প্রেমানুরাগ পর্ব-৯

0
828

#প্রেমানুরাগ পর্ব-৯
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথি

দেখতে দেখতে আরো দুই মাস কেটে গেছে। অনুরাগ ও প্রেমার সম্পর্ক এখনো সিক্রেটলি চলছে। প্রেমার ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান একটু পিছিয়েছে কারন প্রেমা, সিয়া, ইশা, প্রিয়া এদের সেমিস্টার পরিক্ষার পরই অনুষ্ঠান হবে। এপ্রিলে প্রেমা ও ইশার থার্ড ইয়ারের লাস্ট সেমিস্টার আর সিয়ার সেকেন্ড ইয়ারের লাস্ট সেমিস্টার শেষ হবে। প্রিয়ার প্রথম সেমিস্টার শেষ হবে।

এদিকে প্রিয়মেরো মাস্টার্স শেষ হবে মে মাসের পরে। প্রিয়ম ইশাকে ভালোবাসার কথা বলবে বলবে ভাবছে। তবে সে ইশার ভাবসাব বুঝতে পারেনা। জারিফকে সানাফ বুঝিয়েছে। সানাফ এই বলেছে,
“যদি প্রেমা ভুল কাউকে ভালোবাসে আর তারপর নিজে নিজের জীবন সঙ্গী নির্বাচন করতে না পারে তখন হয়তো তোর ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে।”

জারিফ সেই আশাও রাখেনা। প্রেমার ভালোবাসা পূর্ণতা পেলে তো জারিফ মিছিমিছি কষ্ট পাবে। এর থেকে নিজের মনকে কাজে ব্যাস্ত রাখা ভালো।

অনুরাগ প্রেমাকে ভিডিও কলে তার আলমারি দেখাচ্ছে। যেখানে প্রেমার জন্য শাড়ি, লং ফ্রক, থ্রিপিস সাঁজানো। প্রতিটা আইটেম পাঁচ পিস করে। শাড়ি পাঁচটা, লং ফ্রক পাঁচটা, থ্রিপিস পাঁচটা। এগুলো কিনেছে নিজের পছন্দে তবে সেটারো কাহিনী অনেক!
ছদ্নবেশে মার্কেটে গেছে সাথে এক ভারতীয় বডিগার্ড। বডিগার্ডের একাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করেছে যাতে শপিংমলে কেউ বুঝতে না পারে। নিজের ক্রেডিট কার্ড দিলে তো বিক্রেতা বুঝে যাবে। আর মেয়েদের পোশাক যে কিনছে তাতে আরেকটা নিউজ বের হবে! সবদিকেই ঝামেলা।

প্রেমা এগুলো শুনে হাসতে হাসতে কলই কেটে দিছিলো। অনুরাগ বলছে সে বাংলাদেশে আসতে চাচ্ছে কিন্তু নতুন মুভির কাজ শুরু হয়ে গেছে। মুভির কাজ করতে ছয় মাস তো লাগবেই। মাত্র ২০ দিন কাজ করেছে।
প্রেমা অনুরাগকে জারিফের কথাটা বলেছে। প্রেমার ভাষ্যমতে,
প্রেমার সন্দেহ হয় যে জারিফ প্রেমাকে পছন্দ করে। দুইদিন আগে জারিফ কিসের জন্য জানি সানাফের সাথে দেখা করতে এসেছিল তখন প্রেমা ভার্সিটি থেকে ফিরেছে সবে। সানাফ বাসায় ছিল না বলে প্রেমার বাবার সাথে ড্রয়িংরুমে বসে কথা বলছিল। প্রেমা তখন বাড়িতে ঢুকলো তারপর সে জুতা খুলে রেখে জারিফকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করে বাবাকে পত্রিকার বিলের কাগজটা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলো জারিফ কেমন করে যেনো তাকিয়ে আছে। এরপর ও ফ্রেশ হয়ে আসার পর ওর মা যখন নাস্তা দিয়ে পাঠালো তখনও কেমন করে তাকিয়েছিল।

