‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৪৭||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
হঠাৎই চোখ গেলো আমার জিয়ার দিকে ও খাদের অনেকটা ধারে রয়েছে। আমাদের বাকি বন্ধুরা সব এগিয়ে গেছে। ও কি করতে চাইছে? কোনো উল্টো পাল্টা কিছু না তো?
কথাটা মাথায় আসতেই আমি জিয়া বলে চিৎকার করে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। ও কোনো কর্ণপাত করলো না আমার কথার। ও খাদের দিকে আরো এগিয়ে গেলে আমি দ্রুত ওর কাছে যাই আর ওকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দি ফলে ও হুমড়ি খেয়ে পরে।। সাথে সাথে পিছন থেকে আমাকে কেউ সজোরে ধাক্কা মারে আর আমিও হুমড়ি খেয়ে পরে যায় সামনের দিকে। পিছনে তাকাতেই দেখি, আদিত্য নীচে পরে যায় মাটি ধসে।
মৌমিতা: আদিত্যওও!!
উপস্থিত সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো এক মুহূর্তের জন্য। হঠাৎ করেই কোয়েল এসে মৌমিতার পাশে এসে বসলে মৌমিতা হতভম্ব হয়ে কোয়েলের দিকে তাকায় একবার, আরেকবার পাহাড়ের খাদের দিকে তাকায়। রাজ দৌঁড়ে গিয়ে একটু ঝুঁকে আদিত্যের নাম ধরে চিৎকার করে।
রাজ: আদি, তুই ঠিক আছিস?
আদিত্য: কতক্ষন থাকবো বুঝতে পারছি না।
রাজ সাথে সাথে নিজের জ্যাকেটটা খুলে ফেলে আর শুয়ে পরে হাত বাড়িয়ে অনেকটা ঝুঁকে। কারণ আদিত্য বেশি নীচে যাওয়ার আগেই পাহাড়ের খাঁজ ধরে নিয়েছে এবং কিছুটা উঠে এসেছে। রাজকে অতটা নীচের দিকে ঝুঁকে যেতে দেখলে অঙ্কিত পিছন থেকে বলে,
অঙ্কিত: রাজ, অতটা ঝুঁকিস না। বিপদ হতে পারে।
ততক্ষণে রাজ আদিত্যের হাত ধরে ফেলেছে। রাজ বেশি জোর বা চাপ জায়গাটার উপর দেয় না কারণ এই জায়গাটাও ধসে যেতেই পারে। আদিত্য প্রায় অনেকটা উঠে এলে অঙ্কিত অপরদিকে গিয়ে হাত ধরে নেয় যাতে রাজের উপর চাপ না পরে। এরপর অঙ্কিত আর রাজ দুজন মিলেই আদিত্যকে টেনে উপরে তুলে নিয়ে আসে। এদিকে কোয়েল মৌমিতাকে শক্ত করে ধরে থাকলেও মৌমিতার চোখ আদিত্যের দিকে। আদিত্য উঠতেই রাজ আদিত্যকে জড়িয়ে ধরে।
রাজ: ঠিক আছিস তো?
আদিত্য: হ্যাঁ, ঠিক আছি আমি।
রাজ ছাড়তেই হুট করে জিয়া এসে আদিত্যকে জড়িয়ে ধরে।
জিয়া: তুমি ঠিক আছো আদি?
আদিত্য: ঠিক আর থাকতে দিচ্ছো কই?
জিয়া: (আদিত্যকে ছেড়ে) ম..মানে?
আদিত্য: এই যে, আমি সদ্য উপরে এলাম আর তুমি আমাকে আবার নীচে পাঠিয়ে ডাইরেক্ট উপরে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে যাচ্ছিলে, এতো জোরে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে।
জিয়া মাথা নীচু করে পিছিয়ে গেলে আদিত্য, অঙ্কিত আর রাজ চলে আসে। আদিত্য আসতেই স্যার ম্যাডামরা ওকে জিজ্ঞেস করে ও ঠিক আছে কি না। আদিত্য সবাইকে উত্তর দিচ্ছে ঠিকই কিন্তু ওর চোখ মৌমিতার দিকে কারণ মৌমিতা এখনও স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
স্যার: কি যে হচ্ছে এসব। একবার মৌমিতার সাথে তো একবার তোমার সাথে। (চিন্তিত সুরে)
আদিত্য: স্যার যা হওয়ার হয়ে গেছে, চিন্তা করবেন না। আপনারা এগোন আমি আসছি।
স্যার ম্যাডামরা সব স্টুডেন্টদের নিয়ে এগিয়ে গেলে আদিত্য মৌমিতার দিকে এগিয়ে এসে দাঁড়ায়। সে কিছু বলবে তাঁর আগেই মৌমিতা তাঁর বুকে ঝাঁপিয়ে পরে তাঁকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আদিত্য নিজেও হতবাক ঘটনাক্রমে। কোয়েল মিটিমিটি হাসতে থাকলে ওর চোখ রাজের দিকে যায়। রাজ ইশারায় কোয়েলকে ওখান থেকে সরে আসতে বললে কোয়েল চুপচাপ সরে আসে।
কোয়েল: ওই দেখো, জিয়া কীভাবে দেখছে দেখো ওদেরকে। কুনজর দিচ্ছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
রাজ: দেওয়াচ্ছি।
বলেই রাজ জিয়ার কাছে গিয়ে ওকে বলে,
রাজ: রাস্তা এদিকে নয় ওদিকে। যাওয়া যাক?
