শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
Part_67
#Writer_NOVA
এক সপ্তাহ পর…..
হঠাৎ করে পেছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরতেই আমি কিছুটা ভড়কে গেলাম। আচমকা হওয়ায় ভড়কে গিয়েছি। ঘাড় ঘুরিয়ে এনাজকে দেখে চোখ ছোট ছোট করে তাকালাম। উনি আমার দৃষ্টি উপেক্ষা করে গালে টাইট করে একটা চুমু খেলো। সে ঘাড়ে হালকা করে নাক ঘষে কাঁধে থুঁতনি রেখে বললো,
— শীতের মধ্যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছো কেন?
— এমনি।
— মন খারাপ?
— না তো।
— আমি জানি তো মন খারাপ।
— তেমন কিছু নয়।
— আগামীকাল বাবার বাড়ি থেকে চলে যাবে তাই মন খারাপ করছে তাই না?
— হুম অনেকটা তাই।
আমাকে তার দিকে ঘুরিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে নাকের সাথে নাক হালকা ঘষে বললো,
— মন খারাপ করো না। আবার সামনের মাসে এসে কয়েকদিন বেড়িয়ে যেয়ো।
আমি তার নাক ধরে কিছুটা জোরেই টান দিয়ে বললাম,
— নাকটা বেশি লম্বা হয়ে গেছে।
— হবেই তো নতুন বউ পেয়েছে যে।
— ফাজিল ছেলে, মুখে কিছু আটকায় না
— কিছু না বলতেই এমন নাক,মুখ সিটকানো শুরু করলে। যদি বলা শুরু করি তাহলে কি হবে?
— মুখে তো এখন কিছু আটকায় না।
— আটকাবেও না। এতদিন অনেক কষ্টে সবকিছু আমার মায়াবী বউটার জন্য হেফাজত করে রাখছি। এখন সেগুলো তো কাজে লাগাতে হবে।
— এনাম ভাইয়া কোথায়?
— আছে মুহিনের সাথে আশেপাশেই।
— চলেন খাবার খাবেন।
উনি এক হাতে শক্ত করে আমার কোমড় জড়িয়ে আমাকে কাছে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
— একটু পর।
— কেন?
— তুমি পাশে আছো তাই।
— বাহ বাহ কি ভালোবাসা!
— আকাশে আজ চাঁদও উঠেনি। উঠলে জোছনা বিলাস করা যেতো।
— ইস, কত শখ!
— হুম অনেক শখ।
আমি চুপ হয়ে গেলাম। উনি চেয়ারে বসে আমাকে তার কোলে বসিয়ে দিলো। দুই হাতে কোমড় জড়িয়ে ধরে রাখলো।আমি চোখ বড় বড় করে বললাম,
— হচ্ছেটা কি? দরজা খোলা। কেউ এভাবে দেখলে কি ভাববে? ছাড়ুন বলছি।
— কেউ আসবে না। আর দেখলে আমাদের রোমান্স করতে দিয়ে তারাই চলে যাবে।
— হইছে ছাড়েন। কেউ দেখে ফেললে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরতে হবে।
— কেউ দেখবে না তো।
— এনাজিও সংস্থা ছাড়েন।
—ছাড়তে পারি এক শর্তে।
— আবার শর্ত?
— জ্বি।
— কোন শর্ত মানতে পারবো না।
— চুপচাপ বসে থাকলে তো কোন শর্ত দেইনা আমি।
— আমাদের দেখতে না পারলে কেউ চলে আসবে। তখন কেউ দেখে ফেললে লজ্জায় পরতে হবে।
— তুমি না রোমান্স করার মুডটাই নষ্ট করে দাও।
— আমি আবার কি করলাম?
— চুপচাপ কোলে বসে থাকো। কোন মোচড়ামুচড়ি করবে না। তোমার ছটফটানি দেখলে আমার মনে হয় অন্যের বউকে চুরি করে জড়িয়ে ধরছি।
উনার কথায় কিছুটা বিরক্তি ও অসন্তোষের প্রকাশ পেলো। আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘাপটি মেরে তার বুকে মাথা রেখে বসে রইলাম। তার অবাধ্য হওয়া যাবে না। বেচারা মন খারাপ করে ফেলছে। অবশ্য মন খারাপ হওয়ারি কথা। উনি মুখ ঘুরিয়ে রাখলেন। আকাশে চাঁদ না থাকলেও ফকফকা আলো আছে। সেই আলোতে তার বিষন্ন মুখটা দেখে আমার খারাপ লাগলো। তার খোঁচা খোঁচা দাড়ির সাথে আমার গালটা হালকা করে ঘষা দিয়ে বললাম,
— রাগ করছো?