এসব অনুরাগকে বলার পর অনুরাগ বলে,
–তুমি উনার থেকে দূরে থাকবে। সে সম্পর্কে তোমার ভাইয়ার সমন্ধি। তোমার পরিবার যদি কোনো উল্টা পাল্টা ডিসিশন নিয়ে নেয়! এখন তো আমারি ভয় হচ্ছে। তুমি সাবধানে থাকবা। বেয়ান হিসেবেও কথা বলবা না ওই লোকের সাথে।

প্রেমা অনুরাগের ভয় ও চিন্তা দেখে মুচকি হেসে বলে,
–আরে ভয় পেয়ো না। আমি ভাইয়াকে বলে রেখেছি। ভাইয়া সামলে নিবে তবে তোমাকে একটু মিডিয়ার গুজব থেকে বেঁচে থাকতে হবে। তোমাকে ওরা মেনে নিলেই হলো।

ওদের প্রতিদিন ভিডিও কলে কথা বলা অভ্যাস হয়ে গেছে।

________

সানাফ ও সিয়ার বিয়ের অনুষ্ঠান। প্রেমা, ইশা ও প্রিয়া যথাক্রমে কমলা, নীল ও মেরুন রঙের কাঞ্জিভরমের শাড়ি পড়েছে। শাড়ির সাথে একটু হালকা করে পার্টি মেকওভার। কমলা রঙটা প্রেমার গায়ে মানিয়েছে। মেরুনটা নিতে চেয়েছিল কিন্তু প্রিয়ার পছন্দ হওয়ায় আর নিতে পারেনি। প্রিয়ম ইশাকে দেখে ডিজাইনার নীল পাঞ্জাবী পড়েছে। ইশা কেমন যেনো লাজুক হাসছে প্রিয়মকে দেখে। সেন্টারে এসে প্রিয়ার চোখ শুধু জারিফকেই খুঁজছে। বর বরণের সময় এক ঝলক দেখেছে তারপর আর দেখা নাই। জারিফ তো বোনের বিয়ের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

ছেলে পক্ষের জন্য খাবারের টেবিল গুছানোর দিকে তদারকি করছে জারিফ। প্রিয়া সেদিকে যায়। জারিফের পড়নে কালো ও মেরুন মিশেলে পাঞ্জাবী। প্রিয়া গিয়ে জারিফকে পেছোন থেকে বলে,

–আপনার ও আমার ড্রেসের রঙ অনেকটা মিলে গেছে। আসুন সেই খুশিতে একটা সেলফি তুলে নেই!

জারিফ কারো এরূপ কথায় ঘুরে দাঁড়ায়। তারপর দেখে একটা মেয়ে। জারিফ চিনতে পারছে না বলে কনফিউজড হয়ে বলে,

–স্যরি মিস! আমি আপনাকে চিনতে পারছি না।

প্রিয়া গাল ফুলালো বাচ্চাদের মতো। তারপর ঠোঁট উল্টে বলে,
–আমি প্রিয়া। সানাফ ভাইয়ের কাজিন।

জারিফ এবার চিনতে পেরেছে। বিয়ে বাড়িতে সে আসলে কোনো মেয়েকে খেয়াল করেনি। এমনকি প্রেমাকেও না। খেয়াল করলেও চিনতে বেগ পেতে হতো। জারিফ এবার হাসিমুখে বলে,

–ওহ আপনি! আমি ভেবেছিলাম..

জারিফকে বলতে না দিয়ে প্রিয়া বলে,
–কি ভেবেছিলেন?

জারিফ হেসে ফেলে মেয়েটার চঞ্চলতায়। আর প্রিয়া মুগ্ধ নয়নে চোখে হাসা ছেলেটাকে দেখছে। স্নিগ্ধ সেই হাসি প্রিয়ার কাছে। জারিফ বলে,

–সত্যি বলতে, পার্লারে যে ঢোকে সে বের হয়না।

প্রিয়া কনফিউজড হয়ে বলে,
–এ্যাঁ!

জারিফ মুচকি হেসে বলে,
–এই যেমন, আপনি এক বাচ্চা মেয়ে পার্লারে ঢুকেছেন আর বের হয়েছেন এক পূর্ণ বয়স্ক রমণীর সাঁজে!