রাজের কথার উত্তর না দিয়ে জিয়া মাথা নীচু করে সামনে এগিয়ে যায়। কোয়েল এসে রাজের পাশে দাঁড়ালে, দুজনেই একবার আদিত্য, মৌমিতার দিকে তাকায়। এখনও একভাবেই রয়েছে ওরা, তাই সেটা দেখে হেসে এগিয়ে যায় সামনে। এগোতে এগোতে রাজ কোয়েলকে জিজ্ঞেস করে,
রাজ: তুমি আমাকে এভাবে কবে জড়িয়ে ধরবে?
কোয়েল: (ভ্রু কুঁচকে) কি জন্য তোমাকে জড়িয়ে ধরতে যাবো?
রাজ: জড়িয়ে ধরার কারণ লাগে নাকি? ভালোবেসে জড়িয়ে ধরবে। (হেসে)
কোয়েল: শখ দেখলে বাঁচি না। হুর! ভাগো এখান থেকে। (ভেংচি কেটে, বিরক্তি নিয়ে)
রাজ: আচ্ছা তাহলে আমি আদির মতো পাহাড় থেকে পরে গেলে জড়িয়ে ধরবে?
রাজের কথা শুনে কোয়েল দাঁড়িয়ে যায়। কারণ কোয়েল জানে রাজের দ্বারা সব সম্ভব। কিছুক্ষন চুপ থেকে ঠোঁট চেপে হেসে বললো,
কোয়েল: তোমাকে কষ্ট করতে হবে না, আমিই ধাক্কা মেরে দিচ্ছি আসো?
রাজ: না থাক, মরে গেলে যাও ভালোবাসা পাওয়ার আশা আছে সেটাও চলে যাবে। কপালে ভালোবাসার বড্ড অভাব আমার। হে ঠাকুর একটু ভালোবাসা লিখলে কি খুব ক্ষতি হতো? (উপরে দিকে তাকিয়ে দু হাত তুলে) চলো।
রাজ এগিয়ে গেলে কোয়েল মাথা নীচু করে নেয়। মজা করে বললেও রাজ যে অন্তরের মধ্যে জমে থাকা কষ্ট থেকেই কথাটা বলেছে তা কোয়েল বুঝতে পেরেছে। সত্যি ছেলেটা ভালোবাসার কাঙাল। কি হয় তাঁকে একটু ভালোবাসলে? হয়তো একটু ভালোবাসলেই সে খুশি হয়ে যাবে কারণ ভালোবাসার স্বাদ যে কোনোদিন পায়নি তাঁর কাছে একটু ভালোবাসাই অনেক। ভাবছে কোয়েল।
রাজ: কি হলো, চলো? (পিছন থেকে)
কোয়েল: হম, চলো।
৬৯.
আদিত্য: মৌ, আমি ঠিক আছি। রিল্যাক্স! দেখো আমার দিকে?
আমার চোখের সামনে শুধু আদিত্যের পরে যাওয়ার দৃশ্যটাই ভেসে উঠছে। মনের ভিতরে ভয়টা জানো জেঁকে বসেছে, কীভাবে কাটাবো এটা বুঝতে পারছি না।
আদিত্য: (মৌমিতাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে) আমি একদম ঠিক আছি, দেখো আমাকে। এতটা ভয় পাওয়ার কিচ্ছু হয়নি।
মৌমিতা: আচ্ছা? আপনি যদি সত্যি খাদে পরে যেতেন তাহলে? (ছলছল চোখে, কাঁপা কণ্ঠে)
আদিত্য: পরিনি তো? তাহলে কেন ভয় পাচ্ছো এত?
