‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘🌸❤️
||পর্ব~৫২||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
রাজ কোয়েলকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে ওর ঘাড়ে মুখ গুঁজে রয়েছে। যেহেতু অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে তাই কোয়েল আস্তে করে নিজের মাথাটা রাজের কাঁধ থেকে তুলে সামনে এসে আলতো করে রাজের গালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। তারপর কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে গিয়ে বলে,
কোয়েল: অনেকটা সময় হয়ে গেছে আমরা এদিকে এসেছি। চলো এবার।
রাজ কোয়েলের কথা শুনে কোয়েলকে ছেড়ে সোজা হয়ে কোয়েলের কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে বলে,
রাজ: এক মুহূর্তের জন্যেও একা কোথাও যাবে না। মনে থাকবে তো?
কোয়েল: আজ্ঞে। চলুন এবার।
রাজ আর কোয়েল হেসে সবাই যেখানে আছে সেদিকে হাঁটতে শুরু করলো। হাঁটতে হাঁটতেই কোয়েল হঠাৎ করে পিছন ফিরে তাঁকায়, কাওকে দেখতে পায় না শুধু পাতার “খচখচ” একটা শব্দ পায়।
কোয়েল: (মনে মনে– তার মানে আমাদের কেউ ফলো করছিলো। এটা সৌভিকদা ছাড়া আর কেই বা হবে?)
রাজ: কি ভাবছো?
কোয়েল: হম? নাহ কিছু না।
৭৮.
সূর্য অস্ত গিয়ে আকাশটা হুট করেই মেঘলা করেছে, বেশ সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। এমন সময় আমরা গেস্ট হাউসে ফিরে এসে বাগানে বসি। বাগানে এসে আড্ডা দিতে দিতেই অনেকে বলে ওঠে,
__আচ্ছা গান তো আমরা শুনেছি ট্রেনেই। এইবার একটু নাচ দেখলে কেমন হয়?
অঙ্কিত: হ্যাঁ, ভালোই হবে। আমাদের ভার্সিটির কম্পিটিশনের উইনার তো আমাদের সাথেই আছে।
মৌমিতা: এই রে, কোয়েল! এই অঙ্কিত আবার আমাকে ফাঁসাবে জানিস তো? আমি নাচ…এ কি? কোয়েল কোথায় গেলো? (বিড়বিড় করে)
আদিত্য: আরে অঙ্কিত! এটা তুই একদম ঠিক বলেছিস কিন্তু আরেক জনের কথা ভুলে যাচ্ছিস কেন?
অঙ্কিত: তুই কি..??
আদিত্য হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
আদিত্য: মৌ, কোয়েল কোথায়?
মৌমিতা: আমিও খুঁজে পাচ্ছি না। এখানেই তো ছিলো কিন্তু ওকে কেন…
আদিত্য: ওই তো, তবে রে দাঁড়া।
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই আদিত্য ঝট করে উঠে ছুট দিলেন ভিতরের দিকে। সেই দিকে আমরা সবাই তাকালে দেখি কোয়েল জোর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে ভিতরের দিকে। আদি যেহেতু দৌঁড়ে গেছে তাই কোয়েলকে ধরে ফেলতে পারবে কিন্তু সেই মুহূর্তে কোয়েল একবার পিছন ফিরে তাকালেই আদিকে দেখতে পেয়ে যায় আর দৌঁড় শুরু করে। আমরা সবাই অবাক হয়ে দেখছি কোয়েল আর আদি ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে।
কোয়েল: আমার পিছনে কেন পড়েছো? আমাকে ঘরে যেতে দাও প্লিজ? আমি ঘরে যাবো।
আদিত্য: আচ্ছা তাই নাকি? এতো সহজে তুই আমার হাত থেকে ছাড় দাবি ভাবলি কি করে?
