প্রেমানুরাগ পর্ব-১১
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথি
–রাজরানী! তুমি কি আমার উপর রাগ করে আছো?
প্রেমা বিছানায় শুয়ে ফোনটাকে উপরের দিকে নিয়ে অনুরাগকে মুচকি হেসে বলে,
–রানীদের রাগ হয়না। হয় পাহাড় সম অভিমান! রাজাকেই সেই অভিমান ভাঙতে হবে।
চমৎকার হাসে অনুরাগ। তারপর রম্যতার সুরে বলে,
–রাজরানীর এক ডাকে রাজা তার সেবায় হাজির হবে। শুধু একটু অপেক্ষা করো। রাজরানীর মতো করে সাঁজিয়ে তুলবো তোমায়। এখানে তোমার জন্য আমি একটা গুজরাটি শাড়ি কিনেছি। অনেক ভারী। তুমি সামলাতে পারবে তো!
প্রেমা অবাক হয়ে বলে,
–বেশি ভারী হলে আমি চ্যাপ্টা হয়ে যাবো। তখন তো তোমার সুবিধা তাইনা!
প্রেমার হঠাৎ মুডের পরিবর্তন অনুরাগের বোধগম্য হলো না। কনফিউজড হয়ে বলে,
–হঠাৎ কি হলো? শাড়িটা দেখে তোমাকে সাঁজাতে মন চাইল বলেই কিনে ফেললাম। সাথে গুজরাটি জড়োয়া। তোমাকে দারুন লাগবে তাতে। পুরো রাজরানী লুক। আমার রাজরানী!
প্রেমা বলে,
–দেখা যাক। আমি সামলাতে না পারলে তুমি আমায় কোলে করে রাখবে।
হেসে ফেলে অনুরাগ। ওদের এরকম কথা চলতেই থাকে। আজকে আন্ধার থেকে মুম্বাইতে এসেছে। রবিবার সহ তিনদিন ছুটি দিয়েছে ডিরেক্টর।
এমনেও কাল শুক্রবার। প্রেমার ক্লাস নেই আর অনুরাগের কাল ছুটি। দুজনেই রাত জেগে শত কথার ফোয়ারা তুলছে। টানা চারদিন নেটওয়ার্কের কারনে কথা হয়নি ওদের। একদিনেই যেনো পুষিয়ে নিচ্ছে!
পরেরদিন,,
জুম্মার নামাজ পড়ে যখন দুপুরের খাবার খেতে সবাই ডাইনিংয়ে বসেছে তখন সিয়া খাবার সার্ভ করে খেতে বসলো। সবাই মাত্র দুয়েক লোকমা খেয়েছে তখন প্রেমার বাবা বলে,
–খাবারের পর তোমরা সবাই ড্রয়িংরুমে থাকবে। কথা আছে।
প্রেমা ও সানাফ কিছু বুঝতে না পেরে সায় দিয়ে খেতে থাকে। সিয়া কিছুটা বুঝতে পারলেও চুপ করে থাকে।
ড্রয়িংরুমে গম্ভীর পরিবেশ। প্রেমা সোফার হ্যান্ডেলে বসে আছে। প্রেমার পাশে সানাফ সোফাতে বসা আর সিয়া সানাফের পাশে। ওদের মুখোমুখি সোফাতে ওদের বাবা-মা বসা।
মৌনতা ত্যাগ করে প্রেমার বাবা বলে,
–আমি প্রেমার বিয়ে ঠিক করেছি।
প্রেমা হতভম্ব হয়ে যায় এই এক কথায়। সানাফ অবাক হয়ে আছে। সিয়া চুপ করে বসে আছে। প্রেমার মনের ভিতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। প্রেমার বাবা আবারো বলে,
–ছেলে আমাদের পরিচিত। খুব ভালো ছেলে। বউমার ভাই জারিফকে পছন্দ করেছি।
প্রেমা কি বলবে বুঝতে পারছে না। শব্দ ভান্ডার যেনো ফুরিয়ে গেছে সাথে কানের ভিতর সব যেনো ভনভন শব্দ তুলছে। সানাফ এবার কথা তুলে,
–কিন্তু বাবা, মৌয়ের (প্রেমা) অনুমতি নেওয়া দরকার ছিল। ওরো তো পছন্দ থাকতে পারে!