— না।
— আমার তো মনে হয় রাগ করছো।
এনাজ স্পষ্ট রাগী গলায় বললো,
— রাগ করবো কেন? আমি রাগ করার কে?
— আল্লাহ কি রাগ! রাগ করেও বলে রাগ করার কে?
— হুম ছাড়ো আমায়। কেউ দেখে ফেললে লজ্জায় পরবে। আমি চাই না তুমি লজ্জায় পরো।
আমি দুই হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে আদুরে কন্ঠে বললাম,
— এত রাগ আমদানি হয় কোথা থেকে?
— আমার রাগ এখনো দেখোনি তুমি।
— দেখবো কি করে? তুমি তো আমার সাথে রাগ দেখাতেই পারো না।
— কে বললো পারি না?
গলার থেকে হাত সরিয়ে গাল দুটো টেনে দিয়ে বললাম,
— আমি জানি। তোমার মনের খবর আমি রাখি এনজিও সংস্থা।
— কিচ্ছু জানো না তুমি। জানলে আমার সাথে এমন করতে না। একটু আদর করতে গেলেই তোমার এই সমস্যা, ঐ সমস্যা। তুমি আমায় একটুও ভালোবাসো না। ভালবাসলে এমন করতা না।
মুখ গোমড়া করে ঠোঁট ফুলিয়ে বাচ্চাদের মতো করে অভিযোগ করতে লাগলো। আমি এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসতে লাগলাম।উনি আমাকে হাসতে দেখে বললো,
— সত্যি কথা বলছি।
আমি তার কথার উত্তর না দিয়ে তার গালে টুপ করে এক চুমু খেয়ে বসলাম। সে গাল ডলে অভিমানী সুরে বললো,
— লাগবে না।
— তাহলে কি লাগবে?
— কিছু লাগবে না। সরো, আমার ভালো লাগছে না।
— কেন ভালো লাগছে না? তোমার ভালো লাগার ঔষধ তো তোমার সাথেই আছে।
এনাজ এতটাই অভিমান করেছে যে এতখন ধরে যে আমি ওকে এক নাগাড়ে তুমি বলে সম্বোধন করছি সেই দিকেও খেয়াল নেই। হঠাৎ ভ্রু জোড়া কুঁচকে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
— তুমি কি আমাকে এতখন তুমি বলে সম্বোধন করেছো?
আমি দুষ্টুমি করে বললাম,
— কই নাতো!
— না তুমি আমাকে তুমি করে বলছো।
— একটুও না।
— মিথ্যে বলো না।
— জ্বি মহাদোয় আমি তোমাকে এতখন ধরে তুমি বলে সম্বোধন করছি। কিন্তু তোমার তো কোন খেয়াল নেই।
এনাজের চোখ মুখ খুশিতে ঝলকে উঠলো। শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে বললো,
— আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তুমি আমাকে তুমি করে বলছো। প্লিজ আরেকবার বলবে।
— কি বলবো বলো?
— তুমি বলো।
— কি বলবো বলো তুমি?
— লাভ ইউ টিডি পোকা।
— লাভ ইউ টু।
— আমিও এর মধ্যে ভেবেছিলাম তোমাকে তুমি করে বলতে বলবো। কিন্তু তুমি তার আগেই বলে ফেললে। আমার যে কি খুশি লাগছে।
— কেউ আমার সাথে রাগ করেছিলো।
— রাগ করে তো লাভ হলো।সে আমাকে তুমি করে বললে।
💖💖💖
কথাটা বলেই আমার সারা মুখে অসংখ্য চুমু খেলো। সামান্য তুমি বলায় কেউ এতো খুশি হয় তা এই প্রথম দেখলাম। মনে হচ্ছে এই ছেলে পাগল ছাড়া আর কিছু না। হ্যাঁ পাগলই তো,আমার পাগল। আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
— এতো খুশি হয়েছেন মনে হচ্ছে আমি আপনাকে বাবা হওয়ার সুসংবাদ দিয়েছি।
— তা হলে তো আমি খুশিতে পাগল হয়ে যেতাম।
— বাকি নেই।
— কি?
