#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
Part_43
#Writer_NOVA
বিয়ের দিন…..
গতকাল রাতে ঘুম হারাম আমার। সাড়ে তিনটার দিকে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ফলাফল শূন্য। সকালে উঠে চোখ ডলছি। রাতের পর থেকে এনাজ, তায়াং ভাইয়ার খবর জানি না। সামাদ ভাইয়াকে দেখে চেচিয়ে বললাম,
— রাতে কি খাইছিলা ভাইয়া? একেকজন যে টাল হয়ে পরে ছিলা। তা কোন জাদুর পানি পান করেছিলেন ভাইজান?
সামাদ ভাইয়া দ্রুত এগিয়ে এসে আমার মুখ আটকে ধরে বললো,
— চুপ কর। তুই তখন আমাদের রুমে গিয়েছিলি কেন?
ওর হাতে জোরে চিমটি দিতেই আহ্ বলে হাত সরিয়ে ফেললো। আমি দাঁত কিড়মিড় করে বললাম,
— আমি সব ভিডিও করে রেখেছি। তোর বিয়ের প্যান্ডেলের মাঝখানে ল্যাপটপে ছেড়ে দিবো। আর যদি তাও না পারি তাহলে ভিডিওটা শুধু আব্বুকে দেখাবো। তারপর বাকিটা ইতিহাস 🥱।
— তুই এমন কিছু করবি না।
— আমাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই ভাই। আমি দেখিয়েও দিতে পারি। তবে তুই যদি আমার মুখ বন্ধ করতে চাস তাহলে ১ হাজার টাকা দিতে পারিস। নয়তো ভিডিও ভাইরাল।
— এক টাকাও দিবো না। দেখি তুই কি করিস।
— ওকে আমি আব্বুর কাছে গেলাম।
আমি উঠোনের পশ্চিম দিকে যেতে নিলেই সামাদ ভাইয়া আমার হাত ধরে আটকে বললো,
— ৫০০ দিবো। কাউকে কিছু বলতে পারবি না।
— এক হাজারের মধ্যে এক টাকাও কম না। একে তো কালকে তোর স্টেজের জন্য খাবার ডিজাইন করতে গিয়ে আমার দেরী হইছে। একটু সাজতেও পারি নি।সবাই মিলে আমাকে বকছে। তার জন্য তুই টাকা দিসনি। আবার ৫০০ টাকা দিতে চাস। আরেকটা কথা বলবি দুই হাজার টাকা দিতে হবে।
— আচ্ছা যা মানিব্যাগ নিয়ে আয়। আমার রুমের টেবিলের ওপর দেখবি। কিন্তু ভিডিও কারো হাতে পরলে তোর খবর আছে।
আমি দৌড়ে ওর রুম থেকে মানিব্যাগ নিয়ে এলাম। সেটা ওর হাতে দিতেই ও বললো,
— একটা চেয়ার নিয়ে আয়।
রেগে ওর দিকে তাকাতেই শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,
— টাকা তো দিবোই। তাহলে একটু খাটিয়ে দেই।
চেয়ার আনতেই ও বসে মানিব্যাগ খুলে পাঁচশত টাকা সাধলো। কিন্তু আমি তো নিবো না। এক হাজার টাকা নিয়ে তবেই ওকে ছাড়ছি।সাথে আমার স্পেশাল ব্লাকমেইল তো আছেই। খুশিমনে টাকাটা ভাজ করে হাতে রেখে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম,
— বাকি দুই গাধাকে যে দেখছি না। উনারা কি উঠেছে? নাকি এখনো টাল হয়ে পরে আছে।
— আস্তে কথা বল।
— তোরা খেতে পারবি আর আমি বলতে পারবো না? খাওয়ার সময় মনে ছিলো না?
— চুপ করতে বলছি।
—ওকে আমি চুপ🤫।
— তুই কার কথা বলছিস?
