আমার মা ঢাকায় বিভিন্ন বাসা বাড়িতে ছুটা কাজ করে। আমি আর আমার ছোট বোন গ্রামের বাড়িতে আমার নানুর কাছে থাকি। আমার নানা মারা গেছেন আমার মায়ের বিয়ের পূর্বেই।
আমার বয়স যখন সাত বছর আর ছোট বোনটার চার।তখন একদিন আমার বাবা আমাদেরকে নানুর বাড়ি রেখে চলে গেছে। আর কখনোই ফিরে আসেনি আমার বাবা। মানুষের কাছে মুখে মুখে মা জানতে পেরেছে। আমার বাবা নাকি কোনো এক মহিলাকে বিয়ে করে তাকে নিয়ে সংসার পেতেছে। তার আগে নাকি আমার বাবা আমার নানুর বাড়ির গাঁয়ের মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে এসে। গাঁয়ের কিছু মুরব্বিদেরকে সাক্ষী রেখে মৌখিক ভাবে আমার মা’কে ডিভোর্স দিয়ে গেছে। এই ডিভোর্সের ঠিক দশ বছর আগে মৌখিক ভাবেই আমার বাবা আর মায়ের বিয়ে পড়িয়েছিলেন এই মসজিদের ইমাম সাহেব। সেই হুজুরের কাছে এসেই তালাক দেয় আমার মা’কে। আগেকার সময় নাকি গাঁয়ের প্রায় সকল বিয়েই মৌখিক ভাবে পড়ানো হতো মুরব্বিদের উপস্থিতিতে।
ডিভোর্সের কথাটা শোনার পরে আমার মা মাটিতে গড়াগড়ি করে পাগলের মতো কান্না করেছিল। আমার নানা বেঁচে ছিলেন না। মায়ের একটা ভাই পাঁচটা বোন। সবাই খুবই গরীব ছিল। নানুকে মামা খালারা খাবারের ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু আমরা মা বোন সহ তিনটা মানুষকে কে খাওয়াবে। মা তখন আমাদেরকে গাঁয়ের বাড়িতে রেখে ঢাকায় চলে আসলেন তার এক খালার সাথে। তখন থেকেই মা ঢাকায় বিভিন্ন বাসাবাড়িতে কাজ করে। মা নিজে খেয়ে না খেয়ে আমাদেরকে টাকা পাঠায়। আমরা দুই বোন ও নানু সহ সব খরচ মা চালায়।
আমাদের সংসারে অনেক অভাব।খুব কষ্ট করে আমাদের জীবন চলতে লাগল। ডাল ভাত, আলু ভর্তা, শাক পাতা খেয়ে আমরা বড়ো হতে থাকলাম। আমার বাবা আমাদেরকে ফেলে গেছে।মা’কে ডিভোর্স দিয়েছে। এর জন্যও গাঁয়ে আমাদেরকে প্রায় সকলেই তুচ্ছ করে দেখত। আমরা দরিদ্র মেয়ে তার উপর বাবা ছেড়ে চলে গেছে। কে বিয়ে করবে ইত্যাদি নানাবিধ অপমানে বড়ো হতে লাগলাম।
আমার মায়ের ডিভোর্সের পর থেকে আমি কোনোদিনই আমার মায়ের মুখে কোনোরূপ হাসি দেখিনি। আমি সেই সাত বছর বয়সেই একটা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। আমি আমার মায়ের মুখে হাসি ফুটাবোই ফুটাব।
আমি আমার নানু ও মায়ের কাছে শুনেছি যে। আমার বাবার কাছে আমার মায়ের একটাই ব্যার্থতা ছিল। তা হলো আমার মায়ের পেটে পুত্র সন্তান হয়নি। হয়েছে দু’টো কন্যা সন্তান। আর সেই কন্যা সন্তান হওয়ার কারণে আমার মা’কে ডিভোর্স দিয়েছে আমার বাবা। কারণ বাবার পুত্র সন্তান চাই। আমার মায়ের পেট পুত্র সন্তান দিতে পারবে না। কী ভয়ঙ্কর নির্মমতা আমাদের সমাজের কিছু মানুষের মস্তিষ্কে।