মৌমিতা: কে বলেছিল আপনাকে ওখানে আসতে? না আসলেই তো পারতেন।
আদিত্য: আচ্ছা? কে বলেছিলো তোমাকে জিয়াকে বাঁচাতে যেতে? আমি না আসলে তুমি পরে যেতে। আমি তাও কিছু একটা ধরে নিয়েছি, তুমি হলে পারতে?
মৌমিতা: জিয়া পরে যেতো আর আমি কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম নাকি?
আদিত্য: জিয়া পরতো না। ও তোমাকে ফেলে দেওয়ার জন্যেই কাজটা করেছে। জায়গাটায় জল ফেলে দিয়ে বেশি করে চাপ প্রয়োগ করে নরম করে রেখেছিলো জায়গাটা যাতে তুমি দৌঁড়ে এসে দাঁড়ালেই পরে যাও। আমি পিছন থেকে সবটা ফলো করেছি।
মৌমিতা: তাঁর মানে জিয়া ইচ্ছা করে…?
আদিত্য: তা নয় তো কি? চলো এখন। সাবধানে থাকতে হবে আমাদের।
মৌমিতা: দাঁড়ান। আপনার কোথাও লাগ…আপনার হাত থেকে তো রক্ত গড়াচ্ছে? (অবাক হয়ে)
আদিত্য: কোথায়…ওহ, আমি তো খেয়ালই করিনি।
আমার কথা শুনে আদিত্য নিজেও অবাক হয়ে নিজের ডান হাতের দিকে তাকায়। হয়তো কুনুইয়ের দিকটা কেটে গিয়ে রক্ত আঙুল বেয়ে পরছে। সেটা দেখে আমি ওনাকে বললাম,
মৌমিতা: জ্যাকেটটা খুলুন, জায়গাটা দেখি।
আদিত্য: আরে ঠিক আছে, গেস্ট হাউসে গিয়ে দেখে নেবো।
মৌমিতা: একদম বেশি কথা বলবেন না, চুপচাপ দেখান।
আদিত্যকে জোর করে জ্যাকেটটা খুলিয়ে দেখি হাতের কুনুইয়ের নীচে আমার মতই কিছুটা জায়গা জুড়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। অনেক রক্ত পরছে দেখে আমি আমার কাছে থাকা ছোট্ট স্কার্ফ টা নিয়ে প্রথমে রক্তটা আস্তে আস্তে একটু মুছিয়ে দিয়ে সাথে সাথে ওটা বেঁধে দিলাম ওনার ক্ষতস্থানে।
মৌমিতা: আর কোথায় লেগেছে?
আদিত্য: আর কটা স্কার্ফ এনেছো তুমি? (হেসে)
মৌমিতা: উফ, আপনি এখনও মজা করছেন?
আদিত্য: (হেসে) চলো, আর কোথাও লাগেনি আমার।
মৌমিতা: সত্যি তো?
এইবার আদিত্য বিরক্তি নিয়ে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে সামনে হাঁটা দিলো। জিয়া যে এরকম সাংঘাতিক হয়ে উঠবে ভাবিনি আমি। মানুষের ক্ষতি করা ঠিক আছে কিন্তু একবারে মেরে ফেলা? না জানি আর কি কি ভেবে রেখেছে ও।
গেস্ট হাউসে,
টাইগার হিল ভিসিট করে গেস্ট হাউসে ফিরে আসার পর সবাই মিলে ঠিক করলো রাতে বনফায়ার হবে। আমি সেসবে মাথা না ঘামিয়ে আগে আদিত্যকে ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে বললাম। আমিও ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে নিলাম আর ফাস্ট এইড বক্সটা নিয়ে আদিত্যের রুমে চলে এলাম। দেখলাম উনি বসে বসে বাঁ হাত দিয়ে ফোন ঘাটছেন। আমি ওনার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে বললাম,
মৌমিতা: ফোনটা রাখুন।
আদিত্য: (নিশ্চুপ)
মৌমিতা: কি হলো? ফোনটা রাখুন?
আদিত্য এইবারও আমার কথার কোনো উত্তর দিলেন না দেখে মাথা গরম হলো। আমি ওনার সামনে বসতেই উনি আমার দিকে তাকালেন। আমি রাগী দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকালে উনি আমার দিকে তাকিয়েই কান থেকে কিছু একটা খুললেন। আমি অবাক হয়ে গেলাম।
মৌমিতা: আপনার কানে এয়ারপডস ছিলো?