প্রিয়া সলজ্জ হাসে। তারপর খানিকটা অভিমানী হবার ভান করে বলে,
–আমি পিচ্চি! আপনি আমায় পিচ্চি বলতে পারলেন? আপনি জানেন আমি কত্তো বড়!

জারিফ দুহাতের ভাঁজ থেকে এক হাত নিজের থুতনিতে নিয়ে বলে,
–নাতো! আমি তো জানি আপনি পিচ্চি। একটা দুষ্টু আদুরে পিচ্চি। চোর পিচ্চিও বলা চলে!

প্রিয়া হা করে চোখ ছোট ছোট করে বলে,
–কি বললেন আপনি? আমি চোর পিচ্চি! আমাকে কোন দিক দিয়ে পিচ্চি লাগে আপনার কাছে?

জারিফ চিন্তিত সুরে বলে,
–উমম! সব দিক দিয়েই। পুরোটাই তো পিচ্চি!

প্রিয়া এবার কাঁদো কাঁদো মুখ করে ফেলে। ভালোবাসার মানুষটার চোখে নিজেকে পিচ্চি লাগে ভাবতেই তার কান্না পাচ্ছে। আজ ওরই জোড়ালো ইচ্ছেতে ওরা তিন বোন শাড়ি পড়েছে। আর প্রেমার খালাতো বোন সাদিবা মাত্র ক্লাস সেভেনে পড়ে। প্রেমার ফুপির কোনো মেয়ে নেই। ফুপির দুই ছেলে তাও দুইটার একটা কলেজে পড়ে আরেকটা নাইনে পড়ে। প্রিয়া কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,

–আমার বয়স ১৯ বছর ১মাস। আমাকে আপনি পিচ্চি বলতে পারেন না। আমি এডাল্ট। বিয়ের বয়স হয়ে গেছে আমার। এখন বিয়ে দিলে আমার নিজেরি কয়েকটা পিচ্চি থাকবে।

জারিফ অবাক হবার ভান করে বলে,
–ওমা! আপনি এতো বয়স্ক! আমারো তো এতো বয়স না। মাত্র ২৭ বছর ৫ মাস!

প্রিয়া বাঁকা চোখে তাকায়। তারপর বলে,
–মানলাম আমি ছোট। তাই বলেকি একটা ছবি তোলা যায় না?

জারিফ হেসে বলে,
–হ্যাঁ, যায়। আচ্ছা আসেন ছবি তুলি।

কাছের এক ক্যামেরাম্যানকে ডেকে জারিফ প্রিয়ার সাথে ছবি তোলে দুইটা। তারপর প্রিয়া ক্যামেরাম্যানের থেকে নিজের ফোনে ছবি নিয়ে নেয় আর জারিফের সাথে আরো দুইটা সেলফি তোলে। এবার জারিফ বলে,

–শুধু মাত্র ড্রেসের কালার মিলাতেই ছবি তুললেন! ওই দেখুন আমার খালাতো ভাই রাতুলের সাথে আপনার ড্রেসের কালার পুরো মিলে গেছে। তো ওর সাথেও তোলেন।

প্রিয়া ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। সামনো তাকিয়ে দেখে আসলেই মিলে গেছে। প্রিয়া আমতা আমতা করে যুক্তি মিলিয়ে বলে,

–উনাদের তো আমি চিনি না। আপনাকে চিনি বলেই তুলেছি। নাহলে তুলতাম না। ছবি তুলতে না চাইলে বলে দিলেই পারতেন। আমি কিছু বলতাম না। আমি বিয়ে বাড়িতে পরিচিত সবার সাথেই ছবি তুলেছি তাই আপনার সাথেও তুলতে এসেছিলাম। থাকেন আপনি এখানে। তুলবো না ছবি। হুহ!

