শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
Part_46
#Writer_NOVA
গোসল করে ড্রেস পরে নিলাম। হালকা পাতলা সেজে বাইরে বেরিয়ে এলাম। দুপুরের খাবারের বৈঠক বসে গেছে। মেহমানরাও অনেকে এসে পরেছে। আরো আসবে। তায়াং ভাইয়া, এনাজ, সামাদ ভাইয়া, মুহিন আমার এক ফুপাতো ভাই আরো অনেকে খাবারের টেবিলে তদারকি করছে। ভাবীকে পার্লারের মেয়ে সাজাচ্ছে। সাজগোজ প্রায় শেষ পর্যায়। সে ঘর থেকে একটু ঘুরেফিরে বাইরের উঠনো হাঁটতে লাগলাম। খাবারের পর্ব আমাদের বহু আগে শেষ হয়ে গেছে। এখন শুধু আমাদের কাজ পুরো বাড়ি চক্কর মারা।তায়াং ভাইয়া কাজের ফাঁকে আমার সামনে দৌড়ে এসে দুটো মোবাইল দিয়ে বললো,
— শাঁকচুন্নি এই দুটো তোর কাছে রাখ। হারালে কিন্তু তুই জরিমানা দিবি। তাই সাবধানে রাখিস।
— পারবো না আমি। আমার ঠেকা পরে নাই। পকেটে রাখলেই তো হয়। আবার আমার কাছে রাখার কি দরকার?
— রাখতে বলছি রাখবি। এত কথা বলিস কেন?
— আমি পারবো না রাখতে। আমার হাত ব্যাথা করবে। তিনটা মোবাইল নিয়ে ঘুরবো আমি।
ভাইয়া কোন কথা না বলে মোবাইল দুটো জোর করে আমার হাতে দিয়ে প্যান্ডেলের দিকে দৌড়ালো।আমি, নূর আপি ও তন্বী একসাথে সারা বাড়ি কারণ ছাড়াই এদিক সেদিক ঘুরছি। ইভা, অনন্যা,অর্থি বউয়ের সামনে বসে আছে। আমার পরনে আজ এ্যাশ কালারের গাউন। সাথে সেম কালারের হিজাব বেঁধেছি। এনাজের পরনে দেখেছিলাম ডিপ ব্লু কালার শার্ট, কালো প্যান্ট। শার্ট ইন করে পরা। পায়ে সু জুতা। তায়াং ভাইয়াও সেম ড্রেসআপ। শার্টের কালারটা শুধু ভিন্ন,শ্যাওলা কালার।এরা দুই বন্ধু একরকম পরতেই বেশি পছন্দ করে।
আমরা উঠোনের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছি। এনাজ জগ ভর্তি পানি নিয়ে আমাদের সাইড কাটিয়ে টেবিলের দিকে চলে গেলো। আমি তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে তন্বীকে জিজ্ঞেস করলাম,
— এই তন্বী উনি না একটু আগে ডিপ ব্লু কালার শার্ট পরেছিলো। এখন আবার এ্যাশ কালার কেন?
— সত্যিই তো। আমি তো খেয়াল করিনি নোভাপু।
নূর আপি টিটকারির সুরে তন্বীকে বললো,
— আরে বুঝিস না কেন? তার প্রেয়সীর সাথে ম্যাচ করে শার্ট পরেছে। আগেরটা তো ম্যাচিং ছিলো না তাই পাল্টে ফেলেছে।
তন্বী নূর আপিকে বললো,
— একদম ঠিক বলেছো। দুজনের কি মিল তাতো দেখতেই পাচ্ছি। যাকে বলে ভালুপাসার প্রতিক্রিয়া।
— নোভার মুড কিন্তু সকাল থেকে আজ আমি অনেক খুশি খুশি দেখছি তন্বী। ঘটনা কি রে নোভা? কি চলছে তোর মনে? এনাজ ভাই কি এমন বললো যার জন্য সকাল থেকে তোকে অনেক খুশি দেখাচ্ছে।
আমি শান্ত দৃষ্টিতে নূর আপির দিকে তাকিয়ে বললাম,
— ভাইয়ের বিয়েতে তো মন এমনি খুশি থাকবে। এতে এনাজের কি বলতে হবে? তোমরা যে কি বলো না।
