#তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৮
নিলি হস্পিটালে এসেছে রেজোয়ানের সঙ্গে দেখা করতে। সাথে রেজাও ছিলো। তাঁকে অপেক্ষা করতে বলে নিলি একাই ঢুকলো ভেতরে। দুজনকে একসঙ্গে আসতে দেখেছে জাহিদ। মেজাজ বিগড়ে গেলো তাঁর। নিলির ভেতরে ঢোকার পথে বাধা সৃষ্টি করে বললো,’এখন ভেতরে ঢোকা যাবে না। স্যার ঘুমাচ্ছেন।’
-‘আমার জরুরি কথা আছে ওর সঙ্গে।’
-‘পরে। এখন স্যারকে ডাকা যাবে না।’
-‘প্লিজ জাহিদ ভাই। আমি শুধু পাঁচমিনিট কথা বলেই বেরিয়ে যাবো।’
-‘সরি। আমাকে স্যারের হেলথের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।’
-‘আমি দেখেছি একটু আগে ওর মা দেখা করে গিয়েছে। আপনি ইচ্ছে করে আমাকে ঢুকতে দিচ্ছেন না।’
-‘উনার মায়ের সঙ্গে নিশ্চয়ই আপনার তুলনা করা চলে না?’
-‘আমি তুলনা করছি না। আমি জাস্ট সত্যিটা বলেছি।’
-‘সত্যির প্রসঙ্গ থাক। এমন অনেক সত্যি আছে যেগুলো আমি বললে আপনি নিজেকে সামলাতে পারবেন না।’
জ্বলে উঠলো নিলি। বললো,’বলুন দেখি! কি এমন সত্যি যেটা শুনলে আমি নিজেকে সামলাতে পারবো না?’
-‘এই যে আপনি একজন গোল্ড ডিগার। প্রথমে স্যার এরপর মি.রেজা। তারপর কার সিরিয়াল সেটা আপনিই ভালো জানেন।’
-‘মুখ সামলে কথা বলুন মি.জাহিদ।’
-‘তার আগে আপনি নিজেকে সামলান মিস নিলি। আমি রেজোয়ান মুরসালীন নই যে আপনার সব অন্যায় মুখ বুঝে সহ্য করবো। আমি ইটের জবাব পাটকেলে দিতে জানি। শুধুমাত্র স্যার বারণ করেছেন বলে, তা না হলে আপনাদের চৌদ্দ শিকের ঘানি টানিয়ে ছাড়তাম। একটা মানুষকে মেরে রক্তাক্ত করে দেওয়ার অধিকার কে দিয়েছে আপনাদের? আপনাদের তো মানুষ বলতেও ঘৃনা হচ্ছে!’
-‘সে তাঁর নিজের দোষে মার খেয়েছে!’, নিলি মাথা নিচু করে ফেললো।
-‘সিরিয়াসলি?’ হাসলো জাহিদ।
এতকিছুর পরেও নিলির নির্লিপ্ততা দারুণ ভাবে আঘাত করলো জাহিদকে। স্বার্থপর একটা মেয়ে! রাগে দাঁতেদাঁত চেপে বললো,’হস্পিটালে কেন এসেছেন?’
-‘সেই কৈফিয়ত কি আপনাকে দিতে হবে?’
