একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️ ||পর্ব~৬৫||

0
2608

‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৬৫||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

৯৮.
__আমাকে নিজের ঘরে নিয়ে এলেন যে? ড্রয়িং রুমে বসে কথা বলতে ভয় লাগছিলো নাকি?

আশীষবাবু: আমি কখনো কাওর থেকে ভয় পাইনি রাজ। এখনও পাইনা।

রাজ: আপনার মেয়েকে হারানোর ভয় ও পাননা বলতে চাইছেন?

রাজের প্রশ্ন শুনে আশীষবাবু মাথা নামিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হাসলেন। হেসে রাজের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলেন,

আশীষবাবু: তোমার মনে হয় কোয়েল আমাকে বাবা হিসেবে মানে? ও’কে আমি অনেকদিন আগেই হারিয়ে ফেলেছি। আমার কাছে এখন হারানোর মত কিছুই নেই।

রাজ: নিজের দোষে আপনি ও’কে হারিয়ে ফেলেছেন মিস্টার ব্যানার্জী। যাই হোক, আমাকে কেন ডেকেছেন এখানে? কি প্রয়োজন আমায় আপনার?

আশীষবাবু: প্রয়োজন আমাকে তোমার নাকি তোমার আমাকে? তুমি জানো না কোয়েলের বিয়ে ঠিক করেছি আমি?

রাজ: হ্যাঁ তো? বিয়ে ঠিক করেছেন, দিয়ে তো দেননি। আর যে আমার সম্পদ তাঁকে আপনি এতো সহজে অন্যকাওর হাতে তুলে দিতে পারবেন ভাবলেন কি করে? আমি তো আপনাকে সেই অধিকার দিইনি। এছাড়া আপনি খুব ভালো ভাবে জানেন এখন আমার ক্ষমতা সম্পর্কে। আমি আর আগের মতো দুর্বল নেই। বলুন, কি জন্যে ডেকেছেন কাজের সূত্রে নাকি এসব বলতে?

আশীষবাবু: আমি খুব ভালোভাবেই জানি তুমি কে। তোমাকে কাজের সূত্রে আমি ডাকিনি এখানে। ডেকেছি এটা জানতে…তুমি, তুমি কেন হুট করে আমার মেয়েকে ছেড়ে গেছিলে? ভবিষ্যতে যে তুমি আবারও ওভাবে আমার মেয়েকে ছেড়ে যাবেনা তাঁর কি নিশ্চয়তা আছে?

মুহূর্তেই রাজের মুখমন্ডলে গম্ভীরতা এসে ভর করলো। নিজের চলে যাওয়ার কারণটা চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠলো। চোয়াল শক্ত করে বললো,

রাজ: আপনার জন্যে! শুধুমাত্র আপনার জন্যে আমি সবটা ছেড়ে চলে গেছিলাম মিস্টার ব্যানার্জী। আপনি আমাকে বাধ্য করেছিলেন কোয়েলের লাইফ থেকে সরে যেতে। সেই সময় থেকেই আপনি ওর জন্যে বড়লোক ছেলে খুঁজছিলেন তাই আমি সেই খবর পেয়ে আপনার কাছে ওর হাত চাইলে আপনি আমাকে অপমান করেছিলেন। বলেছিলেন ও’কে খুশি রাখার, ভালো রাখার মুরোদ নাকি আমার নেই। যদি আমি নিজেকে ওর জীবন থেকে না সরিয়েনি তাহলে আপনি ও’কে নিয়ে চলে যাবেন অনেক দূরে। এতটা দূরে যে আমি ওর নাগাল পাবো না, চোখের দেখাটাও দেখতে পাবো না। আপনি বলেছিলেন কোয়েলকে অর্জন করতে হলে আমাকে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। সাফল্য অর্জন করতে হবে কিন্তু বিনা কাওর সাহায্যে, এই ব্যাপারে কাওকে কিছু না জানিয়ে। শুধুমাত্র এইজন্যই আমি আদিকেও কিচ্ছু জানাতে পারিনি মিস্টার ব্যানার্জী! ওদের দুজনকেই কষ্ট দিয়েছি আর নিজেও কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু এর আমি এমনটা হতে দেবো না। কোয়েল আমার ছিলো, আমার আছে আর আমারই থাকবে।