— হইছে, হইছে আর ভাব ধরতে হবে না। এনাজ ভাই যে তোকে কত সুন্দর করে প্রপোজ করেছে তা কিন্তু তন্বী আমাকে সবই বলেছে। তাই আমার সাথে আর ভাব ধরিস না।
— আমি ভাব কোথায় ধরলাম নূর আপি! কি যে বলো না তোমরা। ধ্যাত! থাকবোই না তোমাদের সাথে।
তন্বী মুখ টিপে হেসে বললো,
— এখন আমাদের সাথে থাকবে কি করে? এখান থেকে তো এনাজ ভাইয়াকে দেখে যাচ্ছে না।
আমি মুখ বাঁকিয়ে তাদের সামনে থেকে সরে গেলাম। মনে মনে কিন্তু আমি হেব্বি খুশি। সকালে সে ভালোবাসার কথা বলার পর থেকে মনটা খুশি খুশি লাগছে। যেটা তন্বী,নূর আপি ধরে ফেলেছে। এখন তাদের সাথে বেশি সময় থাকলে আমি ধরা পরে যাবো। তাই এখান থেকে কেটে পরাই ভালো।
এনাজ যেই টেবিলে খাবারের তদারকি করছে সেই টেবিলের বরাবরি কোণায় গিয়ে দাঁড়ালাম। হাতে তিনটা মোবাইল। এনাজের মোবাইল ওন করতেই ওয়ালপেপারে আমার শাড়ি পড়া একটা ছবি দেখে থমকে গেলাম। এটা তো পূর্ণমিলনী অনুষ্ঠানের প্রথম দিনে কালো শাড়ি পরার পিক। নিশ্চয়ই তায়াং ভাইয়া দিয়েছে তাকে। হার্ড লক দেওয়া। কিছু সময় ভেবে আমার নাম টাইপ করে দিলাম। কিন্তু লক খুললো না। দুজনের নাম একসাথে মিলিয়ে দিলাম তাও খুললো না। ব্যর্থ হয়ে যখুনি মোবাইল বন্ধ করে রেখে দিলাম তখুনি এনাজ এসে বললো,
— ইংরেজীতে নোভানাজ টাইপ করো তাহলেই লক খুলে যাবে।
আমি চমকে গেলাম। হুটহাট কোথা থেকে এসে এমনভাবে কথা বলে যে আমি চমকে উঠতে বাধ্য হই।সাথে একটু লজ্জাও পেয়েছি। সে দেখে ফেলছে যে আমি তার মোবাইলের লক খোলার চেষ্টা করছিলাম। উনি আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বললেন,
— আমি যেভাবে বলছি সেভাবে টাইপ করো।N বড় হাতের তারপর ছোট হাতের ov লিখে আবার বড় হাতের A অক্ষর এরপরে ছোট হাতের na সবশেষে আবার বড় হাতের J অক্ষর।
তার কথামতো টাইপ করলে পুরো শব্দটা হয় NovAnaJ। সেটা লিখে ওকে দিতেই লক খুলে গেলো।আমি বিস্মিত চোখে তার দিকে তাকাতেই সে মুচকি হেসে বললো,
— আমাদের দুজনের নাম মিলিয়ে এই শব্দটা হয়। আমি মিলিয়ে নামটা বানিয়েছি। “নোভানাজ” নামটা কি সুন্দর তাই না?
আমি ওপর নিচ মাথা নাড়িয়ে তার কথার সায় দিলাম। উনি মুচকি হেসে প্রশ্ন করার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,
— সকালের উত্তর কিন্তু আমি এখনো পাইনি। আমি রিটার্ন উত্তর চাই। এতো সুন্দর করে আই লাভ ইউ বললাম কিন্তু তোমার কোন উত্তর দেওয়ার তোড়জোড় নেই। এটা কোন কথা হলো?
আমি গানের সুরে মিনমিন করে বললাম,
❝আমার কাছে তুমি অন্যরকম,
ভালোবাসি বেশি প্রকাশ করি কম।❞
উনি আমার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত চোখে বললো,
— রিয়েলি?
আমি আবারো তার উত্তর গানের সুরেই দিলাম।
❝সব কথা বলে না হৃদয়,
কিছু কথা বুঝে নিতে হয়।❞
— তাও মুখে স্বীকার করবে না?
