর নিশাদ বিছানার মাঝে ঘুমিয়ে রয়েছে। কফির মগ হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে যেতেই আজাদ সিগারেট ফেলে দিলো। আমি হাসি দিয়ে কফির মগ বাড়িয়ে দিলাম। আজাদের চোখের দিকে তাকিয়ে সিগারেট তো ফেলে দিতে বলিনি।
আজাদ: আমার জন্য কারো অসুবিদা হোক তা আমি চাই না। আমি চাই সবাই ভালো থাকুক সুখে থাকুক।
আর আপনি নিজে ভালো থাকতে চান না?
আজাদ: আমিতো বেশ ভালো আছি।
আপনি কি জানেন আপনি যাদের সুখ চান ভালো চান, সেই মানুষ গুলো আপনার ভালো থাকায় ভালো থাকবে। কিংবা আপনার ভালো থাকাটা তাদের কাম্য।
আজাদ: হুম জানি তাই আমি ভালো আছি। কফি ভালো হয়েছে।
আমি একটু হেসে আসলে আমি কফি বানাতে পারি না। আরিশা সাহায্য করলো আমি বানালাম। আপনার অনেক দায়িত্ব। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নির্মম বাস্তবতা আমরা কেউ চিরকাল বেঁচে থাকবো না। কিন্তু সময় থেমে থাকবে না। আমি জানি শুভ্রা আপুকে আপনি অনেক ভালোবাসতেন আর আপুও আপনাকে অনেক ভালোবাসতো। তার স্মৃতি আপনি কোন দিনও ভুলতে পারবেন না। আর ভুলাও সম্ভব নয়। আর আমি চাই ও না আপনি আপুকে কখনো ভুলে যান।
আজাদ: তোমাকে শুভ্রার কথা কে বলেছে আরিশা?
হুম আরিশা বলেছে। তা নহলে কি করে আমি জানতাম এই চুপচাপ থাকা মানুষটা বুকের ভিতর কত বড় একটা পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। যে মানুষটার হাসিতে পুরো বাড়ি হাসতো সেই মানুষটা হাসতে ভুলে গেছে। তার সাথে পুরো বাড়িটাও নিরব হয়ে গিয়েছে।
আজাদ: কখনো কখনো পরিস্থিতি মানুষকে পাথর হতে বাধ্য করে। পরিস্থিতি মানুষকে হাসতে ভুলিয়ে দেয়। স্মরণ করিয়ে দেয় তাকে বেঁচে থাকার তাগিত শুধু প্রিয়জনদের প্রয়োজনেই।
আপনি এমন করে কেন ভাবছেন? যাদের প্রয়োজনে আপনি বেঁচে আছেন বলে মনে করছেন, তারা সকলেই আপনার ভালো চায় সুস্থতা চায়। তারা আপনাকে প্রয়োজন নয় প্রিয়জনই মনে করে। আর আপনি মন খারাপ করে থাকলে কিংবা নিজের উপর অবহেলা করলে কি শুভ্রা আপু ওপার থেকে দেখে খুব খুশি হবে?
রাত বেড়ে চলছে চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসছে তবুও আজ কথারা জেনো শেষ হতে চাচ্ছে না। মানুষটার ভিতরে যত কষ্ট, যত বেদনা লুকায়িত রয়েছে। খুব ইচ্ছে করছে সব নিংড়ে বের করে নিয়ে আসি। সব দুঃখ গুলো ভুলিয়ে শুধু ভালো থাকতে শিখুক মানুষটা। যেমন করে তার চারপাশের মানুষ গুলোকে ভালো রেখেছে।
আজাদ: অনেক রাত হয়েছে যেয়ে শুয়ে পরো।
আপনি ঘুমাবেন না?
