তুমি_তাই অরিত্রিকা আহানা পর্বঃ৮

0
668

তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৮

গরম ধোঁয়া উঠা কফির মগ হাতে নিয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে রেজোয়ান। অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। সন্ধ্যে হতে আর বেশি বাকি নেই। তথাপি নিচে নামতে মন চাইছে না রেজোয়ানের। বিকেলের এই সময় নিরিবিলিতে বসে প্রকৃতি উপভোগ করতে বেশ ভালো লাগে তাঁর। গোধুলীর সময় ঘরে ফিরতে ব্যস্ত পাখিদের কিচিরমিচির অদ্ভুত এক প্রশান্তি দেয়।

কিন্তু এই বিল্ডিংয়ে যে তিন্নি নামের একজন আছে সেটা সে ভুলে গিয়েছিলো। তাই তো প্রকৃতি উপভোগ করার জন্য বারান্দায় না দাঁড়িয়ে ছাদে এসেছে।

তিন্নি এসেছিলো ছাদে কাপড় নিতে। রেজোয়ানকে চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে, সহ্য হলো না। না হওয়ারই কথা। বেশিকিছুদিন ধরে মনমতো ঝগড়া করতে পারছে না রেজোয়ানের সঙ্গে।
তারওপর এক তারিখ থেকে ফাইনাল পরীক্ষা। একমাস রেজোয়ানের সঙ্গে দেখা হবে না।
পা টিপেটিপে রেজোয়ানের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপরই সজোরে ‘ভাউ’ বলে তাঁর কানের কাছে চিৎকার করে উঠলো। আচমকা ভয় পেয়ে গেলো রেজোয়ান। চমকে উঠে পেছনে সরে গেলো। রাগে কটমট করে তিন্নির দিকে চাইলো।

এদিকে তাঁকে চমকে দিতে পেরে বেজায় খুশি তিন্নি। চোখেমুখে দুষ্টুমিভরা চাহনি নিয়ে বললো,’ভয় পেয়ে ছিলেন?’

রেজোয়ানের মন চাইলো কষে এই বদ মেয়েটার কানের নিচে একটা চড় বসিয়ে দিতে। তথাপি, অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজেকে সামলে নিলো। কারণ মিথ্যে বলায় তিন্নির জুড়ি নেই। দেখা যাবে তাসলিমা বেগমের কাছে গিয়ে বলবে রেজোয়ান তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দিতে চেয়েছিলো।

তাই তিন্নির প্রশ্নটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সামনে ঘুরে গেলো। কফিতে চুমুক দিয়ে আপনমনে সেটার স্বাদ অনুভবের চেষ্টা করলো। কিন্তু তাতেও বাগড়া বসালো তিন্নি। কফির মগটা নিয়ে রেজোয়ানের অনুমতি ছাড়াই তাতে চুমুক বসালো। ধমকে উঠলো রেজোয়ান। কিন্তু পাত্তা দিলো না তিন্নি। নিজের মত করেই বলে গেলো,’আপনার কি মন খারাপ? কি হয়েছে বলুন তো? ইদানীং দেখছি খুব চুপচাপ হয়ে গেছেন?’

কফির মগটা তাঁর হাতে দিয়ে রেজোয়ান নেমে যাচ্ছিলো। প্রকৃতি উপভোগের সাধ মিটে গেছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে রাজ্যের গল্প শুরু করে দেবে তিন্নি। বকবক করে মাথাটা খারাপ করে দেবে। তারচেয়ে বাসায় বসে রেস্ট করাই ভালো। কিন্তু তিন্নি তাঁকে নিচে নামতে দিলো না। সামনে দাঁড়িয়ে হাত দুটো মেলে ধরে পথ আটকালো। ফের নরম গলায় বললো,’কি হয়েছে আপনার? কেন এমন করছেন?’

-‘কিছু হয় নি। তুই প্লিজ সামনে থেকে সর।’

-‘কি হয়েছে সেটা না বললে আমি সামনে থেকে সরবো না।’

-‘বললাম তো কিছু হয় নি।’

-‘হয়েছে। আপনি আমাকে বলতে চাইছেন না।’

-‘সেটা যখন বুঝতেই পারছিস তখন খামোখা বিরক্ত করছিস কেন?’

