তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৩
অফিস থেকে বেরিয়ে তপ্ত রোদ মাথায় নিয়ে রাস্তায় হাঁটা ধরলো নিলি। সূর্যের তাপ সরাসরি মাথার তালুতে এসে লাগছে। প্রচণ্ড গরমে মাথা ঘুরছে। এখন আবার দুটো টিউশনি করে বাসায় যেতে হবে। কাল থেকে এই টিউশনিগুলো আর করা যাবে না। তাই আজকে গিয়ে বারণ করে দিতে হবে। কিন্তু এখান থেকে ছাত্রীর বাসায় পৌঁছাতে হলে কম করে হলেও ৫ কিলো হাঁটতে হবে তাঁকে। রিক্সা ভাড়ায় অপচয় করার মতন যথেষ্ট টাকাপয়সা তাঁর হাতে নেই।
এইমাসের বাজার খরচার পর আর অল্পকিছু টাকা হাতে আছে। কখন কি দরকার পড়ে বসে। টাকাগুলো হাতে রাখা প্রয়োজন। যথাসম্ভব দ্রুত পা চালিয়ে ছাত্রীর বাসার দিকে রওনা হলো।
সূর্য ডুবেছে অনেক্ষণ। ঘরে আলো দেওয়া হয় নি। নিজামউদ্দিন সাহেব বিছানায় শুয়ে কাঁতরাচ্ছেন। নিলিকে ভেতরে ঢুকতে দেখে রুগ্ন কন্ঠে আলোটা জালিয়ে দিতে বললেন। তারপর ক্ষীণ স্বরে ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করলেন চাকরীর ইন্টার্ভিউ কেমন হয়েছে।
নিলি কাপড় বদলে নিয়ে বাবার বিছানার পাশে বসলো। খালিপেটের ওষুধটা উনার মুখে গুঁজে দিয়ে ক্লান্ত গলায় বললো,’ইন্টার্ভিউ ভালো হয়েছে। চাকরী কনফার্ম। কাল থেকে জয়েন করতে হবে।’
চোখেমুখে অবিশ্বাস ফুটে উঠলো নিজামউদ্দিন সাহেবের। ইন্টার্ভিউ দিতে না দিতেই চাকরী? এটা কি করে সম্ভব? নিলি নিশ্চয়ই উনাকে মিথ্যে বলে সান্ত্বনা দিচ্ছে। কন্ঠস্বরে দ্বিধা নিয়ে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন তিনি,’হয়ে গেছে মানে?’
-‘হয়ে গেছে মানে হয়ে গেছে। একদিন তুমি যাকে রাস্তার লোকেদের দিয়ে জুতোপেটা করেছিলে তাঁর অফিসেই হয়েছে!’
নিমিষেই চেহারার রঙ উড়ে গেলো নিজামউদ্দিন সাহেবের। নিলি কার কথা বলছে? কাকে জুতোপেটা করেছিলেন তিনি? কে?
খানিকক্ষণ পুরোনো স্মৃতি নাড়ানড়া করে ভেতরে ভেতরে সংকিত হয়ে উঠলেন। তবে কি সেই ছেলেটা? তিন বছর আগে নিলিকে ভালোবাসার অপরাধে যাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে জুতোপেটা করেছিলেন তিনি। মার খেয়েও শুধুমাত্র নিলিকে বিয়ে করার জন্য তাঁর পায়ে ধরে সময় ভিক্ষা চেয়েছিলো ছেলেটা! কি যেন নাম ছেলেটার….মনে করতে পারলেন না।
-‘নামটা মনে আসছে না….
-‘রেজোয়ান। রেজোয়ান মুরসালীন।’
-‘তাঁর সঙ্গে তোর দেখা হয়েছে?’