আজাদ: আমি পরে আসছি তুমি যেয়ে ঘুমাও।
আমি আর কথা না বলে ভিতরে চলে আসলাম। আমি জানি এই মুহুর্তে শত চেষ্টাতেও তাকে আর ঘরে নিতে পারবো না। মানুষটা যতটা ভালো ঠিক ততটাই ঘাঢ় ত্যাড়া। বিছানার শেষ প্রান্তে শুয়ে নিশাদকে বুকের মাঝে নিয়ে আজাদের দিকে তাকালাম সে সিগারেট জ্বালিয়ে আকাশের দিকে ধোয়া উড়িয়ে চলছে। এসব দেখতে দেখতে একটা সময় ঘুমিয়ে পরলাম।
সকালের দিকে চমকে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠলাম। আজাদ আমাকে ডাকতে ডাকতে এক সময় আমার হাত ধরে টানতে থাকে। হালকা ঘুম ঘুম অবস্থায় আমি কিছুটা ভয় পেয়ে যাই। তখন আমার মনের ভিতর অন্য কিছু হচ্ছিল। কিন্তু যখন পুরোপুরি চোখ মেলে তাকালাম। তখন বুঝতে পারলাম সকাল হয়ে গিয়েছে। আর আজাদ বলতে শুরু করলো।
আজাদ: তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে নাও। আর নিশাদকেও তৈরি করে নাও। আমরা নাস্তা করেই বের হয়ে যাবো। নয়তো যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে। বলেই বিছানার পাশে একটা কালো রঙের শাড়ি রাখলো।
আমার কিছুই মনে ছিলো না। তাই আজাদের দিকে তাকিয়ে বললাম কোথায় যাবো আমরা?
আজাদ: কোথায় যাবো মানে? তোমার গ্রামে যাবো, মানে তোমার মামার বাড়িতে।
আজাদের কথায় আমার মনে পরলো মা গতরাতে আমাদের গ্রামে যেতে বলেছে। আমি বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠলাম, আজাদ রুম ছেড়ে বের হয়ে গেলো। আমি নিশাদকে ডেকে তুলে ফ্রেশ করিয়ে জামা কাপড় পরিয়ে দিয়ে ডাইনিং এ যেতে বললাম। আমি বিছানা থেকে শাড়িটা হাতে নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে পরলাম। নিজের গায়ে জড়িয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ডাইনিং এর সামনে এসে দাঁড়ালাম। আজ নিজেকেই নিজের বলতে ইচ্ছে করছে তুমি অপরূপা তুমি অনন্যা। মানুষটার পছন্দের প্রশংসা করতেই হয়। আমি আরও কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করলাম। হালকা সাজুগুজু করলাম। চোখে হালকা কাজল, ঠোঁটে হালকা লিপিস্টিক, কপালে ছোট কাজলের কালো ফোঁটা নিয়ে বার বার আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগলাম। মনে মনে নিজেই বলে উঠলাম প্রিয়া এতো বার দেখিস না তোর নজরই লেগে যাবো। একা একা হেসে এক সময় রুম থেকে বের হয়ে নিচে ডাইনিং এ নেমে আসলাম।
সবাই সেখানে বসে রয়েছে, আমি নেমে আসতেই আরিশা বলে উঠলো ওয়াও! ভাবী আজতো তোমাকে চেনা যাচ্ছে না।
আমি হেসে তাহলে এটা খুলে আসি, আমি অচেনা হতে পারবো না।
আরিশা: আরে না না তা কেন হবে, তুমিতো আমাদের চেনা। আসলে সত্যি তোমাকে খুব সুন্দরি দেখাচ্ছে।
মা: সত্যিই মা তোকে সুন্দর লাগছে।
আজাদ মাথা তুলে আমার দিকে চেয়ে রয়েছে আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে। আমি মাথাটা নিচু করে নিয়ে নাস্তা করতে শুরু করলাম।
নাস্তা শেষ হতেই আজাদ বললো তোমরা ব্যাগ গুছিয়ে নাও আমি একটু বাহির থেকে আসছি।
আমি নিশাদ আর আরিশাকে সাথে নিয়ে উপরে উঠে তিনজনের জামা কাপড় ব্যাগে গুছাতে শুরু করলাম।
আরিশা: বুঝলে ভাবী ভাইয়ার উপর তোমার প্রভাব যাদুর মত কাজ করছে।
কাপড় গুছাতে গুছাতে আমি আরিশার দিকে তাকিয়ে মানে কি? কিসের যাদু?
