প্রেমানুরাগ পর্ব-১৫
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথি
সুবিশাল অম্বরে কৃষ্ণ উত্তরীয় হটিয়ে রক্তিম ভোরের সূর্যের সূচনা। এক নতুন আশার দ্বারপ্রান্তে কিছু সম্পর্ক। পূর্ব আকাশে গোল থালার মতো রবিকে আগুনের গোলার থেকে কম লাগছে না!
প্রেমা ভোরের সূর্যের দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছে। নিজেও ঘুমায়নি অনুরাগকেও ঘুমাতে দেয়নি। ফজরের পর প্রেমা নিজেই অনুরাগকে নামাজ পড়ে ঘুমাতে বলেছে। নাহলে তো শুটিংয়ে অসুস্থ হয়ে পরবে। প্রেমার ভয় এখন তার বাবা মেনে নিবে কিনা!
সানাফ অফিসে যাবার জন্য বের হচ্ছে। আজও প্রেমা নাস্তার টেবিলে আসেনি। বের হবার আগে প্রিয়ম কল করে। প্রিয়ম বলে,
–ভাই, প্রিয়ার তো জ্বর। সকালে আম্মু ডাকতে গেছিলো তখন দরজা খুলেনি। ওর ক্লাস আছে তাও উঠেনি। সকাল ৮.৩০ এ ক্লাসের জন্য তো ৭.৩০ এ বের হতে হয়। সে উঠেনি বলে ডুবলিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেখি জ্বর ওর। মেপে দেখলাম ১০৩ ডিগ্রি। আমি কিছু ওষুধ দিয়েছি যেগুলা জ্বরের জন্য দিতে হয় কিন্তু কিছু খেতে পারছে না। আম্মু জোর করে খাওয়াতে গেছিলো আর সে বমি করে দিছে। এখন কিছু খেতেও চাচ্ছে না। কি যেনো বিড়বিড় করছে।
সানাফ চিন্তিত হয় তারপর বলে,
–চাচিকে বল ওকে আবারো জোর করে খাওয়াতে। কি যে হচ্ছে! আমি তাহলে বিকেলের অপেক্ষা না করে জারিফকে হাফ ডে করে ছুটি নিতে বলি। সাথে আমিও ছুটি নেই। স্যুপ করে খাওয়াতে বল প্রিয়াকে। নাহলে তো ওষুধ খেতে পারবে না।
ফোন রেখে হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে সানাফ অফিসে চলে যায়।
_________
পার্কের একটা বেঞ্চে বসে আছে সানাফ ও জারিফ। দুজনেই চুপচাপ। জারিফ সানাফের দিকে তাকাচ্ছেও না। সানাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে জারিফকে বলে,
–জীবন কি কাউকে না পাওয়ার দুঃখে থেমে থাকে?
জারিফ মলিন চোখে তাকায় সানাফের দিকে। সানাফও তাকায় তারপর আবার বলে,
–অনেকে না পেয়ে নিজেকে হতাশাগ্রস্থ করে তারপর আস্তে আস্তে মানষিক স্থিতি হারায়। অনেকে আত্নহত্যার দিকে ঝুঁকে। এসব করে কি তার পরিবারকে সে দুঃখ দেয় না?
জারিফ মলিন কন্ঠে বলে,
–আমি এসব দিকে যাবো না। এটুকু তুই আমাকে চিনিস নিশ্চই!
সানাফ বলে,
–হ্যাঁ চিনি। তুই নিজেকে সামলে নিবি তাও জানি কারন তুই তোর পরিবার ও প্রতিটা সম্পর্কের প্রতি দায়িত্বশীল। তবে আরেকজন যে এদিকে অবুঝের মতো নিজেকে কস্ট দিয়ে যাচ্ছে!