তিন্নি বেশ অবাক হওয়ার ভান করে বললো,’ওমা! আপনি জানেন না? আপনাকে বিরক্ত করাটাই তো আমার প্রধান কাজ। এখন সময় নষ্ট না করে ঝটপট বলে ফেলুন কি হয়েছে?’

-‘তুই আমাকে জ্বালানো বন্ধ কর প্লিজ।’

তিন্নি ঠোঁট উল্টালো। জোর করে লাভ হবে না। রেজোয়ান একবার যখন ঠিক করে নিয়েছে তখন বলবে না। জোরাজুরি বাদ দিয়ে অনুরোধের সুরে বললো,’ঠিক আছে বলতে হবে না। শুধু একটা প্রশ্নের জবাব দিন, আপনি কি কোন কিছু নিয়ে আপসেট?’

-‘হুম।’

-‘কি সেটা?’

-‘তোকে বলা যাবে না।’

-‘এমন করছেন কেন? কি হয় একটু বললে? আমি কথা দিচ্ছি কাউকে বলবো না।’

-‘তোকে আমি বিশ্বাস করি না।’

তিন্নির হাসি পেয়ে গেলো। মুচকি হেসে বললো,’ঠিক আছে। কিন্তু আপনি চলে যাচ্ছিলেন কেন? আমি আপনার কফিতে চুমুক দিয়েছি বলে? দাঁড়ান আমি আরেক মগ বানিয়ে নিয়ে আসছি।’

-‘লাগবে না।’

-‘আর ইউ সিউর? পরে আবার আমাকে এই নিয়ে কথা শোনাবেন না তো?’

রেজোয়ান তাঁর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পুনরায় আকাশ পানে চাইলো। মনটা ভীষণ খারাপ তাঁর। অদ্ভুত বিষন্নতায় সমস্ত শরীর ছেয়ে আছে। মন,মস্তিষ্ক কোনটা থেকেই নিলিকে বাদ দিতে পারছে না। পুরোনো স্মৃতিগুলো একএক করে চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
উদাস গলায় বললো,’তুই গান গাইতে জানিস তিন্নি? পুরোনো দিনের রোমান্টিক বাংলা গান?’

-‘অল্প অল্প।’

-‘সমস্যা নেই।’

তিন্নি দুষ্টুভাবে ভ্রু জোড়া নাচালো। ফিচেল হেসে বললো,’কি ব্যাপার বলুন তো? আমাকে কি আজকে বেশি সুন্দর লাগছে?’

তাঁর এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে রেজোয়ান ঠাট্টারচ্ছলে খানিকটা হাসলো। তারপর হাসি থামিয়ে বললো,’তুই সত্যিই গান গাইতে জানিস তো?’

-‘আরে জানি, জানি।’

তারপর তিন্নি তাঁকে অবাক করে দিয়ে যথেষ্ট কনফিডেন্স এর সহিত গান গাইতে শুরু করে দিলো,
‘আমার লাইন হইয়া যায় আঁকাবাঁকা
ভালো না হাতের লেখা।
আসো যদি বাঁশবাগানে
আবার হবে দেখা গো আবার হবে দেখা।’

রেজোয়ান হতবম্ভ! হাতে উচিয়ে চড় মারার ভঙ্গি করে বললো,’তুই থামবি? না আমি কানের নিচে একটা দিবো?’

-‘গান শুনবেন না?’

-‘তোর এই গান শুনে গান নামক বস্তুটার ওপর থেকে রুচি উঠে গেছে আমার।’

ইচ্ছে করে রেজোয়ানকে হাসানোর জন্য গানটা গেয়েছে তিন্নি। রেজোয়ান মুড অফ করে থাকলে তাঁর একদম ভালো লাগে না। কিন্তু হাসার পরিবর্তে রেজোয়ানকে বিরক্ত হতে দেখে তাঁর নিজেরই হাসি পেয়ে গেলো। হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতন অবস্থা।

তাঁর অবস্থা দেখে রেজোয়ানও হেসে ফেললো। মৃদু হেসে বললো,’তুই এসব কই থেকে শিখেছিস?’

