রংধনু-৯ম পর্ব
#লেখনীতে_শাহরিয়ার
আজাদের কথায় হাসতে হাসতে ঝুমা বলে উঠলো কেন আমার আপু কি বুড়ি হয়ে গেছে? বরং দিন দিন আমার আপু আরও রূপসী হচ্ছে। তাহলে তার বোন হয়ে আমি কি করে বুড়ি হবো?
আজাদ: হুম এটাওতো ঠিক।
ঝুমা: হুম হয়েছে এবার চলুন নাস্তা খাবেন।
তিনজন চলে আসলাম নাস্তা খেতে। রিফাত নিশাদকে নিয়ে আগে থেকেই নাস্তার টেবিলে বসে ছিলো। একটু পরে মামাও চলে আসলো। সবাই মিলে নাস্তা খেতে বসলাম। নাস্তা শেষে রিফাত বললো ভাইয়া চলুন আজ দূরে কোথাও ঘুরতে যাই।
আজাদ: ভালো ঘুরার মত হলে যেতে পারি।
রিফাত: আপনার অবশ্যই পছন্দ হবে।
আজাদ: বেশতো তাহলে যাওয়া যায়।
নাস্তার পর্ব শেষ করে সকলে যার যার রুমে চলে আসলাম। ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ পর সকলে এক সাথে ঘুরতে বের হলাম। আজাদ গাড়ি চালাচ্ছে আমি পাশের সিটে বসে আছি। পেছনে ঝুমা, রিফাত নিশাদ বসে রয়েছে। গাড়ি এগিয়ে চলছে রিফাতের বলা পথ ধরে। প্রায় এক ঘন্টার ও বেশী সময় পর আমরা বিশাল এক সবুজ মাঠের সামনে এসে দাঁড়ালাম। মাঠের একপাশে সবুজ ধান ক্ষেত আর একপাশে বহমান নদী। গাড়ি থেকে নেমে সকলে মাঠ দিয়ে হেঁটে চলছি। ওরা তিনজন আগে আগে আমি আর আজাদ ওদের পিছু পিছু। আমি শক্ত করে আজাদের হাত ধরে রেখেছি। দু’জন দু’জনের দিকে তাকাচ্ছি মাঝে মাঝে চোখাচোখি হচ্ছে, হাসছি লজ্জা পাচ্ছি চোখ সরিয়ে নিচ্ছি। এমনি করেই সামনের দিকে এগিয়ে চলছি সবাই।
হাঁটতে হাঁটতে এক পর্যায় বুঝতে পারলাম। আমরা বেশ উঁচুতে উঠে এসেছি। মানে মাঠটা পাহাড়ের মত খাড়া। অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে চারিদিকের মনোরম দৃশ্য দেখে চলেছি। একটা পর্যায় যেয়ে দেখা গেলো যে বয়ে চলা নদীটা নিচে দেখে এসেছি। তার শুরু হয়েছে পাহাড়ের উপর থেকে। এটাকে ঠিক পাহাড় বলা যায় কিনা আমি জানি না তবে বেশ উঁচু। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ সেই সাথে শীতল বাতাস মুহুর্তে চোখ মন প্রাণ জুড়িয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট্য।
উপরে উঠতে উঠতে সকলে বেশ খানিকটা ক্লান্ত হয়ে পরলাম। প্রথমে সকলে এক সাথে মাঠে বসলাম। তারপর একে একে সকলে গা ছেড়ে সেখানে শুয়ে পড়তে লাগলো। হঠাৎ করেই আজাদ ঘাসের উপর শুয়ে পরে। আমাকে টান দিয়ে মাথাটা তার বুকের উপর নিয়ে নিলো।
আমি কিছুটা হকচকিয়ে কি করছেন? ওরা কি মনে করবে?
