শিশির_ভেজা_রোদ্দুর Part_58

0
1236

শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
Part_58
#Writer_NOVA

২ দিন পর…..

কলেজের ক্যান্টিনে বসে আছি। সাথে তন্বী ও শারমিন। ওরা দুজন বকবক করছে আমি নিরব শ্রোতার মতো সব শুনছি। তবে ওদের কোন কথা আমার মাথায় গাঁথছে না। আমি তো গত দুই দিন আগের কথা চিন্তা করতে করতে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কি হবে সামনে তা জানি না।এদিকে এরা দুজন রাজ্যের পেচাল শুরু করছে। ওদের থামানো এখন আমার জন্য দায়। শারমিন কথা থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— কিরে তুই এমন স্টপ হয়ে আছিস কেন?

— এমনি।

— চিন্তা করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে।

— কিচ্ছু ঠিক হবে না। যদি না আমরা ঠিক করি।

— তাহলে ঠিক করে নে।

— মুখে বললে তো ঠিক হয়ে যায় না। এর জন্য ইচ্ছা, আগ্রহ, পরিশ্রমও চাই।

তন্বী আমার হাতের ওপর একটা হাত রেখে আস্বস্ত গলায় বললো,

— তুমি টেনশন করে শুধু শুধু নিজের চেহারার বেহাল দশা করো না। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমাকে ভেঙে পরলে চলবে না।

— আমি ভেঙে পরছি না তন্বী, আমি ভয় পাচ্ছি।

— কেন নোভাপু?

— শেষ অব্ধি আমরা একে অপরের হবো তো?

— আল্লাহ চাইলে সব ঠিক হয়ে যাবে। যদি তোমার ভাগ্যে এনাজ ভাইয়া থাকে তাহলে দশ বছর পর হলেও সে তোমারি হবে।

আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে তন্বীকে বললাম,
— কিন্তু সে তো আজকাল ইগনোর করছে তন্বী।

— এটা কখনো হতে পারে না নোভাপু। আমি এনাজ ভাইয়াকে সেই ছোটবেলা থেকে দেখছি। তাকে আমি ভালো করে চিনি। সে কখনো তোমাকে ইগনোর করতেই পারে না।

— গত দুদিন ধরে না হলেও আমি শত শত কল দিয়েছি। বারবার সুইচ অফ বলেছে। সে নিজ থেকে একটা কলও দেইনি।

— না জেনে কথা বলো না তুমি।

শারমিনও তন্বীর সাথে একমত হয়ে বললো,
— তুই না জেনে কথা বলিস না। এমনও তো হতে পারে তার মোবাইলের কোন সমস্যা হয়েছে।

আমি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ওদের দিকে মলিন চোখে তাকিয়ে বললাম,

— জানি না। হতেও পারে। বাদ দে এসব কথা। তোরা কি খাবি বল?

শারমিন চোখ মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন একে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

— খাবারের কথা পরে। আগে বল আন্টি-আঙ্কেল কি চলে গেছে?

— হ্যাঁ, কেন?

— যাওয়ার আগে কিছু বলে যায়নি?

— না।

— আবার কবে আসবে?

—তায়াং ভাইয়ার কাবিনের সকল ব্যবস্থা হয়ে গেলে সামনের সপ্তাহে আসবে। ভাইয়ার বিয়েতে সবাই রাজী আছে। শুধু দাদী ছাড়া। দাদীকে রাজী করালে আগামী সপ্তাহে ওদের কাবিন হয়ে যাবে। তারপর খালু এলে অনুষ্ঠান করে উঠিয়ে নিয়ে আসবে।

— কিন্তু তন্বী যে বললো তোর নূর আপি নাকি রাজী না। তাহলে বিয়ে কিভাবে হবে?

— কে বলেছে রাজী না? আমার সাথে তায়াং ভাইয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছিল বলে আপি খুব কষ্ট পেয়েছে। তাই এখন ভাইয়ার সাথে অভিমান করে আছে। যার জন্য সবাইকে বলে বেরুচ্ছে সে বিয়েতে রাজী নয়।

— ওহ আচ্ছা। আঙ্কেল, আন্টি এবার এলে তাদের সাথে তুই নিজে কথা বলে দেখিস।

— হুম তাই করতে হবে। তন্বী খাবার নিয়ে আয়।

— ওকে নোভাপু।

তন্বী চলে গেল। ও যাওয়ার পরপরই রওনক আমাদের সামনে হাজির। অনেক দিন পর তাকে দেখলাম। লাফ দিয়ে সামনের চেয়ারে আমার মুখোমুখি বসে বললো,

— আসসালামু আলাইকুম ভাবী। কেমন আছো?

আমি মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে মিষ্টি করে সালামের উত্তর দিলাম।

— ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?

— আলহামদুলিল্লাহ। তা দিনকাল কেমন যাচ্ছে?