কোয়েল: দ..দেখো আমার খুব টায়ার্ড লাগছে। আমাকে যেতে দাও।
ওরা ঘুরতে বাগানের এদিকেই চলে এসেছে। বাগানের মাঝে একটা সেন্টার টেবিলকে কেন্দ্র করে চারটে সোফা রাখছিলো। কোয়েল সেটার একপ্রান্তে এসে দাঁড়ালে আদি অপরপ্রান্তে এসে দাঁড়ায়। কোয়েলকে এতক্ষন ধরে একবার এদিক আর একবার ওদিক করছিলো।
আদিত্য: দেখ ছুটি, ভালোয় ভালোয় বলছি এদিকে যায় নাহলে একটামার বাইরে পড়বে না।
কোয়েল: না, না, না। প্লিজ যেতে দাও আমাকে।
আদিত্য: শুনবি না তুই আমার কথা তাই তো? ফাইন, যা।
আদি বেশ রেগে কথাটা বলেছে সেটা আমরা সবাই বুঝতে পারছি। কোয়েল আস্তে আস্তে পিছিয়ে গিয়ে দৌঁড় দিতে নিলেই আদি সঙ্গে সঙ্গে কোয়েলকে পিছন থেকে কোমর জড়িয়ে ধরে কোয়েলকে হালকা করে তুলে ধরে। কোয়েল সমানে ছুটোছুটি করতে করতে বলে,
কোয়েল: দাভাই প্লিজ! প্লিজ ছেড়ে দাও আমাকে আমি যাবো না ওখানে। তুমি এটা একদম ঠিক করছো না।
আদি কোয়েলের কোনো কথা না শুনেই কোয়েলকে আমাদের সবার মাঝে নিয়ে এসে দাঁড় করালো। আমি এখনও কিছুই বুঝতে পারছি না। একবার আদির দিকে তাকাচ্ছি তো একবার রাজদা আর অঙ্কিতের দিকে। ওরাও হাসছে আদি আর কোয়েলের কান্ড দেখে। কিন্তু কোয়েল চলে গেছিলো কেন আর ওকে ধরেই বা আনলো কেন? এক মিনিট! নাচের কথা উঠতেই কোয়েল পালিয়ে গেছিলো না? কিন্তু কেন?
আদিত্য: আমি ভাবিনি তুই কোয়েলের নাম নিতে ভুলে যাবো অঙ্কিত। কোয়েল তোর ডান্স পার্টনার আর তুই ওকেই ভুলে গেলি?
আমার মাথায় একটা বাছ পড়লো তৎক্ষণাৎ। কোয়েল অঙ্কিতের ডান্স পার্টনার? এটা আমাকে দুজনের কেউই বলেনি এতদিন? আমি রেগে কোয়েলের দিকে তাকাতেই কোয়েল কাঁচুমাচু মুখ করে আদির দিকে তাকিয়ে বললো,
কোয়েল: কেন আমাকে বাঁশ খাওয়ালে এভাবে? কি ক্ষতি করেছিলাম আমি তোমার? (কাঁদো কাঁদো গলায়)
আদিত্য: ওলে বাবা লে, এখনও তো কিছুই করিনি আমি।
কোয়েল কথাটা বলে আমার দিকে একবার তাকালো আরেকবার রাজদার দিকে তাকালো। সেই অনুযায়ী আমি রাজদার দিকে তাকালেদেখলাম রাজদাও কটমট করে কোয়েলের দিকে তাকিয়ে আছে। এতক্ষন তো হাসছিলো তার মানে রাজদাও জানতেন না আমার মতো এই বিষয়ে।
অঙ্কিত: আমার কি দোষ? কোয়েল পাখিই তো বারণ করেছিল আমাকে এই বিষয়ে কাওকে জানাতে নাহলে আমি আমার ওয়ান এন্ড অনলি পার্টনারের কথা কখনো ভুলতে পারি? (মুখ টিপে হেসে)
কোয়েল প্রথমে চোখ বড় বড় করে অঙ্কিতের দিকে তাকিয়ে তারপর কাঁদো কাঁদো মুখ করে বাচ্চাদের মতো করে বলে,
কোয়েল: কেন এমন করছো তোমরা আমার সাথে? কি ক্ষতি করেছি আমি সবার? এই বাচ্চা মেয়েটার উপর দয়া মায়া হয় না কাওর?