রাজ চুপ করে গেলো কথাগুলো বলে। কিছুক্ষণ নীরব থেকে একটু দম নিয়ে বললো,

রাজ: আমি পেরেছি আমার কথা রাখতে। আমি সেদিন ওখানে দাঁড়িয়ে বলে গেছিলাম আমি নিজেকে গড়ে তুলবো। নিজের ভাগ্য নিজে তৈরী করবো কর্মের দ্বারা। এখন আপনি যেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমিও ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে মিস্টার ব্যানার্জী। অনেক চেষ্টা করেছিলেন আপনি আমাকে দমানোর। আমি যেই যেই জায়গায় কাজ করা শুরু করেছিলাম, সব জায়গায় দিয়ে আপনি আমাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষে হয়নি। ভগবানের দূতের মতো একজন এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলো। আমার যোগ্যতা অনুযায়ী নিজের কোম্পানিতে কাজ দিয়েছিলো। আমার মনে হয়েছিলো আমি পারবো না।কিন্তু উনি আমার মনে সাহস জুগিয়ে বলেছিলেন যে আমি পড়াশোনাও করবো আর এই কাজও। বয়স কম তো কি হয়েছে ঠিক শিখে যাবো, শিখতে হবে কারণ আমাকে তো সাফল্যের সাথে সাথে নিজের ভালোবাসাকেও অর্জন করতে হবে। উনি এসবের পাশাপাশি আমাকে দিয়ে বিজনেসের কোর্স করানো শুরু করেছিল। আজ তাঁরই কোম্পানির সব দায়িত্ব আমার কারণটা জানেন? আমি, আমি দিনরাত নিজের পরিশ্রম দিয়ে কোম্পানিটাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছি এই চার বছরে যাতে আপনার সাথে কম্পিট করতে পারি। সেটাও পেরেছি আমি! আপনার মেয়েকে খাওয়াতে পড়াতে তো যেকোনো বড়লোকের ছেলে পারবে কিন্তু ভালোবাসা দিয়ে রাজরানী করে রাখতে শুধুমাত্র এই রাজই পারবে।

রাজের শেষ কথাটা শুনে আশীষবাবু বেশ অনেকটা প্রশস্ত করলেন নিজের ঠোঁটজোড়া। রাজ যেটা দেখে কিছুটা অবাক হলো কিন্তু এর চাইতেও বেশি অবাক হলো যখন আশীষবাবু বললেন,

আশীষবাবু: হ্যাঁ রাজ! তুমি যা বলেছো একদম ঠিকই বলেছো। তুমি যাওয়ার পরে আমিই তোমার খোঁজ রেখেছিলাম যাতে তুমি যেখানে যেখানে কাজের জন্য যাবে সেখান থেকে জানো তোমাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। প্রত্যেকেই আমার কথা শুনেছিল তাঁর কারণ ওরা অনেক বড়ো অংকের টাকা পেয়েছিলো এই কাজের জন্য। আসলে, আমি চাইনি কোয়েলকে তোমার হাতে তুলে দিতে কখনও। তাই এসব….

আশীষবাবু কথা শেষ করার পূর্বেই অনেক জোরে কাঁচ ভাঙার আওয়াজ পেলেন। রাজও সেই শব্দটা পেতেই উঠে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে তাকায়। এরপর রাজ ঘাবড়ে গেলেও আশীষবাবু নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলেন,

আশীষবাবু: ভিতরে আসতে পারো কোয়েল মা।

রাজ আশীষবাবুর কথা শুনে আশীষবাবুর দিকে তাকিয়ে ভয়ভীত চোখ নিয়ে কোয়েলের দিকে তাকায়। নিজের মনে মনে কিছু একটা ভেবে আশীষবাবুর দিকে আবারও তাঁকায়। মনে মনে বলে ওঠে,

রাজ: এটা আপনি ঠিক করলেন না মিস্টার ব্যানার্জী। সব ঠিক হতে যাচ্ছিল যখন তাহলে কেন আবার সবটা শেষ করে দিলেন?