— যাচ্ছে ঠেলে ধাক্কিয়ে কোনরকম আপনার?

— এই তো ভালোই।

— হঠাৎ কি মনে করে আজ আমার কাছে?

— না এমনি। ভাবলাম অনেক দিন ধরে বড় ভাইয়ের হবু বউয়ের সাথে দেখা হয় না তাই একটু দেখা করে আসি।

আমি তাচ্ছিল্য করে বললাম,
— আর ভাইয়ের হবু বউ!

— এমন করে বললে কেন?

— নাহ কিছু না।

— আমি কিন্তু সবই জানি ভাবী।

— জানলে তো ভালোই।

— তুমি আমার থেকে বয়সে ছোট তাই তুমি করে বলছি। কিছু মনে করো না।

— নাহ মনে করার কি আছে?

— কিছু মনে না করলেই ভালো।খুদা লাগছে, কিছু খাওয়াও।

উনার কথা বলার ভঙ্গিতে আমার হাসি পেলো। অন্য সময় হলে এর সাথে এই খাওয়ানো নিয়ে নানা কথা শুনিয়ে দিতাম। কিন্তু আজ তা করতে মন সায় দিলো না। ধীর কন্ঠে বললাম,

— কি খাবেন বলুন?

রওনক চোখ দুটো গোল গোল করে বললো,
— আল্লাহ তুমি রাজী হয়ে গেলেন মিস ঝগড়ুটে সরি ভাবী? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আমার সাথে ঝগড়া করবে। কিন্তু তা না করে রাজী হয়ে গেলে? আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না।

— আপনার কি ধারণা আমি সবসময় ঝগড়া করি😒?

— তাই ভাবতাম এতদিন।

💖💖💖

আমাদের কথার মাঝে তন্বী চলে এলো। তন্বী খাবারগুলো আমাদের সামনে রেখে আড়চোখে রওনকের দিকে তাকালো। দুজনের চোখাচোখি হতেই মিষ্টি একটা হাসি বিনিময় হলো। চোখে চোখে কিছু ইশারাও হলো। আমি দেখেও না দেখার ভান করে বসে রইলাম। আপাতত এসব বিষয়ে নিজেকে ফোকাস করতে ইচ্ছে করছে না। তন্বীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রওনক ওকে তাড়া দিয়ে বললো,

— এই চেয়ারে বসো।

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রুর কাছে চুলকে লাজুক ভঙ্গিতে রওনক বললো,

— আজ আসি ভাবী। আমাকে একটু উঠতে হবে। পাশের কলেজে আমাদের সভা আছে।

আমি ভদ্রতা বজায় রাখতে তাকে বললাম,
— সেকি খেতে না চাইলেন? না খেয়ে চলে যাবেন? এটা ঠিক নয় বসুন।

— আজ নয় আরেকদিন। আজ উঠি।

সবার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে রওনক চলে গেলো। ওর যাওয়ার পানে তন্বী এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ওর মুখটা অনেকটা মলিন দেখাচ্ছে। আমি ওর মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললাম,

— কি দেখিস তন্বী?

তন্বী কিছুটা চমকে আমার দিকে ফিরে মুখ কুচোমুচো করে বললো,

— কিছু না।

আমি কথা বাড়ালাম না। চুপচাপ খাবার খেতে লাগলাম। ওরা দুজন হাসি-ঠাট্টায় মেতে খাবার খাচ্ছে। আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখে খাবার মুখে পুরছি। হঠাৎ এনাজকে দেখতে পেয়ে কিছুটা চমকে উঠলাম। এনাজের সাথে রওনককে কথা বলতে আরেকদফা অবাক। রওনক হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলছে। এনাজ চুপ করে তা শুনছে। আমি দ্রুত খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। তন্বী, শারমিন একসাথে প্রশ্ন করে উঠলো,

— কোথায় যাস নোভা?

— যাচ্ছো কোথায় নোভাপু?

আমি দ্রুত সেখান থেকে যেতে যেতে ওদের দিকে পেছন ঘুরে হাত দেখিয়ে বললাম,

— একটু আসছি। তুই এখানেই থাকিস।

আমি দৌড়ে এনাজের দিকে গিয়েও তাকে নাগাল পেলাম না। রওনকের সাথে কথা বলে সে দ্রুত পায়ে এখান থেকে কেটে পরছে। আমি পেছন থেকে বেশ কয়েকবার ডাকলাম।

