‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৬||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
১৩.
‘কেমন আছিস এখন?’
‘উফ আদিত্যদা কতবার এই এক কথা জিজ্ঞেস করবে বলো তো? আসার পর থেকে একই কথা বারবার জিজ্ঞেস করছো। বললাম তো ঠিক আছি।’
‘সেই, ওইজন্যেই তো আমি আজকে না আসলে তুই ঘরে মাথা ফাটিয়ে পরে থাকতিস আর কেউ টেরও পেতো না।’
কোয়েল চুপ করে গেলো আদিত্যের কথা শুনে। কিছুক্ষণ আগে আদিত্য হোস্টেলের ম্যাডামের সাথে কথা বলে পারমিশন নিয়ে, কোয়েলের রুমে ঢুকতে না ঢুকতেই দেখে কোয়েল একহাতে নিজের মাথা আরেক হাতে পড়ার ডেস্ক ধরে কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে। সেই দেখে আদিত্য কোয়েলের দিকে এগোতে না এগোতেই কোয়েল নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। আদিত্য এগিয়ে আসায় সে কোয়েলকে ধরে নিয়ে বেডে শুয়ে দেয়। ডক্টরকে ফোন করে আস্তে বলে, ডক্টর ওষুধ দিয়ে চলে যাওয়ার কিছুক্ষন পর কোয়েলের জ্ঞান ফেরে। আর সেই থেকেই আদিত্য কোয়েলকে জিজ্ঞেস করে চলেছে সে ঠিক আছে কি না। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর আদিত্য জিজ্ঞেস করলো,
‘এই জন্য বলি নিজের খেয়াল রাখ। একটাবার আমাকে ফোন করতে পারিসনি তুই? এতো শরীর খারাপ তোর আর আমাকে একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না।’
‘কেন করো আমার জন্য এতো চিন্তা? করো না। আমি তো বলিনি করতে। আমাকে আমার অবস্থায় ছেড়ে দাও প্লিজ!’
কোয়েল মুখ ঘুরিয়ে নিলে আদিত্য কোয়েলের হাত দুটো নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বললো,
‘কেন এরকম অবুঝের মতো কাজ করছিস বল তো? এভাবে একা একা থাকলে কি জীবন চলবে?’
‘দৌঁড়াবে। আমি নিজের জীবনে কাওকে চাই না। কাউকে না। বুঝেছো? তাই এভাবে আমার খেয়াল রাখা বন্ধ করো তুমি, সবাই ভুল ভাবে আমাদের নিয়ে।’
‘ভাবতে দে। যার যা ভাবার ভাবুক আমার বা তোর তাতে কোনো যায় আসবে না। বুঝলি?’
কোয়েল কিছু বলতে যাবে তার আগেই আদিত্য কে বিড়বিড় করতে শুনলো,
‘তোর খেয়াল না রাখলে আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে।’
‘কি? কি বললে?’
‘ক..কিছু না। আমি আসছি, তুই নিজের খেয়াল রাখবি ওকেই?’
কথা শেষ করেই আদিত্য পিছন ফিরে চলে যেতে নিলে কোয়েল বলে ওঠে,
‘তাকে বলে দিও এসব করে কোনো লাভ নেই।’
‘এই যাহ, ঠিক শুনে ফেলেছে। কেন যে তুই বিড়বিড় করিস আদি? খালি ধরা পড়ে যাস।’
আদিত্য মনে মনে কথাটা বলে জোরে একটা নিশ্বাস নিয়ে কোয়েলের দিকে ফিরে বললো,
‘তোর প্রাণের মায়া না থাকলেও আমার প্রাণের মায়া আছে।’
আদিত্য একনাগাড়ে কথা শেষ করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলে কোয়েল সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সামান্য হাসলো। তারপর আস্তে আস্তে শুয়ে পড়লো।
‘তুমি? তুমি কখন এসেছো?’