আরিশা: আরে মায়ার যাদু, ভালোবাসার যাদু। দেখছো না ভাইয়া এখন তোমাকে নিয়ে গ্রামে বেড়াতে যাবে। ভাইয়াতো কোথাও যেতে চায় না। তোমার কল্যানে একটু ঘুরতে যাবার সুযোগ হয়েছে। কথাটা বলেই আরিশা হেসে চলেছে। আমিও ওর হাসির সাথে তাল মিলে কিছুটা সময় হেসে নিয়ে বললাম। আরিশা তুমিও আমাদের সাথে চলো।
আরিশা: না ভাবী এখন না, যাবো যাবার অনেক সময় রয়েছে। এখন তোমরা দু’জন কাছাকাছি থাকো। একে অপরের অনেক বেশী ঘনিষ্ঠ হও। তোমাদের মাঝে ভালোবাসার সৃষ্টিহোক। এটাই আমি চাই।
আমি কিছু না বলে শুধু চেয়ে রইলাম আরিশার দিকে। আচ্ছা ওরা আমার কাছে যা প্রতাশা করে আমি কি তা দিতে পারবো? না ব্যর্থ হয়ে ওদের চোখে ছোট হয়েই বাকিটা জীবন পার করতে হবে? এসব ভাবতে ভাবতে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। দরজায় নক পরতেই আরিশা উঠে দাঁড়ালো। আমি যেয়ে দরজা খুলে দিতেই আজাদ ঘরের ভিতর ঢুকলো।
আরিশা: তোমরা আসো আমি নিশাদকে নিয়ে নিচে অপেক্ষা করছি। বলেই নিশাদকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
আজাদের সাথে আমিও নিচে নেমে এসে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হলাম। আজাদ ড্রাইভারকে বললো সে নিজেই গাড়ি চালাবে। আমাকে আর নিশাদকে সামনে বসতে বললো। দু’জন উঠে বসলাম গাড়িতে। আজাদ বাড়ির ভিতর থেকে গাড়ি বের করতে করতে বললো সিট বেল্ট বাধার জন্য। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম আমি বাধতে পারি না।
সে এক সাইডে গাড়ি পার্কিং করে বেল্ট ধরে লাগিয়ে দিতে লাগলো। আমার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো কোমরে তার হাতের স্পর্শে। সে বেল্ট লাগাতে লাগাতে বললো এভাবে বেল্ট লাগাতে হয়। এরপর থেকে নিজে লাগাবে। আমি মাথা নেড়ে শুধু হ্যাঁ সূচক বুঝালাম।
নিশাদ: আম্মু তুমি কিছু পারো না কেন?
আমি নিশাদের দিকে তাকিয়ে হেসে দিয়ে বললাম তোমার বাবা শিখিয়ে দিবে বলে। আমার কথা শুনে নিশাদ হেসে দিলো গাড়ি এগিয়ে চলতে শুরু করলো আর শহরের উচু উচু বিল্ডিং গুলো পেছনে পরতে শুরু করলো। জানালা খোলা থাকায় বাতাস এসে আমার খোলা চুলে লাগছে আর চুল গুলো বাতাসে এলোমেলো হয়ে উড়ছে। নিশাদ কোলে ঘুমিয়ে পরেছে। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে রেখেছি। আজাদ এক মনে গাড়ি চালাচ্ছে আর আমি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছি তার দিকে। মনে হচ্ছে মানুষটা আমার কতদিনের চেনা কতই না আপনজন।
#চলবে…