-‘সে আমার বস। এখন বিরাট বড় কোম্পানির মালিক। মেলা টাকাপয়সা।’
সময় বদলায়। সেই সঙ্গে মানুষের অবস্থান। আল্লাহতালা কখন কাকে কি পরিস্থিতিতে ফেলবেন সেটা একমাত্র তিনি ছাড়া আর কেউ বলতে পারবেন না।
দুঃসময় রেজোয়ানেরও গেছে। নিলির বিয়ের পর মানসিকভাবে খুব ভেঙ্গে পড়েছিলো সে। চাকরী হারিয়ে ছয়মাস বেকার অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছিলো। কিন্তু এরপর আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ায়। পরিবারের চেষ্টায় ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে একজনের সঙ্গে পার্টনারশিপে বিজনেস চালু করে। তারপর নিজের আলাদা ব্যবসা।
পারিবারিক সম্পত্তি যা ছিলো বিক্রি করে সব ব্যবসার পেছনে ইনভেস্ট করে। তারপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। নিজের মেধা এবং পরিশ্রম দিয়ে আজকের এই অবস্থানে পৌঁছেছে। কোটি কোটি টাকা এখন তাঁর হাতের ওপর দিয়ে লেনদেন হয়। অথচ থেমে থাকার জো নেই। নিরন্তর ছুটে চলা।
অপরদিকে এই তিনবছরে নিজামউদ্দিন সাহেব সব হারিয়ে একেবারে সর্বস্বান্ত। চোখের পানি মুছে নিরবে মেয়ের দিকে চেয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। কিন্তু নিলির কোন হোলদোল হলো না। মনে মনে আজও বাবাকে ক্ষমা করতে পারে নি সে। তাঁর এই দুর্দশার জন্য নিজামউদ্দিন সাহেবই দায়ী। তিনি জোর করে বিয়েটা না দিলে এমন কিছুই হতো না। চুপচাপ উঠে গিয়ে রাতের খাবার তৈরী করতে চলে গেলো সে।
★
অফিসের কাজ শেষ করে বাসায় ফিরছিলো রেজোয়ান। বাসার কাছাকাছি আসতেই দেখলো বিল্ডিং এর নিচে দাঁড়িয়ে রিক্সাওয়ালার সাথে ঝগড়া করছে তিন্নি। আশেপাশের লোকজন দাঁড়িয়ে তামাসা দেখছে। কাছে এগিয়ে গেলো সে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই রিক্সাওয়ালা রাগতমুখে জানালো মাত্র পাঁচ টাকা বেশি চেয়েছে বলে তাঁর সাথে ঝগড়া করছে তিন্নি। তিন্নি খেপে গিয়ে বললো,’বেশি চাইবেন কেন আপনি? আমি কি এই কলোনিতে নতুন?’
রেজোয়ান তাঁকে থামিয়ে দিয়ে রিক্সাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বললো,’ভাড়া আমি দিয়ে দিচ্ছি মামা। আপনি নিয়ে যান!’ তারপর দাঁতেদাঁত চেপে তিন্নিকে উদ্দেশ্য করে বললো,’কোথায় যাবি উঠ!’
জবাবে তিন্নি কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তারআগেই রিক্সাওয়ালা ওকে নিয়ে যেতে বারণ করে দিয়ে বললো,’আমি এরে রিসকায় নিমু না মামা। বড় ভেজাইল্লা পাবলিক! লাগবো আমার ট্যাকা! আমি যাই গা।’ কথা শেষ করে আর একমুহূর্তও দাঁড়ালো না সে। সঙ্গে সঙ্গেই রিক্সার প্যাডেলে চাপ মারলো। আশেপাশে লোকজন যারা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে তামাসা দেখছিলো তাঁরাও মুখ টিপে হাসছে।
রেজোয়ান ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললো,’এবার ভালো লাগছে? অপমান করে দিয়ে গেছে। পাঁচ টাকার জন্য এমন করছিলি যেন তোর বিয়ের গেট আটকে গেছে। অসভ্য বেয়াদপ!’
-‘আমার বাবা অনেক কষ্ট করে রোজগার করে। আমার কাছে এই পাঁচটাকা পাঁচকোটি টাকার সমান। আপনি কি বুঝবেন আমাদের দুঃখ?’
-‘না আমি কিচ্ছু বুঝি না। সব তুইই বুঝিস! খালি তোর বাপই কষ্ট করে টাকা রোজগার করে। আর এই রিক্সাওয়ালা তো উড়ে উড়ে রিক্সাচালায়! তার তো কোন কষ্ট নেই।’
-‘খবরদার একদম খোঁচা দিয়ে কথা বলবেন না। সে কষ্ট করুক আর যাই করুক বাড়তি ভাড়া চাইবে কেন?’
-‘পাঁচটাকাই তো চেয়েছে, তোর বাবার কিডনী তো আর চায় নি?’
