শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
Part_51
#রহস্য_সমাধান
#Writer_NOVA
মাঝে কেটে গেছে দুই দিন। আজ থেকে কলেজ খোলা।আমি কলেজে এসে মনোযোগ দিতে পারিনি। কেমন জানি সবকিছু বিস্বাদ ঠেকছে। এই দুইদিনে এনাজের সাথে কোন যোগাযোগ হয়নি। তাকে ভীষণ মিস করছি ।গতকাল রাতে তায়াং ভাইয়া বলেছিলো তার পায়ে একটু ব্যাথা পেয়েছে। তারপর থেকে কতবার যে তাকে কল করতে চেয়েছি কিন্তু সাহসে কুলায়নি। কেন জানি ভীষণ ভয় এসে ঘিরে ধরছিলো। তবে তার খোঁজ নেওয়ার জন্য তো কল করা উচিত আমার। শারমিনের সাথে নিরবে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। তন্বী ক্লাশ করছে।অন্য সময় হলে এতখনে শারমিনের কান পচিয়ে ফেলতাম। কিন্তু আজ আমি চুপচাপ। শারমিন হঠাৎ ধাক্কা দিয়ে আমাকে বললো,
— কিরে কি হয়েছে তোর? সকালে কলেজে আসার পর থেকে দেখছি তুই কেমন মনমরা হয়ে আছিস।
— কিছু না। আমি ঠিক আছি।
— বিয়ের আনন্দ কেমন কাটলো?
— আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
— গ্রামের বিয়েতে অনেক মজা হয় তাই না?
— হুম অনেক।
— শুনলাম এনাজ ভাইয়া নাকি তোদের সাথে গিয়েছিল।
— হ্যাঁ। কিন্তু তুই জানলি কি করে?
— তওহিদ ভাইয়া বললো।
— তার সাথে তোর দেখা হলো কি করে?
— একদিন চাচাতো বোনের সাথে শপিং করতে গিয়েছিলাম সেদিন দেখা হয়েছিলো।
— ওহ্ আচ্ছা।
— কফি হাউসে যাবি?
— না ভালো লাগছে না।
ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে ডায়াল লিস্টে গেলাম। এনাজের মোবাইল নাম্বারটা এনজিও সংস্থা দিয়ে সেভ করা আছে। কিন্তু আজ অব্দি কখনো কল করা হয়নি। কল দিবো কি দিবো না তাই ভেবে দ্বিধাদ্বন্দে পরে গেলাম। ভাবতে ভাবতে কল দিয়ে ফেললাম। বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে।এই বুঝি কল ধরে ফেললো। একসময় কল রিসিভও হয়ে গেলো। অপরপাশ থেকে তার কণ্ঠস্বর পাওয়া গেলো।
— আসসালামু আলাইকুম।
আমি দ্রুত কল কেটে দিলাম। হুট করে এতো ভয় এসে হানা দিলো যে মনে হলো সে আমাকে বকবে।যদি জিজ্ঞেস করে কেন কল করেছি তাহলে কি বলবো? তাও তো জানি না। তার শরীরের কন্ডিশন কেমন তা আদোও জিজ্ঞেস করতে পারবো কিনা সন্দেহ। হাত-পা কাঁপছে আমার।তাকে মিস করছি তাতো বলতে পারবো না। এখন তো কথা বলার সাহস পাচ্ছি না। শারমিন আমার কান্ড দেখে বললো,
— কিরে কাকে কল করিস?
— কাউকে নয়, চল তো।
হঠাৎ পেছন থেকে একটা মেয়েলি কন্ঠে কেউ ডেকে উঠলো,
— রাই দাঁড়া!
কণ্ঠস্বরটা ভীষণ পরিচিত লাগছে। আমি থমকে দাঁড়িয়ে পেছনে তাকাতেই আরেকদফা অবাক। এ আমি কাকে দেখছি! আমার সামনে স্বয়ং জারা দাঁড়িয়ে আছে। এতদিন পর একে দেখে আমার কপাল কুঞ্চিত হয়ে গেলো। জারা সামনে এসে বললো,
— তুই শুরু করেছিসটা কি?
আমি কপালে কুঞ্চিতভাব রেখে শারমিনের দিকে তাকাতে দেখলাম ওরও সেম দশা। আমি বিস্মিত কন্ঠে বললাম,
— সরি!
— এখন সাধু সাজছিস?
