#তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২০
যাত্রীদের প্লেনে উঠার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। রেজোয়ান বারবার জাহিদের নাম্বারে ট্রাই করছে। নাম্বার আনরিচেবল। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক। এইসময়ে জাহিদের ফোন কিছুতেই বন্ধ থাকার কথা নয়। রেজোয়ানের চিন্তায় হচ্ছে। নিশ্চয়ই কোন ঝামেলায় আটকে গেছে জাহিদ। আরো কয়েকবার ট্রাই করলো। এবার রিং হলো কিন্তু কেউ রিসিভ করলো না।
মাথা থেকে দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে আস্তে আস্তে প্লেনে উঠার প্রস্তুতি নিলো সে। মিনিট খানেক বাদে জাহিদ নিজেই কল ব্যাক করলো। রেজোয়ান ফোন রিসিভ করে সর্বপ্রথম তাঁর অবস্থানের কথা জানতে চাইলো,’হ্যাঁ জাহিদ। কোথায় তুমি? তোমার ফোন বন্ধ কেন? আধঘণ্টার মাঝে প্লেইন টেইক অফ করবে।’
-‘একটা খারাপ খবর আছে স্যার।’ ওপাশ থেকে জাহিদের উদ্বিগ্ন ককন্ঠস্বর শোনা গেলো। রেজোয়ান এমনিতেই টেনশনে ছিলো। তারওপর খারাপ খবরের কথা শুনে ধৈর্য রাখতে পারলো না। কিঞ্চিৎ গলা চড়িয়ে বললো,’কি?’
-‘নিলি ম্যাম অ্যাক্সিডেন্ট করে হস্পিটালাইজ। সারভাইব করার চান্স খুবই কম। অ্যাক্সিডেন্টের খবর শুনে মি.রেজা পালিয়েছে। স্থানীয়রা একটা সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেছে উনাকে। কিন্তু এখানে আইসিইউ, বেড, কেবিন কিছুই খালি নেই। তাই বাধ্য হয়ে বারান্দায় রাখা হয়েছে। ডাক্তাররা বলছে এক্ষুনি যদি আই সি ইউর ব্যবস্থা না করা হয় তবে খুব তাড়াতাড়ি কোন অঘটন ঘটে যাবে।
রেজোয়ানের হাতে ফাইল পত্র,কাগজ যা কিছু ছিলো সব মাটিতে পড়ে গেলো। শূন্য, ভোঁতা দৃষ্টিতে শায়লা মুরসালীনের মুখের দিকে চেয়ে রইলো সে। ক্রমশ দৃষ্টি ঝাপ্সা হয়ে আসছে তাঁর। মস্তিষ্ক ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। শায়লা মুরসালীন ছেলের অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেলেন। রক্তশূন্য ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে রেজোয়ানকে।চাদর দিয়ে তাঁর মুখমন্ডলের ঘাম মুছে দিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,’কি হয়েছে বাবা? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’
-‘মা জাহিদ কি বলছে এসব?’ বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো রেজোয়ান। শায়লা মুরসালীন এবার আরো বেশি ঘাবড়ে গেলেন। আতংকিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,’কি বলছে?’
-‘নিলি অ্যাক্সিডেন্ট করে হস্পিটালে ভর্তি মা। বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম। আমি এখন কি করবো মা!’
রেজোয়ানের পাগলের মত অস্থির আচরণ করছে। কান্নার বেগ ক্রমশ বাড়ছে তাঁর। আশেপাশে সবাই হাঁ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। শায়লা মুরসালীন রেজোয়ানের হাত থেকে ফোন নিয়ে নিজে জাহিদের সঙ্গে কথা বললেন,’কন্ডিশন কেমন জাহিদ? বাঁচবে?’
-‘ভালো না ম্যাম। যে কোন সময় অঘটন ঘটে যেতে পারে। জরুরি ভিত্তিতে আই সি ইউতে শিফট করা প্রয়োজন।’
-‘ব্যবস্থা করো। আমরা আসছি।’
ফোন রেখে ছেলের হাত ধরে উঠে দাঁড়ালেন শায়লা মুরসালীন। ধমক দিয়ে বললেন,’কান্নাকাটি পরে হবে। আগে হস্পিটালে চল।’
রেজোয়ান কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না। যার জন্য সে এতগুলো দিন অসহ্য বেদনায় দিন কাটিয়েছে, এত আত্মত্যাগ করেছে, দেশ ছেড়ে পর্যন্ত পালিয়ে যাচ্ছে সে আজ দুনিয়া ছেড়ে পালানোর পায়তারা করছে। নিজেকে কি করে স্থির রাখবে রেজোয়ান। শায়লা মুরসালীন একপ্রকার টেনে ছেলেকে বের করে নিয়ে গেলেন।
★
নিলির কন্ডিশন খুব একটা ভালো নয়। ব্রেনে মারাত্মক আঘাত লেগেছে। মেজর অপারেশন করানো লাগবে। বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম। পরিস্থিতি আউট অফ কন্ট্রোল দেখে রেজা সটকে পড়েছে। এতদিন রেজোয়ানকে শায়েস্তা করার জন্য নিলিকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলো সে। নিজামউদ্দিন সাহেবের চিকিৎসার সব দায়ভারও নেবে বলেছিলো। কিন্তু এখন যখন সেটা হচ্ছে না তখন আর নিলিকে দিয়ে তাঁর কোন কাজ নেই। উপরন্তু রেজোয়ানও সব ছেড়েছুড়ে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। অতএব এই উটকো ঝামেলার মরা বাঁচাতে তাঁর কিছু আসে যায় না।
