শিশির_ভেজা_রোদ্দুর Part_50

0
1280

শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
Part_50
#Writer_NOVA

জামাই বাজার উপলক্ষে সামাদ ভাইয়ার শ্বশুর বাড়ি এসেছি। আজকে ভাইয়া ও ভাবীকে নিয়ে যাবো বাসায়। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব চুকানোর পর একগাদা ফল কেটে দিয়েছি। সবার মুখ চললেও আমি চুপ করে বসে আছি। একটু আগে খেয়ে এখন আবার এসব পেটে ঢুকবে না। অনন্যা, অর্থি,ইভা, তন্বী, নূর আপি বাইরে ঘুরছে।অনেকখন ধরে আরেকটা বিষয় খেয়াল করছি। যার দরুন আমি তাদের সাথে ঘুরতে যাইনি। ভাবীর এক মামাতো বোন কিছু সময় পরপর এনাজের দিকে তাকাচ্ছে। যেটা আমার চোখ এড়ায়নি। কেন জানি আমার এটা সহ্য হচ্ছে না। আমি ধীর পায়ে তার সামনে গিয়ে বসলাম। মেয়েটা তার সমবয়সী এক মেয়ের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে আর আড়চোখে এনাজকে দেখছে। এনাজ ও তায়াং ভাইয়া বাইরের চেয়ারে বসে আছে। আমি মিষ্টিসুরে জিজ্ঞেস করলাম,

— তোমার নাম কি আপু?

মেয়েটা এনাজের দিক থেকে চোখ সরিয়ে কিছুটা বিব্রত হয়ে বললো,

— জেরিন।

— তুমি মারিয়া ভাবির মামাতো বোন?

— জ্বি আপু। আপনি?

— ওর ননদ। আবার অন্য দিক থেকে বড় বোনও হই।

— ওহ আচ্ছা। আপু আপনি কি বিবাহিত?

— না কেন?

— না, আপনার নাকে নাকফুল তাই জিজ্ঞেস করলাম।

— আমার নাকফুল পরতে ভালো লাগে। তাই পরে রাখছি। তবে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। খুব শীঘ্রই হয়ে যাবে। ঐ যে মিষ্টি কালার শার্ট পরা যে ছেলেটাকে দেখছো তার সাথে। আমার হবু বর।

আমি জানি মিথ্যে বলেছি। না বললে তো মেয়েটা ওর দিকে সারাক্ষণ এনাজের দিকে তাকিয়ে থাকবে। যেটা আমার সহ্য হবে না। আমার কথা শুনে জেরিন নামের মেয়েটি চমকে উঠলো। এনাজ আজকে মিষ্টি কালার শার্ট ও কালো প্যান্ট পরে এসেছে। জেরিন, এনাজকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলো,

— ঐ ছেলেটা আপনার হবু বর?

— জ্বি আপু।

— ওহ্

— কেন আপু, কোন সমস্যা? আমার হাসবেন্ডটা দেখতে সুন্দর না?

— না মানে হ্যাঁ খুব সুন্দর। আচ্ছা আপু আমি একটু আসছি।

জেরিন কোনমতে সেখান থেকে কেটে পরলো। আমি মুখ টিপে বেশ কিছু সময় হেসে নিলাম। বেচারীর মুখটা দেখার মতো হয়েছিলো। মন ভেঙে গেছে নিশ্চয়ই। একদম ঠিক হয়েছে। এত ছেলে থাকতে আমরটার দিকে নজর দিবে কেন? এবার বুঝুক মজা।এবার গিয়ে আরেকজনকে টাইট দিতে হবে। কে বলেছিলো তাকে এত সুন্দর করে সেজে আসতে।

“জামাই বাজার” বিক্রমপুরের বিয়ের একটা রিতী। একেক অঞ্চলে বিয়ের একেকটা রিতী থাকে। যেগুলো শুধু সেই অঞ্চলভেদে পালন করা হয়। আমাদের এই রীতিটা অন্য কোথাও পালন করা হয় কিনা তা আমি জানি না। বৌ-ভাতের আড়াই দিন পর এটা পালন করা হয়। যাকে আরেক ভাষায় আড়াই নাহারি ও বলা হয়। জামাই বাজারের দিন সকালবেলা নতুন জামাই রুমাল মেলে ধরে। সেখানে মেয়েরপক্ষের আত্মীয়রা যার যার সামার্থ্য অনুযায়ী দুই হাজার, পাঁচ হাজার, সাত হাজার টাকা যে যা পারে ততটুকু টাকা দেয়। মোট টাকা ও নিজের টাকা মিলিয়ে সেদিন নতুন জামাই রান্নার প্রয়োজনীয় যাবতীয় জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আসবে। সেই জিনিসপত্র দিয়ে মেয়েবাড়ির লোক রান্না করবে। তাতে ছেলেপক্ষের লোককেও দাওয়াত করা হবে। ছেলেপক্ষের লোক দাওয়াত রক্ষা করে নতুন বর-কনে কে নিয়ে যাবে।

— এই যে শুনুন। এদিকে একটু আসুন তো।

এনাজের সামনে গিয়ে তাকে ডাকতেই তার কপাল কুঁচকে এলো। শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

— কি হয়েছে?