— দুই গালে দশ আঙুলের ছাপ বসাতে না চাইলে আমার চোখের সামনে থেকে ভাগ তুই কাল নাগিনী।
নয়তো কানের নিচে এমন থাপ্পড় দিবো কানে কিছু শুনবি না।
আমার কথা শুনে জারা, শারমিন দুজনেই অবাক হয়ে গেলো। আমার মাথায় চিনচিন করে রাগ উঠছে। কখন জানি সত্যি আমি এই জারার সাদা গাল লাল করে ফেলি। জারা সম্ভবত আমার কথাটা হজম করতে পারলো না। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
— তুই তো এরকম ছিলি না।
— আগের নোভার সাথে এই নোভার আকাশ-পাতাল তফাৎ। গাল দুটো লাল না করতে চাইলে আমার সামনে থেকে সরে যা।
— আমি থাকতেও আসিনি। তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।
— বৈইমানের সাথে আমার কোন কথা থাকতে পারে না। ভালো থাকলে রাস্তা মাপ কাল নাগিনী। তোর মতো বান্ধবীতো দূরে থাক শত্রুও যাতে কারো না হয়।
— তুই কিন্তু এবার বেশি বলছিস।
— তুই আমার সামনে থেকে না সরলে বলার সাথে সাথে হাতও চলবে।
— রোশানকে মার কেন খাইয়েছিস?
আমি চমকে ওর দিকে তাকালাম। আমি রোশানকে মার কেন খাওয়াবো? কি বলে এসব? আমি মুখটাকে থমথমে করে বললাম,
— মানে?
— রোশান রাত থেকে হসপিটালে ভর্তি। ওকে একটা ছেলে ইচ্ছে মতো ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে মেরেছে।
— মরে নাই?
—গুরুতর আহত হয়ে হসপিটালে ভর্তি আছে। এক হাত, এক পা ভেঙে দিয়েছে।রোশান বললো ঐ ছেলেটা নাকি তোর নতুন প্রেমিক।
— একদম ঠিক করেছে। তা তোর নাগর রোশান দেওয়ান কি আছে নাকি পটল তুলেছে?
জারা রেগে বললো,
— কি ধরনের কথাবার্তা এসব?
আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললাম,
— কেন শুনতে পাচ্ছিস না?
— তুই কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছিস।
— আমি কোনকালেই বেশি বাড়াবাড়ি করিনি। করেছে রোশান তাই ও হসপিটালে ভর্তি। তুই করলে তোকেও ভর্তি করবো। যাতো কাল নাগিনী পথ ছাড় আমার। তোর মতো ফালতু মেয়ের সাথে কথা বলে আমি আমার মুড নষ্ট করতে চাই না। চল তো শারু।
শারমিন আমাদের মাঝে একটা কথাও বলেনি।ওকে নিয়ে পেছনে ঘুরতেই জারা বললো,
— এই সবকিছুর পেছনে আহাদ ভাইয়া ছিলো। সেই ছিলো মেইন কালপ্রিট। সে আমাকে তোর বিরুদ্ধে যেতে বাধ্য করেছিলো। রোশানের কানে বিষ ঢুকিয়েছিলো। তোর ছবি অন্য ছেলের সাথে এডিট করে ওকে দেখিয়েছিলো। তোকে রোশানের কাছে খারাপ করেছে।
💖💖💖
আমি ওর দিকে ঘুরে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললাম,
— আমি জানি।
জারা অবাক হয়ে বললো,
— তুই জানিস?
— হ্যাঁ, আমি জানি। তাও দেড় বছর আগের থেকে।
— কে বললো তোকে?