আদিত্য: চুপ! এই মৌ। ওঠো, ওঠো। আজকে তোমাদের ডুও দেখবো সবাই।
আদিত্য একহাতে কোয়েলের হাত ধরে আমাকে আরেকহাতে টেনে তুলে দাঁড় করালে আমি কোয়েলের দিকে একবার তাকিয়ে রাগ নিয়ে বলি,
মৌমিতা: আমার ওর সাথে কোনো নাচ তোলা নেই। জানবো ওর সম্পর্কে তারপর তো এইসব কথা আসবে। জানতামই তো না।
কোয়েল: হ..হ..হ্যাঁ তাই তো। তাই তো! আমি বরং ঘরে যাই, অনেকদিন হয়ে গেছে নাচ ছেড়ে দিয়েছি মনেও নেই কিছু।
কোয়েল চলে যেতে নিলে আদি আবার ওর হাত ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে আসে। অঙ্কিত পিছন থেকে আমাকে জিজ্ঞেস করে,
অঙ্কিত: মৌ তোর “তাল সে তাল মিলা” নাচটা প্র্যাকটিস আছে না?
মৌমিতা: হ্যাঁ, কেন?
অঙ্কিত: কোয়েলেরও ওটা খুব ভালো ভাবে প্র্যাকটিস করা আছে। কিছুদিন আগেই তো প্রোগ্রাম করলে, থাকবে নাই বা কেন?
আমি আরেকদফা অবাক হয়ে কোয়েলের দিকে তাকালে কোয়েল প্রায় কেঁদে দেয় এমন অবস্থা।
কোয়েল: (কপালে এক হাত দিয়ে চাপড় মেরে) হে বিষ্ণু! কাওর ভালো হবে না। সবাই মিলে আমাকে ফাঁসালো। (মনে মনে– কিছুক্ষণ আগেই জমরাজের রাগ ভাঙালাম এখন আবার বোম্ব হয়ে গেলো। এইবার মনে হয় আমি সামনে গেলেই ব্লাস্ট হয়ে যাবে আর রাগ ভাঙাবো কি?)
আদিত্য: চল, চল শুরু কর।
অঙ্কিত: আমি ব্লুটুথ স্পিকারটা নিয়ে আসছি।
অঙ্কিত দৌঁড়ে স্পিকার আনতে গেলে আমি যেখানে নাচবো সেখানে চলে যাই। গিয়ে দাঁড়াতেই দেখি কোয়েল হাত কচলাতে কচলাতে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। ও কিছু বলতে যাবে তাঁর আগেই আমি মুখ ঘুরিয়ে নেই আর অঙ্কিতও চলে আসে। কোয়েল সেটা দেখে নিজের পজিশন নিয়ে নেয়।
গানের প্রথমাংশ শুরু হয় নাচের তালের বোল দিয়ে। সেটা শুরু হতে মৌমিতা নিজের মতো আর কোয়েল নিজের মতো নিজেদের স্টেপ শুরু করলো। নিজের নাচের মধ্যেই মৌমিতা কোয়েলকে দেখছে কিন্তু কোয়েল দেখছে না।
🎶”দিল ইয়ে বেচ্যান ভে, রাস্তে পে নেইন ভে🎶
🎶দিল ইয়ে বেচ্যান ভে, রাস্তে পে নেইন ভে🎶
🎶জিন্দারি বেহাল হ্যা, সুর হ্যা না তাল হ্যা🎶
🎶আজা সাভারিয়া, আ আ আ আ🎶
🎶তাল সে তাল মিলা, ওও, তাল সে তাল মিলা”🎶
ওদের দুজনের স্টেপের কোনো অমিল নেই, ভুল হওয়া তো দূরের কথা। দুজনের টাইমিং একদম পারফেক্ট যার কারণে দুজনের স্টেপ, হাতের মুদ্রা, মুখের ভঙ্গিমা সব একরকম হচ্ছে। কিন্তু ওরা একসাথে কখনও প্র্যাকটিসই করেনি কারণ মৌমিতা তো জানতোই না কোয়েল নাচ করে। অবাক হয়ে সবাই এইটাই দেখছে এছাড়া মৌমিতা নাচের শুরুতেই যে জায়গাটা সব থেকে কঠিন ছিলো সেই জায়গাটায় কোয়েলকে ফলো করেছে বেশ ভালো ভাবেই। সেটা দেখার পর মৌমিতার বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি যে কোয়েল অনেকদিন ধরেই নাচ করে সুতরাং কোয়েল কিছুক্ষণ আগেও মিথ্যে কথা বলেছে যে সে, নাচ ছেড়ে দিয়েছে অনেকদিন হয়েছে। এরফলে মৌমিতার মাথাটা আরো গরম হয়ে গেছে। প্রথম দু-মিনিটই নাচের অংশ ছিলো। নাচ শেষ করতেই সবাই জোরে হাততালি দিতে শুরু করে। আদিত্য তো সিটি বাজাচ্ছে, সেটা দেখে মৌমিতা সামান্য হাসলেও পরক্ষণে কোয়েলের কথা মনে পড়তেই হাসিটা মলিন হয়ে গেল।