— তায়াং ও এনাজ নামক দুই রামছাগলের।
— তায়াং, এনাজ, মুহিন ভোর সকালে শাহবাগ গিয়েছে বাসরঘরের ফুল আনার জন্য। এতক্ষণে তো চলে আসারও কথা।
— ওহ আচ্ছা।
ভাইয়ার অনেকগুলো বন্ধু আসতেই আমি কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে চলে এলাম। বাকিগুলো পরে পরে ঘুমাচ্ছে। অনন্যা উঠেছে আমার আগে। কিন্তু ওকে খুঁজে পাইনি। চোখ জ্বলছে। ঘুম না হওয়ার
ফল এটা।
ঘড়ির কাটা এখন দুপুর ১২ টার ঘরে। রুমে দরজা আটকিয়ে আমি, নূর আপি, তন্বী, অনন্যা, অর্থি বসে আছি। খুশিতে না ভাই। বাইরে রং দিয়ে একেকটাকে ভুত বানাচ্ছে। তার হাত থেকে রক্ষা পেতে। একটু আগে সবগুলো মিলে ভাইয়ার গোসলের জন্য কলসি করে পুকুর থেকে পানি এনে রাখতে না রাখতেই রং খেলা শুরু হয়ে গেলো। শুরুটা করেছে তায়াং ভাইয়া। তারপর একে একে সব। এখন বাইরে যাওয়া মানে যেচে বিপদ ডেকে আনা। আমি সুতি একটা থ্রি পিস নিয়ে গোসলে চলে গেলাম। আজ আমি গতকালের ভুল করছি না। গোসল থেকে বের হতেই দেখি সবগুলো রং দিয়ে ভূত হয়ে আছে।আমি হাসতে হাসতে খাটে গড়াগড়ি খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— সবার এই অবস্থা কেন?
অনন্যা বললো,
— আমাকে ছোট মামা ডাক দিছে। আমি প্রথমে যেতে চাই না। তারপর জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম রং খেলা বন্ধ হয়ে গেছে। তাই ভালো বলে গেলাম। মেজু নানাভাই মুখে অল্প একটু রং দিলো। তারপর সবাই একসাথে আমাকে ধরলো। আর বাকি সবাইকে বাইরে টেনে নিয়ে ভুত করছে।
আমি হাসি আটকিয়ে বললাম,
— একদম ঠিক হয়েছে। বলছিলাম কেউ ডাক দিলে যেতে না। গেলি কেন?
অর্থি শরীরের রংগুলো ঝাড়তে ঝাড়তে আমাকে বললো,
— আমি তো ভালো মনেই গেলাম। তারপর এই অবস্থা।তুমি বাইরে যাইয়ো না নোভা খালামণি। তায়াং মামা আর এনাজ আঙ্কেল তোমাকে খুজতাছে।
নূর আপি বললো,
— তুই গোসলে গিয়ে বেঁচে গেছিস। নয়তো তোর অবস্থাও আমাদের হতো।
— হইছে আর কথা বলো না। সবাই একে একে গোসলে ঢুকে যাও। নয়তো সাজতে দেরী হবে।
বারান্দার দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম সবগুলো রং খেলে এখন পুকুরে গোসল করতে নেমেছে। শুধু শুধু চিল্লাচিল্লি করছে আর ডুবাচ্ছে। আমি দরজা আটকে সাজতে বসে পরলাম। আজ আর গতকালের মতো ভুল করছি না।
💖💖💖
পেস্ট কালারের লেহেঙ্গার সাথে গোল্ডেন রঙের হিজাব বেঁধে হাই হিল পরে নিলাম। বাইরে বের হয়ে দেখি আব্বু, চাচ্চু,ভাইয়ারা রাগারাগি করছে। এখনো অনেকের রেডি হওয়া বাকি আছে। আমি আজ সবার আগে তৈরি হয়ে গেছি। বাকি সবাই তাড়াহুড়ো করছে। ছেলেরা জুম্মার নামাজ পরে চলে এসেছে কিন্তু এখনো মেয়েদের সাজগোজ হয়নি। আমি বের হতেই তায়াং ভাইয়া ও এনজিও সংস্থাকে দেখতে পেলাম। তায়াং ভাইয়া কালো কোর্ট-প্যান্ট পরেছে। এনাজের পরনে সাদা কোর্ট-প্যান্ট ভেতরে পেস্ট কালারের শার্ট। অনেকটা আমার সাথে ম্যাচিং। আমি ওদের সাথে কথা না বলে সাইড কেটে যাওয়ার সময় এনাজ নিচু স্বরে কানের কাছে বললো,
—সবকিছু আছে তবুও মনে হচ্ছে কিছু নেই। বলতো কি নেই? ওহ হ্যাঁ পেয়ে গেছি। আমার আমিটাই নেই আমার কাছে। থাকবে কি করে বলো তো? সে যে বহু আগে তোমাতে হারিয়ে গেছে। মনে রেখো প্রিয়, তোমাতেই আমি এবং আমাতেই তুমি।
তার নিচুস্বরে বলা কথাগুলো মনের মধ্যে একটা ঝংকার তুলে দিলো। হুট করে একরাশ লজ্জা ঘিরে ধরলো আমায়। মাথা নিচু করে সেখানেই থমকে দাঁড়িয়ে রইলাম। সে আবারো বললো,
— মা শা আল্লাহ টিডি পোকা। এত সাজছো কেন? আমিই তো আজ তোমায় দেখে হার্ট অ্যাটাক করবো। অন্য ছেলেদের কি হবে? আমার প্রতিযোগী বাড়ানোর জন্য এত সাজছো তুমি?
