শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
Part_68
#Writer_NOVA
— ভাবী, একটু শুনবে প্লিজ!
বাবার বাসার থেকে বড় একটা সফর দিয়ে আজ ফিরে এসেছি। বিয়ের পরের এই দিনগুলো খুব তাড়াতাড়ি কেটে গেলো। বাইক থেকে নামতেই একটা মেয়েলী কন্ঠ পেয়ে থমকে দাঁড়ালাম। এনাজ, এনাম ভেতরে চলে গেছে। লং কুর্তি পরহিত একটা মিষ্টি দেখতে মেয়ে আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি এক চিলতে হাসি দিয়ে বললাম,
— আমাকে বলছেন আপু?
— হ্যাঁ ভাবী তোমাকেই বলছি।
— জ্বি বলুন।
— আমি তোমার ছোট হবো ভাবী। তাই প্লিজ আপনি করে বলবে না। আমার নাম নিতুয়া। সবাই নিতু বলে ডাকে। তুমিও আমার নাম ধরে ডেকো।
— আমি তোমাকে চিনতে পারলাম না। যদি দয়া করে তোমার পরিচয় দিতে নিতু।
— আমি ঐ পাশের দালানে থাকি। আসলে তোমার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে। এনাজ ভাইয়ার সাথে বলতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু ভাইয়াকে আমার ভয় করে। তাই তোমার কাছে এসেছি। তুমি পারো আমাদেরকে সাহায্য করতে।
— আমাকে একটু খুলে বলো নিতু। আমি তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।
— একটু আড়ালে যাই চলো।
— ওকে চলো।
নিতু আমার হাত ধরে দেয়ালের আড়ালে নিয়ে গেলো। আমার মাথায় কিছু খেলছে না।নিতু হাসফাস করছে। বারবার হাত কচলাচ্ছে। চোখ দুটো এদিক সেদিক ঘুরছে। বেচারীকে অনেক চিন্তিত মনে হচ্ছে। আমি ওর হাত ধরে আশ্বাসের সুরে বললাম,
— তোমার যা বলার বলতে পারো। এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
আমার আশ্বস্ত কন্ঠ শুনে নিতু আমার হাত ধরে কান্না করে দিলো। আমার কিছু বোধগম্য হচ্ছে না। অচেনা, অজেনা একটা মেয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে কেন কাঁদবে? কাহিনিটা কি? মুখটাকে থমথমে করে বললাম,
— তুমি কান্না করো না প্লিজ। কি হয়েছে বলো?
— ভাবী আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কিভাবে শুরু করবো? আমার কাছে সব এলোমেলো লাগছে।
— কোন কিছু না ভেবে শুরু করে দাও।
নিতু কিছু সময় থেমে চোখের পানি মুছে নিলো। বেচারী আসলেই বুঝতে পারছে না কোথা থেকে কি শুরু করবে। এনাম ভাইয়া ডাকতে ডাকতে এদিকে আসছে মনে হচ্ছে। আমার সামনে এসে বললো,
— এই যে ভাবী আপনি এখানে? আর আমি আপনাকে সারা দালান খুঁজে হয়রান।
এনাম ভাইয়া প্রথমে নিতুকে খেয়াল করেনি। এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে নিতুর দিকে তাকিয়ে অবাক কন্ঠে বললো,
— নিতু তুমি এখানে? ভাবীর সাথে কি কথা বলো?
নিতু গম্ভীর কন্ঠে বললো,
— যা এতদিন তুমি বলতে পারোনি তাই বলতে এসেছি। আমি বড় বিপদে পরে আজ এখানে এসেছি। আমি আর লুকোচুরি চালাতে পারছি না।
— তুমি আমার কথাটা শুনো নিতু।
— তোমার আর কোন কথা শুনবো না আমি এনাম।আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি কি করতে হবে।
— আমি তো আছি। তাহলে তুমি এতো টেনশন করছো কেন বলো তো?
