প্রেমানুরাগ পর্ব-৫
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথি
শিলিগুড়িতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা পার হয়ে যায়। প্রেমা ক্লান্ত থাকায় ঘুমিয়ে পড়ে। অনুরাগকে আর জানানো হয় না। মধ্য রাতে ঘুম থেকে উঠে যখন মনে পড়ে তখন মোবাইলের নেট অন করে সে তাজ্জব হয়ে যায় কারন,
অনুরাগ তার অফিসিয়াল পেজ থেকে ম্যাসেজ করেছে।
“এই রাজরানী! এতো ভুলোমনা কেনো তুমি? আমাকে অপেক্ষা করাতে বুঝি আনন্দ পাও? তোমাতে আসক্ত বলে আজও তোমার জন্য আমি নিদ্রাহীন রাত কাটাই। ভালো নাহয় নাই বাসলে! শুধু একবার আমার মনের শহরে ঘুরে যাও। যেখানে সর্বতো তুমি নিজেকে খুঁজে পাবে।”
প্রেমা কেঁপে উঠে এক অন্যরকম ভালো লাগায়। ক্ষুদে বাত্রার মাধ্যমে কারো মনের অনুভূতি পুরোপুরি ব্যাক্ত করার প্রচেষ্টা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত ৩টা বাজে। এখন কি অনুরাগ জেগে আছে? এই নিয়ে সংশয় আছে। পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে মহানন্দা নদীর তীরে শহরটিতে এখন গভীর রাতের নৈসর্গিক সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে। রুমের সাথে এটাচড ব্যালকনি নেই তাই জানালার কাছে থাইয়ের পর্দা সরিয়ে সেখানে চেয়ার টেনে বসে মগে কফি পাউডার ঢেলে ফ্লাস্ক থেকে গরম পানি নিয়ে কফি বানিয়ে ফেলে। জানালার থাই গ্লাসে শিশির বিন্দু জমা হয়েছে।
ব্লক লিস্ট থেকে অনুরাগকে আনব্লক করলো প্রেমা। তারপর টেবিলের উপর মোবাইল রেখে চুপ করে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে। নিস্তব্ধতার মাঝে শীতল আবহাওয়া ও সাথে গরম কফি! কম্বিনেশনটা প্রিফারেবল। তবে কফিটা ধোঁয়া উঠানো হলে জমতো ভালো। রুমে রুম হিটার নেই। সময়টা তো ডিসেম্বরের লাস্টে তাই শীত এখনো ঝেঁকে পড়েনি। জানুয়ারির মাঝামাঝিতে শীত বেশি পড়ে।
কফির মগ খালি হবার পর পরই অনুরাগ মেসেঞ্জারে কল করে। প্রেমা ঘড়িতে দেখে রাত ৩.২০ মিনিট। এতো রাতে অনুরাগ জেগে আছে বলে সে অবাক হয়না কারন অনুরাগের অভ্যাস জানা আছে। অনুরাগ রাত জেগে নেটফ্লিক্সে মুভি দেখে, পাবজি গেম খেলে ইত্যাদি। অনুরাগ কল করে চুপ করে আছে। প্রেমাই প্রথমে বলে,
–আপনি কিভাবে জানলেন আমি ব্লক খুলেছি? আর এই মধ্যরাতে আপনি এখনো জেগে জেগে মুভি দেখছেন?
অনুরাগ বিমোহিত স্বরে বলে,
–যার অপেক্ষায় ক্লান্ত পথিক আমি! তার জন্য জেগে থাকাতেও ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে। তোমার ইনবক্সেই বসে ছিলাম। আগের ম্যাসেজ গুলা পড়ছিলাম।
–ওহ আচ্ছা। এখন ঘুমিয়ে পড়ুন। নাকি ফজরের পর ঘুমাবেন? আচ্ছা, আপনি কি নামাজ পড়েন? না মানে মিডিয়াতে মুসলিম এক্টর ও একট্রেসদের দেখি নামাজ পড়ে কালেভদ্রে। এমনটা শোনা যায়। আর তারা নামাজ পড়লে সবাইকে জানিয়ে পড়ে! ব্যাপারটা আমার ভালো লাগে না। নামাজ হচ্ছে ইবাদাত। সেটাও কেনো সপ্তাহে একদিন পড়ার পর আবার মানুষকে জানাতে হবে? যার যার আমলের হিসাব সে সে দিবে। এভাবে জানিয়ে নিজেদের মুসলিম প্রমান করার কি আছে?