ভার্সিটি থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছিলাম কোয়েলের খেয়াল রাখবো বলে। কিন্তু এসেই দেখি আদিত্য ওর কাছে বসে কথা বলছে তাই আর সাহস পাইনি ভিতরে যাওয়ার। ভেবেছিলেন ওনার বেড়ানোর আগে সরে যাবো কিন্তু উনি যে এমন হুট করে বেরিয়ে আসবেন সেটা ভাবিনি।
‘কি হলো টা কি? এভাবে এখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন?’
‘ন..না আসলে, আপনারা কথা বলছিলেন তাই আর ভিতরে যাইনি।’
মাথা নিচু করে কথাটা বলার পর ওনার যখন কোনো উত্তর পেলাম না তখন ওনার মুখের দিকে তাকাতেই দেখি উনি চোখ ছোটো ছোটো করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি আবার চোখ নামিয়ে নিতেই উনি বললেন,
‘আসো আমার সাথে। কোয়েল সবে শুয়েছে, তোমাকে দেখলে আবার এখন উঠে বসবে। ওর রেস্ট নেওয়াটা দরকার।’
উনি কথা শেষ করে হাঁটা ধরলে আমিও কথা না বাড়িয়ে ওনার পিছন পিছন যাই। বাইরে বেরিয়ে এসে ওনার বাইকের সামনে আসতেই উনি বলেন,
‘বসো।’
আমি অবাক চোখে ওনার দিকে তাকিয়ে আছি। মনে মনে ভাবছি, বসবো মানে? উনি আমাকে ওনার বাইকে বসতে বলছেন? মাথা আমার খারাপ হয়েছে নাকি ওনার?
‘এরকম হা করে তাকিয়ে থাকার কিছুই হয়নি। আমার বাংলো থেকে তোমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসতে যাবো। আর কিছুই না।’
‘আমাদের জন্য খাবার আনতে যাবেন কেন?’
‘বাইকে বসো, যেতে যেতে বলছি।’
মন তো কিছুতেই চাইছিলো না ওনার বাইকে বসতে। কাচুমাচু মুখ করে ওনার দিকে তাকাতেই উনি আবার চোখ ছোটো করেন আর আমি একপ্রকার বাধ্য হয়ে বসে পরি। উনি বাইকে স্টার্ট দিতে দিতে বললেন,
‘ধরে বসো। পরে গেলে আমার খাটনি বাড়বে। একদিকে কোয়েল আরেক দিকে তুমি।’
ওনার কথা শুনে অনেক কষ্টে কাঁপা হাতে ওনার কাঁধে হাত রাখলাম। কেন জানো একটা দ্বিধাবোধ কাজ করছিল, হয়তো বিয়ের প্রথম রাতে ওরকম ব্যবহারের জন্য। আমার এসব ভাবনার মাঝেই উনি বললেন,
‘আমি হোস্টেলের ম্যাডামের সাথে কথা বলেই কোয়েলের সাথে দেখা করতে গেছিলাম। তখনই ওনাকে বলি যতদিন কোয়েলের জ্বর থাকবে ততদিন আমি খাওয়ার পাঠাবো। আর একাজে আমাকে তুমিই হেল্প করতে পারবে।’
‘আমি?’
‘হ্যাঁ তুমি। কোয়েল যদি জানতে পারে আমি খাবার পাঠাচ্ছি তাহলে তুলকালাম করবে তাই তুমি বলবে এটা হোস্টেলেরই খাওয়ার, তুমি ম্যাডামকে রিকুয়েস্ট করে বানাতে বলেছো।’
‘নাহ, আমি এটা বলবো না।’
‘দেখো, প্লিজ তুমি আমার কথাটা রাখো। আমার উপর যদি তোমার রাগ থাকে তাহলে সেটা কোয়েলের উপর প্লিজ বাড় ক..
