#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___১৫
‘ স্লা/ট বুঝিস তুই? বুঝিস?বুঝবি না কেন?তুই নিজেই তো এই কাতারের। কয়বার গিয়েছিলি বয়ফ্রেন্ডের সাথে রুমডেটে?চার বার হবে না?’
রাগে থরথর করে কাঁপছে সাফারাতের কন্ঠনালি। চোয়াল শক্ত। চোখ দুটো রক্তাক্ত লাল। ফর্সা মুখ ছেয়ে আছে রক্তিম আভা। জেরিন গালে হাত দিয়ে কেঁদে যাচ্ছে ফুঁপিয়ে। রেস্টুরেন্টের সবাই ফ্যালফ্যাল নয়নে চেয়ে আছে যেন কোনো সার্কাস চলছে। ফ্রি তে লুফে নিচ্ছে মজা, আনন্দ। পাশে দাঁড়িয়ে আছে জেরিনের বয়ফ্রেন্ড। চিকন রোগা ছেলেটা সুঠাম, বলিষ্ঠ সাফারাতের ক্রোধ দেখে ভয়ে সেঁটে আছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। পালিয়ে যাবারও জো নেই।
চৈত্রিকা কে অপমান করে বয়ফ্রেন্ডের সাথে রেষ্টুরেন্টে দেখা করতে আসে জেরিন। ড্রাইভার চৈত্রিকাদের মিহিতার বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে সাফারাত কে কল দেয়। জেরিনের করা সমস্ত কর্মকাণ্ড খুলে বলে সাফারাত কে। সব শুনে নিঃশব্দে কল কেটে দেয় সাফারাত। দিহান কে কল করে জানায় জেরিন ঢাকা শহরের যে প্রান্তেই থাকুক তাকে যেন লোকেশন সেন্ড করা হয়। সাফারাতের ঠান্ডা স্বর হজম করতে পারে নি দিহান। উৎকন্ঠা হয়ে অনেকবার জিজ্ঞেস করেও সাফারাতের কাছ থেকে কিছুই জানতে পারে নি। ব্যর্থ হয়ে জেরিনের নাম্বার ট্র্যাক করে লোকেশন পাঠিয়ে দেয় সাফারাতকে। সাফারাত ততক্ষণে বনানী পৌঁছে গেছে। রেষ্টুরেন্টে ঢুকেই টেনে চেয়ার থেকে তুলে জেরিন কে। মেয়েটা কিছু বুঝে উঠার আগেই সাফারাতের বলিষ্ঠ হাতের থাবা পড়ে যায় গালে। ব্যাথায় কুঁকড়ে যায় জেরিন। মুখের আদল বদলে যায় সম্পূর্ণরূপে। গালে লাল আস্তরণ। সেই বিষাক্ত যন্ত্রণায় এখনো টনটনিয়ে উঠছে গালটা।তীব্র রাগ হচ্ছে তার। কিন্তু তা সাফারাতের রাগের কাছে একদম ফিকে। নিতান্তই নগন্য।
সাফারাত চেয়ার টেনে বসল। টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি উঠিয়ে খেয়ে নিল গটগট করে। মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে রাগ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টায় লেগে গেল। কিছু সেকেন্ড অতিবাহিত হতেই বুঝতে পারে এই রাগ কমার নয়। তীব্র এই রোষানল যে বক্ষস্থলের যন্ত্রণার সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িত। হ্যাঁ! তার যন্ত্রণা হচ্ছে। প্রবল যন্ত্রণায় ছটফট করছে প্রশস্ত বুকখানি। ঠেলে চেয়ার টা সরিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। রাগে লাথি দিয়ে ফেলে দিল তা। রেস্টুরেন্টের মালিক ভয়ে কিছুই বলতে পারছেন না। তাছাড়া প্রথমবার যখন আটকাতে এসেছে সাফারাত সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে–‘ আপনাদের রেষ্টুরেন্টের রেপুটেশন নষ্ট হবে না। যতটা লস হবে তার চেয়ে দ্বিগুণ পেমেন্ট করে যাবো আমি। কিন্তু বাঁধা দেওয়া পছন্দ করব না একদম।’
সাফারাত ক্ষীণ এগিয়ে এলো। জেরিনের সামনে দাঁড়াল। হিসহিসিয়ে বলে উঠল,
‘ কি ভেবেছিস বাহিরে রঙ লিলায় মেতে থাকবি আর রাতের গভীরে আমার বউ সেজে আমাকে বিনোদন দিবি?’
জেরিনের মাথা নত হয়ে গেল। ঝা ঝা করে উঠল কান দুটো। সে ভাবতেই পারে নি সাফারাত কখনও এতো জঘন্য কথা বলে বসবে। নত মস্তক দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল সাফারাত। ক্রুদ্ধ গলায় পুনর্বার বললো,
‘ তোরা মা মেয়ে মিলে ভেবেছিলি আমায় বিয়ে করে আমার টাকায় আরাম আয়েশ করবি। বাহিরে বয়ফ্রেন্ড পুষবি আবার সবাইকে দেখিয়ে বেড়াবি তোর সুদর্শন হাসবেন্ড আছে। এটাই তো?’