— তুমি আছো তবে নীরব দর্শকের ভুমিকা পালন করছো। আর কিছু নয়।
এদের দুজনের কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। অবাক চোখে একবার এনামের দিকে আরেকবার নিতুর দিকে তাকাচ্ছি। তারা দুজন যে দুজনকে আগের থেকে চিনে তা আমি সিউর। আমি দুজনকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,
— তোমারা কি আমাকে বলবে এখানে হচ্ছেটা কি?
নিতু কিছু সময় থেমে বললো,
— আমি বলছি ভাবী। এনাম ও আমি একে অপরকে প্রায় দেড় বছর ধরে ভালোবাসি। আমরা চুটিয়ে প্রেম করছিলাম। হঠাৎ করে আব্বু আমাদের ভালোবাসার কথা জেনে গেছে। তবে এনামের কথা জানে না। শুধু জানে আমি একটা ছেলেকে ভালোবাসি। তাই এখন আমাকে বিয়ে দিতে চাইছে। এনামকে কত করে বললাম এনাজ ভাইয়ার কাছে আমাদের কথা বলতে। কিন্তু এনামের কোন হেলদোল নেই। তাই বাধ্য হয়ে তোমার কাছে আসতে হয়েছে। এখন তুমিই পারো আমাদেরকে বাঁচাতে। ভাইয়ার কাছে তুমি যদি আমাদের বিষয়টা খুলে বলতে তাহলে ভাইয়া নিশ্চয়ই মেনে নিবে।
পুরো তায়াং ভাইয়ার লাভ স্টোরির মতো ওদের কেস।আমি চোখ দুটো ছোট করে এনাম ভাইয়ার দিকে তাকালাম। এনাম মাথা নিচু করে চুলে হাত বুলাতে লাগলো। তলে তলে দেড় বছর ধরে প্রেম করে। আর তাকে জিজ্ঞেস করলে বলে কেউ নেই। কন্ঠে কিছুটা কঠিনভাব রেখে এনামকে বললাম,
— এই ছিলো আপনার মনে? আমিও তো বলি আমার এত সুন্দর একটা দেবরের কোন গার্লফ্রেন্ড নেই। তা কি আদোও বিশ্বাসযোগ্য। আপনি তো আপনার ভাইকে বলে দিলেই পারতেন। আপনার ভাইয়া তো মানা করতো না। যেহেতু আপনার ভাইয়েরও লাভ ম্যারেজ। তাকে না বলতে পারলে আমাকে বললে মেয়েটাকে কি এত টেনশন করতে হয়? দেখেন তো চেহারার কি হাল হয়েছে? একটা মেয়ের কাঁধে যখন বিয়ের প্যারা আসে তখন কি অবস্থা হয় তা আমি খুব ভালো করে জানি।
এনাম মুখটাকে অসহায় করে অপরাধী ভঙ্গিতে বললো,
— ভাইয়ার বিয়ের চাপে কিছু বলা হয়নি। বিয়ের আগেও তো আপনাকে নিয়ে ভাইয়া অনেক টেনশনে ছিলো। তাই নতুন করে ভাইয়ার মাথায় কোন টেনশন ঢুকাতে চাইনি। ভেবেছি ভাইয়াকে বিয়ের ঝামেলা যাওয়ার পর ধীরেসুস্থে সব বলে দিবো।
নীতু আমার হাত ধরে কাঁদো কাঁদো ফেস করে বললো,
— প্লিজ ভাবী তুমি কিছু করো। আমার এখন শেষ ভরসা তুমি। আমি সব ভেবে তোমার কাছে এসেছি। আব্বু এনাজ ভাইয়াকে অনেক ভালোবাসে। আমার বিশ্বাস সে প্রস্তাব দিলে আব্বু মানা করতে পারবে না।
আমি ডান পাশের কপাল ডলে কিছু সময় ভেবে নিতুকে বললাম,
— আচ্ছা তোমরা আমার সাথে চলো। আমি দেখছি কি করা যায়!
