গল্পঃ- পিচ্চি বউ
পর্বঃ-৩
কাল থাইল্যান্ড যেতে হচ্ছে হানিমুনে। এক রকম জোর করে পাঠাচ্ছে বাবা। বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছে নেই এহেন গুণ্ডি বউ নিয়ে হানিমুনে যেতে। যেহেতু বাবা বলেছে তাই ফাঁকি দেওয়ার উপায় বের করাও মুশকিল। সন্ধ্যার দিকে জিনিস পত্র গোছানো শুরু করতে যাবো, ওয়ারড্রপ খুলে দেখি আমার অর্ধেক জামা কাপড় হাওয়া। সেখানে বউ আমার স্বযত্নে নিজের শাড়ির দোকান বসিয়েছে। রাগে ফেটে পরলাম,
-মিথুউউউউউউউউউউউউউউউউউউহ
– সমস্যা কি তোর হ্যাঁ?
-আমার বাকি জামাকাপড় কোথায়?
-ফুপ্পির কাছে দিয়ে এসেছি।
-আমার ড্রয়ারে হাত দিয়েছিস কেন?
-তো?
-তো মানে? সাহস হল কেমন করে?
– আমি না তোর বউ?
-বউ তো কি?
.
হয়ত বুঝেছে রাগ করেছি, তাই কথা না বাড়িয়ে আম্মুর কাছে গিয়ে জামাকাপড় গুলো সুবোধ বালিকার মত নিয়ে আসল।
-ব্যাগ গুছিয়ে নে।
সে কোনো কথা না বলে ব্যাগ গুছানো শুরু করল।
আমার প্রায় শেষ। ব্যাগে বিন্দুমাত্র জায়গা নেই। এখন বাঁধল মহাবিপত্তি, ট্রাউজার আর গেঞ্জি নেওয়া হয় নি। মেজাজ সপ্তমে উঠে গেল। নতুন করে শুরু করার কোনো মানে হয় না। মিথিলার এখনও শেষ হয় নি। বড় ব্যাগটা সে দখল করেছে। কিছু বলতেও পারছি, শেষমেষ কোনো উপায় না দেখে আবার মানবিক আবেদন করতে হল,
-মিথু
-হু
-এই মিথু…
-আচ্ছা, তোর কি মনে হয় আমার কানে সমস্যা আছে?
-মোটেই না?
-তাহলে মিথু মিথু করছিস কেন? বলে ফেল!
-ক্ষুদ্র পরিসরে একটা মানবিক আবেদন…
-কি?
-আমার ব্যাগে জায়গা নেই। ট্রাউজার গেঞ্জি গুলো তোর ব্যাগে নিতে পারবি?
-যদি না নেই?
এবার প্রচন্ড রাগ লাগছে, এত ভালো করে বললাম, তার পরেও শুনল না। কিছু না বলে রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে শুরু করলাম,
তখন বউ আমার পিছন থেকে ডাক দিল,
-কোনটা কোনটা নিব?
-তোর ইচ্ছে।
বলে চলে আসলাম। নিচে নামতে গিয়ে আবার রুমে উঁকি মারলাম, দেখি সে যত্নে সহকারে ট্রাউজার আর গেঞ্জি ভাঁজ করে তার ব্যাগে পুড়ে দিল।
.
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হলাম, মিথুও উঠে গেছে।তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পরতে হবে, সাড়ে ন’টায় ফ্লাইট। আকাশী রঙের শার্ট গায়ে দিতে যাবো এর মধ্যে মিথু বলল,
-তোর কালো রঙের শার্ট নেই?
-আছে। কেন?
-সেটা পর না! তোকে সুন্দর লাগবে।
মিথু এই কথা বলছে? ভাবতেই অবাক লাগছে! বলেছে যখন ড্রয়ার থেকে কালো শার্ট টা বের করে পরলাম। টাই হাতে নিয়েছি, নট বাঁধতে যাবো,
-দে আমি বেঁধে দিচ্ছি।
বাধ্য ছেলের মত কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইলাম। নট বাঁধা শেষ করে সে বলল,
-দেখ, তোকে অনেক সুন্দর লাগছে।
আমি বরাবর নিজের উপর উদাসীন টাইপ পাবলিক, তাই আয়না দেখতে ইচ্ছে হল না। একটু পরে বান্দা জেল আর চিরুনি নিয়ে এসে চুল্গুলোর একটা হেস্তনেস্ত করে দিল। যত সময় যাচ্ছে তত বেশি অবাক লাগছে। রুম থেকে বের হবার জন্য পা বাড়ালাম, পিছন থেকে মিথু ডাকল,
-অভ্র
-হুম বল।
-শাড়িটা একা পড়তে পারছি না, একটু হেল্প করবি?
