প্রেমানুরাগ পর্ব-১৩
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথি
সানাফ ও প্রেমা মুখোমুখি বসে আছে। সানাফের মুখ থমথমে। প্রেমা খুব ভীত হয়ে আছে। একটু আগে সানাফকে নিজের রুমে এনে অনুরাগের ব্যাপারটা বলেছে। বলার আগে অনুরাগের সাথে কথাও বলে নিয়েছিল। অনুরাগও এখন বিষয়টা নিয়ে খুব টেনশনে আছে। মাত্র দেড় মাস হলো মুভিটা শুরু করলো আর এখনি পারসোনাল লাইফ নিয়ে সমস্যা শুরু। বেচারা কাজে কি করে মন দিবে? আর সেলিব্রেটিরা অমনোযোগী হলে মিডিয়াতে যা-তা রটে যায়। অনুরাগ প্রেমাকে আশ্বস্ত করেছে সে পরের সপ্তাহে বাংলাদেশে আসবে।
সানাফ মাথা নিচু করে চুপ করে আছে। প্রেমা এখন কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। অনেকটা সাহস ও আশা নিয়ে সে ভাইকে সব বলেছে। সানাফ অনেকক্ষণ চুপ থেকে গম্ভীর স্বরে বলে,
–অনুরাগ খান একজন সুপারস্টার। সে তোকে জোর করে বিয়েও করলো। তুই কি এর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত না? সেলিব্রেটিদের পারসোনাল লাইফ আর পারসোনাল থাকে না। তিল থেকে তাল হয়ে যায়। আর সেলিব্রেটিদের সংসার অনেক ভাঙে!
শেষের কথায় আঁতকে উঠে প্রেমা। সত্যি এই ভয়টাও তার মনে আছে। খুব গভীর ভাবে আছে। সেলিব্রেটিদের যেমন ফ্যান-ফলোয়ার তেমনি প্রচুর হেটার্স। হেটার্সদের থেকে বাঁচতে অনেকে নিজের ক্যারিয়ার বর্বাদ করেছে বা অনেকে নিজের পারসোনাল লাইফকে বর্বাদ করেছে।
প্রেমা শঙ্কিত কন্ঠে বলে,
–ভাইয়া, এই ভয়টা আমারো। তবে অনুরাগকে মুভির জগতে ওর বাবা টেনে এনেছে। অনুরাগ চায়নি আসতে। অনুরাগ নিজের মায়ের করুন পরিনতির পর মুভির জগতে পা রাখতে চায়নি কিন্তু ওর মাকে দেয়া শেষ কথার জন্য ওকে ওর বাবার কথায় মুভির জগতে আসতে হয়েছে। ও চেষ্টা করছে ওর বাবার গন্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে। অনেকটা চেষ্টা করেছে। অনুরাগ নিজের পারসোনাল লাইফকে বাঁচাতে ওর বাবার প্রডাকশন হাউজের মুভি খুব কৌশলে রিজেক্ট করেছে। হয়তো সে মুভির জগতকে ছাড়তে পারবে না বা ছাড়লেও অনেক কষ্ট করতে হবে কারন ওর নিজের বাবা!
এতোগুলা কথা বলে হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়লো প্রেমা। সানাফ সবটা শুনলো। মিডিয়ার কিছু খবর তো তারও রাখা হয়। না চাইলেও নিউজফিডে এসব আসে। একটা সামান্য খবরকে কতোটা বাড়িয়ে চড়িয়ে বলা হয় তা সানাফেরও জানা। খবরকে আকর্ষণীয় করতে নানা রকম বানোয়াট তথ্য দিয়ে হেডলাইন দেয়। শুধু গল্প পাতাতে পারলেও হলো কিন্তু এতে যে কারো পারসোনাল লাইফ রিস্কে যেতে পারে তা তারা ভাবেই না।
সানাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
–দেখ মৌ, আমার কোনো সমস্যা নেই তোর পছন্দে কিন্তু একজন দায়িত্ববান ভাই হিসেবে বোনের সুরক্ষা চাওয়া আমার কর্তব্য। অনুরাগকে এখানে আসতে বল। জানিনা বাবা-মা ব্যাপারটাকে কিভাবে নিবে! আমি বাবার সাথে কথা বলার আগে একবার চাচার সাথে কথা বলবো। বাবা যদি ব্যাপারটা না বুঝে তো চাচা বোঝানোর চেষ্টা করবে। আর তোদের বিয়েটা তো হয়ে গেছে। এখন কিছু করারো নেই। জানিনা কি হবে!
সানাফ হতাশ হয়ে চলে যায়। তার ইচ্ছে করছিলো রাগারাগি করতে কিন্তু বিকেল থেকে কান্না করে করে প্রেমার অবস্থা নাজেহাল। গলাও বসে গেছে। পুরো ঘটনা বলার সময়ও অনেক কষ্টে কান্না আটকিয়ে তারপর বলেছে। প্রেমার মা সন্ধ্যার পর প্রেমার নাজেহাল অবস্থা দেখে প্রেমার মা প্রেমার বাবাকে না বলে সানাফকে বলে। তারপরই সবটা হলো।
সানাফ চলে যাবার পরেও প্রেমা মনের ভিতর একরাশ ভয় নিয়ে বসে আছে। তার বাবার রিয়াকশন কি হবে সেটা তার ভাবতেও ইচ্ছে করছে না।
___________
রাদ ১০টার পর প্রিয়ম বাড়িতে এসে দেখে তার মা চিন্তিত মুখ নিয়ে দরজা খুলেছে। প্রিয়ম ওর মাকে প্রায় প্রতিদিন হয় বিরক্তি বা তাড়াহুড়ো নিয়ে দরজা খুলতে দেখে কিন্তু আজ ব্যাতিক্রম দেখে চোখে আটকিয়েছে। এমন না যে এর আগে মাকে চিন্তিত দেখেনি! দেখেছে তারপর চিন্তার কারনও জেনেছে।
প্রিয়ম ওর মাকে জিজ্ঞাসা করে,
–কি হলো তোমার আবার? এমন চিন্তিত লাগছে কেন?