রেজোয়ান রিসেপশনে টাকা জমা দিয়ে আই সি ইউর বাইরে বসে আছে। আজই অপারেশন করা হবে নিলির। যাবতীয় ফর্মালিটিজ সব জাহিদ পালন করছে।
শায়লা মুরসালীন এই প্রথম স্নেহের দৃষ্টিতে ছেলের মুখের দিকে চাইলেন। দুহাতে মুখ চেপে ধরে নিঃশব্দে কাঁদছে তাঁর আদরের ছেলেটা। চোখের পানি হাতের গাল ভিজে যাচ্ছে।
রিসেপশনের কাজ শেষ করে ফিরে এলো জাহিদ। রেজোয়ানকে উদ্দেশ্য করে নরম গলায় বললো,’আপনি টেনশন করবেন না স্যার। উনার কিচ্ছু হবে না।’
বাচ্চা শিশুর মত ফুঁপিয়ে উঠলো রেজোয়ান। চোখের সামনে নিলির এমন করুণ অবস্থা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না সে। তাঁর আসার আগে হস্পিটালের বারান্দায় পড়ে ছিলো নিলি। জাহিদ ছাড়া সঙ্গে কেউ ছিলো না। একটা লোক ছিলো না আফসোস করার মতন। রেজোয়ানের পূর্বের সব অভিমান ভুলিয়ে দিলো নিলির অসহায় অচেতন মুখ। বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইলো হৃদপিন্ডটা। শত চেষ্টা করেও নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না সে। ছুটে গিয়ে নিলিকে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে চাইছে,’অভিমান আমার করার কথা ছিলো হৃদয়হীনা নিষ্ঠুর, তোমার নয়। তুমি কেন আমাকে বারবার কষ্ট দিচ্ছো? কেন তুমি আমার ভালোবাসা বুঝতে পারো না।’
শায়লা মুরসালীন ছেলের মাথায় হাত রাখলেন। আঁচল দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিলেন। অশ্রুসজল, করুণ মুখে মায়ের দিকে চাইলো রেজোয়ান। ঠোঁট কাঁপছে তাঁর। চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছে। বাচ্চা ছেলেটির মতন তাঁর মাথা বুকে টেনে নিলেন শায়লা মুরসালীন। মাথা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,’পুরুষ মানুষ এত ভেঙ্গে পড়লে চলে না। পুরুষ মানুষকে শক্ত হাতে সকল পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়।আল্লাহ ভরসা। ধৈর্য রাখ।
রেজোয়ান ফের কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। মায়ের হাত দুটো চেপে ধরে বললো,’ওকে তুমি বদদোয়া দিও না মা। ও বেঁচে থাকলেই আমি খুশি। ওর কাছে যাবো না। কথা দিচ্ছি তোমাকে।’
শায়লা মুরসালীন ছেলের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তেমন কোন কঠোর মনোভাব দেখালেন না। রেজোয়ান মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। এইমুহূর্তে মা হিসেবে উনার ছেলের পাশে থাকা দরকার। ছেলেকে আশ্বস্ত করে বললেন,’এসব কথা এখন থাক। আমি চাই সে বাঁচুক। অন্যের সন্তানের মৃত্য কামনা করা কোন মায়ের পক্ষেই সম্ভব নয়।
★
নয়ঘন্টা যাবত অস্ত্রপাচার শেষে ওটি থেকে বের করা হলো নিলিকে। মাথা, হাতে, পায়ে গলায় ব্যান্ডেজ। অচেতন অবস্থায় আই সি ইউর বেডে পড়ে আছে তাঁর নিথর দেহ। রেজোয়ান গ্লাসের ফাঁক দিয়ে চাইলো। চোখের পানি আজকে বাধ মানছে তাঁর। সারাজীবন এই মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছে। সবাই তাঁকে ঠকিয়েছে। কখনো রেজোয়ানকে বাঁচাতে গিয়ে ঠকেছে কখনো বা নিজেকে সুখি করতে গিয়ে। কিন্তু ঠকেছে। সুখের দেখা একমুহূর্তের জন্যেও পায় নি। হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছলো রেজোয়ান। শায়লা মুরসালীনকে উদ্দেশ্য করে বললো,’তুমি মামার বাসায় চলে যাও মা। গিয়ে রেস্ট নাও। আমি হস্পিটালে থাকি।’
-‘কিন্তু ওর জ্ঞান তো এখনো ফেরেনি। তাছাড়া ওর বাবাকেও খবর দেওয়া হয় নি।’
-‘উনি আজ বারোদিন যাবত হস্পিটালে ভর্তি। হুঁশ নেই। ডাক্তাররা অক্সিজেন দিয়ে রেখেছে।’
-‘বলিস কি?’
-‘হ্যাঁ। জাহিদ নিলির বাসায় গেছিলো খবর জানাতে। সেখানে ওর প্রতিবেশিরা বললো নিলির বাবা আজকে বারোদিন যাবত অচেতন।’
শায়লা মুরসালীন কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। নারীহৃদয় স্বভাবতই কোমল। তাঁর ওপর নিলির এমন দুর্দশার কথা শুনে বিগলিত হয়ে গেলেন। আফসোসের সুরে বললেন,’লোকটা নিজেও শান্তিতে রইলো না মেয়েটাকেও শান্তিতে থাকতে দিলো না।’
রেজোয়ান জবাব দিলো না। নিলির এমন পরিস্থিতির জন্য সে ঠিক কাকে দোষ দিবে বুঝতে পারছে না। সে নিজেও তো দোষী। চাকরীতে জয়েন করার পর থেকে কম অত্যাচার তো করে নি নিলির ওপর। বাধ্য হয়ে মেয়েটা চাকরী ছেড়ে দিয়েছে। এতকিছুর পর রেজোয়ান নিলিকে কি করে একতরফা দোষ দেয়?