#তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১২
গাড়িতে একসঙ্গে বসে আছে রেজোয়ান এবং তিন্নি। মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে রেজোয়ান। বেরোনোর সময় শায়লা মুরসালীন বারবার করে বলে দিয়েছেন তিন্নিকে যেন সঙ্গে করে নিয়ে যায়। তিন্নির পরীক্ষা শেষ। কয়েকদিন উনার কাছে থাকবে।
রেজোয়ান আড়চোখে তিন্নির দিকে চাইলো। কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছে। খুব একটা তাকাচ্ছে না সামনের দিকে। ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিলো রেজোয়ান।
বাসার কাছাকাছি চলে এসেছে প্রায়। তিন্নি হঠাৎ কান থেকে হেডফোন খুলে বললো,’আপনি কি আমাকে দিয়ে আবার চলে আসবেন?’
-‘সেরকমই তো ইচ্ছে। কিন্তু মা ছাড়বে কিনা সেটাই আসল কথা।’
-‘ও আচ্ছা।’
-‘কেন? তোর কিছু লাগবে?’
-‘হ্যাঁ। আমি আসার সময় আমার ওষুধের বক্সটা ফেলে এসেছি।’
-‘কিসের ওষুধ?’
-‘মাথাব্যথার!’
-‘সেটা তো যেকোন দোকান থেকে কিনে নেওয়া যাবে। নাম মনে আছে ওষুধের?’
-‘আছে।’
-‘তাহলে সমস্যা নেই। আমি বেরোনোর সময় মনে করিয়ে দিলেই চলবে।’
‘আচ্ছা’ বলে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো তিন্নি। অন্যদিনের তুলনায় আজকে একটু চুপচাপ লাগছে ওকে। রেজোয়ান সেটা লক্ষ্য করে বললো,’কি রে। কি হয়েছে তোর? মন খারাপ নাকি?’
-‘অল্প,অল্প।’
রেজোয়ান হেসে ফেললো। ইশারায় জিজ্ঞেস করলো,’কেন?’
-‘আব্বা বলেছে রেজাল্ট ভালো না হলে আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে।’
-‘ভালোই তো? এই জন্য মন খারাপ?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘কেন তুই না বিয়ে করতে চেয়েছিলি?’
-‘হ্যাঁ। চেয়েছিলাম। কিন্তু সমস্যা তো আপনার জন্যই হচ্ছে। আপনি আমাকে বলেছিলেন শিক্ষিত মেয়ে ছাড়া বিয়ে করবেন না।’
রেজোয়ান চুপ করে গেলো। এই মেয়েটাকে এত করে বোঝানোর পরেও সে বারবার একই কাজ করছে। ইচ্ছে করে আগুনে ঝাপ দিতে চাইছে।
বাস্তবিক, তিন্নিকে বড্ড ভালোবাসে রেজোয়ান। কিন্তু তিন্নি যেমন করে চায় তেমন করে নয়। তেমন করে সে কেবল একজনকেই ভালোবেসেছে।
-‘কি হলো? আপনি কথা বলছে না কেন?’
-‘তোর সঙ্গে কথা বলা যায়? বলিস তো সব আবোলতাবোল কথাবার্তা। কতদিন নিষেধ করেছি আমার সামনে এই ধরনের কথাবার্তা বলবি না তবুও কেন বলিস?’
-‘ভালো লাগে। আপনাকে রাগাতে আমার ভালো লাগে।’
-‘তুই আমাকে রাগানোর জন্য ইচ্ছে করে এসব বলিস?’
-‘হ্যাঁ। কিন্তু সত্যি বলি।’
রেজোয়ান দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তিন্নি কেন এত অবুঝ? কেন বুঝতে চাইছে না সে যা চাইছে তা অসম্ভব।
মাঝেমাঝে তিন্নির জন্য ভীষণ ভয় হয় রেজোয়ানের। ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণা এই বাচ্চা মেয়েটা সহ্য করতে পারবে তো?