-‘আরো আছে। শুনবেন?’

-‘আর দরকার নেই। যথেষ্ট হয়েছে।’

-‘তাহলে আপনি একটা গেয়ে শুনান।’

-‘আমি গান পারি না।’

-‘পারতে হবে না। লিরিক্স মুখস্থ থাকলেই হবে।’

রেজোয়ান যেন তাঁর কথা শুনতেই পায় নি এমনভাবে বললো,’আমি নিচে যাচ্ছি। তুই কি এখন যাবি না আরো কিছুক্ষণ থাকবি?’ বলতে বলতেই হাঁটা ধরলো সে। তিন্নিও তাঁর পেছন পেছন দৌঁড়ে লাগালো।

লিফটে করে নামার সময় তাড়াহুড়া করে বললো,’আপনার সাথে আগামী একমাস আমার দেখা হবে না রেজোয়ান ভাই।’

-‘আলহামদুলিল্লাহ।’ সকৌতুকে হাসলো রেজোয়ান।

কিন্তু তিন্নি এবার সত্যি সত্যি মুখটা ভার করে বললো,’আমি সত্যি বলছি। কাল থেকে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হবে না। এক তারিখ থেকে ফাইনাল পরীক্ষা। আম্মা বলেছে পরীক্ষার সময় একদম বাসা থেকে বেরোনো যাবে না। এই একমাস ভালো করে পড়তে হবে।’

-‘ঠিকই তো বলেছেন। সারা বছর তো পড়াশুনা করিস নি। ফাঁকিবাজি করেই কাটিয়ে দিয়েছিস। এখন মন দিয়ে না পড়লে পাশ করবি কি করে?’

-‘সেসব নাহয় বুঝলাম। কিন্তু একটা কথা বলুন তো,আপনি আমাকে মিস করবেন না?’, এবার আগের চাইতেও বেশি করুণ শোনালো তিন্নির কন্ঠস্বর। চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে। এই একমাস রেজোয়ানের সঙ্গে তাঁর দেখা হবে ভাবতেই কান্না পাচ্ছে। অথচ রেজোয়ান কিছুতেই তিন্নির ভালোবাসাটা বুঝতে চায় না। সারাক্ষণ শুধু পালিয়ে বেড়ায়।

তার করুণ মুখ পানে চেয়ে মিথ্যে বলতে পারলো না রেজোয়ান। নরম গলায় বললো,’করবো।’

বাস্তবিকই এই মেয়েটাকে ভীষণ মিস করবে সে। তিন্নি ভীষণ মিশুক একটা মেয়ে। যখনই দেখা হবে রেজোয়ানের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য কিছু না কিছু করবে। যদিও বেশিরভাগ সময় ঝগড়াই করে তবুও ওর এই চঞ্চল স্বভাবের জন্যই রেজোয়ান ওকে বিশেষ স্নেহ করে।

তিন্নির মুখে হাসি ফুটে উঠলো। বলা বাহুল্য, রেজোয়ান তাঁকে মিস করবে শুনে ভেতরে ভেতরে অসম্ভব খুশি হয়েছে সে। কিন্তু মুখে প্রকাশ করলো না।

লিফটের কাছাকাছি এসে রেজোয়ান তাঁর মাথায় একটা হাত রেখে স্নেহের সুরে বললো,’পরীক্ষাটা এবার ভালো করে দে তিন্নি। এখন আর অন্য কোন দিকে মনযোগ দিস না। হাতে মাত্র একমাস সময় আছে। এই একমাস একটু ভালো করে পড়।’

তিন্নি বাধ্য মেয়ের মতন হ্যাঁসূচক মাথা দোলালো। রেজোয়ান ভাই যখন বলেছে, তখন ভালো করে পড়াশোনা করতেই হবে তাঁকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here