প্রেমার অনবরত কথায় অনুরাগ খানিকটা হাসে। তারপর বলে,
–সবাই কিন্তু করে না। কয়েকজন করে। আর আমি প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত পড়ি না তবে তিন বা চার ওয়াক্ত পড়ি। আমি কিন্তু এগুলো মানুষকে জানিয়ে বেড়াই না। যাদের জানাতে ভালো লাগে তারা করে। ওদের তো কিছু বলতে পারবো না।
প্রেমা চুপ করে থাকে তারপর বলে,
–পাঁচ ওয়াক্ত পড়ার চেষ্টা করবেন। আর রোমান্টিক মুভি কম করবেন। পারলে করবেন না। আপনার মায়ের মতো ইনসিকিউরিটিতে থাকতে চাই না আমি।
অনুরাগ হতাশ হয়ে বলে,
–মুভি তো করি বাবার বানানো গুলো। দুইটা অন্য প্রডাকশন হাউজ থেকে অফার এসেছে। এখন তারা মুভির ধরন বললে আমি রাজী হতে পারি। বেশি মুভি করবো না। আমি একটা ব্যাবসাতে শেয়ার রেখেছি ৫০% এর। ওটা লন্ডনে। বাবা জানে না ওটার ব্যাপারে। দুই বন্ধু মিলে শুরু করেছিলাম। এখন দেখা যাক কি হয়।
–হু।
অনুরাগ আবার বলে,
–তোমার মোবাইল নাম্বারটা দেও। ইন্ডিয়াতে আর কয়দিন আছো?
প্রেমা বলে,
–নাম্বার টেক্সট করে দিয়েছি। পরশু সকালে কলকাতা রওনা হবো। কলকাতা গিয়ে মিমের বিয়ের জন্য বেনারসি কিনবো। মূলত ঘোরাফেরার সাথে শপিং করতে এসেছি। মিমের সাথে সারিফের বিয়ে। ওদের বাবা-মা স্টুডেন্ট থাকা অবস্থায় ওদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে যাতে ওদের মাথায় খারাপ কিছু না আসে। ওদের ফ্রেন্ডশিপ ছোট থেকে।
অনুরাগ খুশি হয়ে বলে,
–ওয়াও। ফ্রেন্ডশিপ থেকে বিয়ে। তোমার আমার বিয়ের কথাটা পাবলিক করলে আমিও শ্যালিকা ও শ্যালকের বিয়ে খেতে পারবো।
প্রেমা ভয় পেয়ে যায়। সে আন্দাজও করতে পারছে না এই বিয়ের পরিনতি! ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,
–অনুরাগ! আমার বাবা-মা যদি না মানে? প্লিজ বিয়ের খবর পাবলিক করবেন না।
অনুরাগের মাথায়ও আসেনি প্রেমার পরিবারের কথা। সত্যি তো! যদি তারা না মানে? তাও অনুরাগ প্রেমাকে স্বান্তনা দিয়ে বলে,
–আরে টেনশন করো না। তারা মেনে নিবে।
প্রেমা চুপ করে থাকে। তার বাবা-মা কতোটা রক্ষণশীল তা সে জানে। ইন্ডিয়াতে আসতে কতোটা কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। হ্যাঁ, স্বাধীনতা দেয় তবে গন্ডির ভেতরে। এখন সবটা জানাজানি হলে যে কি হবে!