আজাদ: ফিসফিসিয়ে ওরা কিছুই মনে করবে না। আর মনে করার মত কিছুই নেই। আমি কি অন্য মেয়ের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছি যে শালা শালি দেখে যেয়ে তার বোনের কাছে বিচার দিবে। বলেই ঠোঁটটা আমার ঠোঁটের দিকে এগিয়ে দিলো।
আমি কিছুটা সরে এসে আপনি খুব দুষ্টমি করছেন বুঝছেন। সব কিছু একটু রয়ে সয়ে করতে হয়। তাছাড়া ছেলে রয়েছে ওদের সাথে এটা ভুলে গেলেতো চলবে না।
আজাদ: খুব শক্ত করে চাপ দিয়ে ধরে ওহ তাই বুঝি তা আমি কি এমন অন্যায় করলাম? যদি অন্যায় হয়ে থাকে তাহলে ছেড়ে দেই।
আমি আজাদের দিকে ঘুরতেই সমস্ত খোলা চুল আজাদের মুখের উপর পরলো। আমি ওর বুকের দুই সাইডে ভর দিয়ে মুখের উপর থেকে চুল সরিয়ে নিতে নিতে আমি কি তা বলেছি আপনাকে? ওদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওরা অন্যদিকে সবুজ অরণ্য দেখায় ব্যস্ত। আজাদের দিকে তাকিয়েই চোখ বন্ধ করে আজাদের ঠোঁটের সাথে নিজের ঠোঁটটা চেপে ধরলাম। আজাদ দু’হাতে আমাকে আরও শক্ত করে চেপে ধরলো।
বেশ খানিকটা সময় পর সমস্ত শরীর শীতল বাতাসে ঠান্ডা হয়ে এলো।
রিফাত: ভাইয়া কেমন লাগলো এই জায়গাটা?
আজাদ: হাসি দিয়ে খুবি সুন্দর। অনেক বছর মনে থাকবে এই জায়গার কথা। সত্যিই এতো সুন্দর সুন্দর জায়গা রয়েছে এদেশে। অথচ আমরা অনেকেই জানি না।
রিফাত: হ্যাঁ ভাইয়া আমার ভীষণ পছন্দের এই জায়গাটা। আর যদি সত্যিই এই জায়গাটা অনেক বছর মনে রাখতে চান তবে আমি মনে করি। প্রতি বছর বর্ষার মৌসুমে অনন্ত একবার হলেও আপনার এখানে ঘুরতে আসা দরকার।
আজাদ: তাতো বলতে পারছি না প্রতি বছর আসতে পারবো কিনা তবে কথা দিচ্ছি সময় পেলে আবার আসবো।
গল্প করতে করতে সবাই আবার নিচের দিকে গাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলাম। নিশাদ আমার কোলে এসে উঠে বসলো। আমি নিশাদের কপালে চুমু দিতেই নিশাদ বলে উঠলো। মা মা নদীতে গোসল করা যায় না?
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম যায়তো। কিন্তু তার জন্য সাঁতার জানা লাগে। তুমি কি সাঁতার জানো?
নিশাদ: না আমিতো পারি না। সাঁতার কাটা কিভাবে শিখবো?
আচ্ছা আমি তোমার রিফাত মামাকে বলে দিবো বাড়িতে যেয়ে তোমাকে ছোট পুকুরে সাঁতার কাটা শিখাবে কেমন।
নিশাদ খুশি হয়ে আমার কপালে চুমু এঁটে দিয়ে মাথা নেড়ে ঠিক আছে বুঝালো। সকলে মিলে নেমে গাড়িতে উঠে বসলাম। আজাদ গাড়ি স্ট্রার্ট দিয়ে সব কয়টা গ্লাস নামিয়ে গাড়ি চালাতে শুরু করলো। চারিদিক থেকে বাতাস এসে আমার খোলা চুল গুলো এলেমেলো ভাবে উড়তে শুরু করলো। বিষয়টা আজাদের বেশ ভালো লাগছে এটা বুঝতে আমার একটুও দেরী হলো না। সে গাড়ি চালাচ্ছে আর মাঝে মাঝেই আমার দিকে ঘুরে তাকাচ্ছে।
ঘুরতে ঘুরতে একটা পর্যায় সকলে শহরে চলে আসলাম। আজাদ একটা দোকানের সামনে গাড়ি পার্কিং করে সকলের জন্য আইসক্রিম কিনে নিলো। সকলে গাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খেতে শুরু করলাম। সূর্য তখন ঠিক মাথার উপরে অবস্থান করছে। আজাদ বললো হালকা গরমে আইসক্রিম খাবার মজাই আলাদা। ঝুমা আর রিফাতও উনার সাথে একমত জানালো। আইসক্রিম শেষ করে আবার গাড়িতে উঠে বসলাম।
রাতের খাওয়া শেষ করে আজাদ মামা মামীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো কাল সকালে আমরা ঢাকা চলে যাবো।
মামা: সে কি আমাদের এখানে কি তোমাদের ভালো লাগছে না?