— এনজিও সংস্থা। মিস্টার এনাজ! ও হ্যালো।

উনি একবারের জন্যও পেছনে তাকালো না। দ্রুত পায়ে কলেজের গেট পেরিয়ে বাইরে চলে গেল। আমি আরো কয়েকবার ডাকলাম। কিন্তু সে সাড়াও দিলো না, পেছনে ফিরেও তাকালো না। গেটের বাইরে গিয়ে বাইকে উঠে চাবি ঘুরিয়ে স্টার্ট দিলো। তারপর সে একটানে চলে গেলো। আমি দৌড়ে গেইটের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। যতখন অব্দি তার বাইক দেখা গেলো ততক্ষণ পর্যন্ত ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। আমাকে ইগনোর করলো সে। আমি তো অনেক জোরেই তাকে ডেকেছি। দূরের মাঠের ছেলেগুলো আমার কন্ঠ শুনে অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়ে ছিলো। কিন্তু সে এত কাছে থেকে শুনতে পায়নি। বিষয়টা কিরকম সন্দেহজনক। উনি বোধহয় সত্যি আমাকে ইগনোর করা শুরু করেছে। নয়তো একবারের জন্য হলেও ফিরে তাকাতো। কখনও তো এমনটা হয়নি। ইগনোর না করলে আজ এমনটা হলো কেন?

ধীর পায়ে পুনরায় কলেজের ভেতর প্রবেশ করলাম। সামনেই রওনককে দেখতে পেলাম। ওকে দেখে আমি ওর দিকে এগিয়ে গেলাম।

— রওনক আপনার সাথে আমার একটু কথা ছিলো।

রওনক কয়েকটা ছেলের সাথে কথা বলছিলো। আমার দিকে ঘুরে কপাল কুঁচকে তাকালো। তারপর সাথের ছেলেগুলোকে বিদায় জানিয়ে আমাকে বললো,

— হ্যাঁ ভাবী বলো।

— কথায় কথায় ভাবী বলেন না তো ভালো লাগে না।

আমি কঠিন গলায় কথাটা বলতেই রওনক মুচকি হেসে বললো,

— ভাইয়ার ওপর রাগ করেছো?

— নাহ, রাগ করবো কেন?

— ওহ তাহলে অভিমান হয়েছে।

— কিছুই হয়নি।

মুখে স্বীকার না করলেও তার ওপর আমার প্রচন্ড অভিমান হয়েছে। উনি তো কখনও এমন করেননি। অন্য সময় হলে নিজে আমার সাথে দেখা করতে চলে আসেন। আজ আমি ডাকলাম আর উনি আমাকে এড়িয়ে চলে গেলো। অভিমান হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। রওনক আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বললো,

— তুমি কি জানি বলবে!

— হুম বলবো তো।

— কি?

— তোমার ভাইয়া তোমার সাথে কি কথা বললো?

— ওই তো তোমার খোঁজ খবর নিলো। আমাকে তোমার কাছে সেই পাঠিয়ে ছিলো।

আমি অবাক চোখে জিজ্ঞেস করলাম,
— সে তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়েছে?

— হ্যাঁ, সকালে কল করে কলেজে আসতে বললো। আমি তো আজ আসতাম না। শুধু তোমার খবর নিতে ভাইয়ার অনুরোধে আসতে হলো।

— সে তো কলেজে এসেছিলো। তাহলে নিজে এসে কেন জিজ্ঞেস করলো না।

— সেটা তো আমি জানি না। তুমি তাকে জিজ্ঞেস করো।

— তাকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে তো আমায় ইগনোর করে চলে গেলো। কতবার ডাকলাম একটু শুনলো না।

রওনক অবিশ্বাস্য কন্ঠে চোখ দুটো বড় বড় করে বললো,

—এনাজ ভাই তোমাকে ইগনোর করছে এটা আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না। তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। ভাই কখনো তোমাকে ইগনোর করবে না।

— কিন্তু এটাই হয়েছে।

— রওনক যাবি না সভায়?

পেছন থেকে একটা ছেলে রওনককে চেচিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করলো। রওনক উঁকি মেরে তার দিকে তাকিয়ে বললো,

— হুম যাবো তো। একটু দাঁড়া আমি আসছি।

— ওকে আয়। আমি এখানে আছি।

রওনক আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
— আমাকে যেতে হবে। আমি তোমাদের বিষয়ে নাক গোলাতে চাইছি না। আমি চাই তোমাদের মধ্যকার যাবতীয় কিছু তোমরা নিজেরাই সমাধান করে নাও। আসছি।

রওনক আমাকে সাইড কাটিয়ে সামনের দিকে চলে গেল। আমি শূন্য দৃষ্টিতে দূরের মাঠটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সেখানে কয়েকজন ছেলে-মেয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে। টুপ করে চোখের কর্ণিশ বেয়ে দু ফোঁটা জল অবাধ্য হয়ে ঝড়ে পরলো। আমি শত চেষ্টা করেও তাদেরকে আটকাতে পারলাম না।

#চলবে

আজকে তাড়াহুড়ো করে কি লিখছি নিজেও জানি না। যেভাবে সাজাতে চেয়েছিলাম সেভাবে পারিনি।আজকের পর্ব ভালো না লাগলে, আমি ক্ষমাপার্থী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here