এমন সময় হাওয়ার বেগ তীব্র হয়ে গেলো। আদিত্য সবাইকে বললো,
আদিত্য: (হেসে) এদের নাচ দেখে স্বয়ং বরুনদেবও আপ্লুত হয়ে পড়েছে। চল, চল জলদি ভিতরে চল। এই ঠান্ডার মধ্যে ভিজলে হয়ে গেছে।
আমি কোয়েলের দিকে তাকাতেই দেখলাম ভয়ে ভয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। ও যেদিকে তাকিয়ে আছে সেদিকে তাকাতেই দেখলাম রাজদা চুপচাপ চোয়াল শক্ত করে হাত মুঠ করে বসে আছে। তা দেখে কোয়েলের দিকে তাকাতেই কোয়েলের সাথে চোখে চোখ পড়ে গেলো। আমি এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ভিতরে চলে এলাম। আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠছি সেইসময় খেয়াল করলাম রাজদা আমাকে পাশ কাটিয়ে উঠে গেলেন।
★
আদিত্য: কি রে, একা দাঁড়িয়ে আছিস যে? ভিতরে চল, বৃষ্টি আসবে তো?
আদিত্য কোয়েলের পিছনে দাঁড়িয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করলে কোয়েল মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নেয়। আদিত্য বুঝতে পারে কোয়েলের রাগ হয়েছে। তাই কোয়েলের দু-বাহু ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করে,
আদিত্য: রাগ হয়েছে?
কোয়েল অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে এখনও। আদিত্য গেসে কোয়েলের দু-গালে হাত রেখে বললো,
আদিত্য: কতটা রাগ হয়েছে শুনি? একটুখানি নাকি অনেএএকখানি? (হাত দিয়ে দেখিয়ে)
আদিত্যের প্রতিক্রিয়া দেখে কোয়েল হেসে ফেললে আদিত্যও হেসে নিজে থেকেই কোয়েলকে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে। কোয়েল আদিত্যের বুকের মাঝে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে উঠলে আদিত্য কোয়েলকে সোজা করে চোখ মুছিয়ে ইশারায় কাঁদতে বারণ করে আবারও বুকে টেনে নেয়। আদিত্যের বুকে মাথা রাখতেই কোয়েলকে চোখ যায় মৌমিতার দিকে।
আমি রাজদাকে ওরকমভাবে উপরে উঠে যেতে দেখে আবার বাগানের দিকে ফিরে যাই কারণ আদিও এখনও আসেনি। সিঁড়ি থেকে নেমে বাইরে বেরিয়ে একটু এগিয়ে যেতে দেখলাম আদি কোয়েলকে বুকের মাঝে জড়িয়ে রেখেছে। আমি দেখতেই কোয়েল আদির থেকে দূরে সরে গেলে আদি অবাক হয়ে কোয়েলের দিকে তাকায়। কোয়েলের চাহুনি অনুসরণ করে আমার দিকে তাকালেই আমি ওখান থেকে পিছন ফিরে সোজা ঘরে চলে আসি।
[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে🥀]
আইডি- কোয়েল ব্যানার্জী