আমি তার কথার উত্তর না দিয়ে মাথা নাড়িয়ে না বুঝালাম। তারপর লাজুক হেসে সেখান থেকে সরে গেলাম। ইস, এখনো লজ্জা লাগছে। সে কি ভাবলো কে জানে! পেছন থেকে এনাজ জোরে চেচিয়ে বললো,
— টিডি পোকা, আমার মোবাইলের সব ফাংশনে তুমি যেতে পারবে। কোন সমস্যা নেই।তবে গ্যালারির কোন ছবি তুমি কাটবে না। কাটলে কিন্তু তোমার জন্য সেটা মোটেও ভালো হবে না।
তার কথার আগামাথা কিছুই বুঝলাম না। তার গ্যালারীর ছবি আমি কেন কাটবো? আজব তো! যেহেতু কাটতে মানা করেছে তাহলে নিশ্চয়ই কোন কারণ তো অবশ্যই আছে।
💖💖💖
এনাজের মোবাইলে আমার দুই বছর আগের পুরনো ছবি দেখে আমি অবাকের ওপর অবাক। এগুলো যে তায়াং ভাইয়া পাঠিয়েছে তাতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।গ্যালারী ভর্তি আমার ছবি দিয়ে। এর জন্য এনাজ সাবধান করে আমাকে বললো কোন ছবি কাটতে না। এতক্ষণে পুরো বিষয় ক্লিয়ার হলো।
— রাই, একটু দাঁড়াও।
সকালের সেই শিশির ভেজা ঘাসের মাঠে যেতে নিলেই কেউ পেছন থেকে ডাকলো। সেখানে গিয়ে ঘাসের ওপর বসে কতগুলো ছবি তুলবো।রাই, শব্দটা শুনে সবার আগে রোশানের কথাটাই মাথায় আসলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি রসুন মহাশয়ই। বৌ-ভাতের অনুষ্ঠানে চেয়ারম্যান বাড়ির সবাইকে দাওয়াত করা হয়েছে। সে তো অবশ্যই আসবে। আমি রেগে ফোঁস করে মুখ দিয়ে গরম নিঃশ্বাস ছেড়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। এদিকটায় কোন মানুষ নেই। তবুও আমি অনুষ্ঠানের মাঝে কোন সিনক্রিয়েট করতে চাইছি না। ঘুরে যেতে নিলেই রোশান এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে আমাকে আটকে বললো,
— রাই, প্লিজ আমার কথাটা একবার শুনো।
তাকে দেখে এমনি রাগ উঠে গেছে। সে হাত ধরায় যেন রাগটা আরো চড়া হলো। পেছনে ঘুরে ঠাস করে তার গালে এক চড় বসিয়ে দিলাম। রোশান আমার হাত ছেড়ে নিজের গালে ধরে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি যে ওকে চড় মারবো সেটা হয়তো বেচারা কল্পনাও করতে পারেনি। তার চোখের দিকে তাকিয়ে রেগে বললাম,
— এই থাপ্পড়টা না আমার আরো আগে মারা উচিত ছিলো। তাহলে আপনি এত সাহস পেতেন না। আর ৩য় বার আমাদের দেখাও হতো না। কোন সাহসে আমার হাত ধরেন আপনি? চেয়ারম্যানের ছেলে হয়েছেন বলে কি পার পেয়ে যাবেন প্রতিবার? ভেবেই নিয়েছেন নোভা আমাকে কিছু বলে না। তাহলে আমি কেন ওর সামনে যাবো না? এই আপনার কি লাজশরম কি কিছু নেই? এত অপমান করি তবুও নির্লজ্জের মতো চেহারা দেখাতে ডেং ডেং করে চলে আসেন। এবারের থাপ্পড়ের কথা যদি মনে থাকে তাহলে আমার সামনে ৪র্থ বার এসেন না। তাহলে আপনার জন্য অনেক খারাপ হয়ে যাবে মিস্টার রোশান দেওয়ান।
কথাগুলো বলে আবার পেছন দিকে ঘুরে গেলাম। রোশান গালে হাত দিয়ে ফুঁসছে। তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। মনে মনে আনন্দ লাগছে। আবার আফসোসও লাগছে। প্রথম দিনই যদি ওর গালো ঠাটিয়ে দুটো চড় মারতাম তাহলে এবার দেখা হতো না। পেছন থেকে আবারো রোশান শক্ত করে হাত ধরে টেনে পশ্চিমে নিয়ে যেতে লাগলো। আমার এক দূর সম্পর্কের ফুপির বাসা আমাদের বাসার সাথে। তাদের দালানের পিছু নিয়ে রোশান থামলো। একটু ভয় ভয়ও করছে। ওর