নিতু একবার এনামের দিকে আরেকবার আমার দিকে তাকালো। ও ভয় পাচ্ছে। এনাম ওকে চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করলো। আমার দিকে তাকিয়ে নিতু বললো,
— আমার ভয় করছে ভাবী। ভাইয়া যদি মেনে না নেয় কিংবা আমাদের ওপর রাগ করে।
আমি মুচকি হেসে বললাম,
— তেমন কিছু হবে না। তোমারা চলো তো আমার সাথে। আমি আছি তো।
আমার কথায় নিতু কিছুটা স্বাভাবিক হলো। গুটি গুটি পায়ে আমার সাথে চলতে লাগলো। এনামের মুখটাও শুকনো দেখাচ্ছে। আমি ওপরে সাহস দেখালেও মনে মনে একটু ভয় পাচ্ছি। যদি আমার পাগল রেগে যায় তাহলে কি হবে?
💖💖💖
সোফায় গম্ভীর হয়ে বসে আছে এনাজ। ওর মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই ও এখন কোন মুডে আছে। ওর বরাবরি নিতু বসা। আর পাশে এনাম ভাইয়া। আমি কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছি। এনাজকে আমি সবটা খুলে বলার পর থেকে ও এমন গম্ভীর মুখে বসে আছে। নিতু ওড়নার কোণা ধরে মোচড়াচ্ছে। ওর মুখে স্পষ্ট ভয়। এনাম ভাইয়া চুপচাপ বসে আছে। এনাজ এতখন পর মুখ খুললো। নিতুকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— তুমি বাসায় যাও। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আমি দেখি কি করা যায়। তুমি টেনশন করো না। আমি তোমার আব্বুর সাথে কথা বলে দেখি কি হয়।
নিতু মুখ কুচোমুচো করে বললো,
— আচ্ছা ভাইয়া।
— এনাম যা নিতুকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আয়।
— তার কোন দরকার নেই ভাইয়া। আমি একা চলে যেতে পারবো। পাশাপাশি দালানেই তো আছি।
— সন্ধ্যা হয়ে আসছে। তাই দরকার আছে। এনাম কি বলেছি শুনতে পেয়েছিস কি?
এনাম ভাইয়া মাথা নিচু করে বললো,
— ঠিক আছে ভাইয়া। চলো নিতু।
নিতু সোফা থেকে উঠে ধীর পায়ে আমার সামনে এসে ফিসফিস করে বললো,
— আসছি ভাবী। কোন আপডেট এলে আমাকে জানিয়ো।
— নিশ্চয়ই, আর দেরী করো না। জলদী চলে যাও।
— আল্লাহ হাফেজ।
নিতু ধীর পায়ে বের হয়ে গেলো। ওর পিছু পিছু এনাম ভাইয়া। আমি এনাজের পাশে গিয়ে বসলাম। ও মনোযোগ সহকারে কিছু ভাবছে। আমি মৃদুস্বরে ডাকলাম।
— এনজিও সংস্থা।
— হুম বলো।
— রাতের জন্য কি রান্না করবো?
— তোমার যা মন চায়।
— আচ্ছা।
— আমি রুমে যাচ্ছি। কোন দরকার পরলে ডেকো।
আমি মাথা হেলিয়ে সম্মতি প্রকাশ করলাম। সে ভীষণ চিন্তায় আছে। তাকে একটু একা থাকতে দেওয়া উচিত। তাই আমি কোন দ্বিধা না করে কিচেনে চলে গেলাম। রাতের জন্য হালকা-পাতলা নাস্তার আয়োজন করলাম। মগরিবের নামাজ পরে দুই মগ কফি হাতে রুমে ঢুকলাম। এনাজ মসজিদ থেকে নামাজ পরে মাত্র ফিরছে। এনাম ভাইয়া সেই যে নিতুকে এগিয়ে দিতে গেছে এখনো আসেনি।
রুমে ঢুকে এনাজকে কোথাও পেলাম না। বারান্দার দরজাটা হালকা করে আবজানো। আমি সেদিকে ছুটলাম। এনাজ একটা চেয়ারে বসে আরেক চেয়ার পা তুলে বসে আছে। দৃষ্টি তার সামনের দিকে। আমি কফির মগটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
— কফি!
— Thanks
— শুধু Thanks?
— আর কি লাগবে?
— কিছু না। পা সরান আমিও একটু বসি।
এনাজ পাশের চেয়ার থেকে পা সরিয়ে আমাকে জায়গা করে দিলো। আমি চেয়ারে বসে তার দিকে তাকালাম। সে ততক্ষণে কফির মগে চুমুক দিয়েছে। আমি ধীর কন্ঠে বললাম,
— টেনশনে আছেন?