জারিফ অবাক চোখে তাকিয়ে বলে,
–আমি বাবা-মাকে বলে দিয়েছি আমি প্রেমাকে বিয়ে করবো না। আমার অতো সাহস নেই যাকে ভালোবাসি তার চোখে নিজেকে অপরাধী দেখার। আর আমার জন্য সে কস্ট পাবে তাও চাই না। প্রেমা আমাকে পছন্দ করেনা তা আমি আগেই বুঝে গেছি। কারো ভালোবাসা ছিনিয়ে নিয়ে আমিও সুখে থাকবো না।
সানাফ একটা ইটের টুকরো নিয়ে সামনের জলাধারে ঢিল মেরে বলে,
–এটাকে ফেরাতে পারবি? হয়তো পারবি। সব পানি সেঁচে ফেলে দিয়ে হয়তো কর্দমাক্ত মাটিতে ইটের টুকরোটাকে পাবি। তবে এতে যে কতোটা কসরত করতে হবে তা তুইও জানিস। এর থেকে ভালো নয় কি এটাকে পানিতে না ফেলা! আর নয়তো এটাকে তোলার প্রচেষ্টা না করা। আবার তোর ইটের টুকরোটা জলাধারে ফেলে দিয়ে তুলতো যেই কস্ট হয়েছে তুই কি তোর চোখের সামনে একই কস্ট করতে কাউকে দেখতে চাস? সে যদি কর্দমাক্ত মাটিতে ইটের টুকরোটা খুঁজে না পায়!
জারিফ কিছুই বোঝেনি। সে কপাল কুঁচকে বলে,
–বুঝলাম না।
সানাফ হেসে বলে,
–তুই প্রেমাকে ভালোবাসিস। আর এখন সেটা ফেরাতে পারছিস না। ফেরাতে গেলে তোকে অনেক কস্ট করতে হবে। ভুলতে তোর কস্ট হবে বা পারবি না। এখন তুই কি এটা চাইবি, তোকে কেউ ভালোবেসে না পেয়ে তোর মতো কস্ট পাক। এরপর আস্তে আস্তে তোকে ভুলতে না পেরে ডিপ্রেশনে চলে যাক?
জারিফের মাথায় কথার কিছুই ঢোকেনি। সে বলে,
–আমাকে কে ভালোবাসে?
সানাফ ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
–আমার আরেক বোন। প্রিয়া।
জারিফ অবাক হয়। কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে,
–কিসব বলিস! প্রিয়া কেন আমাকে ভালোবাসতে যাবে?
সানাফ বলে,
–তা তো জানি না। প্রেমার সাথে তোর বিয়ের কথা শুনে সে একদম চুপ হয়ে গেছে। জোর করে দিনে একবার খাওয়াতে পারে ওকে। সারাদিন নিজেকে রুমবন্ধি করে রাখে। প্রিয়ম অনেক কস্ট করে জানতে পেরেছে প্রিয়া তোকে ভালোবাসে। আজকে সকালে প্রিয়ম বললো প্রিয়ার নাকি জ্বর হয়েছে। কিছু খেতেও পারছে না। বারবার কি যেনো বিড়বিড় করে।
জারিফ অবাক হয়ে বলে,
–বিশ্বাস কর দোস্ত, প্রিয়ার সাথে আমি কখনো এমন কোনো বিহেভ করিনি যাতে সে আমাকে পছন্দ করে। তবে তোর বিয়ের সময় দেখেছিলাম সে বারবার আমাকেই দেখে। এজন্য আমি ওর সামনে যাতে না পরি সেটার দিকে খেয়াল রেখেছি। আমি চাইনি কারো হার্ট ব্রেক হোক।
সানাফ হুট করে বলে,
–বিয়ে করবি প্রিয়াকে?