-আমি?
-হ্যাঁ!
-পারি না তো।
-বেশি কিছু না। শুধু কুঁচি গুলো একটু ধরলেই হবে।
গেলাম, সাথে সাথে হাতে শাড়ীর কুঁচি ধরিয়ে দিল, সুদীর্ঘ ৯ মিনিটের চেষ্টার তার শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে সফল হলাম। সাজসজ্জা শেষ। নেহাৎ আমি কবি নই, হলে হয়ত ওর রুপ দেখে এখনই সাহিত্য রচনায় বসে যেতাম। প্রথম লক্ষ্য করলাম, ওর চোখে ভিন্ন রকম একটা মায়া আছে।
.
আব্বু আম্মুর দোয়া নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম। এয়ারপোর্টে পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে আটটা বেজে গেল। গিয়ে শুনি ফ্লাইট ডিলে হবে একঘন্টার মত। কিছু করার নেই, ওয়েটিং রুমে বসে আছি তখন মিথু বলল,
-চল, আইসক্রিম খেয়ে আসি।
-ইচ্ছে করছে না।
-চল না।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতে হল, যেহেতু ফ্লাইট ডিলে হবে, তাই এত সময় বসে থাকার মানে হয় না। তবে একটু রাগী হলেও মিথুর মধ্যে বাচ্চামি অভ্যাগ গুলো এখনো রয়ে গেছে।
.
দেখতে দেখতে ডিপাচার টাইম হয়ে আসল। থাই এয়ারওয়েজ এর ফার্স্ট ক্লাস টিকিট। দীর্ঘ যাত্রা শেষে গিয়ে নামনাল থাই এয়ারপোর্টে। যেখান থেকে ট্যাক্সি যোগে সোজা Centra Grand Beach resort এ উঠলাম। অসাধারণ জায়গা। রিসোর্টের সামনে বিশাল এক সুইমিং পুল। আরেকটু সামনে বীচ। তারপর সু-বিশাল সমদ্র। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, প্রকৃতিও যেন তার রুপ আরো বেশি ঢেলে সাজিয়ে নিচ্ছে। সারাদিনের জার্নি তে খুব ক্লান্ত লাগছে। মিথু এসেই বিছানায় শুয়ে পরেছে। সে খেয়াল করে নি জায়গাটা এত সুন্দর। শাওয়ার নিয়ে বাইরে এসে দেখি মিথু বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে,
-যা ফ্রেস হয়ে নে।
-হ্যাঁ যাচ্ছি! আর শোন, তুই রেডি হয়ে নে, বীচে যাব।
-আমার খুব ক্লান্ত লাগছে।
-কোনো কথা বলবি না।
চুপসে গেলাম, পাগলীটা যেহেতু বায়না ধরেছে কিছু করার নেই। ।
.
বীচে হাটছি, পাশে মিথিলা, একটু এগিয়ে সমুদ্রের পানিতে পা ভিজিয়ে দিলাম। সামনে বসার জায়গা, গিয়ে বসলাম, আলো আঁধারের অসাধারণ খেলা চলছে, বেশ লাগছে দেখতে। হঠাৎ বউ আমার বলে উঠল,
-জানিস, অনেক দিনের ইচ্ছে, alcohol খাব। কখন সাহস হয়ে উঠে নি। নিয়ে আসবি?
-এখনই খাবি?
-হুম!
.
মুখ ফুটে বলেছে আনতে গেলাম,আমার এই সবের উপর কোনো নেশা নেই তাই নিজের জন্য একটা ফ্রুট জুস নিলাম। ওর কাছে ফিরে গ্লাস টা হাতে দিয়ে আবার পাশে বসলাম।খেয়াল করলাম মিথিলা ঘাড়ে মাথা রেখে চুপ করে বসে আছে। নিজের কাছে একটু বিব্রত বোধ হচ্ছে। আশে-পাশে লোকজন কমে আসছে, রাতও হয়ে এল। উঠতে হবে। মিথিলা ঘুমিয়ে গেছে। ডাকবো কি না বুঝতে পারছি না, কিন্তু এভাবে তো বসে রাত কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে না। ডাক দিতে গিয়ে থমকে গেলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম কোলে করে রিসোর্টে নিয়ে যাব, উপায় না পেয়ে তাই করতে বাধ্য হলাম, কোলে তুলে নিলাম ওকে, হাঁটতে শুরু করলাম রিসোর্টের দিকে, আমার গলা জড়িয়ে ধরেছে। এ তো মহা মুসিবত, যে মেয়ে আমার সাথে ঝগড়া না করলে পেটের ভাত হজম হয় না, সে ড্রিংস করে গলা ধরেছে, ঘুমে না থাকলে হয়ত আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলত। রুমে ফিরে খাটে শুইয়ে দিলাম, গুটিশুটি শুয়ে পড়ল। পাতলা একটা চাদর ওর গায়ে টেনে দিলাম। মুখের উপর কিছু চুল উড়ে এসেছে, সড়িয়ে দিলাম, ও অন্য পাশ ফিরল। আমি আর কি করব, সোফায় একটা বই নিয়ে শুয়ে পরলাম।
.