অথচ আজকে লেখাপড়া করে আমি যতদূর জানি। সায়েন্স এর ভাষ্যমতে সন্তান পুত্র বা কন্যা হওয়ার ক্ষেত্রে ভুমিকা পুরোপুরি বাবার। অথচ আমার বাবা একটা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে আমার মাকে ডিভোর্স দিয়ে দিলো। নানুর কাছে আরও জানতে পেরেছি। পুত্র সন্তান হয়নি বলে আমাদের সমাজে বহু বহু পুরুষ দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার বিয়ে করেছে। বহু পুরুষ স্ত্রীকে তালাক দিয়েছে। এরপর থেকে আমার আর কোনো পুরুষ মানুষের প্রতি ঘৃণা ছাড়া কিছুই আসে না। কীভাবে আসবে বলুন! মেয়ে বলেই তো আমি, আমার বোন ও মা এতোটা নিগৃহীত হয়েছি।
আসলে আমার কষ্টটা আমার।আমার মায়ের কষ্ট আর অপমানটাও আমার। আমার বাবা আমার কাছে আর আমার মা ও বোনের কাছে একজন খারাপ মানুষ। আমি আমার জীবনে ভালো বাবা পাইনি। আমার বাবা কন্যা সন্তান বলে আমাদেরকে তার জীবন থেকে ফেলে গেছে। ছেলে সন্তানের আশায় নিজের মেয়েদেরকে ফেলে গেছে একজন বাবা।
আমি একজন মেয়ে হয়ে দিনের পর দিন আমার মা এবং আমার নারীত্বের অপমান সয়েছি। আমি পুরুষ রূপে আমার বাবার রূপটায় কলুষতা দেখেছি। কিন্তু আমি এবং আমার মা হেরে যাইনি। আমরা মেয়ে জন্ম নিয়েও টিকে থেকেছি এই পৃথিবীতে।
দিনের পর দিন মানুষের কাছে তুচ্ছ থেকেও আমরা বেঁচে থেকেছি। প্রতিদিন ক্ষুধার সাথে লড়াই করেছি।সামাজিক অপমানের সাথে মানসিক যুদ্ধটা করেছি দাঁতে দাঁত কামড়ে। এবং আস্তে আস্তে আমরা আমাদের সাহস, মানসিক শক্তি, মেধা, ধৈর্য ও পরিশ্রম দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছি মাথা উঁচু করে। দেখিয়ে দিয়েছি পৃথিবীকে। জন্মের জন্য একজন বাবার প্রয়োজন হলেও। বেঁচে থাকার জন্য বাবা লাগে না।
আজকে আমি, আমার মা, নানু, বোন মিলে আমরা নিজেরা স্বাবলম্বী হয়েছি। এবং আমাদের নিজেদের সাথে সাথে দেশের অগুনতি অসহায় নারীদেরকে স্বাবলম্বী করেছি। সাহসে মাথা উঁচু করে বাঁচার মতো আত্মবিশ্বাস বুনে দিয়েছি বাংলাদেশের অধিকাংশ নারীর মনে। আমার চেষ্টাই হলো নিজের ও সকল নারীর সম্মান প্রতিষ্ঠা করা। নারীদেরকে স্বাবলম্বী করা। মানুষের ছোট বড়ো সকল কাজের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন ও প্রতিষ্ঠা করা। আমার মা সহ বাংলাদেশের অসহায় ও বঞ্চিত মায়েদেরকে মর্যাদাপূর্ণ জীবনের স্বাদ দেয়া।
আমরা মেয়ে হয়েও আজকে সমাজে ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি আলহামদুলিল্লাহ।
কীভাবে হলাম!