— আমার সাথে একটু আসতে বলছি।

তায়াং ভাইয়া শয়তানি হাসি দিয়ে এনাজকে বললো,
— আরে যা যা। দেখ তোর টিডি পোকা তোকে কি জানি দিবে।

আমি ভাইয়ার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে এনাজের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। সে কোন কথা না বলে আমার সাথে চলে এলো। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পাশে সেই বালুর মাঠে চলে এলাম। সেখানে আসতেই তার চুলগুলো সব এলোমেলো করে দিলাম। শার্টের বোতাম একদম কলার অব্দি লাগিয়ে দিলাম। ফোল্ড করা হাতা নামিয়ে কব্জি অব্দি নিয়ে আসতেই সে বললো,

— আরে করছো কি? পাগল হলে নাকি? আমার স্টাইলগুলো সব নষ্ট করে দিলে। এমন পাগলামি করছো কেন?

শার্টের হাতা কব্জি অব্দি এনে বোতাম লাগিয়ে তাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে আমার মুখে হাসি ফুটলো। আমি হাসিমুখে বললাম,

— এবার ঠিক আছে।

— এই নিরিহ ছেলেটার ওপর এমন অত্যাচার কেন? একা একটা ছেলেকে পেয়ে এভাবে অত্যাচার করতে পারো না তুমি। কি করলে দেখো তো?

— খবরদার যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে। যদি কোনকিছু ঠিক করেছেন তাহলে আপনার সাথে আমার কোন কথা নেই।

— এমন আবুল সাজানোর মানেটা কি?

— কে বলছিলো নায়ক সেজে আসতে?

— কোথায় নায়ক সেজেছি? সমন্ধির শ্বশুর বাড়ি আসছি একটু ভালো গেটআপে আসতে হবে না? নয়তো মানুষ কি বলবে?

—তাই বলে এমন নায়ক সেজে আসবেন?

— তোমার হঠাৎ কি হলো বলো তো? তুমি তো কখনো আমার ড্রেসআপ নিয়ে মাথা ঘামাওনি? আজ এমন আবুল সাজিয়ে দিলে কেন?

আমি তার কথার উত্তর না দিয়ে এক হাত কোমড়ে আরেক হাতের আঙুল ঠোঁটে দিয়ে তাকে পা থেকে মাথা অব্দি স্ক্যান করতে লাগলাম। তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,

— চুপ করেন তো। কি জানি একটা মিস পরে গেছে। কি মিস পরেছে, কি মিস পরেছে? ওহ পেয়েছি। প্যান্টটাকে পায়ের দিকে কিছু অংশ ভাজ করে দিতে হবে। তাহলে ঠিক হবে।

যেমন ভাবা তেমন কাজ। নিচে বসে তার টাখনুর দিকের প্যান্টে কয়েকটা ভাজ দিয়ে দিলাম। তারপর উঠে গাল দুটো টেনে দিয়ে বললাম,

— হু এবার ঠিক আছে। পুরো পারফেক্ট। এখন আর কোন মেয়ে নজর দিবে না।

— তুমি ঠিক আছো তো?

— এতখন ছিলাম না। এখন ঠিক আছি।

— তাতো দেখতেই পাচ্ছি।

— এবার চলুন।

— এই অবস্থায়?

— বেশি কথা বলবেন আপনার সাথে আর কথাই বলবো না।

উনি আর কথাই বললেন না। চুপচাপ আমার সাথে চলতে লাগলো।বেচারাকে যা লাগছে না। তাতে আমার কি? কেউ তো এখন আর আমার এনজিও সংস্থার দিকে নজর দিবে না। তার এক বাহু ধরে হাঁটতে লাগলাম। উনি বোকার মতো একবার আমার দিকে তাকিয়ে নিরবে আমার সাথে পথ চলতে লাগলো।তায়াং ভাইয়ার সামনে যেতেই সে চোখ কপালে তুলে বললো,

— কি রে এনাজ তুই এমন আবুল সাজে কেন?

— আর বলিস না ভাই। তোর বোনের হঠাৎ কি হলো আমি কিছুই বুঝলাম না। দেখ তো আমাকে কি সাজিয়ে দিলো?

তায়াং ভাইয়া হো হো করে হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে পরে যাওয়ার জোগাড়।আমি মিটমিট করে হেসে ঘরের ভেতর ঢুকে পরলাম।আমার জিনিস নিয়ে যদি আমি না ভাবি তাহলে কে ভাববে!