— হুম অনেকটা।
— কি করবেন এখন?
— দেখি তায়াং-এর সাথে কথা বলে।
— যা ভালো মনে করেন তাই করেন। তবে দেখেন শেষ অব্দি যেনো ওরা এক হতে পারে।
— এর জন্য একটু বেশি চিন্তিত।
— চিন্তা করেন না সব ঠিক হয়ে যাবে।
— তাই যেন হয়।
আমি কোন কথা না বলে কফির মগে বিশাল এক চুমুক দিলাম। এনাজ ডান হাতে কফির মগ ধরে রেখেছে। বাম হাতে আমার ডান হাত নিয়ে শক্ত করে ধরলো। তারপর কফি রেখে আমার হাতের আঙুল নিয়ে খেলতে লাগলো। আমি মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলাম,
— হচ্ছেটা কি?
— কিছু না। একটা কথা বলবে?
— হুম বলেন।
— তুমি সাথে থাকলে আমার মন যত খারাপ থাকুক নিমিষেই মন ভালো হয়ে যায়। এই যে এখনকার উদাহরণ দেই। এতখন মনটা ভীষণ খারাপ ছিলো। তুমি আমার পাশে বসতেই মন খারাপ লেজ গুটিয়ে পালালো। তুমি সত্যি আমার ম্যাজিক টিডি পোকা।
— আপনিও আমার ম্যাজিক।
— মাঝে মাঝে মনে হয় তোমাকে হারিয়ে ফেললে আমার কি হতো? আমি বোধহয় দমবন্ধ হয়ে মারাই যেতাম।
আমি কিছুটা রাগ দেখিয়ে বললাম,
— খালি উল্টোপাল্টা কথা! চুপ করেন।
— সত্যি কথা। আমার ভালো থাকার জন্য যে তোমাকে ভীষণ প্রয়োজন।
— ভালোবাসি!
— আমিও খুব বেশি।
এনাজ চুপ হয়ে গেলো। আমার হাতটাকে শক্ত করে ধরে নিজের কেলের মধ্যে রাখলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
—আমার একরাশ শূন্যতার মাঝে তুমি এক বিশাল পূর্ণতা টিডি পোকা 🌼।
আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।এই মানুষটাকে যত দেখছি তত বেশি ভালোবেসে ফেলছি।আজকাল একে ছাড়া আমার চলেই না। এনাজ আমার মাথাটা তার বুকের সাথে চেপে ধরে মাথার ওপরে চুলের মধ্যে একটা গাঢ় করে চুমু খেলো। মগটা গ্রীলের পাশে রেখে দুই হাতে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
— তোমাকে ছাড়া আমি নিঃস্ব। আমার বাকি জীবনটা তোমার সাথে কাটিয়ে দিতে চাই। শুধু ইহকাল নয় পরকালেও আমি শুধু তোমাকে চাই। অনেক অনেক ভালোবাসি তোমাকে।
আমি চুপ করে তার বুকে মাথা হেলিয়ে রাখলাম। কথা বলে আমি এত সুন্দর মুহুর্তটা নষ্ট করতে চাই না। তার বুকে মাথা রাখলে আমার সারাদিনের হয়রান নিমিষেই হাওয়া। এনাজ পরম যত্নে আমার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে। আমি চুপ করে তার হৃৎপিণ্ডের ঢিপঢিপ শব্দ শুনছি। সময়টা থমকে যাক না এখানে, মন্দ কি তাতে?
#চলবে
আসসালামু আলাইকুম।সরি, এক ঘন্টা দেরী হওয়ার জন্য। আমি ঘুমিয়ে গেছিলাম😑। ভেবেছিলাম আজকে গল্পটা শেষ করে দিবো। কিন্তু পরে চিন্তা করলাম এনামের একটা গতি না করে দিলে গল্পটা কিছুটা অসম্পূর্ণ লাগতে পারে। তাই আরো পর্ব বাড়লো। তবে আমি খুব শীঘ্রই শেষ করে দিবো।