— রোশানের আরেক বন্ধু। ফয়সাল ভাইয়াকে চিনিস সে বলেছে।আহাদ আমাকে একবার কুপ্রস্তাব দিয়েছিলো। তাতে আমি রাজী হয়নি বলে এতো কিছু করেছে। রোশান জানতে পেরে আহাদকে আমার কাছে মাফ চাইয়েছিলো।এতে আহাদের প্রেস্টিজে লেগেছে। তাই আমার ও রোশানের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়েছিলো। দুজনের ওপর প্রতিশোধ নিতে এমন করেছে। সে ভেতরে ভেতরে ছকের গুটি সাজাতে লাগলো। অথচ সে উপরে আমাকে রোশানের সাথে সেটিং করে দিলো।এমন একটা ভান ধরেছিলো যে আমাদের দুজনকে সেটিং করে দিয়ে সে এতো খুশি, সাথে তার পুরনো কাজের জন্য সে লজ্জিত।আর সে মাঝ থেকে ভালো হয়ে গেলো।
আমাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে সে ভালো সাজতে আমাকে পরে অনেক হেল্পও করেছে। সব বন্ধুদের বিপরীতে সে যখন আমাকে এসে হেল্প করেছে তখুনি আমার খোটকা লেগেছে। কথায় আছে না অতিভক্তি চোরের লক্ষণ। তুই রোশানকে পছন্দ করতি। তাই তোকেও হাত করে নিলো।ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার জন্য বান্ধবীর সাথে বৈইমানী করলি।তোর কাছে বন্ধুত্বের থেকে রোশান বেশি হয়ে গেলো।তুই তো জেনেশুনে আমার সাথে এমন করেছিস। দোষ তিনজনেরি। কারো একটু কম কিংবা কারো একটু বেশি নয়। বরং সবারই সমান।নিজে এখন এসে রোশানের মতো ভালো সাজছিস? হাহ, তোদের তিনজনকে ক্ষমা আমি জীবনেও করবো না। ভাগ এখান থেকে। নয়তো রোশানের পাশের সিটে তোকে ভর্তি হতে হবে। না আমার প্রেমিক মারবে না, আমি মারবো তোকে।
জারার উত্তরের অপেক্ষা না করে আমি শারমিনের হাত ধরে দ্রুত অন্য দিকে চলে এলাম। আরেকটু সময় থাকলে জারার গালে ঠাটিয়ে দুটো চড় মারতাম। কিন্তু আমি ওর মতো মেয়েকে থাপ্পড় মেরে নিজের হাত নষ্ট করতে চাই না। তবে একটা বিষয় ক্লিয়ার হয়ে গেলো গতকাল রাতে রোশানকে একা পেয়ে এনাজই মেরেছে। একদম ঠিক করেছে। কিন্তু সমস্যা হলো মারতে গিয়ে নিশ্চয়ই রোশানের হাতে কয়েক ঘা খেয়েছে। সাথে পায়ে ব্যাথাও পেয়েছে। এবার হিসাব পুরো মিলে গেলো।
এই সবকিছুর পেছনে আহাদ ছিলো। হ্যাঁ সেই মেইন কালপ্রিট। সে এখন আব্দুল্লাহপুর জেলে আছে। না আমার জন্য নয়। ড্রাগের ব্যবসা করতে গিয়ে ধরা খেয়েছে। মাস দুই আগে ফয়সাল ভাইয়ার থেকে খবর পেয়েছিলাম। ফয়সাল ভাইয়া আমার সাথে হওয়া অন্যায়টা মেনে নিতে পারেনি। তাই পরবর্তীতে আমাকে সব জানিয়ে দিয়েছিলো। সব বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ নষ্ট করে দিয়েছে। তাও শুধুমাত্র এই জন্য যে ওরা আমার সাথে সবাই অন্যায় করেছে বলে। ভাইয়া আমাকে হাতজোড় করে বলেছিলো,
—আমি যদি প্রথম থেকে এসব জানতাম, তাহলে কখনো তোমার সাথে এমনটা হতে দিতাম না নোভা। তাই আমাকে কেউ কিছু বলেওনি।আমি তখন ঢাকায় ছিলাম। ঢাকা থেকে এসে যখন সব জানতে পারলাম তখন সব শেষ। তবু্ও আমি হাল না ছেড়ে সবকিছু খুঁজে বের করে তোমাকে বলে দিলাম। তুমি এসব ভুলে গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করো।যারা তোমাদের সাথে এমন করেছে তাদের পাপের ফল তারা অবশ্যই পরবর্তীতে ভোগ করবে।
আমি নিরব চোখে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এর জন্য আমি বলি পৃথিবীর সব ছেলে খারাপ নয়। খারাপ হলে পৃথিবী ঠিক থাকতো না।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে শারমিন বললো,
— মন খারাপ?
— না তো!
— তুই এতকিছু সহ্য করেছিস কি করে? আমি হলে সত্যি মরে যেতাম।
— মরতেই তো চেয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছি৷ তবে এখন আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই। কি ভুল করতে গিয়েছিলাম।এত সুন্দর জীবনটাকে আমি নিজ হাতে নষ্ট করতে চেয়েছি।
— এই নোভা ঐদিকে দেখ।
— কি দেখবো?