আমি কোন কথা না বলে মুখ ভেংচি দিয়ে সরে গেলাম। একটার সাথেও কথা বলবো না। কালকে ড্রিংক করছে কেন? তার জন্য এটাই ওদের শাস্তি। অবশেষে পৌনে তিনটায় সবাই রেডি হয়ে আসতেই আমাদের HICE ছাড়লো। তায়াং ভাইয়া এনাজের সাথে যেতে বলেছিলো। কিন্তু আমি ওদের কথা না শুনে এক প্রকার ত্যাড়মি করেই হাইসে চলে আসি।
মেয়ের বাড়ি আমাদের পাশের উপজেলায়। আসতে প্রায় আধা ঘণ্টার বেশি সময় লেগেছে। বিয়ে বাড়িতে আসার পর ভাইয়াকে তার শালীরা গেইট আটকায়। এখন দশ হাজার টাকা না দিলে ছাড়বে না। তায়াং ভাইয়া, মুহিন, এনাজ, দুলাভাই মিলে বুদ্ধি করে ওদের হাতে চার হাজার ধরিয়ে দেয়। বেচারীরা তো মানবে না। কিন্তু মিচকা শয়তানগুলোর সাথে কি এরা পারবে। অবশেষে ফিতা কেটে ভাইয়ার সাথে সাথে আমরা ভেতরে ঢুকি। ভাইয়াকে স্টেজে বসিয়ে সাগরআনা দিয়েছে। কিন্তু আমি,নূর আপি,ইভা ও তন্বী টেবিলে খেতে বসেছি। ভাইয়ার সাথে অনন্যা, অর্থি, ঐশী, আশা ভাইয়ারা বসেছে। তন্বী, তায়াং ভাইয়াকে বললো,
— ভাইয়া কম করে খাস। নয়তো পেট খারাপ করবে।
ভাইয়া রেগে তাকাতেই তন্বী চুপ হয়ে গেলো। আমি এখন অব্দি তায়াং ভাইয়া ও এনাজের সাথে একটা কথাও বলিনি। নূর আপিও না। এনাজ অনেকবার কথা বলতে এসেছিলো আমি এড়িয়ে গেছি। খাবার শেষ করে হাত ধুয়ে অন্য দিক দিয়ে আসতে নিলেই একটা হাত এসে আমার হাত টেনে ধরে একটা ঘরের আড়ালে নিয়ে গেলো। আমি চিৎকার করতে গেলেই সে মুখ আটকে বললো,
— আস্তে আস্তে টিডি পোকা করো কি? আমাকে গণধোলাই খাওয়াবে নাকি?
আমি তার হাত আমার হাত ও মুখের থেকে সরিয়ে চলে যেতে নিলে উনি হাত আটকে বললো,
— হয়েছি কি তোমার? সকাল থেকে দেখছি আমাকে ইগনোর করছো। কি করেছি আমি?
আমি কিছুটা রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বললাম,
— এখন সাধু সাজা হচ্ছে? আপনি জানেন না কি হয়েছে?
— জানলে কি জিজ্ঞেস করতাম?
— জানেন না যখন তাহলে আর জানতে হবেও না।
— প্লিজ, প্লিজ বলো না আমি কি করছি? আমার ভুল হলে আমি অবশ্যই মাফ চাইবো। তোমার ইগনোর আমার সহ্য হচ্ছে না।
— রাতে কি খাইছেন?
— বিরিয়ানি।
— আর কি খাইছেন সাথে?
আমি রেগে কথাটা বলতেই উনি মাথা চুলকে অপরাধী ভঙ্গিতে বললো,
— আসলে সবার সাথে সাথে আমিও একটু খাইছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারি নাই তুমি দেখলে নারাজ হইবা।
— না, আমি খুশি হবো।এত খুশি হইছি যা বলার বাইরে। এগুলা খাওয়া যে হারাম তা কি আপনি জানেন না?
