গল্প_টু_সিস্টার_দ্বিতীয়_পর্ব

0
608

#গল্প_টু_সিস্টার_দ্বিতীয়_পর্ব
#লেখা_নাজনীন_নাহার
১৯.০৩.২০২২
(এখানে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের গোল নম্বর ১ দেখানো হয়েছে)

এভাবেই আমি ক্লাস নাইনে কমার্স নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। বাড়িবাড়ি কাজ করা আমার অশিক্ষিত মা আমার ইচ্ছের গুরুত্ব দিলেন।আমাকে আমার ভালোলাগায় লেখাপড়ার বিষয় পছন্দ করতে বললেন। আমার অশিক্ষিত মায়ের মতো এমন অনন্য বোধ আমাদের এশিয়ার অধিকাংশ বাবা-মায়ের মধ্যে নাই।
আমি নেট ঘেটে ও টিভি নিউজ ও পত্রিকার নিউজ থেকে জেনেছি। অধিকাংশ সন্তানদের উপর শিক্ষিত বাবা-মায়েরাও সাবজেক্ট চাপিয়ে দেয়। ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ারিং এর স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে কত কত ছেলে মেয়ে লেখাপড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। সুইসাইডও করে। এটা একদমই উচিত না। বিষয়গুলেতে আমাদের সচেতন হওয়া উচিত। আমাদের পাঠ্য বইয়ে এইসকল বিষয়ে সঠিক মোটিভেশন ও দিকনির্দেশনা থাকা উচিত। কারণ আমরাই একদিন বাবা-মা হব। আমাদের আগামী ভবিষ্যতের দায়িত্ব আমাদেরই। দৃষ্টিভঙ্গিগুলো বদলানো জরুরি। তাহলেই আমাদের দেশ আরও আরও উন্নত হবে। উন্নত হবে আমাদের সকলের জীবনের মান।

ক্লাস নাইনে আমি বানিজ্য শাখায় ক্লাস করা শুরু করেই বিজনেসের বিভিন্ন খাত ও বিষয়ে পড়াশোনা করা শুরু করলাম। বিভিন্ন বিজনেস পেইজে গিয়ে এবং বিভিন্ন দেশের কাজগুলোও দেখতে লাগলাম। আমার আরও বেশি জানতে হবে। আমার মধ্যে একটা ক্ষুধা কাজ করে সব সময়। তা হলো জানার ক্ষুধা। ভবিষ্যতে আমি অনার্স মাস্টার্স শেষ করে বিসিএস পরীক্ষা দেব।ক্যাডার অফিসার হব। মা’কে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা দেব। সম্মান দেব।

আমি চিন্তা করে দেখলাম আমার এসব স্বপ্ন ও ইচ্ছেগুলো সব ঠিক আছে। এসব করলে আমি, মা ও আমার পরিবার ভালো থাকব। কিন্তু খেটে খাওয়া আমার মায়ের মতো অধিকাংশ নারীরা তো সবসময়ই অসহায় থেকে যাবে। সকলের সন্তান তো আর আমার মতো হবে না। আমাকে আমার মায়ের জন্য, মায়ের মতো ভুক্তভোগীদের জন্য এবং মায়েদের উত্তরসূরীদের জন্য সম্মান ও স্বচ্ছলতার ব্যবস্থা করতে হবে। এগিয়ে নিতে হয়ে অসহায় ও বঞ্চিত নারীদেরকে।

তাই আমি ক্লাস নাইনে উঠে প্রথমেই আমার নিজের নামে একটা ফেসবুক আইডি ও একটা পেইজ খুলে নিলাম। আমার নাম উর্মি।তাই অনেক চিন্তা ভাবনা করে এবং আমার লক্ষ্য পূরণের কথা মাথায় রেখে আমার পেইজের নাম দিলাম ” উর্মি কেয়ার “। আস্তে আস্তে আমার পেইজে বিভিন্ন শিক্ষা ও জনসচেতনতা মূলক কনটেন্ট ভিডিও তৈরি করে পোস্ট করতে লাগলাম।

কীভাবে মনদিয়ে লেখাপড়া করতে হবে।কীভাবে মানুষের উপকার করতে হবে।
কীভাবে কম টাকায়, কম সুযোগ সুবিধায় সম্মানের জীবন যাপন করা যায়। কথা দিয়ে কথা রাখার উপকারিতা। এরকম বিভিন্ন পজেটিভ চিন্তাগুলো এবং এর ব্যাবহার নিয়ে বানানো আমার কনটেন্টগুলো বেশ জনপ্রিয় হতে লাগল।