প্রেমার বাবা আঁতকে উঠে। তারপর হতাশ গলায় বলে,
–এখন তো বললাম। তোমরা বলো। আত্নীয়ের মধ্যে প্রস্তাব তো তাই ভালো মনে করে আমরা রাজী হয়ে গেছি। তাছাড়া প্রেমার জারিফকে অপছন্দের কারন নেই।
সানাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
–জারিফকে পছন্দ অপছন্দের কথা হচ্ছে না। কথা হলো, মৌয়ের অন্য কাউকে পছন্দও থাকতে পারে। বিয়েটা যেহেতু সে করবে তাই মনে হয় একবার ওকে জিজ্ঞাসা করে জবাব দেয়া দরকার ছিলো। আমার ক্ষেত্রেও তুমি জিজ্ঞাসা করোনি। তাও বাঁচা গেছিলো যে তোমার ফ্রেন্ডের মেয়েরো অন্য পছন্দ ছিল। আমার বোনের অমতে বিয়েতে আমি রাজী না বাবা। পরে যদি বোন আমার কষ্ট পায়!
প্রেমার বাবা চশমাটাকে এরেকটু ভিতরের দিকে ঠেলে দিয়ে মেয়ের দিকে তাকায়। মেয়ের মুখের অভিব্যক্তি বোঝা যাচ্ছে না। সিয়া অধীর আগ্রহে বসে আছে। সে চাইছে বিয়েটা হোক। নিজের ভাইয়ের কষ্ট যে তার সহ্য হচ্ছে না। প্রেমার বাবা বলে,
–তোমার কি মত প্রেমা?
প্রেমা হকচকিয়ে উঠে। তারপর আমতা আমতা করে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। প্রেমার বাবা মেয়ের মৌনতা দেখে বলে,
–তোমার কি সম্মতি আছে?
প্রেমা ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে আছে। চোখে পানিতে টইটুম্বুর। তার তো এখন নিজেকে অসহায় লাগছে। অনুরাগের কথা বলতেও ভয় হচ্ছে। যদি সবাই মেনে না নেয়! জোর করে তাকে বিয়ে দিতে চায়? কিন্তু সে তো বিবাহিত! ইসলামে নারীর তালাক ব্যাতিত দ্বিতীয় বিয়ে কার্যকর না। এমনকি কোনো আইনেই না। প্রেমা অস্ফুটভাবে কিছু বলতে চাইলো।
সানাফ বোনের দিকে এতোক্ষন চেয়ে ছিল। বোনের যে কষ্ট হচ্ছে সে তা বুঝতে পারছে। এজন্যই তো জারিফকে ভালো করে বুঝিয়েছিল। তাও জারিফ এই কাজটাই করলো! জারিফের সাথে তার কথা বলা দরকার তাই সে সেখান থেকে উঠে যায় জারিফকে কল করবে বলে। সিয়াও সানাফের পেছোনে যায়। সানাফ কল করার জন্য ফোনটা হাতে নিয়েছে মাত্র তখনি সিয়া গিয়ে সানাফের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বলে,
–কাকে ফোন করছো?
সানাফ সিয়ার হাত থেকে ফোনটা নিতে চাইলো কিন্তু সিয়া দিলো না বরং আবারো প্রশ্ন করলো,
–আগে বলো কাকে ফোন করছো?
সানাফ এবার খানিকটা রেগে সিয়ার হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে বলে,
–তুমি নিজেও আন্দাজ করতে পারছো আমি কাকে কল করবো! তুমি ও জারিফ দুজনেই জানতে সবটা। আমি তোমাদের আগেই বলেছি যে মৌ জারিফকে পছন্দ করে না। মৌ অন্য কাউকে ভালোবাসে। তারপরেও কেনো সম্পর্কের মধ্যে একটা ভেজাল আনলো? আমার বোনের মুখের অবস্থা দেখেছো?