‘আমি বলবো ম্যাডামকে বলে আমি ওর জন্য এই খাওয়ারগুলো বানিয়েছি। তাহলে ওর কোনো সন্দেহই থাকবে না।’
‘সিরিয়াসলি?’
আদিত্য এতো উত্তেজিত হয়ে পড়েন যে অনেক জোরে ব্রেক কষেন আর আমি টাল সামলাতে না পেরে ওনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি যার ফলে ওনার শরীরের সাথে আমার শরীরের কোনো বিভেদ থাকে না। উনিও পিছন দিকে মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন আর আমিও ওনাকে শক্ত করে ধরে ওনার দিকে তাকিয়ে আছি। ঘোর কাটলো একজন বয়স্ক লোকের গলার স্বরে যিনি ওনার নাম নিয়ে ওনাকে ডাকছেন।
‘আদি বাবা, ও আদি বাবা? কোয়েল পাখির খাওয়ার তৈরী হয়ে গেছে।’
আদিত্যের কথা জানি না, আমি সঙ্গে সঙ্গে লোকটার কথা শুনে বাইক থেকে নেমে পড়ি। নেমে ওনার দিকে তাকাতেই দেখি উনি এখনো আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন, সেই দেখে আবার চোখ ঘুরিয়ে নিলাম আমি লোকটার দিকে। একের পর এক লজ্জা পেয়েই চলেছি আমি। লোকটা আদিত্যকে আবার ডাকলো আর আমিও ওনার দিকে তাকালাম,
‘আদি বাবা?’
‘তুমি খাবারটা নিয়ে এসো।’
এই কথাটাও উনি আমার দিকে তাকিয়েই বললেন। কি হয়েছে ওনার? এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকার মানে টা কি?
‘থ্যাংক ইউ সো মাচ।’
‘ক..কি জন্য?’
‘তোমার এই ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন নেওয়ার জন্য।’
‘মানে?’
আমার অবাক হয়ে যাওয়া দেখে উনি সামান্য হেসে বললেন,
‘তুমি যদি এই ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন না নিতে তাহলে কোয়েল তোমাকে পেতো না সঙ্গী হিসেবে। আর তোমাকে সঙ্গী হিসেবে না পেলে ও ভালো থাকতো না। আমি যদি জানতাম না, তোমাকে পেলেই কোয়েল ভালো থাকবে তাহলে কবেই তোমাকে কোয়েলের কাছে এনে দিতাম।’
ওনার কথাগুলো শুনে কেমন জানি বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। না চাইতেও বলে ফেললাম,
‘এতো ভাবেন ওকে নিয়ে? খুব ভালোবাসেন তাই না?’
কথাটা বলার পর খেয়াল এলো কি বলে ফেলেছি। উনি কাকে ভালোবাসেন না বাসেন এটা নিয়ে আমার কি দরকার? তাই কথা সামাল দেওয়ার জন্য কিছু বলবো তার আগেই উনি বললেন,
‘আমার থেকেও বেশি অন্য কেউ ভাবে। সবসময় আমরা যা দেখি তা সত্যি হয় না।’
‘কি বলতে চাইছেন আপ..??
আমি কথা শেষ করার আগেই বয়স্ক লোকটা খাবার নিয়ে এসে হাজির হলেন আর আমি চুপ করে গেলাম। আদিত্য ওনাকে বললেন,
‘মৌমিতাকে খাবারটা দিয়ে দাও হারু কাকা।’
‘মৌমিতা? মৌমিতা নাম তো আমাদের বউমার তাই না আদিত্য বাবা? উনি, উনি আমাদের বউমা?’
আমার ভিতরটা ভয়ে শুকিয়ে গেলো এই ভেবে যে উনি যদি ফুলশয্যার রাতের মতন রিয়াকট করেন এখন? তাহলে কি হবে? আমি এখন কি কর..