আদিত্য: (হেসে) হ্যাঁ। তাই জন্যেই টের পাইনি তুমি কখন এসেছো। আসলে এইটাই একমাত্র আমার বাঁচার উপায় যখন আমি জিয়ার সাথে থাকি।
মৌমিতা: মানে? (আশ্চর্য হয়ে)
আদিত্য: মানে, ওর ওই সারাক্ষণ আজেবাজে বকা দ্যান একটা টাইম অলওয়েজ তোমাকে ইনসাল্ট করা ওগুলো না শোনার জন্য এটা। ও বুঝতেও পারতো না কখন আমি কানে এয়ারপডস লাগিয়ে নিতাম ওর কথা বলা শুরু করার পর। ও তো নিজের মনে নিজে বকে যেতো। ওর বাবার কারণে তোমাকে কিছু বললে আমি না কিছু বলতে পারতাম আর না’ই কিছু করতে পারতাম তাই না শোনাটাই বেটার ছিল। কারণ না আমি শুনবো আর না আমার রাগ হবে। তাছাড়া এটার কালার টাও এমন যে বোঝা যায় না। সিম্পল!
মৌমিতা: (মনে মনে– সত্যি তো, এটা তো কোনোদিন ভালোভাবে লক্ষ্য করিনি আমি। তারমানে সেদিন যখন আদিত্যকে পাশে নিয়ে জিয়া আমাকে অপমান করেছিলো, সেদিন আদিত্য কিছু শোনেনইনি? (পর্ব ১৯) হে ভগবান! আমি এতো কানা কবে হলাম? আমার সাথেসাথে ওই কোয়েল আর অঙ্কিতটাও কানামদন। ধুর, ধুর! খালি খালি ভুল বুঝেছিলাম ওনাকে।)
আদিত্য: কোথায় হারিয়ে গেলে? (চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে)
মৌমিতা: না না কিছু না। দিন হাত দিন ব্যান্ডেজ করে দেই।
উনি আমার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলে আমি একটু শিউরে উঠলাম হাতটা দেখে। হাতের চামড়াটা পুরোই উঠে গিয়ে মাংস দেখা যায় যায়। ওনার হাতটা ব্যান্ডেজ করতে করতে বললাম,
মৌমিতা: কি দরকার ছিলো বলুন তো এমন করার? আমাকে ডাকলেই পারতেন। কতটা কেটে গেছে দেখুন তো, কষ্ট হচ্ছে নিশ্চই? (অসহায় ভাবে)
আদিত্য: তোমাকে বললে জানো তুমি দাঁড়িয়ে যেতে? তোমার মত মহান মানুষ আর আছে নাকি পৃথিবীতে?
মৌমিতা: হুহ!
আদিত্য: একদিকে ভালোই হয়েছে এটা হয়ে। (মুচকি হেসে)
মৌমিতা: কি? (অবাক হয়ে)
আদিত্য: হ্যাঁ, কিছুদিন আগে তুমি কষ্ট পাচ্ছিলে একা একা এখন আমিও তোমার দলে যোগ দিলাম। তোমাকে একা দেখতে ভালো লাগে নাকি আমার? তাই আর কি, কষ্টটা ভাগাভাগি করার চেষ্টা। (হেসে)
আমি ওনার কথা শুনে চোখ সরিয়ে নিলাম। কি আজব কথাবার্তা! ধুর, পুরোই মাথা খারাপ হয়ে গেছে এই ছেলেটার যা বুঝছি। তাড়াতাড়ি ব্যান্ডেজ করে বেরিয়ে এলাম আমি। বেরিয়ে আসার পর খুশিতে একটু নেচে উঠলাম। আমি ভাবিইনি এমন কোনোদিন আসবে যেদিন উনি আমাকে নিয়ে এতটা ভাববেন। হয়তো সময় এসে গেছে ওনাকে মেনে নেওয়ার।
[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে 🥀]
বি:দ্র: আসলে আজকে আমার রিচার্জ শেষ তাই আর বড় করলাম না। বড়ো করলে ধামাকাটা দিতে পারতাম। কোই নাহি, নেক্সট পার্টে ধামাকা আছে। আর নেক্সট পার্ট কিন্তু খুব ছোট হবে কারণ কালকে আমার এক্সাম আর কালকেই দেওয়ার চেষ্টা করবো আমি। গুড নাইট!💐
আইডি- কোয়েল ব্যানার্জী