💖💖💖

আজও এনাজের পিঠকে বালিশ বানিয়ে নিয়েছি। সকাল সকাল ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা হয়েছি। মনটা ভীষণ খারাপ। দিনগুলো কত দ্রুত চলে গেলো। মনে হচ্ছে সেদিন বাসায় গেলাম। আজ ফিরে আসছি। বাসার সবার মুখ থমথমে ছিলো আম্মু,ইভা,অনন্যা,
অর্থি সবার মনটা খারাপ করে রেখেছিলো। আম্মুর মুখটা পুরো কাঁদো কাঁদো ছিলো। তাদের রেখে আসতেই মন চাইছিলো না। সবাই অনেক জোর করেছিলো আরেকটা দিন থাকার জন্য। কিন্তু আমার বিটলার খালাতো ভাই কিছুতেই থাকবে না। নূর আপিরা আমাদের সাথেই বের হয়েছে। এতখনে বোধহয় বাসায়ও চলেও গেছে। আমি ও এনাজ আজও বাইকে এসেছি। তন্বী,তায়াং ভাইয়া ও খালামণি সিএনজি ঠিক করে তাতে করে আসছে। আমরা তাদের থেকে অনেক এগিয়ে।

— মন খারাপ করো না টিডি পোকা। আবার ডিসেম্বরে চলে যেয়ো।

নীরবতা ভেঙে এনাজই প্রথম কথা বলে উঠলো।আমি কোন কথা বললাম না। চুপ করে রাস্তার দুই ধারের পরিবেশ দেখতে ব্যস্ত হলাম। এনাজ থেমে আরেকবার বললো,

— তোমার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। সত্যি বলতে আমার নিজেরই খারাপ লাগছে। তোমার লাগাটা তো একেবারেই স্বাভাবিক। সবাই কত সহজে আমাকে আপন করে নিয়েছিলো। ভালোবেসে একেকটা কাজের দায়িত্ব দিচ্ছিলো। আমার তখন মনে হয়েছে আমি নিজের বাসায় আছি। সময়গুলো কত দ্রুত চলে গেলো। আমার স্মৃতিতে এই ছয়টা দিন বেস্ট থাকবে। আমি কখনও ভুলতে পারবো না। ধন্যবাদ তোমাকে। তুমিও কিন্তু আমায় অনেক সুন্দর সুন্দর মোমেন্টের সাথে পরিচিত করে দিয়েছো।

একটা দীর্ঘশ্বাস বুক চিঁড়ে বের হয়ে গেলো। বিষন্ন মনে কোন কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না। তার পিঠে মাথা ঠেকিয়ে চোখ দুটো হালকা বন্ধ করে রাখলাম। হঠাৎ ব্রেক কষতেই আমি কিছুটা চমকে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,

— কি হয়েছে?

— কিছু না।

আমার দিকে না তাকিয়ে সামনের একটা ফুল বিক্রতা ছোট ছেলেকে জিজ্ঞেস করলো,

— গোলাপ ফুল কত করে?

— একটা দশ টেহা ভাইজান।

— দুইটা দাও তো।

—আইচ্ছা।

ছেলেটা তার নীল বালতি থেকে সতেজ দুটো লাল গোলাপ এনাজের হাতে তুলে দিলো। এনাজ মানিব্যাগ খুলে বিশ টাকার নোট ছেলেটার হাতে দিয়ে দিলো। ছেলেটা অন্য দিকে চলে গেল। আমার দিকে ফিরে মিষ্টি হেসে বললো,

— এই দুটো তোমার জন্য।

— শুকরিয়া।

হাত বাড়িয়ে ফুল দুটো নিয়ে মুঠ করে রেখে দিলাম।বিনিময়ে মিষ্টি হাসি ফেরত দিয়ে দিলাম। সে মাথা চুলকে বিষন্ন মনে বললো,

— আমার তো এতো এতো টাকা নেই। তাই মাত্র দুইটা গোলাপ উপহার দিলাম। আমার অঢেল টাকা থাকলে তোমাকে পুরো বালতির ফুল উপহার দিতাম।

— কি শুরু করলেন বলেন তো? এই পুরো বালতি ফুল দিয়ে কি আমি মাথায় বেঁটে দিবো? দুটো দিয়েছেন তাতেই আমি খুশি। আপনি ভালোবেসে আমাকে একটার বদলে দুটো গোলাপ দিয়েছেন তাও বা কম কিসের? আমি সামান্য কিছুতেই খুশি থাকি।তাই আপনার মন খারাপ করার কোন দরকার নেই।

এনাজ মুচকি হেসে বাইক স্টার্ট দিলো। গোলাপের ওপর পানি ছিটানোর দরুন সেগুলো মুক্ত দানার মতো পাপড়ির গায়ের ওপর বসে আছে। আমি একবার গোলাপের ঘ্রাণ নিয়ে সেগুলোকে হাতেই রেখে দিলাম।ভালোবাসার প্রতীক বলে কথা💖।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here