-‘ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। আমি কিন্তু আম্মাকে গিয়ে বলে দিবো রেজোয়ান ভাই আমার বাপ তুলে কথা বলেছে।’
তাঁর বলার ভঙ্গি দেখে রেজোয়ান না চাইতেও হেসে ফেললো। একমাত্র এই মেয়েটার সামনেই পুরোপুরি অন্যরকম মানুষ হয়ে যায় সে। নিজেকে তখন একেবারে ছোট বাচ্চাদের মতন মনে হয়। আলতো করে তিন্নির মাথায় চাটি মেরে বললো,’ঝগড়া করা ছাড়া তোর পেটের ভাত হজম হয় না? আজকে এই রিক্সাওয়ালা মামাকে ছাড়া আর কাউকে পাস নি?’
-‘এসব বলে লাভ নেই। আমি কিন্তু সত্যি সত্যি আম্মাকে গিয়ে বলে দেবো। আপনি আব্বাকে গালি দিয়েছেন।’
-‘গালি? এই কখন গালি দিয়েছি আমি? একদম মিথ্যে কথা বলবি না।’
-‘বলবো। একশোবার বলবো। কালকে আপনি আমাকে মার খাইয়েছিলেন মনে আছে?’
রেজোয়ান ফের হেসে ফেললো। এখন ঝগড়া করার সময় নেই। বাসায় যেতে হবে। হার মেনে নিয়ে বললো,’আচ্ছা ঠিক আছে যা, আমার ভুল হয়ে গেছে। এখন বল তুই কোথায় যাবি?’
-‘আমার এক বান্ধবীর জন্মদিন আজকে। ওদের বাসায় যেতে হবে।’
-‘ আয় রিক্সায় তুলে দিই তোকে।’
-‘রিক্সায় তুলে দিতে হবে কেন? আপনার গাড়িতে করে পৌঁছে দিন না?’
-‘আমি এখন তোকে নিয়ে আবার বেরোবো?’
-‘হ্যাঁ। কি হয়েছে?
-‘আমি সারাদিন অফিসের কাজ শেষ করে মাত্র বাসায় যাচ্ছি তিন্নি।’
-‘তাহলে ড্রাইভারকে বলে দিন। সে আমাকে পৌঁছে দিক।’
-‘সম্ভব না। আমি একটুপর মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাবো।’
উল্লেখ্য যে, এই বাসাটাতে রেজোয়ান একাই থাকে। অফিসের সুবিধার জন্য এখানে অ্যাপার্টম্যান্ট ভাড়া নিয়েছে সে। আর একমাত্র মেয়েকে নিয়ে তাঁর মা শায়লা মুরসালীন তাদের বনানীর আলিশান বাড়িটাতে থাকে। এই নিয়ে অবশ্য রোজ ছেলের সঙ্গে নিয়ম করে ঝগড়া হয় শায়লা মুরসালীনের। কিন্তু কিছুতেই এখন বাসা চেইঞ্জ করবে না রেজোয়ান। তাঁর ইচ্ছে আরো কিছুদিন এখানে থেকে ব্যবসাটাকে আরেকটু শক্তভাবে গুছিয়ে নেবে। তারপর শিফট হবে।
রেজোয়ান গাড়ি দেবে না শুনে তিন্নির মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। মুখ ভেংচি কেটে বললো,’গাড়ি নিয়ে যেতে দেবেন না সেটা বললেই তো হয়। এত বাহানা দেওয়ার কি আছে? লাগবে আপনার গাড়ি।’
তিন্নির গাল ফোলানো দেখে রেজোয়ান আরো একবার হেসে ফেললো। আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে বললো,’ঠিক আছে নিয়ে যা। বান্ধবীর জন্মদিনে মন খারাপ করে থাকা ভালো দেখায় না।’
-‘লাগবে না। পরে আবার এই নিয়ে ঠিকই কথা শোনাবেন। আমার জন্য মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পারেন নি, আমি গাড়ি নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে গেছি, আমি সবসময় বেশি বেশি করি, আমার কোন আক্কেল আন্দাজ নেই। দরকার নেই বাবা এসব ঝামেলার। তারচেয়ে আপনি যান আপনার গাড়ি নিয়ে। আমি বরং রিক্সায়ই যাই। সেই ভালো হবে।’
-‘অফিস থেকে অন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিতে বলবো। তুই এটা নিয়ে যা!’