এদিকে, কোয়েল স্থির ভাবে তাকিয়ে আছে ওদের দুজনার দিকে। সে নিজের ক্লাসের একটা বই বাড়িতে ফেলে যাওয়ায় ফিরে এসেছিল। যখন ঘরে যাচ্ছিলো তখন মিতা দেবী বলেন যাতে আশীষবাবুর ঘরে চা, আর একটা জুসের গ্লাস পৌঁছে দিতে। জুসের গ্লাসটা আশীষবাবুর অতিথির জন্য। ট্রে হাতে নিয়ে কোয়েল ঘরে ঢুকবে তাঁর আগেই সে রাজের কন্ঠস্বর শুনতে পায় আর দাঁড়িয়ে যায়। দরজাটাও খোলা ছিলো যাতে রাজের শরীরের পিছন দিকটা বসা অবস্থায় কোয়েল দেখতে পাচ্ছিলো। কোয়েল দাঁড়িয়ে যায় সেই মুহূর্তেই রাজের কথাগুলো শুনে।

রাজ: কুহু, আমার কথাটা শোনো…

কোয়েল নিজের হাত উঠিয়ে রাজকে থামার নির্দেশ দেয়। তারপর আস্তে আস্তে পিছিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। রাজ কোয়েলের পিছনে যেতে নিলে আশীষবাবু রাজের কাঁধে হাত রেখে আটকান আর বলেন,

আশীষবাবু: ও’কে একা ছেড়ে দাও। আমার মেয়ে নিজেকে একা সামলাতে জানে।

রাজ: আপনি ও’কে একা কীভাবে রাখতে হয় সেটা জানেন দেখেই ও নিজেকে একা সামলাতে জেনেছে। কিন্তু আমি ও’কে আর একা থাকতে দিতে চাই না।

রাজও বেরিয়ে যায় বাড়ির থেকে কিন্তু কোয়েলকে কোথাও খুঁজে পায় না। আদিত্যকে কল করলেও সে বলে কোয়েল নেই ভার্সিটিতে। রাজ হতাশ হয়ে ফিরে যায় নিজের বাড়ি কারণ কোয়েল এখনও ওকে ব্লক করে রেখেছে সব জায়গা থেকে।

দুদিন পর,
ঘটনাটার দুদিন কেটে গেছে কিন্তু এখনও আদিত্য বা মৌ আশীষবাবু আর রাজের মধ্যে কি কথা হয়েছে এবং কোয়েল কি শুনেছে সে সম্পর্কে কিছু জানেনা। আর না জানে রাজ কোথায় আছে। সেদিন যে রাজ কোয়েলের খবর নিয়েছিলো সেটাই শেষ, এই দুদিনে রাজের খোঁজ পায়নি আদিত্য। কিন্তু সেটার রাজের থেকে, অন্যের মাধ্যমে সে ঠিক রাজের খোঁজ বার করেছে। কারণ রাজকে জানাতে হবে, কোয়েল মুম্বাই চলে যাচ্ছে। জানার মধ্যে এটুকুই জানে শুধু আদিত্য আর মৌ। তাই তাঁরা রওনা দিয়েছে রাজের আস্তানার উদ্দেশ্যে।

মৌমিতা: যেই ঠিকানাটা পেয়েছো সেটা ঠিক তো আদি?

আদিত্য: ঠিক হতে বাধ্য ঠিকানাটা। যার থেকে পেয়েছি সে রাজের ঠিকানা না জানলে আর কেউ জানতে পারবে…

আদি কথা বলতে বলতে থেমে গেলো কারণ ঠিকানা অনুযায়ী ওদের সামনে রয়েছে একটা বিল্ডিং কমপ্লেক্স। বিল্ডিং কমপ্লেক্স তাই বড়ো তো হবেই সাথে সুন্দরও। আদির মতো আমিও বেশ হতবাক হয়ে বসে আছি। রাজদা এখানে থাকে? এতবড়ো আর সুন্দর একটা বিল্ডিং কমপ্লেক্সে?

মৌমিতা: আমরা ভুল করছি না তো?