প্রিয়া এতোগুলা কথা বলে সোখান থেকে কেটে পরে। জারিফ বোকার মতো সেখানেই দাঁড়িয়ে রয়।

________বিয়ের পর্ব শেষ হয়ে সন্ধ্যার সময় কনে বিদায়ের সময় আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কান্নারত নয়নে সিয়াকে ওর বাবা বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ির জন্য বিদায় দেয়।

প্রিয়ম, সাদিব (সানাফের খালার ছেলে) ও সানাফের বন্ধুরা তাড়াতাড়ি চলে গেছিলো সানাফের রুম সাঁজানোর জন্য। সানাফের মাও বাড়িতে ছিলেন সেও সাহায্য করবে ওদের।

রাত ৭.৩০ এ ওরা বউ নিয়ে বাড়ি ফেরে। প্রেমা ও ইশা সিয়াকে প্রেমার ঘরে নিয়ে যায় ফ্রেশ হবার জন্য। প্রেমা একটু রিল্যাক্সে আজকের নিজের সব ছবি অনুরাগকে হোয়াটসএপে দিয়ে দেয়। সবাই ফ্রেশ হয়ে নেয়। তারপর কিছু নিয়ম পালন করে রাত ৯.৩০ টায় সিয়াকে সানাফের ঘরে রেখে আসে।

বেচারি সিয়া দুই ঘন্টা ঘরের মধ্যে বসে ছিল তার মধ্যে মাঝে মাঝে প্রিয়া এসে বকবক করে গেছে।
আজকে প্রিয়া ঘুমাবে না। মোবাইলে জারিফের সাথে তোলা ছবি গুলাই বারবার দেখছে। আর প্রেমা ব্যালকনিতে গিয়ে অনুরাগের সাথে কথা বলছে। ইশা রুমে নেই। ইশাকে প্রিয়ম ছাদে ডেকেছে। ইশা ছাদে গিয়ে দেখে অন্ধকার ছাদে কারো থাকার আভাস নেই তাই সে চলে আসতে নিলে দেখে হঠাৎ গিটারের সুর ভেসে আসছে। থমকে দাঁড়ায় ইশা। আস্তে আস্তে সুরটার সাথে কারো পদধ্বনি পেছোন থেকে অগ্রসর হচ্ছে। ভয় হচ্ছে আবার অদ্ভুত মোহনীয় লাগছে।
সুরটা থেমে যায়। তার সাথে পদধ্বনি। তবে নিঃশ্বাসের শব্দ খুব নিকট থেকে আসছে। মনে হচ্ছে কেউ ইশার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ইশা আচমকা পেছোনে ঘুরলে কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে হকচকিয়ে পরে যেতে নিলে কেউ একজন আগলে নেয়। আর সেই মানুষটার মুখশ্রী আবছা প্রদীপের আলোতে কিছুটা স্পষ্ট। স্বস্তি পায় ইশা কারন মানুষটা তো প্রিয়ম।
যেখানে এতোক্ষন অন্ধকার ছিল সেখানে এখন একটা মাঝারি সাইজের লাভ সেপ করা প্রদীপ দিয়ে। আশেপাশের ওয়ালেও প্রদীপ জ্বলানো। ইশা অবাক হয়ে দেখছে সব। এখনো যে সে প্রিয়মের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ সেই খেয়াল নেই তার।

নিস্তব্ধ নিরবতায় হঠাৎ পুরুষালী কন্ঠে ইশা শুনতে পায়,

“ভালোবাসি প্রেমময়ী!”

স্তব্ধ হয় ইশা। মনে হচ্ছে তার পৃথিবী থমকে গেছে।

______
ব্যালকনিতে দোলনাতে বসে প্রেমা অনুরাগের সাথে কথা বলার মধ্যে কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া অনুরাগ প্রেমার উদ্দেশ্য ছন্দ কাটে,

“অমাবস্যার পর আকাশে যখন পূর্ণ চাঁদের তিথি,
শত তারাদের মাঝে হবে কি তুমি আমার রাজরানী!”

মোহনীয় কন্ঠস্বরে মোহিত প্রেমা। তার হৃদয়রাজ আজ কাব্যিক রূপ নিয়েছে। প্রেমাও লাজুক স্বরে বলে,

“তোমার অনুরাগে আজ আমি রাগিণী!
শুধু বলবো ভালোবাসি!”

এক প্রেমপ্রহরে তিন আবদ্ধ জুটি ও দুজন বিচ্ছিন্ন ত্রিকোণ ভাবনায় মত্ত!

চলবে ইনশাআল্লাহ,

ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কার্টেসি ছাড়া কপি করবেন না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here