মুখটা রাগে লাল হয়ে আছে। ও নিয়ে আসার সময় তায়াং ভাইয়াকে রান্নার জায়গায় দেখেছিলাম। দুইবার ডাক দিয়েও লাভ হয়নি। ভাইয়া শুনেছে কিনা সঠিক বলতে পারছি না। তার আগেই তো রসুন আমাকে এখানে নিয়ে এলো। রোশানের হাত আলগা হতেই আমার হাত আমি ঝাড়া মেরে ছাড়িয়ে নিলাম। তারপর সর্বশক্তি লাগিয়ে রোশানের আরেক গালে আরেকটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলাম। এবারের থাপ্পড়টা আগেরটা থেকে বেশি জোরেই লাগছে। অনেক জোরে শব্দ হয়েছে। সাথে আমার হাতও জ্বলছে।আমার হাত ঝাড়া দিতে লাগলাম। মাথা উঠিয়ে রোশানের দিকে তাকাতে আমি ভড়কে গেলাম। চোখ দুটো রক্তবর্ণ হয়ে আছে। গাল দুটো লাল টুকটুকে হয়ে গেছে। সে আচমকা আমার গলা চেপে ধরে বললো,
— অনেক সাহস হয়ে গেছে তাইনা? আমাকে থাপ্পড় মারিস তুই? এর ফল কতটা ভয়ানক হবে তা জানিস তুই? তোর পুরো পরিবার পথে বসানোর মতো পাওয়ার আমাদের আছে।
আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে মুখটাকে বাঁকিয়ে নিচুস্বরে বললাম,
— ঐসব বড় বড় ডায়লগ অন্য কোথায় দিস আমাদের এখানে নয়। বাড়িতে অনুষ্ঠান বলে কোন সিনক্রিয়েট করতে চাইছি না। কিন্তু আমার ভাইয়ারা জানলে তুই চিপা মাইর অবশ্যই খাবি। আর ঐসব দুই টাকার ডয়লগ আমাকে না দিয়ে অন্যকে দে। তোদের এত পাওয়ার হয় নাই যে আমাদের পরিবার পথে বসাবি। আমাদের বংশ তোদের থেকেও বড় আছে। আমরা যদি রাগি তাহলে তোর বাপের যে চেয়ারম্যানি পাওয়ার দেখাস না সেটা আর থাকবে না। আর কি মান-সম্মান নষ্ট করবি তুই? কিছু করতে পারলে না নষ্ট হবে। আগেরবার শুধু আমার ভুলের কারণে এত কাহিনি ঘটতে পেরেছে। এবার তো আমি সেই ভুল করার চান্স রাখবো না।
— মুখে বুলি ফুটছে দেখছি।এতবার বলছি আমার কথাটা একটু শোন কিন্তু তুই নাছোড়বান্দা। আমার কথা শুনতেই চাচ্ছিস না।এখন মনে হচ্ছে একদম ঠিক করেছি আমি। তোর মতো মেয়ের সাথে এমনি হওয়া উচিত। আবার আফসোসও হচ্ছে। আরো বেশি কেন করলাম না?
রোশান হঠাৎ করে এতো প্রতিশোধ পারায়ণ কেন হয়ে গেলো তাই বুঝতে পারছি না। ওর মধ্যে এখন আমি বিন্দুমাত্র অনুশোচনাবোধ দেখতে পাচ্ছি না। মানুষ প্রতিশোধপরায়ণ হলে তার মধ্যে সামান্যতম বোধশক্তি থাকে না। ভালো কিছু চিন্তাধারাও লোপ পায়। রোশান এখন সেইরকম আছে। ওর চোখে স্পষ্ট ক্রোধ দেখা যাচ্ছে।আমি দুই হাত দিয়ে আমার গলা থেকে ওর হাত সরাতে চাইলে রোশান আগের থেকে আরো জোরে গলা চেপে বললো,
— গলার আওয়াজ অনেক বড় হয়ে গেছি দেখছি। ঐ ছেলের আশকারা পেয়ে এতো সাহস? ঐ যে সেদিন কফি হাউসে আমার হাত থেকে যে তোকে বাঁচালো। তোর ঐ নাগরের কথা বলছি আমি।
ওর কথা শুনে ইচ্ছে করছিলো আরো দুটো থাপ্পড় কষিয়ে দিতে। কিন্তু গলা চেপে ধরায় সেই শক্তি নেই। আমি চোখ মুখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। চোখ উল্টে আসছে।মনে হচ্ছে এই বুঝি প্রাণ পাখিটা আমার ছেড়ে চলে যাবে। মনে মনে একবার কালিমাটা আওড়ালাম। আমার এই অবস্থা দেখেও রোশানের কোন ভাবান্তর নেই। সে গলায় হাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ করে একটা ঘুষি এসে পরলো রোশানের নাক বরাবরি। রোশান ছিটকে দূরে পরে গেল। আমি চমকে সেদিকে তাকাতেই…….
#চলবে