পাশাপাশি ঠিকমতো নিজের লেখাপড়ার সাথে সাথে আমি বিভিন্ন দেশের মেইড সার্ভেন্ট মানে বাসাবাড়িতে গৃহপরিচারিকাদের জীবন ও জীবিকাগুলো জানতে লাগলাম।
ইয়োরোপে আমি এই সেক্টরে সেভাবে কিছু পেলাম না। কারণ তারা নিজেদের কাজ সকলে নিজেরাই করে। টয়লেট পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে কাপড় কাঁচা, ঘর মোছা সব নিজেরাই করে। এমনকি বাসা রং করা থেকে শুরু করে ছোটোখাটো ইলেকট্রিক সমস্যা, গাড়ি ধোঁয়া, বাড়ির নিত্যপ্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের মেরামতও নিজেরাই করে। এইসব দেশগুলোতে ওভাবে মেইড সার্ভেন্টের অ্যকটিভিটি নেই বললেই চলে।

এভাবে গুগলে সার্স দিতে দিতে হঠাৎ আমার চোখ আটকে গেলো সিঙ্গাপুরে। ওখানে দেখলাম লেডি মেইড সার্ভেন্ট আছে।আছে ব্যাংককেও কিছু কিছু। ওরা বিভিন্ন হোটেলে কাজ করার পাশাপাশি বাইরেও কিছু অ্যাপার্টমেন্টে ঘর মোছা, টয়লেট ও কিচেন ক্লিন এর কাজ করে। বাংলাদেশ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক অনেক টুরিস্টরা যেহেতু সিঙ্গাপুরে যায়। সকলে বড়ো বড়ো হোটেলগুলোতে থাকতে পারে না। কারণ সিঙ্গাপুর বেশ ব্যায়বহুল শহর। এছাড়াও চিকিৎসা সেবা নিতে প্রচুর লোক সিঙ্গাপুর যায়। ক্যন্সার সহ বেশ কিছু জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর, ব্যাংককে রুগী ও তার পরিবার মাসের পরে মাস অবস্থান করে। হোটেলে এতো লম্বা সময় থাকা সম্ভব হয় না।তাছাড়া নিজেদের মতো করে দেশি খাবার খাওয়ার সুবিধার জন্য তারা কিছু অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেয়। এই সকল দেশে কিছু ছোট বড়ো এপার্টমেন্ট ভাড়ায় পাওয়া যায়।একরুম দুই রুম, তিন রুম এভাবে কিচেনের সুবিধা সহ ভাড়া পাওয়া যায়।
সাথে ওয়াশিং মেশিন, ফ্রিজ, টিভি অর্থাৎ ফার্নিসড থাকে অ্যাপার্টমেন্টগুলো। এই সকল অ্যাপার্টমেন্ট ক্লিন করার জন্য কিছু লেডি মেইড সার্ভেন্ট থাকে। এদের পোশাক পরিচ্ছদও বেশ পরিপাটি। তারা পায়ে জুতা পরেই সকল কাজগুলো করে দিয়ে যায় নিজের আত্মসম্মানের সাথে একজন অফিস কর্মীর মতো।
তারা পোশাকে ও আচরণে ভীষণ স্মার্ট। এবং তাদের বেশ হেলদি সেলারি ও সম্মান দেয়া হয়।

আমি এগুলো আসলে আমার মায়ের জন্য ভাবছি। আমি লেখাপড়া শেষ করতে, বিসিএস দিয়ে চাকরি পেতে আরও অনেক সময় লেগে যাবে। আমি চাচ্ছি মায়ের কষ্ট কিছুটা কমুক। মায়ের সেলারি ও সম্মান বাড়ুক।এজন্যই আমি পথ খুঁজছিলাম। সিঙ্গাপুরের বিষয়টি আমার খুব পছন্দ হলো।

মা বাড়ি এলে আমি মা’কে সব বললাম। মা’কে আরও বললাম।
——–মা আমার এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলে। আমি তোমার সাথে ঢাকায় গিয়ে থাকতে চাই। আশা করছি আমার রেজাল্ট খুব ভালো হবে। আমি চাই ঢাকার একটা ভালো কলেজে ভর্তি হতে।
মা আতঁকে উঠলেন!
_________বলো কী! ঢাকায় বাসা ভাড়া অনেক বেশি। আমি একজনের বাসায় কোনোরকমে একটু যায়গা চাইয়া থাকি। তোমাগোরে নিয়া থাকলে অনেক বেশি ভাড়া দেওন লাগবো। অনেক খরচ।আমি এতো টেকা কই পামু!