এতক্ষনে হাসি ফুটে উঠলো তিন্নির মুখে। মন খারাপ করার ফর্মুলাটা কাজে দিয়েছে। রেজোয়ান ঠিক গাড়ি দিতে রাজি হয়ে গেছে। দেরী না করে চটপট গাড়িতে উঠে বসলো। রেজোয়ান নিচু হয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বললো,’ওকে নিয়ে একেবারে ফিরে এসো। আর শোনো,সাবধানে গাড়ি চালাবে। জানোই তো ঢাকা শহরের রাস্তা।’
তারপর তিন্নিকে উদ্দেশ্য করে বললো,’কোন সমস্যা হলে আমাকে ফোন করবি। আর কাজ শেষ হলে বেশি রাত করিস না।’ তিন্নি ছোট বাচ্চাদের মতন মাথা নাড়িয়ে তাঁর কথায় সায় জানালো।
★
ফ্রেশ হয়ে কফির মগ হাতে নিয়ে বসলো রেজোয়ান। আজকের দিনটা অনেক ক্লান্তির গেছে। অবসন্ন, বিষন্ন,বিষাক্ত একটা দিন। ঠিকমত কাজেও মন বসাতে পারে নি। সারাটা বিকেল নিলির কথা ভেবেছে। নিলিকে দেখলেই বোঝা যায় ভীষণ আর্থিক সংকটে আছে সে। কিন্তু কেন? হাজবেন্ড নেই তো কি হয়েছে বাবা, ভাই এরা তো আছে? এরা থাকতে নিলির এই করুণ অবস্থা কেন? তবে কি নিলির সঙ্গে তাঁর পরিবারের কোন যোগাযোগ নেই?
কফির মগটা পাশের টেবিলে রেখে ল্যাপটপ নিয়ে বসলো। নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীদের ফাইলটা ওপেন করে আরো একবার ভালোমতন নিলির সিভিটা পড়লো। পড়াশুনা পুরোপুরি শেষ করতে পারে নি নিলি। তার আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ের পরেও বোধহয় পড়ার আর সুযোগ দেয় নি শ্বশুরবাড়ির লোকজন। চাকরীর অভিজ্ঞাও নেই।
তবে সংসার চলছে কি করে তাঁর?
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ল্যাপটপ বন্ধ করে দিলো রেজোয়ান। স্বার্থপর মেয়েটাকে নিয়ে খুব বেশি ভাবতে চায় না সে। এই মেয়েটা তাঁর জীবন টাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে কয়লা বানিয়ে দিয়ে গেছে। কোনদিন তাঁর ভালোবাসার মূল্য দেয় নি। শুধু নিজের ভেবে গেছে। টাকার জন্য তাদের চার বছরের সম্পর্ক ভুলে গিয়ে অন্য একজনকে বিয়ে করেছে। একে কোনদিন ক্ষমা করা যায় না।
তাঁকে এই অফিসে চাকরী দেওয়ার একটাই উদ্দেশ্য। সেটা হচ্ছে সব অপমানের প্রতিশোধ। নিজের প্রতি করা সকল অন্যায়ের সকল জবাব নেবে রেজোয়ান। এত অপমান করবে, এত অপমান করবে যে নিলি বাধ্য হবে এই অফিস ছেড়ে দিতে।
#তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৪
মাত্র অল্পকিছুদের মধ্যেই অফিসের সবার কাছে বেশ পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছে নিলি। সেটা অবশ্য ভালো দিক থেকে নয়। অফিসের সবার জন্য নিলির উপস্থিতিটা আনন্দদায়ক হলেও নিলির জন্য সেটা মোটেও সুখকর নয়। কারণ বর্তমান সময়ে অফিসের যেই কোন বিষয়ে কিংবা ঘটনায় বুলি করার জন্য সবার একমাত্র পছন্দের পাত্রী হচ্ছে নিলি। সেইজন্যই তার উপস্থিতি সবাইকে আনন্দ দেয়। নিলির প্রতি রেজোয়ানের কঠোর মনোভাবই এসবের একমাত্র কারণ। অফিসের প্রায় প্রত্যেকেই ইতোমধ্যে জেনে গেছে যে, দোষ যারই হোক না কেন সেটা নিশ্চিন্তে নিলির ঘাড়েই চাপিয়ে দেওয়া যায়। প্রতিবাদ করার মতন সাহস কিংবা রেজোয়ানের কাছে নালিশ করার মতন মুখ নিলির নেই। থাকলেও রেজোয়ান শুনবে না।