সিয়া প্রতিবাদ করে বললো,
–তোমার বোন আদোতে কাউকে ভালোবাসে! আমি তো ওর বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করেছি। কই তারা তো জানে না। এমনও হতে পারে, প্রেমা কাউকে ভালোইবাসে না। শুধু বিয়ে এখন করতে চায় না বলেই এগুলা বলছে। আর আমার ভাইটা প্রেমাকে ভালোবাসে। ভাইয়ের চোখে আমি প্রেমার জন্য ভালোবাসা ও কষ্ট দেখেছি।
সানাফ এবার গলার স্বর উঁচু করে বলে,
–তোমার ভাইকে আমি বুঝিয়েছি। তাকে বারবার বলা হয়েছে এবং সে জানে, আমি আমার বোনকে নিয়ে কতোটা প্রটেকটিভ। ওকে ফাইন! তুমি তোমার ভাইয়ের দিকটা দেখছো আর আমি আমার বোনের। আমার বোন যখন অসহায় চোখে আমার দিকে চাইলো তখন একজন বড় ভাই হিসেবে আমার কেমন লেগেছে তা আমি তোমাকে বোঝাতে পারবো না। এই বিয়েটা হলে তিনটে জীবন নষ্ট হবে। আমি জারিফের সাথে আবার কথা বলবো।
সিয়া ভয় পেয়ে গেছে। সানাফের রাগ অনেক তা জানা স্বত্বেও সে সাহস দেখিয়েছিল। সানাফের উচ্চস্বরে প্রেমার মা ওদের ঘরের দিকে ছুটে এসেছে। প্রেমা এখনো সেখানে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রেমার বাবা ছেলের উচ্চস্বর ও মেয়ের স্তব্ধ মৌনতা দেখে গম্ভীর হয়ে বসে আছে। প্রেমার বাবা প্রেমাকে গম্ভীর স্বরে বলে,
–যাও নিজের ঘরে যাও।
প্রেমা আর দাঁড়ায় না। দৌড়ে চলে যায়। তারপর দরজা বন্ধ করে ইশা, প্রিয়াকে ও গ্রুপের মধ্যে অর্ষা, মিম ও নিশিকে টেক্সট করে বাসায় আসতে। কাঁদতে থাকে বিছানায় শুয়ে। অনুরাগকে কলে ট্রাই করেছিল কিন্তু নেটে নেই। ফোন কলেও কল করেছিল কিন্তু নাম্বার বন্ধ।
অনুরাগ ঘুমাচ্ছে নামাজ পড়ে এসে।
সানাফ জারিফকে কল করে। জারিফ মাত্র বিছানায় শুয়ে ফেসবুকে ঢুকেছিল। জারিফ কল রিসিভ করে বলে,
–কি ব্যাপার? হঠাৎ এসময়?
সানাফ রুক্ষ স্বরে বলে,
–তোকে মানা করেছিলাম তো!
জারিফ উঠে বসে। সানাফের কন্ঠে রুক্ষতা ও সিরিয়াস ভাব। জারিফ আশঙ্কিত হয়ে বলে,
–কি হয়েছে? সব ঠিক আছে?
সানাফ নিজেকে শান্ত করে। তারপর বলে,
–তোকে মৌয়ের ব্যাপারটা বলেছিলাম তো। কেনো শুধু শুধু নিজের কাঁচা ঘা তে আবার খোঁচাচ্ছিস? আমার বোন তোকে প্রেমিক বা স্বামীর নজরে দেখে না। আজ বাবা যখন তোর ও মৌয়ের বিয়ের কথা তুললো তখন আমার বোনের মুখাবয়ব কেমন ছিলো তোকে বলে বোঝাতে পারবো না। বেচারি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে।
জারিফের বুকে মোচড় দিয়ে উঠে। সে তো এসবের কিছু জানে না। বরাবর শান্ত স্বভাবের সে। নিজের মনের কথা বন্ধুকে একবারই বলেছিল। তারপর তো নিজেকে আড়াল করে নিয়েছিল।
–এই ব্যাপারে আমি সত্যি কিছু জানি না। জানলে এমনটা হতেই দিতাম না।
এটুকু বলে ফোন কেটে দেয়।
আর এদিকে প্রিয়া, ইশা, অর্ষা, মিম, নিশি ওরা সবাই বিকেলের মধ্যে প্রেমার বাসায় হাজির।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কার্টেসি ছাড়া কপি করবেন না।