প্রেমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না বলে কল কেটে দেয় অনুরাগকে বলে। দুইজন দুইদিকে টেনশনে ব্যাস্ত।
পরেরদিন,,
সকাল সাড়ে দশটায় ওরা টয় ট্রেন রাইডে শিলিগুড়ি জাংশন থেকে উঠে। পাহাড়ি দৃশ্য দেখতে দেখতে রংতঙ্গে যায়। ট্রেনে থেকেই জঙ্গল ঘুরা যায়। সাড়ে ১২ টার পর শিলিগুড়ি জাংশনে আবার ফিরে আসে।
দুপুরের খাবারের পর রিভার র্যাফটিং দেখতে যাবে। ছেলেরা র্যাফটিং করতে চায় তবে মেয়েরা রাজী না। অনেক স্রোত এখানে। সারিফ বহু কষ্টে মিমকে রাজী করিয়েছে। বলেই নিযেছে বেশিক্ষণ র্যাফটিং করবে না। হঠাৎ প্রেমার ফোনে ম্যাসেজ আসে।
“তুমি রিভার র্যাফটিং করতে চাও? চাইলে বলো। আমি রেডি আছি।”
প্রেমা আচানক অনুরাগের এরকম ম্যাসেজ পেয়ে আশেপাশে খুঁজতে থাকে। কাল তো বলেনি যে অনুরাগ শিলিগুড়িতে আছে! আবারো প্রেমার কাছে ম্যাসেজ আসে,
“ওদেরকে বলে দেও ওরা ছয়জন যেনো র্যাফটিং করে। তুমি করবে না। তারপর আমি এসে তোমার সাথে যাবো।”
প্রেমা কিছুই বুঝতেছে না। অনুরাগকে দেখাও যাচ্ছে না। প্রেমা অনুরাগের কথা মতো ওদেরকে বলে। ওরা রাজী হয় না প্রথমে। প্রেমা বহু কস্টে রাজী করিয়ে অনুরাগের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
তিন মিনিটের মাথায় অনুরাগ তার দুই গার্ডকে নিয়ে হাজির হয়। প্রেমা অনুরাগকে চিনতে পারেনি প্রথমে। এতোটা কভার করেছে নিজেকে! ওরা চারজন একসাথে একটা বোটে উঠে। স্রোতের কারনে বোট যেই হারে দুলছে, প্রতিবার প্রেমা ভয়ে অনুরাগকে খামচি দিয়ে ধরছে আর অনুরাগ হেসে উঠছে। বডিগার্ড গুলো ওদের কয়েকটা ছবি তুলে দেয়।
সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে ওরা হোটেলে ফিরে। সারাদিন ট্রাভেল করে ওরা সন্ধ্যার পর রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কালকে মহানন্দা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারিতে যাবে। সেখানে কিছুক্ষনের জন্য থেকে চা বাগান ট্যুর দিবে তারপর সন্ধ্যা ৬টায় কলকাতা যাবার জন্য বাস ছাড়বে। সেই বাস কলকাতা নামাবে পরেরদিন ভোর ৬টা নাগাদ।
অনুরাগও নাকি সাথে যাবে তবে সে নিজের গাড়িতে করে যাবে সাথে একজন ড্রাইভার ভাড়া করেছে।
________
কলকাতা নেমে ওরা একটা হোটেলে ওঠে ঘন্টা তিনেক ঘুমিয়ে নিয়ে প্রথমেই হাওড়া ব্রিজ দেখতে বেড়িয়ে পরে। তারপর কেনাকাটা করে কিছু। মার্কেট এড়িয়া থেকে চিকেন বিরিয়ানি খেয়ে নেয় দুপুরে। বিকেল বেলা হাওড়া ব্রিজে অনেক ভীর থাকে তবে সুন্দর বেশি লাগে তখন। তাই ওরা সবাই বিকেল বেলা সেখানে যায়। ওরা নৌকা রাইড করতে চায়। মানুষ ৭জন। অর্ষা, শান্ত ওরা প্রেমাকে নিজেদের সাথে যেতে বলে কিন্তু অনুরাগ তো প্রেমাকে আগেই বলে রেখেছে ওর সাথে যেতে।
প্রেমা ওদের বুঝিয়ে শুনিয়ে পাঠিয়ে দিয়ে অনুরাগের অপেক্ষা করতে থাকে। অনুরাগ ম্যাসেজ করে,
–নেমে আসো। আমি সামনের নৌকাতে বসে আছি।
প্রেমা সেখানে যায়। তারপর অনুরাগ তো নৌকা চালাতে পারেনা। সে মাঝি নিয়েছে সাথে। প্রেমা রম্য স্বরে বলে,
–আচ্ছা, আপনি কি আমাকে ফলো করছেন? না মানে যেখানেই যাই সেখানেই আপনি!
অনুরাগ প্রেমার ছবি তুলতে তুলতে বলে,
–আমার বউকে আমি খেয়াল রাখতেছি মাত্র। এতে তোমার সমস্যা কি?
প্রেমা ভ্রুঁ উঁচিয়ে বাঁকা চোখে তাকায়। অনুরাগ তা দেখে হেসে দেয়। সাথে প্রেমাও অনুরাগের হাসি দেখে হেসে ফেলে। অনুরাগের বাম গালে টোল পরে হাসলে। তখন বেশি সুন্দর লাগে।
কলকাতায় ওরা কেনাকাটা ছাড়া থাকবে না। পরেরদিনই আগ্রার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ইন্ডিয়াতে আমার যাওয়া হয়নি তবে বাবার মুখে যেটুকু শুনেছি আর গুগুল করে যা জেনেছি তাই লিখছি। ভুল হলে ক্ষমা করবেন। ভ্যাকসিন দিয়ে অসুস্থ হয়ে গেছিলাম।