আদিত্য: সেটা তো ভিতরে গেলেই জানা যাবে। লেটস গো।

আদি আর আমি কমপ্লেক্সে ঢুকে গাড়ি গ্যারেজে পার্ক করে লিফটে উঠে গেলাম। ঠিকানা অনুযায়ী সিকস্থ ফ্লোরে আসতেই একটা দরজার নেম প্লেটে দেখলাম রাজদার নাম। আদি গিয়ে ডোরবেল বাজাতেই একজন দরজা খুললো।

__কাকে চাইছেন?

আদিত্য: আমি রাজের বেস্ট ফ্রেন্ড হই, আদিত্য ব্যানার্জী। ওর সাথেই দেখা করতে এসেছি।

__আব, আচ্ছা ভিতরে আসুন।

আদি আর আমি স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেলে ভিতরে প্রবেশ করলাম। ভিতরে প্রবেশ করতেই ডাইনিং রুমে কাকাইকে রাজদার সাথে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। আমাদের মতো ওরাও আমাদের দেখে অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

রাজ: উফ শ্বশুরমশাই! আপনি সবসময় আমাকে এভাবে ফাঁসিয়ে দেন কেন বলুন তো? (কানের কাছে আস্তে করে)

আশীষবাবু রাজের কথা শুনে রাজের দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে যান। যা দেখে রাজ বেকুবের মতো সেদিকেই তাকিয়ে থাকে। রাজ মনে মনে এখন ভাবছে আদিত্যকে কি বলবে।

আদিত্য: এটা তোর নিজস্ব ফ্ল্যাট?

রাজ: নাহ তো! আমি ভাড়া থাকি। (মজা করে)

আমি রাজদার কথা শুনে হেসে দিলে আদি আমার দিকে রাগী চোখে তাঁকায় যা দেখে আমি চুপ করে যাই।

আদিত্য: কাকাই কেন এসেছিলো এখানে?

রাজদা আদির কথা শুনে সোফায় আরাম করে বসে বলে,

রাজ: ঘোড়ার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে বস। আর তোর কাকাইকেন এখানে এসেছিল সেটা তোর কাকাইকেই জিজ্ঞেস করিস। আমার মতো গরীবের বাড়িতে ওনার পায়ের ধূলো পড়েছে ঠিক কি কারণে সেটা উনিই বলতে পারবে। যাই হোক কি খাবি বল? ধুর তোকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই, বৌদি কি খাবে বলো?

আদিত্য: (রাজের পাশে বসে) রাজ তুই এতটা রিল্যাক্স হয়ে কীভাবে বসে আছিস? তুই জানিস কোয়েল মুম্বাই চলে গেছে?

রাজ: হ্যাঁ তো তুই আমাকে বাসি খবর দিতে এসেছিস? গেছে তো ভালো করেছে, একটু হাওয়া খেয়ে আসুক। এতে হাওয়া বদলও হবে আর খাওয়াও হবে। সামু কাকা! দুটো স্ট্রং কফি আর একটা কোল্ড ড্রিংক নিয়ে এসো।

এইবার তো আমিও অবাক হয়ে যাচ্ছি আদির সাথে সাথে। রাজদার ব্যবহার দেখে আমি আর আদি একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলে রাজদা নিজের ফোন নিয়ে বসেন। আমি আর আদি সেই ফাঁকে একবার চারিপাশটা চোখ বুলিয়েনি। বেশ সুন্দর করে সাজানো চারিদিকটা। ইতিমধ্যে কফি আর কোল্ডড্রিংক এসে গেলে রাজদা কফি মগ হাতে নিয়ে ফোনের দিকে তাকিয়েই বলে,

রাজ: বাড়ি ফিরে লাগেজ প্যাক করে ফেল। আজ সন্ধ্যের ফ্লাইট মুম্বাই যাওয়ার।

রাজদার কথা শুনে আমি আর আদি খুশি হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসলে রাজদাও আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসে। কিন্তু রাজদার মুখটা বেশ শুকনো লাগছে। তাঁর মুখে হাসিটা দেখে বেশ ভালোই লাগছে এখন। আগে তো কোয়েলের কাছে পৌঁছাই তাহলেই সবটা জানা যাবে।

[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে🥀]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here