— পাগল হওয়ার কথা বলছি।
এনাজ কোন কথা না বলে ঠোঁটে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে দুই হাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বললো,
— বউ, ও বউ!
— জ্বি বলেন।
— আবার আপনি তে নেমে গেছো?
— সরি, বলো।
— আমার একটা পুতুল বেবী লাগবে।
— এখন না পরে।
— না প্লিজ এখুনি।
— সবেমাত্র বিয়ে হলো। এখুনি আমি কোন টেউ টেউ নিতে পারবো না।
— প্লিজ এমন করো না। একটা বাবু নেই আমরা। ও ছোট ছোট পায়ে সারারুমে ঘুরে বেড়াবে। আধো আধো গলায় আমাকে বাবা বলে ডাকবে। তোমাকে মা বলে ডাকবে। আমি অফিস থেকে ফিরে ওকে বুকে নিয়ে ঘুমাবো। ওর সাথে খেলবো, ওর আধো আধো বুলি মুগ্ধ হয়ে শুনবো। প্লিজ একটা বাবু নেই না।
— নিবো না তাতো বলিনি। তবে দেরী আছে। আমার পড়াশোনা শেষ করে নেই।
— তুমি সংসার চালানোর পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। আমি তোমাকে সবসময় হেল্প করবো।প্লিজ রাজী হয়ে যাও।
— একটুও না।
— পেটে একটা বেবী দেই না?
— চুপ করো। কি শুরু করছো?
এনাজ দাঁত বের করে শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,
— আচ্ছা, বেবী না নেই। বেবী নেওয়ার প্রসেসিং তো করতে পারি আমরা?
— লুচ্চা বেডা। মুখে কি কিছু আটকায় না। থামেন তো। তখন থেকে কি বলা শুরু করছে!
আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম। এর মুখে আজকাল কিছু আটকায় না। সে আমার থুঁতনি ধরে মুখ উঁচু করলো। আমি চোখ বন্ধ করে মুখ খিচে রাখছি। এনাজ দুষ্টুমীর সুরে বললো,
— ইস, আমার টিডি পোকা লজ্জা পাইছে। লজ্জা পেলে তোমাকে অনেক কিউট লাগে।
আমাকে আরো লজ্জা দেওয়ার ধান্দা তার। আমি তার বুকে মৃদু করে কয়েকটা কিল বসিয়ে দিয়ে বললাম,
— শুধুই কি বলি আপনি লুচ্চামির ওপর ডিগ্রি করছেন? লাগামছাড়া কথাবার্তা।
— আমার বউয়ের সাথে বলি, অন্য কারো বউয়ের সাথে নয়।
— ছাড়েন তো। কখন থেকে দুষ্টামী শুরু করছে।
তার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ভেংচি কাটলাম।আচমকা এমন হওয়ায় সে কিছুটা চমকে গেলোও সেই ভাবটা মুখে না রেখে শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,
— আজকে রাতে খবর আছে।
আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললাম,
— দেখা যাবে।
— ওকে দেখে নিও।
আমি আর দাঁড়ালাম না। দ্রুত পায়ে আম্মুর কাছে গিয়ে হাতে হাতে কাজ করতে লাগলাম। একসাথে সবাই খাবার খেয়ে নিলাম। বিছানা করে মশারী টানিয়ে নিলাম। তায়াং ভাইয়া, তন্বীর সাথে কথা হয়েছে একটু আগে। খালামণির সাথে কথা বলতে বলতে বারান্দায় চলে গেলাম। কথা শেষ করে বাইরে তাকিয়ে কিছুটা জোরে চিৎকার করে উঠি। এনাজ ওয়াসরুম থেকে দ্রুত বের হয়ে এসে বলে,
— কি হয়েছে? চিৎকার দিলে কেন?
আমি খুশিতে কথা বলতে পারছি না। আমার মুখ হা হয়ে আছে। এনাজ আবারো বললো,
— কি হয়েছে বলবে তো?
আমি হাত দিয়ে বাইরে দেখিয়ে দিলাম। এনাজ বাইরের দিকে তাকিয়ে আমার মতো করে মুখ হা করে রাখলো। তারপর আমার এক হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে বললো,
— টিডি পোকা আমি যা দেখছি তুমিও কি তা দেখতে পারছো?