কিন্তু এই এত এত কর্মচারীদের মধ্যে কেবল একজনই নিলির প্রতি বেশ আন্তরিক। এখন পর্যন্ত নিলির সঙ্গে কোনরকম কোন খারাপ ব্যবহার করে নি সে। বরং বিপদে আপদে সব সময় পাশে দাঁড়িয়েছে। নিলি নিজের যেকোন সুবিধা অসুবিধার কথা একমাত্র এই মানুষটার কাছেই খুলে বলতে পারে। মানুষটা আর কেউ নয়, রেজোয়ানের পার্সনাল সেক্রেটারি জাহেদ সারোয়ার। খুবই ভালো মনের একজন মানুষ। অফিসের প্রতি, রেজোয়ানের প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান।
★
আজকেও সকাল থেকে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত নিলি। গাধার মত তাঁকে দিয়ে পরিশ্রম করাচ্ছে রেজোয়ান। দম ফেলবার সুযোগটুকু পর্যন্ত দিচ্ছে না। মনে হচ্ছে কোন কর্মচারী নয় একটা রোবট নিয়োগ দিয়েছে সে। তারওপর পান থেকে চুন খসলেই রুমে ডেকে নিয়ে অপমান। চুপচাপ মুখ বুজে সব অপমান সহ্য করে নেয় নিলি। তাঁর বিশ্বাস অপমান করতে করতে একদিন রেজোয়ান নিজেই হাঁপিয়ে যাবে। তখন আর নিলিকে কষ্ট দেওয়ার ইচ্ছে তাঁর থাকবে না। সেই পর্যন্ত নিলিকে শুধু একটু ধৈর্য ধরতে হবে। চাকরীটা কোন ভাবে হারানো যাবে না।
ডেস্কে বসে হিসাবপত্র সব কম্পিটারে সেইভ করছিলো নিলি। হঠাৎ করে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আচমকাই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো তাঁর। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো স্টাফরা সবাই আতংকিত চেহারা নিয়ে তাকিয়ে আছে।কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারলো না নিলি। কাউকে জিজ্ঞেস করার সাহসও পেলো না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ করে সেক্রেটারি জাহিদ তাঁর ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে শংকিত মুখে বললো,’স্যার আপনাকে ডাকছে মিসেস নিলি। এক্ষুনি উনার রুমে যেতে হবে।’
ভয়ে নিলির মুখ একবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। আজকে সকাল থেকে একবারও রেজোয়ানের সঙ্গে দেখা হয় নি তাঁর। হঠাৎ ডাকছে শুনে পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। জাহিদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে ভয়ানক কিছু হতে চলেছে। চাকরীটা থাকবে তো?
ডেস্ক থেকে বেরিয়ে ভয়ে ভয়ে রেজোয়ানের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। রুমে ঢুকে দেখলো ভেতরে রেজোয়ানের সঙ্গে অফিসের পুরোনো কর্মচারী আজিজ সাহেব, শিহাব সাহেব এনারাও আছেন।
তাঁকে দেখেই রেজোয়ান হুংকার দিয়ে উঠলো,’কত টাকা নিয়েছো ওদের কাছ থেকে?’
হুংকার শুনে ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো নিলির।রেজোয়ান কিসের টাকার কথা বলছে সে বুঝতে পারছে না। ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইলো। রেজোয়ান ফের গর্জে উঠলো। তাঁকে শান্ত করতে এবার আজিজ সাহেব মুখ খুললেন।
তিনিও নিলিকে উদ্দেশ্য করে একই প্রশ্নটাই আবার করলেন। নিলি ভয়ে ভয়ে বললো,’কিসের টাকার কথা বলছেন আপনারা? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
-‘বুঝতে পারছো না তাই না? নাকি বুঝতে চাইছো না? সত্যি করে বলো কম্পানীর সিক্রেট ইনফরমেশন লিক করার জন্য কত টাকা নিয়েছো রেজা গ্রুপের কাছ থেকে?’, পুনরায় চিৎকার দিয়ে উঠলো রেজোয়ান।
-‘মানে?’, এবারে পূর্বের চাইতে দ্বিগুণ ভয় পেলো নিলি।অবাক হলো। অফিসের সামান্য একজন ক্লার্ক সে। তারপক্ষে কি করে গোপন ইনফরমেশন লিক করা সম্ভব?’