-‘হবে’, একটা গমগমে কন্ঠস্বর জাহিদ এবং নিলির বাকবিতণ্ডা থামিয়ে দিলো। চমকে উঠলো দুজনে। নিলির পেছনে দাঁড়ানো আগন্তুকটিকে দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠলো জাহিদের। রেজোয়ানের মামাতো ভাই ফুয়াদ। দারুণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ! জাহিদের সঙ্গে এর আগেও দুবার দেখা হয়েছে। ভীষণ ভালোলাগে তাঁকে জাহিদের।
শায়লা মুরসালীনের কাছে রেজোয়ানের খবর শুনে দেখা করতে এসেছে ফুয়াদ। নিলির ব্যাপারে সবই জানে সে। নিলি অবশ্য তাঁকে চেনে না। কিন্তু রেজোয়ানের কাছে নিলির কম করে হলে হাজারখানা ছবি দেখেছে ফুয়াদ। তাই চিনতে বিশেষ অসুবিধে হয় নি। শায়লা মুরসালীনের কাছ থেকে সব শোনার পর নিলির প্রতি আগে থেকেই বিরুপ ধারণা সৃষ্টি হয়েছিলো ফুয়াদের। এখানে এসে মনে হলো ধারণাটা নেহায়েত অমূলক নয়। মেয়েটা অত্যন্ত নির্লজ্জ! অন্যায় করে উলটে ফাঁপর দেখাচ্ছে।
নিলি সরু চোখে চেয়ে রইলো ফুয়াদের দিকে। ফুয়াদ তাঁকে অবাক করে দিয়ে আচমকা মুখে হাসির রেখা টেনে নিলো। অত্যাধিক মোলায়েম কন্ঠে বললো,’সরি মিসেস নিলি, আপনাকে ভদ্রতা শেখানো খুবই প্রয়োজন। তাই উত্তর না দিয়ে পারলাম না। আসলে আমার ভাইকে আপনি অত্যাধিক সস্তা ভেবে বসে আছেন। তাই আপনি এবং আপনার ঐ দুটাকার প্রেমিক বা ফিয়ন্সে যাই হোক না কেন, দুজনে মিলে রেজোয়ানের গায়ে হাত তোলার সাহস পেয়েছেন। কিন্তু এবার আর সেটা সম্ভব না। এখানে কিছু করতে গেলে…
থেমে গেলো ফুয়াদ। বার তিনেক তুড়ি বাজালো নিলির সামনে। গুম্ভীর গলায় বললো,’আউট!’
অপমানে নিলির চোখে পানি চলে এসেছে। আজকেই শেষবারের মতন রেজোয়ানের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে সে। এরপর হয়ত আর কোনদিন দেখা হবে না দুজনের। নিলির মনের কথা কোনদিন জানতে পারবে না রেজোয়ান।
এদিকে, রেজোয়ানের ঘুম ভেঙ্গে গেছে। দরজার কাছে ফুয়াদের গলার আওয়াজ পেয়ে ক্ষীণস্বরে ডাক দিলো সে। ফুয়াদ চট করে ভেতরে ঢুকে গেলো। নিলি বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো। যে যাই বলুক না কেন আজকে সে রেজোয়ানের সঙ্গে দেখা করেই যাবে।
ফুয়াদ বেডের পাশে চেয়ার টেনে বসলো। নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,
-‘এখনো কেমন লাগছে।’
-‘ভালো। কখন এসেছো?’
-‘মাত্রই!….রেজার সঙ্গে তোর ঝামেলা হলো কি নিয়ে?’
-‘নিলিকে নিয়ে বাজে কথা বলছিলো।’
ফুয়াদও মনে মনে তাই ধারণা করেছিলো। মিছেমিছি কারো সঙ্গে মারামারি করার মতন ছেলে রেজোয়ান নয়। ঘটনা যাই হোক না কেন কারনটা অবশ্যই নিলি। থমথমে গলায় বললো,’একটা কথা বলি তোকে, কিছু মনে করিস না, নিলিকে তুই ছেড়ে দে। এই মেয়েটা তোর জন্য পার্ফেক্ট না। এর চাইতে অনেক ভালো কিছু ডিজার্ভ করিস তুই।’
-‘নিলি হস্পিটালে এসেছে তাই না? ওর গলার আওয়াজ শুনেছি।’
-‘হ্যাঁ। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আমার সঙ্গে খানিকটা কথা কাটাকাটি হয়েছে। আই ওয়াজ রুড! মেজাজ সামলাতে পারি নি।’
রেজোয়ান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’তুমি ওর সম্পর্কে পুরোটা জানো না। জানলে ওর ওপর রাগ করে থাকতে পারতে না। কারণ ওর এই অবস্থার জন্য আমি দায়ী।’
-‘ঐ মেয়ে তোকে ভালোবাসে না রেজোয়ান।’
রেজোয়ানকে হতাশ দেখালো। মুখ ফিরিয়ে মলিন মুখে বললো,’আমি ওর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।’
রেজোয়ানকে বুঝিয়ে লাভ নেই। ফুয়াদ মুখ কালো করে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার সময় নিলিকে উদ্দেশ্য করে বললো,’আপনাকে ডাকছে। দয়া করে এই অসুস্থ শরীরে ওকে কোন মেন্টাল স্ট্রেস দেবেন না প্লিজ। এইটুকু মানবতা বোধ নিশ্চয়ই আপনার আছে?’