প্রিয়মের মা চিন্তিত হয়ে বলে,
–দিন দিন মেয়েটার যে কি হচ্ছে! বুঝি না বাপু। ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর থেকেই কেমন যেনো গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। আজ কেমন অদ্ভুত ব্যাবহার করলো। কোনোদিনও দেখেছিস! প্রিয়ু ওর জেঠার বাসায় গেলে রাত করে না থেকে ফিরে এসেছে! আমরা সবাই মিলে গেলেও যখন আমরা ফিরে আসতাম তখনও সে ফিরতো না। আর আজ সে বিকেলে গেলো আর সন্ধ্যার পর একা একা ফিরে এলো। কি যে হচ্ছে মেয়েটার?
প্রিয়ম সবটা শুনলো। তারও তো প্রিয়াকে কেমন বদলে যাওয়া মনে হয়। প্রিয়মের মা আবারো বলল,
–কতো করে কারন জানতে চাইলাম কিন্তু মেয়েটা বললোই না। কিচ্ছুটি বললো না। নিজের রুমে চলে গেলো। ওর জন্য চিন্তা হচ্ছে অনেক।
প্রিয়ম ওর মাকে আশ্বাস দিয়ে বলে,
–আচ্ছা তুমি চিন্তা করো না। আমি দেখছি। আর বাবা কই? বাবাকে বলছো?
প্রিয়মের মা বলে,
–তোর বাবা তো ঘরে। তাকে বলার পর সে প্রিয়াকে ডাকতে গেছিলো কিন্তু প্রিয়া বললো সে পড়ছে তাই আর ডাকেনি। তোর বাবা তো ছেলে মেয়েদের পড়ার কথা শুনলে আর ডাকে না।
প্রিয়ম বলে,
–আচ্ছা। আমি দেখছি। তুমি খাবার বারো আমার জন্য।
এই বলে প্রিয়ম প্রিয়ার রুমের দিকে যায়। দরজায় নক করলে প্রিয়া তার বাবাকে বলা কথার মতোই বলল সে পড়ছে। প্রিয়ম আবারো নক করে বলে,
–আমি বাবা নই যে তোর পড়ার বাহানাতে চলে যাবো। দরজা খোল। আর তোর গলা এমন শোনায় কেন? দরজা খোল।
প্রিয়া চোখ মুছে। একটানা কান্না সে করছে না। কিছুক্ষণ পর পর তার কান্না পাচ্ছে। খুব করে কান্না পাচ্ছে। এখন তার ভাই দেখে ফেললে তো ঝামেলা। সে কোনোমতে গলা ঠিক করে বলে,
–ভাই প্লিজ যা এখন। পরে কথা বলবো। আমি পড়ছি তো।
প্রিয়ম এবার গম্ভীর হয়ে বলে,
–দরজা কি খুলবি নাকি আমি তোর রুমের ডুবলিকেট চাবি নিয়ে আসবো?
প্রিয়া ভালো করে মুখ মুছে নেয়। ওয়েট টিস্যু দিয়ে মুখটা মুছে নেয় যাতে কান্নার দাগ অতো বোঝা না যায়। তারপর দরজা খুলে দেয়। দরজা খোলা মাত্রই প্রিয়ম ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। তারপর প্রিয়ার দিকে তাকায়। প্রিয়া মুখ নিচের দিকে করে চুপ করে আছে। প্রিয়ম ওর হাত টেনে ব্যালকনিতে নিয়ে যায়। তারপর দোলনাতে প্রিয়াকে নিয়ে বসে তারপর কিছুক্ষণ আকাশের দিকে মুখ করে বলে,
–অন্ধকার খোলা আকাশকে সাক্ষী রেখে নিজের কষ্ট বলতে পারিস। আমিও হয়তো আলোক স্বল্পতার কারনে দেখবো না। তবে নিজেকে গুটিয়ে নিস না। তোর জন্য যে বাবা-মা চিন্তিত তা তো বুঝিস? তাদেরকে বলতে না পারলেও আমাকে তো বলতে পারিস! আমি তোর বড় ভাই হলেও তোর সাথে ফাজলামো করাটাই আমার বেশি ভালো লাগে। হুট করে তোর বদলে যাওয়া মানতে কষ্ট হয়রে!
প্রিয়া ভাইকে জড়িয়ে ধরে। তারও এখন একজনকে দরকার ছিলো যাকে মনের কথা বলতে পারবে। যাকে সব বলে নিজেকে হালকা করতে পারবে।
প্রিয়া স্বভাববশত ছটফটে। হঠাৎ করে বদলে গেলেও আবেগি ভাবটা তো বদলে যায় না। প্রিয়া প্রিয়মকে সময় নিয়ে আস্তে আস্তে সবটা বলে। এর মাঝে প্রিয়মকে ওদের মা ডাকতে এসে প্রিয়মের কথায় দরজার বাহির থেকে চলেও গেছে। সব বলে প্রিয়া থামে। প্রিয়ম সব শুনে অবাক ও বাকরুদ্ধ হয়।
তার পিচ্চি বোন কাউকে ভালোবাসে! আবার তার আরেক বোন সুপারস্টারের বউ!
নিজেকে কেমন এলিয়েন এলিয়েন লাগছে তার কাছে!
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কার্টেসি ছাড়া কপি করবেন না।