— হুম।
— আমার মনে হচ্ছে স্বপ্নের জগতে আছি।
— আমারো।
— বিশ্বাস হচ্ছে না আমার।
— চলো ছাদে যাই।
— হুম জলদী চলো। এত সুন্দর মোমেন্ট হাতছাড়া করার মতো নয়।
আমি ও এনাজ অনেকটা দৌড়ে ছাদে চলে এলাম। এখন আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে আমরা দুজন কি দেখে দৌড় দিলাম। আমাদের দালানটা দক্ষিণমুখো। বারান্দায় দিয়ে দূর-দূরান্তের আলুর খেত দেখা যায়। আমাদের বারান্দার সামনে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি পোকারা জ্বলছে নিভছে। মনে হচ্ছে ওদের মিছিল লেগে গেছে। সাধারণত শীতের সময় এদের দেখা মিলে না। হঠাৎ কি মনে করে ওরা হানা দিয়েছে তা ওরাই ভালো জানে। জোনাকির আলোতে পুরোটা জায়গা অন্য রকম পরিবেশে পরিণত হয়েছে। ছাদে গিয়ে দুজন পাশাপাশি বসে পরলাম। এনাজের কাঁধে আমার মাথা হেলিয়ে দিয়ে এই সুন্দর মুহুর্তটা অনুভব করতে লাগলাম।
অনেকটা সময় কেটে গেলো এভাবে। সবাই শুয়ে পরেছে অনেক আগে। এতখনে হয়তো ঘুমিয়েও গেছে।ধীরে ধীরে জোনাকি পোকাগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে অন্য দিকে চলে যেতে লাগলো। এক সময় অন্ধকারের সাথে মিলিয়ে গেলো। এনাজ আমাকে মৃদুস্বরে ডাকলো।
— টিডি পোকা!
— হুম বলো।
— ওহ জেগে আছো?
— জ্বি।
— আমি ভাবলাম ঘুমিয়ে গেছো। তাই ডেকেছিলাম।
— কিছু বলবে?
— চলো এবার রুমে ফিরে যাই।
— আরেকটু থাকি?
— জোনাকি পোকা তো নেই।
— তবুও।
— ওকে।
উনি আবারো চুপ হয়ে গেলেন। ভারী একটা সোয়েটার পরে আছি। তবুও শীত করছে। ঠান্ডা লাগবে জেনেও বাইরে থাকতে ভালো লাগছে। প্রিয় মানুষটার কাঁধে মাথা রেখে এই নীরব পরিবেশ অনুভব করতে কার না ভালো লাগে বলুন তো। এনাজ কিছু সময় চুপ থেকে বললো,
— একটা কথা বলি?
— বলো।
— চলো না আজ আবার ডুব দেই নতুন অধ্যায়ে!
আমি চোখ দুটো বড় করে তার দিকে তাকালাম।যদিও আমি পুরোপুরি তার হয়ে গেছি বহু আগেই। বৌ-ভাতের রাতে আমাকে ছাড়েওনি, কোন সময়ও দেইনি। পুরোপুরি নিজের করে ফেলেছে। নতুন জীবনে পদার্পন হয়েছে সেদিন। তবুও আজ তার মুখে এমন কথা শুনে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেছি। তার চোখ দুটো অসহায় হয়ে আমার দিকে স্থির। চাতক পাখির মতো আমার উত্তরের অপেক্ষায় আছে। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে কেন জানি মানা করতে পারলাম না। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম। সে কিছুটা খুশি গলায় বললো,
— তোমার মাঝে দ্বিতীয় বারের মতো ডুব দিতে দিবে আমাকে?
আমি কোন উত্তর দিলাম না। তার বুকে মুখ লুকালাম। তাতেই সে তার উত্তর খুঁজে পেলো। দুই চোখের পাতায় আলতো করে চুমু খেয়ে আমাকে কোলে তুলে নিলো। আমি এখনো তার বুকে মুখ লুকিয়ে রেখেছি।লজ্জায় আমি শেষ। তারপর…… আর কিছু না। যান ভাগেন, এতো কিছু পড়তে হবে না।
#চলবে
ভাবা যায়,আপনাদের নিরামিষ লেখিকা লুমান্থিক (রোমান্টিক) হয়ে গেছে 🤭।