মায়ের কথা শুনে মা’কে আমার কিছু পরিকল্পনার কথা বললাম। মা’কে বললাম যে।
———–শর্মি এইবার ক্লাস এইটে বৃত্তি পাইছে। ও লেখাপড়ায় ভালো। ওর টাকায় ও পড়বে। আমার রেজাল্ট ভালো হলে আমিও স্কলারশিপের কিছু টাকা পামু। সাথে তোমার কাজের টাকা। আমি আর শর্মি আমরা দুই বোন কিছু স্টুডেন্ট পড়ামু। শুরুতে এক রুমের একটা বাসা ভাড়া নিমু। একটু কষ্ট কইরা থাকুম।
আমরা ভালো কইরা যদি স্টুডেন্টগো পড়াইতে পারি।তাইলে দিন দিন স্টুডেন্ট বাড়ব। তখন আমরা আরও একটা রুম নিয়া আমরা দুই বোন মিলে ব্যাচ করে স্টুডেন্ট পড়াইমু। আমাগো কুনু সমস্যা হইবো না মা।তুমি না কইরো না মা। আমার মাথায় আরও অনেক প্লান আছে।

পরিশেষে মা রাজি হলেন। আমার এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্ট এর আগেই নেট ঘেঁটে ঘেঁটে ঢাকার কিছু যায়গা নির্বাচন করলাম।
গুলশান ও বনানীর নিকটবর্তী এলাকা হিসেবে প্রথমেই আমি বাড্ডাকে নির্বাচন করলাম বাসা ভাড়া নেয়ার জন্য। কারণ আমার টার্গেট গুলশান ও বনানীর অভিজাত এলাকা। যেখানে আমার মায়ের ও আরও বাসাবাড়িতে কাজ করা মা বোনদের ভাগ্য ও দরিদ্র উন্নয়নে কাজ করতে পারি। মানে ভালো কিছু করতে পারি।

যেই ভাবনা সেই কাজ। আমার রেজাল্ট বের হলো।জিপিএ গোল্ডেন সহ স্কলারশিপ পেয়ে গেলাম। স্কলারশিপ সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম সারির রেজাল্টের কারণে পেলাম। আমরা এক রুমের একটা বাসা নিলাম অনলাইন থেকে দেখে ও ফোনে কথা বলে। বাড়িওয়ালা আঙ্কেল আমার ও বোনের রেজাল্ট শুনে বাসাটা কনফার্ম করলেন।আমি বিকাশ করে এডভান্স করলাম কিছু টাকা। বললাম আমার মা চাকরি করেন। আমরা দুই বোন নানুকে নিয়ে থাকব। বাবা মারা গেছেন।মা মাঝে মাঝে এসে থাকবেন। ব্যাস হয়ে গেল। জীবনে সম্মান নিয়ে দাঁড়াতে হলে বুদ্ধি করেই সকল কাজ করতে হয়।

এদিকে আমার মায়ের বাসাবাড়ির কাজগুলো থেকে মা’কে ছাড়িয়ে আনলাম না। মা মায়ের মতো কাজ করছিলো তার গোপীবাগ এলাকায়। কারণ নতুন যায়গায় হঠাৎ করে গিয়ে কাজ নিয়ে ঝামেলায় পরে যেতে পারেন মা। আর তাছাড়া আমাদের জন্য টাকারও দরকার আছে। মা এখন প্রতি মাসে ১৫/১৬ হাজার টাকা ইনকাম করেন। সকাল সাতটা থেকে শুরু করে রাত দশটা পর্যন্ত মা পাঁচ ছয় বাসায় কাজ করে। থাকেন ওখানকার এক বাড়িওয়ালার বাসার সিঁড়ির নিচে।