নিলি জবাব না দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো।
★
রেজোয়ান ছলছল দৃষ্টিতে নিলির মুখের দিকে চেয়ে আছে। নিলির যা বলার সে বলে দিয়েছে। বলা হলো না শুধু রেজোয়ানের। মনের কথা মনেই রয়ে গেলো। চুপচাপ নিলির কথাগুলো শুনে গেলো কেবল। অভিমানের পাহাড় জমা হলো। নিলি তাঁকে নিজের জীবন থেকে সরে যেতে বলছে। ভালোবাসার দোহাই দিচ্ছে। আজকে আর অন্যদিনের মতন লড়াই করার শক্তি নেই রেজোয়ানের। চারদিকে থেকে সবার চাপে, নিলির নিষ্ঠুর আচরণে মন ভেঙ্গে গেছে।
-‘ঠিক আছে। আমি আর কখনো তোমাকে বিরক্ত করবো না। কথা দিচ্ছি।’
-‘মি.রেজাকে কোন ধরনের বিপদে ফেলবে না? কথা দাও।’
-‘দিলাম।’
-‘আমার বিয়েতে কোন ঝামেলা বাধাবে না?’
-‘না।’
-‘থ্যাংক ইউ। আসি আমি। ভালো থেকো।’
বেরিয়ে গেলো নিলি। জাহিদ হাঁ করে রেজোয়ানের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। রেজোয়ান শূন্য দৃষ্টিতে সামনের দিকে চেয়ে আছে। বুকের ভেতর ভেঙ্গে চুরে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। ভালোবাসার মানুষটা একটুও বুঝলো না তাঁকে। অভিমান নিয়ে দূরে সরে গেলো!
-‘স্যার? রেজাকে এতসহজে ছেড়ে দেবেন?’ জাহিদের বিমূঢ় কন্ঠস্বর।
রেজোয়ান জবাব দিলো না। আজকে তাঁর বলার মতন কিছু নেই। নিলি তাঁর হাত ধরে অনুনয় বিনয় করে কেঁদেছে। তাঁকে নিজের মতন করে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। রেজোয়ানের আকুলতা সে দেখে নি। রেজোয়ানও আর দেখানোর চেষ্টা করে নি। তাঁর সকল আকুলতা এখন নিলির কাছে অনর্থক। তাই চুপচাপ নিলির কথা মেনে নিয়েছে।
★
ড্রয়িংরুমে শায়লা মুরসালীনের সঙ্গে সোফায় বসে আছে ফুয়াদ। শায়লা মুরসালীন কাঁদছেন আর ইনিয়ে বিনিয়ে নিলির বদনাম করছেন। খানিকবাদে শান্ত হয়ে তিন্নির প্রসঙ্গ তুললেন। ভেবেছিলেন তিন্নির সঙ্গে রেজোয়ানের বিয়ে দেবেন। কিন্তু সেটা যখন হলো না তখন ফুয়াদের সঙ্গে জোড় বেধে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ফোন থেকে তিন্নির একটা ছবি বের করে ফুয়াদকে দেখালেন।
ছবি দেখে ফুয়াদ আঁতকে উঠলো। তিন্নির সেদিনের ব্যবহারের কথা মনে পড়তেই সটাং না করে দিলো সে। শায়লা মুরসালীন ফের হতাশ হলেন। তবে হাল ছাড়লেন না।
-‘ফুপুর কথা শোন ফুয়াদ। এমন মেয়ে লাখে একটা মেলে।’
-‘মেয়ে খারাপ আমি সেকথা বলছি না ফুপু। কিন্তু আমার পছন্দ না। তাছাড়া তুমি নিজেও তো বলেছো মেয়ের বয়স কম। এত ছোট মেয়েকে আমি বিয়ে করবো না।’
-‘তখন ছোট ছিলো। কিন্তু এখন আর ছোট আছে? ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে এবার।’
-‘ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হোক আর যাই হোক আমার সঙ্গে কম করে হলেও বয়সের দশ বছরের ডিফারেন্স হবে।’