এই যন্ত্রণা বড়ই ভয়ানক! সারাজীবন বুকে পাথর চাপা দিয়ে বয়ে বেড়াতে হয়। সে ভেবেছিলো তিন্নি বড় হলে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তাঁর ধারণা ভুল। দিনদিন মেয়েটার পাগলামি বাড়ছে।
★
মায়ের সঙ্গে কথা কাটাকাটি চলছে রেজোয়ানের। কোন এক গোপন মারফতে নিলির ফিরে আসার খবরটা শায়লা মুরসালীন এর কানে গেছে। সেই নিয়েই রেজোয়ানের ওপর খেপেছেন তিনি। রেজোয়ানকে এবার বিয়ে জন্যে চাপাচাপি করছেন। হুমকিও দিয়েছেন রেজোয়ান যদি বিয়ে করতে রাজি না হয় তবে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন তিনি।
রেজোয়ানের মুখ থমথমে। মায়ের কথাটা সে মানতে রাজি নয়। আবার শক্ত ভাবে প্রতিবাদও করতে পারছে না। পাছে তিনি দুঃখ পান।
-‘আমার কথার কোন মূল্য নেই তোর কাছে। এইজন্য তোকে আমি কষ্ট করে মানুষ করেছি? বয়স হয়ে গেলে আসলে মাবাবার কোন দাম থাকে না!’ কেঁদে ফেললেন শায়লা মুরসালীন। রেজোয়ানের তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। হাত ধরতে গেলেই উনি ঝাড়া মেরে সরিয়ে দিয়ে বললো,’খরবদার রেজোয়ান আমি বারবার করে বলে রাখছি তুই ঐ মেয়েটার সঙ্গে কোনরকম সম্পর্ক রাখবি না। তাহলে কিন্তু মহা ঝামেলা হবে তোর সঙ্গে আমার। আমি যদি শুনেছি তুই ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিস তাহলে কিন্তু আমি বাড়ি ছেড়ে
তোর ছোটবোন কে নিয়ে নিরুদ্দেশ হবো।’
-‘মা প্লিজ।’
-‘মা প্লিজ বলে কোন লাভ হবে না। আমি জাহিদকেও বলে দিয়েছি ঐ মেয়েকে যেন আমার ছেলের আশেপাশেও না দেখা যায়। নির্লজ্জ, বেহায়া মেয়ে কোথাকার। নিজের সব ধ্বংস করে এখন আমার ছেলের পেছনে পড়েছে।’
-‘তুমি ভুল করছো মা। ও নিজে থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার কোন চেষ্টা করে নি। চাকরীর ইন্টার্ভিউ দিতে এসেছিলো কেবল।’
-‘তুই একদম আমার সামনে ঐ মেয়ের হয়ে সাফাই গাইবি না। কেন দিয়েছিস অফিসে চাকরী? এতকিছুর পরেও তোর শিক্ষা হয় নি? লজ্জাবোধ নেই তোর?’
-‘আমার রাগ, জেদ এসবের জন্য বিনাদোষে ওকে জেলে যেতে হয়েছিলো মা।’
-‘বেশ হয়েছে। বের করলো কে? তুই?’