জারিফ হতভম্ব হয়ে যায়। তা দেখে সানাফ বলে,
–প্রিয়া আপ্রাণ চেষ্টা করবে তুই যেনো প্রেমার জন্য কস্ট না পাস। আমার দুই বোনের স্বভাব একই রকম। প্রেমা অবশ্য ম্যাচিওর প্রিয়ার মতো হয়নি। তবে ওদের দুজনের ম্যাচিওর হবার জন্য দুইজন পুরুষ দায়ি। প্রেমা দেড় বছর আগে অনুরাগের নামে মিথ্যে খবর রটার পর নিজেকে আড়াল করেছিল অনুরাগের থেকে। তবে প্রেমা তখন প্রিয়ার থেকে বড় ছিল আর ভার্সিটিতে আস্তে আস্তে প্রেমা নিজের গন্ডি তৈরি করে ফেলেছিল। তাই প্রেমারটা আমাদের সামনে প্রকাশ পায়নি। এখন তুই এটাও বলতে পারিস যে প্রিয়া আস্তে আস্তে নিজেকে সামলে নিবে! তবে তুই তো একদিন না একদিন পরিবারের চাপে হলেও বিয়ে করবি। তোর বাবা-মা তাদের একটা মাত্র ছেলেকে বৈরাগীর মতো থাকতে তো দিবে না। জোর করে হলেও বিয়ে দিবে। এখন সেই বিয়েটাই প্রিয়াকে করলে কি সমস্যা? প্রিয়া অন্তত নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে পাক। আমাকে স্বার্থপর ভাবতেই পারিস। তবে আমি তোর দিকটাও চিন্তা করছি কিছুটা।
জারিফ চুপচাপ সবটা শুনলো। উত্তর তার জানা নেই। এটা সেও জানে তাকে একদিন না একদিন বিয়ে করতে হবে। কিন্তু আগে নিজের মনটাকে শক্ত করতে হবে তো।
সানাফ উঠে দাঁড়ায় তারপর জারিফকে উঠিয়ে বলে,
–চল!
জারিফ অবাক হয়ে বলে,
–কোথায়?
সানাফ বলে,
–যেখানে গেলে তুই তোর প্রশ্নের উত্তর পাবি।
সানাফ জারিফকে নিয়ে যায়। জারিফও পিছু পিছু চলতে থাকে। সানাফ নিজের বাইকে করেই জারিফকে অফিস থেকে নিয়ে এসেছে। এখন বাইকে করেই জারিফকে নিয়ে প্রিয়াদের বাসায় যায়। কলিংবেলের শব্দে প্রিয়ার মা দরজা খুললে তিনি সানাফ ও জারিফকে দেখে অবাক হয়। জারিফও অবাক হয়। সে এতোক্ষন সানাফকে অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছে তারা কোথায় যাচ্ছে? কিন্তু সানাফ বলেনি।
জারিফ ও সানাফ প্রিয়ার মাকে সালাম দেয়। প্রিয়ার মা সালামের জবাব দিয়ে ভেতরে আসতে দেয়। সানাফ তার চাচিকে বলে জারিফকে নিয়ে প্রিয়ার রুমে যায়। প্রিয়ার মা ওদের জন্য নাস্তা বানাতে জলদি করে রান্নাঘরে যায়।
সানাফ আগে প্রিয়ার রুমে ঢুকে দেখে প্রিয়া বিছানায় শুয়ে এক দৃষ্টিতে খোলা ব্যালকনি দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ঘরে যে কেউ এসেছে তাতে তার খেয়াল নেই।
জারিফ সানাফের পিছু পিছু প্রিয়ার রুমে ঢুকেনি। সে বাহির থেকে দরজার খোলা অংশ দিয়ে প্রিয়ার রুমের একাংশ দেখছে। রুমের দেয়াল একপাশেরটা গোলাপি আবার আরেকপাশে অফহোয়েট। অফহোয়েট অংশের কিছুটা দেখা যাচ্ছে সেখানে গাছের লতা-পাতা, পাখি, ফুল এসব আঁকা। আর গোলাপি অংশে দেয়ালে প্রজাপতি ও আরো কিছু লাগানো যা দেখা যাচ্ছে না।
সানাফ পেছোন ঘুরে দেখে জারিফ রুমে ঢুকছে না তাই সে আবার বাহিরে গিয়ে জারিফকে টেনে ভিতরে নিয়ে আসে।
জারিফকে প্রিয়ার পড়ার টেবিলের চেয়ারে বসতে বলে সানাফ প্রিয়ার পাশে বসে প্রিয়ার মাথায় হাত রাখে। হকচকিয়ে উঠে প্রিয়া। তারপর পাশে সানাফকে দেখে কিছু বলতে নিবে তার আগেই পড়ার টেবিলের ওখানে জারিফকে দেখে অনেকটা চমকে যায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কার্টেসি ছাড়া কপি করবেন না।