একজন ছুটা কাজের বুয়ার মেয়ে হয়ে কীভাবে আজ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ভাবে মানবতা ও দেশাত্মবোধের মর্যাদার স্বীকৃতি সহ সম্মানিত হলাম তা বলছি।
শুনুন তাহলে আমাদের নারী জন্মে বেঁচে থাকার ও ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প।
আমার মা ঢাকায় বাসাবাড়িতে কাজ করতে চলে আসার পূর্বে আমাকে মায়ের গ্রামের সরকারি প্রাইমারী স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করে দিয়ে এসেছিলেন। মা ঢাকায় বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ছুটা কাজ করে আমাদের ভাত, কাপড়, চিকিৎসা ও লেখাপড়ার খরচ চালাতে লাগলেন। আমার বোনকেও মা পরের বছর স্কুলে ভর্তি করে দিলেন ক্লাস ওয়ানে।
খুব বেশি কোনো বিপদ না হলে মা বছরে তিনবার বাড়ি আসত।দুই ঈদে আর মাঝখানে একবার। মা’কে ছাড়া আমাদের থাকতে কষ্ট হতো। কত কত রাত মা’কে ছাড়া আমরা দুই বোন কেঁদে কাটিয়েছি। কখনও কখনও আমাদের দুই বোনের জ্বর হয়েছে, ডায়রিয়া হয়েছে, কাশি ও দাঁতে ব্যথা হয়েছে। আমরা আমাদের মা’কে কাছে পাইনি। আমরা দুই বোন আমাদের প্রতিটি কষ্টকে জীবনের শক্তিতে পরিনত করেছি। আমরা দু’বোন একে অপরকে বুঝতে শিখেছি। একে অপরের বন্ধু হয়েছি। হয়েছি সাহস আর বিশ্বাস। প্রতি রাতে আমরা দু’বোন ঘুমাতে যাওয়ার সময় একসাথে প্রতিজ্ঞা করতাম। আমরা নিজেরাই নিজেদের কাছে শপথ নিতাম।
” আমরা আরও সাহসী হব।আমরা জিতবই জিতবো ইনশাআল্লাহ ”
মা আমাদেরকে একটা কথা শিখিয়েছিলেন।
——তুমি যেই কাজটাই করবা ভালোবাইসা আর মনোযোগ দিয়া করবা। আর কাজটার প্রতি সৎ থাইকবা বাবা।
আমার মা লেখাপড়া জানতেন না। কিন্তু বোধ, বুদ্ধি, সাহস ও উপলব্ধিতে তিনি অনেক শিক্ষিত মানুষকেও ছাড়িয়ে যেতেন। তাইতো কাজের ছুটি নিয়ে পাঁচ দিনের জন্য বাড়ি আসলে। মা’কে কোনোভাবেই ছয়দিন রাখা যেতো না।মায়ের এক কথা।
———হুন মা। বেগম সাহেবারা রাগ করবো। তাগোরে কতা দিয়া আইছি রে মা। তাগোর ভালাবাসা পাইতে হইলে তাগোরেও ভালা বাসতে হইব। কতা দিয়া কতা রাখন লাইগব।
আমার মা সকলকে কথা দিয়ে কথা রাখতো বলেই সকলে খুশি হয়ে আমাদের জন্য কাপড় জামা ও নানুর জন্য শাড়ি সহ আরও কত কত খাবার দিত মা’কে। আমাদের কোনো বড়ো অসুখ হলেও মা’কে তারা কিছু কিছু করে টাকা দিতো চিকিৎসার জন্য।
আমি ও আমার বোনটা ছোটবেলা থেকেই খুব মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করতাম। আমাদেরকে যে অনেক বড়ো মানুষ হতে হবে। আমার মায়ের মুখে হাসি ফুটাতে হবে। ক্লাস ফাইভে আমি ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেলাম। আমার জন্য আর কোনো টাকা খরচ তো লাগলোই না।আমি প্রতি মাসে বৃত্তির টাকা পেতে লাগলাম।
ক্লাস সিক্সে উঠে মা’কে অনেক বলে বলে আমি কম দামের একটা নেট চালানোর মোবাইল কিনে নিলাম। কারণ আমাকে লেখাপড়ার সাথে সাথে সারাটা পৃথিবী চিনতে হবে।জানতে হবে।
মা আমাকে খুব বিশ্বাস করতেন। তবুও নানু আমার মোবাইল চালানো নিয়ে খুব রাগ করলেন। আমি তখন নানুকে ও আমার বোনকে গুগলে পৃথিবীর অনেক কিছু দেখাতাম। তখন তারাও আমাকে সাপোর্ট দিতে লাগল।
আমি গুগলে সার্স দিয়ে দিয়ে নিজের লেখাপড়ার বিষয়ে অনেক কিছু জানতে লাগলাম। আমার ইংরেজিটাও আমি ভালোভাবে শিখতে থাকলাম। আমি পাঠ্য বইয়ের সাথে সাথে ইন্টারনেটের সাহায্যে নানান বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে লাগলাম। দেশ বিদেশের নানান বিষয়ে জানতে শুরু করলাম। দেশ বিদেশের মানুষের জীবন, জীবিকা ও বৈষম্যগুলো আমাকে খুব টানত।
আমি যখন ক্লাস এইট থেকে ক্লাস নাইনে উঠব তখন মা’কে একদিন জিজ্ঞেস করলাম।
——-মা আমাকে তুমি কী বানাইতে চাও?
মা বলল।
———তুমি কী হইবার চাও?
———আগে তুমি কও মা।তোমার কুনু ইচ্ছা থাকলে।
মা বলল।
_______ তুমি কী ডাক্তর হইবার পারবা? আমি যেই হগগল বাসায় কাম করি। হোগোর পোলাপাইনগো হগগলতেরে ডাক্তর, ইঞ্জিনিয়র বানাইবার চায় হুনি। কুনু কুনু বাড়িতে পোলাপাইনগো বাপ মায়ে খালি বকাবকি করে পড়নের লাইগা। এহন তুমি কও তুমি কী হইবার পারবা?