‘হ্যাঁ। ও তোমাদের বউমা। দাও, ওকে খাবারটা দিয়ে দাও এখন ওর ফিরতে দেরী হয়ে যাচ্ছে।’
আমি কেমন রিয়াকট করবো সেটাই ভেবে পাচ্ছি না। কেমন জানো ভাবলেশহীন হয়ে পড়েছি। হারু কাকা বললেন,
‘বউমা প্রথমবার এলো এখানে, ভিতরে যাবে না?’
‘পরেরবার নিয়ে আসবো তখন বরণ করে ঘরে তুলো। এখন তাড়াতাড়ি করো দেরী হয়ে যাচ্ছে।’
‘আচ্ছা, এই নাও বউমা।’
আমি খাওয়ারের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ওনার পা ছুঁয়ে নমস্কার করতেই উনি বাঁধা দিয়ে বললেন,
‘খুব খুব খুশি থাকো, সুখে সংসার করো এই আশীর্বাদ করি।’
আমি আদিত্যের দিকে তাকাতেই উনি স্মিত হাসলো আমার দিকে আমিও হারু কাকাকে হেসে বিদায় জানিয়ে ওনার বাইকে এসে বসলাম। মাথাটা কেমন জানো ঝিম ঝিম করছে। কিছুক্ষন আগে ওনার ব্যবহার জানো আমি মেনেই নিতে পারছি না। সব কিছু কেমন জানো ওলট পালট লাগছে আমার।
‘মম-ড্যাড হারু কাকাকে তোমার সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছিলো তাই আর মিথ্যে বলতে চাইনি কোনো।’
আমি কোনো উত্তর দিলাম না। মনের মধ্যে একটা ভালো লাগা কাজ করছে। উনি আমাকে হস্টেলে নামিয়ে দিয়ে বললেন,
‘সাবধানে থাকবে আর কোয়েলেরও খেয়াল রাখবে।’
‘আব, আপনিও সাবধানে যাবেন।’
উনি আমার দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে বললেন,
‘তুমি যাও। আসছি আমি।’
আমি চলে এলাম ঘরে আর প্ল্যানিং মতো কোয়েলকে বললাম যে খাবারটা আমি বানিয়েছি। ও প্রথমে মানতে না চাইলেও পরে ম্যাডামের সাথে কথা বলার পর মেনে গেছে। ভাগ্যিস ম্যাডামের সাথে কথা বলে ঘরে গেছিলাম। খাওয়া-দাওয়া সেরে কোয়েলকে শুয়ে আমিও শুয়ে পড়লাম। চোখ বন্ধ করতে আজকের ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো আর ওনার কথাগুলো কানে বাজতে লাগলো। না চাইতেও ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠলো আমার।
অন্যদিকে,
‘অফ ও! আমি পড়ায় ফোকাস কেন করতে পারছি না? শিট ইয়ার।’
আদিত্য মুখ দু-হাত দিয়ে ঢেকে বসতেই কিছুক্ষন আগে ঘটনা মনে পড়ে গেলো। মনে পড়ে গেলো মৌমিতার জড়িয়ে ধরার কথা। আদিত্য কখনোই কোনো মেয়ের এতো কাছে কখনও যায়নি। জিয়া আসতে চাইলেও তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে বিরক্ত হয়ে। কিন্তু মৌমিতা কে দূরে সরাতে মন চায়নি বরং ভালোই লাগছিলো। কথাটা ভেবেই আদিত্য উঠে নিজের কাবার্ডের কাছে গিয়ে আজকের পড়া শার্টটা বের করলো। শার্টটা নাকের কাছে আনতেই একটা লেডিস পারফিউম পেলো।
‘উমম, নাইস স্মেল।’
আদিত্য নিজেই নিজের কথায় ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসলো আর মাথায় চাটি মেরে বললো,
‘পড়ায় ফোকাস কর আদি! কি সব ভাবছিস তুই।’
[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে 🥀]
আইডি- কোয়েল ব্যানার্জী