-‘হলে কি। মেয়েরা একটু ম্যাচিউর ছেলেই পছন্দ করে। তোর সঙ্গে দারুণ মানাবে।’
ফুয়াদ চুপ করে গেলো। শায়লা মুরসালীনকে বুঝিয়ে লাভ নেই। ফুয়াদ যাই বলুক না কেন তিনি নিজের কথাই উপরে রাখবেন। এরা মা ছেলে হয়েছে একধরনের। অতএব চুপ থাকাই শ্রেয়।
এদিকে শায়লা মুরসালীন ভাবলেন ফুয়াদের বোধহয় মেয়ে পছন্দ হয় নি। একথা সত্যি যে তিন্নি দেখতে আহামরি সুন্দরী নয়। উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ, দীঘল কালো চুল কিংবা টানাটানা চোখ কোনটাই নেই তাঁর। তবে একটা ব্যাপার না বললেই নয়, সেটা হচ্ছে তিন্নি মুখে অসম্ভব মায়া আছে দেখলেই মনে হয় যুগযুগ ধরে চেনা। যে কেউ নির্দ্বিধায় একথা স্বীকার করে নেবে।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন শায়লা মুরসালীন। বললেন,’তুই নিশ্চয়ই ভাবছিস ফুপু জেনেশুনে তোর জন্য একটা কম সুন্দরী মেয়েকে কেন পছন্দ করেছি?… রূপ দিয়ে কি হবে বাবা? তোর ভাইও তো রূপসীর প্রেমে পাগল হয়েছিলো, সুখ আছে তাঁর? রাতদিন মনমরা হয়ে পড়ে থাকে। আমার ভয়ে মুখ ফুটে কিছু বলে না। কিন্তু আমি তো বুঝি আমার ছেলে ঐ সর্বনাশী মুখপুড়িকে কতটা ভালোবেসেছে। এখন দিনরাত জ্বলে মরছে।’
শায়লা মুরসালীনের অশ্রুভেজা দৃষ্টি ফুয়াদকে নরম করে দিলো। কোমল কন্ঠে বললো,’আমি তেমন কিছুই ভাবছি না ফুপু। মেয়ে যথেষ্ট সুন্দর। আমি সামনাসামনি দেখেছি কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। মেয়েটার মেজাজ গরম। আমার সঙ্গে মিলবে না। তুমি তো জানোই আমার সম্পর্কে। আমি সবসময়ই শান্তশিষ্ট, নির্ভেজাল প্রকৃতির ছেলে। জীবনসঙ্গী হিসেবে আমার তেমন মেয়েই চাই।’
তারপর শায়েলা মুরসালীনকে সেদিনের ঘটনা সব খুলে বললো ফুয়াদ। সব শুনে শায়লা মুরসালীন তিন্নির পক্ষ নিয়েই কথা বললেন।
-‘তুই যা করেছিস তাতে তো যে কারোরই মেজাজ গরম হয়ে যাবে।’
-‘হ্যাঁ। মেজাজ গরম হওয়াটাই স্বাভাবিক কিন্তু ঐ মেয়ের মেজাজ মাত্রাতিরিক্ত গরম। বাড়ি মেরে আমার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে।’
শায়লা মুরসালীন আরো কিছু বলতে চাইলেন ফুয়াদ তাঁকে থামিয়ে দিলো। বললো,’আমার বিয়ে নিয়ে চিন্তা বাদ দিয়ে রেজোয়ানের দিকে নজর দাও এখন। ওর মনের অবস্থা ভালো না।’
রেজোয়ানের কথা মনে পড়তেই শায়লা মুরসালীন অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। তাঁর ছেলেটা বিনাদোষে নিজেকে শাস্তি দিচ্ছে। কি ছেলে কি হয়ে গেছে। ছেলের মুখের দিকে তাকালে ডুঁকরে কান্না আসে শায়লা মুরসালীনের। অথচ চুপচাপ দেখে যাওয়া ছাড়া আর কিচ্ছু করতে পারছেন না তিনি।