———-হুনো মা।আমি যদি চেষ্টা করি। তাইলে কিন্তু ভালো রেজাল্ট কইরা ডাক্তার হইতে পারুম। কিন্তু মা তাতেও একটা ভেজাল আছে।
————কী কস! ডাক্তরে আবর কী ভেজাল!
——- হুনো মা।তুমি যে আমারে মোবাইল কিননা দিছো। হেই মোবাইলে আমি এট্টু এট্টু কইরা নেট কিননা সারা বাংলাদেশের আর বিদেশের খবর দেহি।হেরপর অনেক কিছু দেহি আর শিখি। নিজে লেখাপড়া কইরা কোনডা কী করুম! কোনডা করতে কেমুন খরচ! কেমুন কী সব দেহি। কোনডা করলে আমি কম সময়ে তোমার আমার জীবন বদলাইবার পারুম।হেইগুলা দেহি।
———- তাইলে তো ভালাই। তাইলে তুমিই কও কী হইবা? ডাক্তর হইবার পারবা না?
————হুনো মা।আইজকইল হইলো ছাত্র ছাত্রী বেশি। হের পর ভর্তি পরীক্ষায় অনেক রাজনীতি হয়। স্বজনপ্রীতি হয়। প্রতিডা বছছরই পরীক্ষার প্রশ্নগুলা ফাঁস হইয়া যায়।
———–হ আমিও হুনছি। ম্যাডামরা কয় ফোনের মইধ্যে৷ আবর টিবির মইধ্যেও হুনছি কিন্তু এতো কিছু আমি বুঝবার পারি না। তাইলে অহন! কেমনে কী!
———–চিন্তা কইরো না মা। আমি ভাবছি কমার্সে পড়ুম।
———-এইডা আবর কী?
———- এইডা হইলো বানিজ্য। বানিজ্য মাইনে হইলো ব্যাবসা। ওইডা পড়ুম।
———-তুমি তো মাইয়া মানুষ। তুমি কেমনে ব্যাবসা করবা?
———-হুনো মা। আমি ডাক্তার হইতে গিয়া সরকারি মেডিকেলে ভর্তি হইতে না পারলে তো প্রাইভেট মেডিকেলে পড়তে পারুম না। কারণ ক্ষমতা, রাজনীতি, বা টাকা। এর কোনোডাই আমাগো নাই। আর আমাগো এতো প্রাইভেট স্যারগো কাছে পড়নের টাকাও নাই। ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি স্যারগো কাছে পড়তেও অনেক টাকা লাইব। তুমি এইগুলা বুঝবা না মা।
তাই আমি এহনই নিজের ভবিষ্যতের চিন্তাডা কইরা ফালাইছি মা। আমি কমার্স পড়ুম। ইংরেজি ও অংকটায় খুব ভালো রেজাল্ট করতে হইব। আমি এইগুলা খুব ভালো পারি। ভালো কইরা পইড়া ভালো রেজাল্ট কইরা আমি একাউন্টিং বা বিবিএ পড়মু। হেরপর বিসিএস পরীক্ষা দিমু।আমি ক্যাডার অফিসার হইমু মা সরকারি অফিসার।
আমি তোমার মুখে হাসি ফুডামু মা। আর হগগল অসহায় মা ও মাইয়াগোর মুখে হাসি ফুডানোর কাজ করুম। ইনশাআল্লাহ।
তুমি খালি আমারে দোয়া কইরা দাও মা।
আমি হারাডা দুইননাইরে দেখাইয়া দিমু। মাইয়ারাও মানুষ। হোগোও জীবন আছে। মাইয়ারাও ইচ্ছা করলে, চেষ্টা করলে সব পারে।
———–তোমরা দুইডা বইনই আমার হগগল কিছু। তোমাগোর লাইগা অনেক দোয়া করি। তুমি যেইডা হইতে ভালা লাগে ওইডাই হও।
———–আমার কলিজার মা। মাগো একটা কতা কইতাম। তুমি আমারে একবার তোমার কাছে ঢাকা নিবা মা? আমি এট্টু নিজের চইক্ষ্যে ঢাকা দেখুম। আমার এসএসসি পরীক্ষার পরে কিন্তু আমারে একবার নিয়া যাইবা।
————আইচ্ছা ঠিক আছে। নিমুনে।
(চলবে)
#pencil4SDGs
#গল্প_টু_সিস্টার_প্রথম_পর্ব
#লেখা_নাজনীন_নাহার