কখন ঘুমিয়ে পরেছিলাম মনে নেই। সকালে ঘুম ভাঙ্গল মিথুর গলার চিল্লাপাল্লা শুনে,
-এই অভ্র, অভ্র! উঠবি নাকি পানি থেরাপি দিতে হবে?
-চোখ ডলতে ডলতে উঠলাম। কি হয়েছে?
-চল সমুদ্রে যাবো
-কোন দরকার নেই।
-চল না। না হলে আমি একা যাবো কিন্তু।
.
না গিয়ে উপায় নেই, পাগলিটা একা গিয়ে কি না কি করে বসে! সাথে যেতে হল, সে মহানন্দে নেমে গেছে, আমি হাটু পানিতে দাঁড়িয়ে আছি, আমার থেকে একটু দূরে সে বাচ্চাদের মত লাফালাফি শুরু করেছে, সামনে দিকে যেতে নিষেধ করে আমি পাড়ে চলে আসলাম, দেখলাম সে আরো সামনে এগিয়ে গেল কিছুটা। যদিও তার পাশে আরো কয়েকজন ছিল।বড় একটা ঢেউ আসতে শুরু করল, কিছু বুঝে উঠার আগেই শুধু একটা চিৎকার শুনলাম…
-অভ্র…
.
মিথিলাকে দেখতে পাচ্ছি না, বুকের বা পাশ টায় মোচড় দিয়ে উঠল, ঘাম ছুটতে শুরু করেছে, আমি এগিয়ে যেতে চাইলাম, সাথে সাথে কিছু রক্ষী বাহিনীর সদস্য আমাকে খপ করে ধরে বসল, ডুবুরী দল নেমে পড়ল, মিথুর পাশে আরো ৪-৫ জন টুরিস্ট ছিল, প্রায় আধা ঘন্টার মধ্যে সবাইকে উদ্ধার করা গেলেও মিথিলার কোনো খবর মিলল না। বুক ফেটে কান্না আসতে চাইছে, সৃষ্টি কর্তার কাছে প্রার্থনা করছি, তার কিছুক্ষন পর তাকেও উদ্ধার করে রিসোর্টের পাশে হসপিটালে ভর্তি করা হল!
.
সারাদিন ওর পাশে বসে থাকলাম, অবস্থা এখন কিছুটা ভালো। বাড়িতে কিছু জানালাম না, খামখা তারা চিন্তা করবে। সব থেকে বড় কথা মিথু সুস্থ। রাত হয়ে এসেছে, সারাদিন কিছু খায়নি সে।নার্স এসে খাবার দিয়ে গেল, জানি একা খেতে পারলেও খাবে না, ভয় পেয়েছে অনেক বেশি, তাই খাইয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম, খাবার মুখে নেওয়ার আগে জিজ্ঞাসা করল,
-তুই কিছু খেয়েছিস?
ক্ষুধার কথাই ভুলেই গেছি, এখন যদি ‘না’ বলি তাহলে হয়ত ও খাবে না তাই মিথ্যে বলতে বাধ্য হলাম,
-হ্যাঁ খেয়েছি…
খাইয়ে দেওয়া শেষ হলে, ওর ঔষধ গুলোও বের করে খাইয়ে দিলাম। বিশ্রাম দরকার তাই শুয়ে পরতে বললাম।
-অভ্র
-বল
-আমার পাশে একটু থাকবি, খুব ভয় করছে…
-তুই ঘুমো, আমি পাশে আছি।
চেয়ার টা আরেকটু পাশে টেনে নিয়ে বসলাম, ও আমার হাতটা ধরে ঘুমিয়ে পরল। যত দিন যাচ্ছে পাগলীটা তত আপন করে নিচ্ছে…
চলবে…
পর্র – ০৪
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1295025617366332&id=934291790106385