— দেখনা।
আমি শারমিনের দৃষ্টি বরাবর তাকাতেই দেখি এনাজ এক পায়ে হালকা খুড়িয়ে আমাদের দিকে দৌড়ে আসছে। আমি তাকে এভাবে আসতে দেখে বেশ অবাক হলাম।সে সামনে এসে দুই হাত হাঁটুতে রেখে কিছুটা দম নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
— তুমি ঠিক আছো?
— আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?
— এতখন খারাপ ছিলাম। এখন ঠিক আছি।
— আপনি এমন দৌড়ে কোথা থেকে এলেন?
এনাজ আমার কথার উত্তর না দিয়ো শারমিনের দিকে তাকিয়ে বললো,
—তোমাকে তওহিদ গেইটের সামনে যেতে বলেছে। তুমি একটু গিয়ে দেখে এসো।
শারমিন কপাল কুঁচকে বললো,
— কেন?
— আমি বলতে পারবো না। তুমি গিয়ে দেখো।
শারমিন চলে গেল। ও হয়তো বুঝতে পেরেছে আমাদেরকে একটু স্পেস দেওয়া দরকার।তাই অমত না করে সেদিকে রওনা দিলো। এদিকে মানুষ একদমি নেই। ক্লাশ চলাকালীন সময় মানুষের আনাগোনা কমই থাকে। শারমিন যেতেই আমার গালে শক্ত করে একটা চড় পরলো৷ ঘটনার আকস্মিকতায় আমি গালে হাত দিয়ে বোকা বনে গেলাম। তাকিয়ে দেখি এনাজ ফুঁসছে। আমি গালে হাত দিয়ে কাঁদো কাঁদো ফেস করে বললাম,
— কি হয়েছে মারলেন কেন🥺?
— আরেকটা কথা বলবে আরো দুটো দিবো। সাধারণ কমোন সেন্স নেই তোমার?
— কি করেছি আমি?
— আবার জিজ্ঞেস করো কি করেছো? মারবো আরেকটা?
উনি হাত তুলতেই আমি দুই হাতে মুখ ঢেকে কুজো হয়ে গেলাম। উনি হাত নামিয়ে এক হাতে কোমড়ে রেখে আরেক হাতে কপালের অর্ধেক অংশ স্লাইড করতে করতে রাগী গলায় বললো,
— তোমার ধারণা আছে আমি কি একটা অবস্থায় ছিলাম। কল দিয়েছিলে কেন? কল দিয়ে কথা কেন বলোনি? কতবার কল দিয়েছি আমি, তা কি জানো? আমি ভেবেছিলাম তোমার কোন বিপদ হয়েছে। তাই দ্রুত বাইক নিয়ে চলে এলাম। এটলাস্ট আমার কলটাতো পিক করতে পারতা। আমি এক মুহুর্তের জন্য চোখ, মুখে অন্ধকার দেখছিলাম। আমি ভেবেছিলাম তোমার কোন ক্ষতি হয়েছে। কলিজা শুকিয়ে গিয়েছিল। তায়াং থাকলে এতখনে আরো দুটো থাপ্পড় তোমার গালে পরতো।
আমি গালে হাত দিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গরিয়ে পরলো।থাপ্পড় মেরেছে তার জন্য নয়,অভিমানে। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে দেখলাম ২৭ টা মিসড কল। মোবাইল সাইলেন্ট করে রেখেছিলাম তাই রিং হয়নি। আর উনি আমার বিপদ ভেবে এখানে চলে এসেছে। নিজের পা ব্যাথা সেদিকেও খেয়াল নেই। কিন্তু আমি কোন কথা বলবো না। আমাকে মারছে কেন? আমি কি জানতাম তাকে কল দিলে সে ভাববে আমার বিপদ হয়েছে। আর এভাবে ছুটে আসবে। সেগুলো না হয় বাদ দিলাম। তাই বলে আমায় মারবে? এত জোরে কেউ থাপ্পড় দেয়? আমার গাল জ্বলে যাচ্ছে। আরেকটু আস্তে দিলে কি হতো? হু হু আমি একটুও কথা বলবো না তার সাথে। মোবাইল যে সাইলেন্ট ছিলো তাও বলবো না।তাকে মিস করছিলাম, তার শরীরের খবর নেওয়ার জন্য কল দিয়েছিলাম সেটাও বলবো না। কোন কথাই বলবো না। মারলো কেন আমায়? ছোট বাচ্চা মেয়েকে কেউ এভাবে মারে🥺?
#চলবে