ভয়ে আতংকে কিছু বলার মতন ভাষা খুঁজে পেলো না। তাঁকে চুপ থাকতে দেখে ক্যাশিয়ার শিহাব সাহেব রেজোয়ানকে উদ্দেশ্য করে বললো,’পুলিশে খবর দিন স্যার। ওরা এলে ঠিক পেটে থেকে কথা বের হয়ে যাবে।’
উনার কথার জবাবে রেজোয়ান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিলির মুখের দিকে চেয়ে রইলো। এই সমস্ত ঘটনার জন্য কম করে হলেও অর্ধশত কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়বে তাঁর কম্পানী। নতুন করে এইবারই প্রজেক্টটা হাতে নিয়েছিলো তাঁরা। কিন্তু ইনফরমেশন লিক হওয়ার কারণে সরকারের কাছ থেকে বিডটা রেজা গ্রুপ জিতে নিয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, তাঁদের কাছে ইমেলটা নিলির কম্পিটার থেকেই গেছে। তাও আবার ওয়ার্কিং আওয়ারে।
★
অফিসে ইতোমধ্যে পুলিশও এসে গেছে। ক্ষতিপূরণ দাবি করার জন্য রেজা গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলা করার কথা ভাবছে রেজোয়ান। জাহিদকে সেই কথা জানাতেই জাহিদ বললো,’সন্দেহজনক কয়েকজনের তালিকা দিতে বলেছে পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পুলিশ এসেছে শুনে নিলি ঘাবড়ে গেলো। এতক্ষণ যাবত অফিসের সবাই মিলে লাগাতর জেরা করতে করতে দিশেহারা বানিয়ে দিয়েছে তাঁকে। এবার পুলিশ! ভীত,অসহায় বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে রেজোয়ানের কাছে ছুটে গেলো। নিজেকে রক্ষা করতে হলে একমাত্র রেজোয়ানের কাছেই সাহায্য চাইতে হবে। এই ছাড়া আর কোন উপায় নেই। ভেতরে রেজোয়ান গম্ভীর মুখ করে চেয়ারে বসে আছে। নিলি কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,’আমি কোন ইনফরমেশন লিক করি নি। বিশ্বাস করো, আজিজ সাহেব আমাকে কালকে একটা ইমেইল পাঠাতে বলেছিলেন আমি শুধু উনার কথামত ইমেইল টা পাঠিয়েছি…আমি কিচ্ছু জানি না।’
তার কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই রেজোয়ান গম্ভীর গলায় বললো,’আজিজ সাহেব আমাদের পুরোনো কর্মচারী। ইউ কান্ট ব্লেম হিম!’
গতকাল দুপুরে আজিজ সাহেব ফোন করেছিলেন নিলির কাছে। উনার কম্পিটারে গণ্ডগোল দেখা দেওয়ায় অফিসিয়াল একটা মেইল নিলির কম্পিটার থেকে পাঠানোর জন্য বিশেষ অনুরোধ করেন। বোকা মেয়েটা বুঝতেই পারে নি,তাঁকে ফাসানোর জন্যই আজিজ সাহেব ইচ্ছে করে নিজে না এসে তাঁকে দিয়ে ফাইল আনিয়েছেন। নিলির এই নির্বুদ্ধিতার ফলাফল স্বরূপ সিসিটিভি ফুটেজে টেবিল থেকে নিলির ফাইল নিয়ে আসা, কম্পিউটার টেবিলের সামনে বসে টাইপ করা, সব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। আর সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে অফিসের সবাই তখন বাইরে ছিলো। লাঞ্চ আওয়ার ছিলো বিধায় ভেতরে কেউ ছিলো না। আজিজ সাহেবও লাঞ্চের ফাঁকেই কলটা করেছিলেন। কিন্তু নিলি এতসব বুঝতে পারে নি। তারওপর ফুটেজ দেখে মনে হচ্ছে যেন সবার বেরিয়ে যাওয়ার অপেক্ষাতেই ছিলো সে।
জলের ফোয়ারার ন্যায় অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়লো নিলির চোখ বেয়ে। পুনরায় আকুতি জানিয়ে বললো,’আমি মানছি আজিজ সাহেব অনেক পুরোনো কর্মচারী। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি এসবের কিছুই জানি না। আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে।’
রেজোয়ান জবাব দিলো না। পূর্বের ন্যায় গম্ভীর মুখে বসে রইলো। নিলি পুনরায় মিনতি ভরা কন্ঠে বললো,’প্লিজ আমাকে বাঁচাও। আমি কিচ্ছু করি নি। সম্পূর্ণ নির্দোষ আমি!’