আমি ঢাকায় এসেই বোনকে কাছের সরকারি হাইস্কুলে স্কুলে ভর্তি করালাম ক্লাস নাইনে। আমি ভর্তি হলাম ঢাকার নামকরা একটা কলেজে।
বোনের স্কুল কাছে হওয়ায় বোন হেঁটে স্কুলে যায়। আমি বাসে করে কলেজে যাই। বাসে যেতে যেতেও নিজের কলেজের কিছু পড়া পড়ে ফেলি। কলেজে গিয়ে ক্লাস করি। বিকেলে ফিরে টিউশনি করি। রাতেও টিউশনি পেয়ে গেলাম।
এদিকে নিয়মিত আমার পেইজের কনটেন্টগুলো চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
এখানে নিজের লেখাপড়ার সাবজেক্ট ও রেজাল্ট নিয়েও আমি কিছু ভিডিও বানিয়ে আপলোড করলাম। আমার পেইজের প্রায় কোটি কোটি ভিউয়ার হয়ে গেলো। এটাকে কাজে লাগিয়ে আমি দু’মাসের মধ্যেই আমার নিজের জন্য বেছে বেছে কয়েকটি টিউশনি নিয়ে নিলাম গুলশানে। আমাকে গাড়ি করে নিয়ে যায়।আবার নামিয়ে দিয়ে যায় স্টুডেন্টদের পরিবার। গুলশানের তিনটা অ্যাপার্টমেন্টে আমি তিনটা টিউশনি শুরু করলাম। এক ঘন্টা করে তিনটা স্টুডেন্টকে ম্যাথ ও ইংরেজি এই দু’টো করে সাবজেক্ট পড়াই। আমি প্রতি মাসে ফর্টি ফাইভ থাউজ্যান্ড টাকা ইনকাম করতে লাগলাম। আমার পেইজে আমি নিয়মিত ইয়াং জেনারেশনের জন্য মোটিভেশনাল ভিডিও আপলোড করি সপ্তাহে বা পনোরো দিনে। ওখান থেকেও আমার একটা আয় আসতে লাগল। এছাড়াও আমি আমার “উর্মি কেয়ার” পেইজে থেকে “পড়ি এবং পড়াই” নামে একটা প্রোগ্রামের বিজ্ঞাপন দিলাম। এর থিম হলো যারা টিউশনি করতে চায় আর যারা টিউটর নিতে চায় তাদের জন্য মধ্যবর্তী মানে মিডিয়া হয়ে কাজ করা। টিউশনির বিজ্ঞাপন ঘোষণার সাথে সাথে ভীষণ সাড়া পাওয়া গেল। আমি আমার পেইজের এই সাইটটা দেখার জন্য কয়েকজন স্টুডেন্টদের মডারেটর হিসেবে নিয়োগ দিলাম। কিছুদিনের মধ্যেই আমার “পড়ি এবং পড়াই ” প্রজেক্টের আওতায় বেশ কিছু ভালো ভালো স্টুডেন্টদেরকে তাদের নিজেদের বাসার কাছাকাছি কিছু টিউশনি ঠিক করে দিতে লাগলাম। ওখান থেকেও পারসেন্টেজ হিসেবে একটা ভালো ইনকাম আসতে লাগল। ঢাকা শহরে ভীষণ জ্যাম।তাই যার যার এলাকায় তাকে টিউশনির ব্যবস্থা করে দিতে লাগলাম। যাতে জ্যামে বসে থেকে সময় নষ্ট না হয়।
আমার বোনটাও নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি চালিয়ে যাচ্ছিল আমাদের বাসার কাছে। ব্যাচ করে স্টুডেন্ট পড়ানোটা আর পেরে উঠছিলাম না আমরা দু’বোনই। তাই ওটা ক্লোজ করলাম।

সব মিলিয়ে আমাদের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো হতে লাগল। মায়ের কিছু ঋণ ছিলো গ্রামে। কিস্তিতে বেশকিছু টাকা নিয়েছিলেন মা। কিছু কিছু করে সেই সকল ঋণ শোধ করতে থাকলাম আমরা।
ততদিনে আমার “উর্মি কেয়ার” পেইজ একটি ছোটখাটো জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান হয়ে গেল। আমি ব্যাংক থেকে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে অ্যাপলিকেশন করে লোন পেলাম। নিজের চলাচলের সুবিধার জন্য আমি একটি স্কুটি কিনে নিলাম। কিছু ডাউন প্যামেন্ট আর কিস্তি লোনে। সপ্তাহে চারদিন স্টুডেন্ট পড়াই। নিজের পেইজ চালাই।কলেজ ক্লাস ও লেখাপড়া। জীবনটা একদম একটা ব্যস্ত ছকে চলতে লাগল। আমাদের সামনে আরও কিছু কাজ আমাদের নিজেদেরকে ও জাতিকে সমৃদ্ধ করার জন্য হাতছানি দিয়ে ডাকছে।যেমন…….

(চলবে)

(গল্পটি তিন পর্বে শেষ হবে। আসছে শেষ পর্ব)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here