আজাদ: না না মামা গ্রাম খুবি সুন্দর। আর ঘুরতেও আমাদের ভীষণ ভালো লাগে। কিন্তু অফিস ফেলে এসেছি। তাই যেতেতো হবেই।
মামা: হুম এটা ঠিক যেতে হবেই কিন্তু বাবাজি সকালে না হয় কাল সন্ধ্যার পর নয়তো দুপুরের পর রওনা দিবেন।
আজাদ: বেশতো আমরা দুপুরের পর পরই রওনা দিবো। তাহলে তাড়াতাড়িই চলে যেতে পারবো।
গল্প করতে করতে খাওয়ার পর্ব এগিয়ে চলছে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। চলে যাবো কথাটা শুনে। যদিও মন খারাপের কিছু নেই, কারণ ঐটাই এখন আমার আসল ঠিকানা তবুও কেন জানি মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। কোন রকমে খেয়ে নিজের রুমে চলে আসলাম। তখনো আজাদ রিফাত ঝুমা ওরা গল্প করেই চলেছে। আমি জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রয়েছি। আজও আকাশে চাঁদ উঠেনি। অথচ এই জানালা দিয়ে কতইনা পূর্ণিমার চাঁদ দেখেছি। ঠান্ডা বাতাস।বয়ে চলছে হয়তো বৃষ্টি নামবে। ঘর বাড়ি ঠান্ডায় আরও শীতল করে দিয়ে যাবে। আর কয়েকটা দিন থাকলে কি এমন ক্ষতি হতো? ব্যস্ত মানুষ খুব সহজে কি সে আর আসতে চাইবে এখানে। নানান অযুহাত অফিসের কাজের চাপ কত কিছুই না বলবে। আর চাইলেই কি আমিই আসতে পারবো নাকি বার বার শাশুড়ি নোনদকে বাড়িতে একা রেখে। এসব কি উনি বুঝে না। মানুষটা সত্যিই জানি কেমন। ঠিকমত বুঝে উঠতে পারি না। কিংবা সেও হয়তো আমাকে বুঝে না।
ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ করেই কোমড়ে কারো স্পর্শে চমকে ঘুরে তাকাতেই আজাদের বুকের সাথে আমার বুকটা মিলে গেলো। আমি বেশ ভয় পেয়ে যাই। ভাবনায় এতোটাই ডুবে ছিলাম। যে কখন ঘরে আসলো তা বুঝতেই পারিনি। তাই কেমন জানি হার্টবিট বেড়ে গিয়েছে মুখ থেকে কোন কথাই বের হচ্ছে না।
আজাদ: এক হাত পিঠে রেখে আরেক হাত দিয়ে আমার কপালের উপর উড়ে আসা চুল গুলো সরিয়ে দিয়ে চোখের উপর চোখ রেখে প্রশ্ন করলো গভীর মনোযোগ দিয়ে কি ভাবছো এতো?
আমি কই তেমন কিছু না। আজও হয়তো বৃষ্টি নামবে তাই দেখছিলাম বাহিরে তাকুয়ে।
আজাদ: হুম তাইতো মনে হচ্ছে। কেন বৃষ্টিতে ভিজবে নাকি?
না না, এতো রাতে বৃষ্টিতে ভিজবো পাগল নাকি আপনি? মামা মামী দেখলে বা জানলে ভীষণ রাগ করবে। আর আমি চাইনা মানুষ গুলো আমার জন্য কষ্ট পাক আর। খুব কষ্ট করেছে তারা আমার জন্য।
দু’জন কথা বলতে বলতে বৃষ্টি শুরু হলো। আমি আজাদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। আজাদও আমাকে তার দুবাহু দিয়ে চেপে ধরলো। তার স্পর্শে আমি দু’চোখ বন্ধ করে ভালোবাসা অনুভব করার চেষ্টা করলাম। আজাদের ঠোঁট এসে স্পর্শ করলো আমার কপালকে। কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে মুখ থেকে বের হয়ে আসলো ভালোবাসি আপনাকে। সারা জীবন আপনার হয়ে থাকতে চাই। আপনাতেই আমার আমিকে খুঁজে পেতে চাই। সুখ, দুঃখ ভালোবাসা সব কিছুই ভাগ করে নিতে চাই এক সাথে।
আজাদের মুখ থেকে কোন শব্দ বের হলো না। তার ঠোঁট নেমে আসলো আমার ঠোঁটে। বৃষ্টি আরও দ্বিগুণ শব্দে টিনের চালে পরছে। মাঝে মাঝেই বজ্রপাতের শব্দে আমি কেঁপে কেঁপে আজাদকে আরও শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরছি। আজাদ একটা সময় জানালার পাশ থেকে আমাকে কোলে নিয়ে এগিয়ে চললো বিছানার দিকে। আমি অন্ধকারে বিজলি চমকে উঠলে দু’চোখ মেলে আজাদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি। তার চোখে মুখে শুধুই আমি মায়া খু্ঁজে পাই।
#চলবে…