-‘তুমি যে নির্দোষ তার কি প্রমাণ আছে? সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণ তো তোমার বিরুদ্ধে কথা বলছে?’
-‘সব মিথ্যে। আমি কিচ্ছু করি নি।’
-‘সেটা তো তোমার মুখের কথা। কিন্তু সত্যিটা অন্যরকম।’
-‘আমাকে বাঁচাও প্লিজ!’, তর্ক করে লাভ নেই সেটা বুঝতে পেরে অসহায়ের মত ডুঁকরে উঠলো নিলি।
রেজোয়ান চুপ করে রইলো। নিলি বিরতিহীন ভাবে কেঁদে চলেছে।
-‘বেশ। আমি কেইসটা তুলে নেবো কিন্তু তার আগে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।’
-‘কি কাজ?’
-‘বেন্ড ডাউন!’
নিলি প্রথমে তাঁর কথা বুঝতে পারলো না। বোবার মতন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। রেজোয়ান চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বললো,’হাটুমুড়ে আমার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাও। তারপর ভেবে দেখবো।’
অকস্মাৎ যেন বজ্রপাত ভেঙ্গে পড়লো নিলির মাথায়। হতবিহ্বল চেহারা নিয়ে বেশকিছু ক্ষণ চেয়ে রইলো রেজোয়ানের মুখের দিকে। আরো একবার অশ্রু বিসর্জন করলো। সে ভাবতেই পারে নি রেজোয়ান এতটা কঠোর হতে পারে তাঁর প্রতি! এত ঘৃণা! এত রাগ!
তবে কি সত্যিই আর কোন ভালোবাসা নেই? সত্যিই রেজোয়ান তাঁকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়?
চোখ মুছে ধীরে ধীরে ভিখিরির ন্যায় হাটুমুড়ে বসে পড়লো। চোখভর্তি পানি, মস্তক অবনত! সম্মুখ পানে হাত দুটো বাড়ানো। রেজোয়ানের মূর্তির মতন সেদিকে চেয়ে আছে। পূর্বের চাইতে দ্বিগুণ কঠিন স্বরে বললো,’আই অ্যাম সরি মিসেস নিলি। আমার পক্ষে একজন ক্রিমিনালকে সাহায্য করা কোনভাবেই সম্ভব না!’
মাথা তুললো নিলি! চোখে সেই আগের মতনই অবিশ্বাস! এতকিছুর পরেও সে কোন ভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না রেজোয়ান তাঁর সঙ্গে এমন আচরণ করতে পারে! এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে তাঁর প্রতি। মহিলা একজন পুলিশ জোর করে টেনে নিয়ে গেলো তাঁকে। যাওয়ার সময় চোখভর্তি পানি নিয়ে পলকহীনভাবে রেজোয়ানের দিকে চেয়ে রইলো সে!
নিলিকে নিয়ে মহিলা পুলিশ বেরিয়ে গেলে চোখ বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো রেজোয়ান। শরীর ভীষণ অবসন্ন লাগছে তাঁর। সেক্রেটারি জাহিদ কখন ফাইল হাতে নিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করে নি। জাহিদ সেটা বুঝতে পেরে গলা খাঁকারি দিলো। তার উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ খুললো রেজোয়ান। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফাইলগুলো সাইন করে উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু দরজার কাছ থেকে পুনরায় ফিরে এসে জাহিদ কে উদ্দেশ্য করে বললো,’আজিজ সাহেবের ওপর নজর রাখার ব্যবস্থা করো জাহেদ। তিনি কখন কোথায় যাচ্ছেন সব ইনফরমেশন আমার চাই! প্রয়োজনে থানায় যোগাযোগ করে তাঁর কল ট্রাকিং এর ব্যবস্থা করো।’