রেজোয়ান জবাব দিলো না। শায়লা মুরসালীনের সঙ্গে এখন স্বাভাবিক কোন কথাবার্তাই বলা যাবে না। রাগে অন্ধ হয়ে আছেন তিনি। একটা সময় রেজোয়ানও ছিলো। কিন্তু এখন সে জানে তাঁকে বাঁচানোর জন্যই বাধ্য হয়ে মুবিনকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলো নিলি। রাগের মাথায় প্রথমে বুঝতে না পারলেও এখন ঠিকই বুঝতে পারছে। সত্যিই তো? মুবিনের বাবার ক্ষমতার সঙ্গে কি পেরে উঠতো রেজোয়ান? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো।
-‘মা প্লিজ একটু শান্ত হও। তোমার প্রেসার হাই হয়ে যাবে।’
-‘যাক। যার ছেলের কাছে মায়ের কথার কোন মূল্য নেই তাঁর আর বেঁচে থেকে কি লাভ! আমার তো মরে যাওয়াই ভালো।’
রেজোয়ান ব্যস্ত হয়ে চেয়ার ছেড়ে মায়ের বিছানার পাশে এসে বসলো। তাঁর হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,’এভাবে বলো না মা। তুমি তো জানো আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি? আমার কাছে তোমার চাইতে বেশি মূল্যবান আর কেউ নয়। কিন্তু আমার কথাটা শোনো প্লিজ। নিলি আমাকে বাঁচানোর জন্যই মুবিনকে বিয়ে করেছিলো। ওর বাবা আর ভাই বাধ্য করেছিলো ওকে।’
-‘আবার? আবার তুই ঐ মেয়ের হয়ে আমার সামনে
কথা বলছিস? যা সর আমার সামনে থেকে!’
-‘আচ্ছা যাচ্ছি। কিন্তু তুমি শুধু আমাকে একটা কথা বলো। এত সবকিছুর মাঝে ওর দোষটা কোথায়? স্বামীর বাড়িতেও অত্যাচার সহ্য করতে হলো, আমিও ভুল বুঝলাম, অসুস্থ বাবা সংসারের বোঝাও কাধে নিলো। একটা মেয়ে কেন বিনাদোষে এত শাস্তি পাবে মা? তাঁর তো এত কষ্ট পাওয়ার কথা ছিলো না?’
-‘সেসব আমার জানার দরকার নেই। খুব বেশি হলে তাঁকে আমি টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করবো। কিন্তু ঐ মেয়ের সঙ্গে তুই কোন সম্পর্ক রাখতে পারবি না ব্যস।’
-‘কেন সবাই ওকেই ছোট করে মা?’, রেজোয়ান যেন নিজেকে নিজেই প্রশ্নটা করলো।
চোখ বড়বড় করে ছেলের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন শায়লা মুরসালীন। ডুঁকরে উঠে বললেন,’ঐ মেয়ে তোর মাথা খেয়ে নিয়েছে। তুই এখন আর মায়ের দুঃখ বুঝতে চাইছিস না।’
-‘ও আমাকে কিচ্ছু বলে নি।’
-‘আলবাত বলেছে। নইলে এতদিন বাদে তোর মুখ দিয়ে এসব বেরোবে কেন? তুই তিন্নির কথাটা একবার ভাববি না? ঐ মেয়েটা কি দোষ করেছে?’
তিন্নির কথা উঠতেই রেজোয়ানের মনটা নরম হয়ে গেলো। কোথাও না কোথাও তো তিন্নিও জড়িয়ে আছে তাঁর সিদ্ধান্তের সঙ্গে। তাই মনে মনে চিন্তিত বোধ করলো। তিন্নি কি আদৌ সহ্য করতে পারবে? পারবে না। ভীষণ ইমোশনাল আর একরোখা মেয়ে। যদি উল্টোপাল্টা কিছু করে বসে?
তিন্নির প্রতি রেজোয়ানের একটা সফট কর্নার আছে সেটা শায়লা মুরসালীন আগে থেকেই জানেন। সেই সুযোগটাই কাজে লাগালেন তিনি। নরম, মোলায়েম কন্ঠে বললেন,’মেয়েটা তোকে ভালোবাসে রেজোয়ান। তুই ওকে কষ্ট দিস না। ওকে নিয়ে নতুন করে শুরু কর। দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।’
জবাব না দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো রেজোয়ান। উভয়সংকটে পড়েছে সে। এর থেকে মুক্তির উপায় কি তাও বুঝতে পারছে না।