— হু জানি তো। বললাম তো সবার তালে তালে খেয়ে ফেলছি।
— তাহলে এখন সবার সাথে তালে তাল মিলিয়ে থাকেন। আমার সাথে কথা বলার চেষ্টাও করবেন না।
— এই না না প্লিজ এমন করো না। তুমি এখন যা শাস্তি দিবে তাই মেনে নিবো। তবু তুমি আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করো না।
— দশবার কান ধরে উঠবস করেন।
— কি?
— নয়তো আমি আপনার সাথে কথা বলবো না।
এনাজ ইনোসেন্ট ফেস করে বললো,
— না করলে হয় না।
— না হয় না।
— আচ্ছা করতেছি। মান-সম্মান আর কিছু রাখলা না। তুমি একটু পাহারা দিও কেউ যাতে না আসে।
এনাজ কান ধরে উঠবস করা শুরু করলো। আমার পেট ফেটে হাসি আসছে। কোনরকম সেটাকে আটকে রাখছি। পাচবার শেষ হতেই বেচারা আমার দিকে করুণ মুখে তাকালো। যার অর্থ বাকি পাঁচটা মাফ করে দাও। আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে সেটা দেখেও দেখলাম না। তার সাথে আমি অবশ্য এখন আর রেগে নেই। কেন জানি তার উপর রাগ করে থাকতেই পারি না। তবুও তাকে শাস্তি পেতে হবে। যদিও শাস্তিটা কম হয়ে গেছে। তবে পরেরবার একি কাজ করলে খবর আছে। দশবার উঠবস করতেই কারো গলার স্বর পেয়ে বেচারা আমার সামনে থেকে দ্রুত কেটে পরলো।দুজন লোক কথা বলতে বলতে এদিকেই আসছে। সে যেতেই আমি ফিক করে হেসে উঠলাম। অনেকখন ধরে হাসি আটকে রাখছিলাম।এখন আর সম্ভব নয়। বেচারার মুখটা দেখার মতো ছিলো।
সেখান থেকে প্যান্ডেলের কাছে আসতেই দেখি ভাইয়ার জুতা লুকানো নিয়ে দুইপক্ষের কথা কাটাকাটি হচ্ছে। আমি আস্তে করে বাসার ভেতরে ঢুকে গেলাম। এই ভেজালে আমি নেই। মারিয়া মানে ছোট ভাবীর সাথে কতগুলো ছবি তুলে বাইরে চলে এলাম। অনেকখন ধরে তায়াং ভাইয়া ও নূর আপিকে খুঁজে পাচ্ছি না। তন্বীকে জিজ্ঞেস করলাম,
— এই তায়াং ভাইয়া আর নূর আপি কোথায়রে? তাদের কি দেখেছিস?
— আমিতো একটু আগে এদিকেই দেখছিলাম। এখন বলতে পারছি না৷
আমি বাইরে চলে এলাম। এনাজকে সামনে দেখে ডাকলাম।
— এই যে মিস্টার এনজিও সংস্থা এদিকে আসেন।
— জ্বি মিস টিডি পোকা বলুন। আপনার কি সেবা করতে পারি?
— নূর আপি আর তায়াং ভাইয়া কোথায়?
— আমিও অনেকখন ধরে তায়াংকে খুঁজতেছি। কিন্তু পাচ্ছি না। ওরা গেলো কোথায়? চলো দুজন মিলে খুঁজি।
আমি ও এনাজ এদিক সেদিক খুঁজতে লাগলাম। খুঁজতে খুজতে বাড়ির পাশের এক বালুর মাঠে চলে এলাম। লেহেঙ্গা উঁচু করে হাঁটতে গিয়েও আমি পিছিয়ে পরছি। হাই হিল পরে বালুর মধ্যে কি হাঁটা যায়? এনাজ পেছনে এসে আমার এক হাত ধরে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো। আমার এক দূর সম্পর্কের চাচ্চুকে দেখে আমি দ্রুত হাত সরিয়ে ফেললাম। উনারা গাড়ির দিকে যাচ্ছে। আমাদের এভাবে দেখে ফেললে ঝামেলা হবে। এনাজ প্রশ্নবোধক চাহনিতে আমার দিকে তাকাতেই আমি ইশারা করে নিচুস্বরে বললাম,
— আমার এক চাচ্চু এদিকে আসছে।
এনাজ সেদিকে তাকিয়ে আর কোন কথা বললো না। বালুর মাঠেই তায়াং ভাইয়া ও নূর আপিকে দেখা যাচ্ছে। তাদের কিছুটা সামনে গিয়ে দেখলাম……
#চলবে