চকিতে মাথা তুলে তাকাল জেরিন। অত্যাধিক ভয় এসে হানা দিল আঁখিদ্বয়ে। সাফারাত কি করে জানল এসব?এসব তো নিজেদের বাড়ি ব্যতীত অন্য কোথাও আলোচনা করে নি সে ও তার মা। জেরিনের মা মৌসুমি বেগম জেরিনকে বুঝিয়েছে সাফারাত কে বশে আনতে যেন সাফারাতের সমস্ত সম্পদের মালিক হতে পারে। তাছাড়া সাফারাতের সুঠাম দেহ, লুক সবকিছুর প্রতি প্রবল আকর্ষণ জেরিনের। এমন সুদর্শন একটা স্বামী কে-ই বা না চায়!জেরিনও চায়। কিন্তু শত চেষ্টা করেও অক্ষম সে সাফারাতকে ভাগে আনতে। আর আজ তো সকল চেষ্টায় শেগুড়ে বালি। কিন্তু একটা বিষয় কোনোমতেই মস্তিষ্কে ঢুকছে না সাফারাত এসব জানল কি করে!জেরিন সাফারাতের অধর কার্নিশে দুর্বোধ্য হাসি দেখতে পেল। এই মুহুর্তে সাফারাত কে ভয়ংকর এক মানব মনে হচ্ছে তার। দুর্দান্ত এক ছেলে। যে কি-না কিশোর বয়সে অনেক কিছুই সহ্য করে আজ অব্ধি এসেছে। সাফারাত হিম শীতল কন্ঠে আস্তে করে বলে উঠল,
‘ স্লা/ট চৈত্র না। স্লা*ট তো তুই। চৈত্র পবিত্র। ওর গায়ে কলংক ঢেলে দেওয়ার চেষ্টা করলে তোর দেহের খন্ডাংশ খোঁজে পেতে অনেক বেগ পোহাতে হবে তোর পরিবারের। আমি একদমই ভালো না। সামলে থাকিস।’
জেরিন ফাঁকা ঢোক গিলল। যেই মেয়েকে প্রথম দিন সবার সামনে চিনে না বলে প্রত্যাখ্যান করে তার জন্য এতো টান সাফারাতের! তার উপর চৈত্রিকা বললো ওরা দু’জন ফ্রেন্ড। সামথিং ইজ ফিশি। জেরিনের কাছে অন্যরকম ঠেকছে সবকিছু। ছোট নয় যে কিছু বুঝবে না। কয়েক দিন আগেই অনার্সের পার্ট চুকিয়েছে সে। বয়েসে সাফারাতের দুয়েক ছোট। সামান্য একটা মেয়ের জন্য মেরে ফেলার হুমকি!জেরিনের চোখ থেকে ঘৃণায় জল গড়াচ্ছে। সাফারাতের হুমকিতে দমে গেলেও চৈত্রিকা কে ধ্বংস করে দেবার ইচ্ছে নিঃশেষ হয় নি। সাফারাত রোষপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আঙ্গুল উঁচিয়ে বললো,
‘ তোর মতো হাজারটা সুন্দর রূপে কলঙ্কিনী মরে গেলেও আমার কিছু যায় আসবে না। কিন্তু চৈত্র!চৈত্র তোর দ্বারা আ*ঘাত পেলে খুন করতে দ্বিধাবোধ করব না। লাস্ট ওয়ার্নিং। ‘
‘ ওই মেয়ের জন্য তোমার এতো টান কেন?’
জেরিনের গলা কাঁপছে। তবুও চৈত্রিকার প্রতি রাগ চেপে রাখতে পারল না। সাফারাত চলে যেতে নিয়েও ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো।
‘ মাইন্ড ইয়োর ওন বিজনেস। ‘ _____________________
মিহিতা পড়নের কাপড় পাল্টে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো। জানালার ধারে মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে বুক টা আর্তনাদ করে উঠল তার। মেয়েটা বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কাছের মানুষের সান্নিধ্য হারিয়ে গুমরে গুমরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে প্রতি মুহুর্তে। হয়ত সময়ও গুণে কবে মুক্ত হবে সকল দায়বদ্ধতা, সকল কষ্ট হতে। অস্ফুটস্বরে ডাকল মিহিতা,
‘ চৈত্র! ‘
চৈত্রিকা ফিরে তাকালো না। দৃষ্টি দূরের অন্ধকারে নিবদ্ধ। ভেজা কন্ঠে বললো,
‘ বল।’
‘ তুই কি কাঁদছিস চৈত্র? এমন শোনাচ্ছে কেন কন্ঠস্বর?’
চৈত্রিকা নিজেকে ধাতস্থ করে নিল। মুখে শুকনো হাসি ফুটিয়ে বললো,
‘ কাঁদছি না। বাসায় যাবো।’
চৈত্রিকা যে মিথ্যে বলছে তা স্পষ্ট। পা বাড়িয়ে কাছে যেতে নিবে বিছানার উপর পড়ে থাকা ছোট্ট ফোন টা বেজে উঠল সশব্দে। চৈত্রিকা ঝটপট ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। মিহিতা কপালে ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে আছে স্ক্রিনে। চৈত্রিকা দ্রুত গতিতে হেঁটে আসল।
‘ মা কল দিয়েছে বোধহয়। যেতে হবে। অলরেডি অনেক লেট হয়ে গিয়েছে মিহি।’
‘ আন্টির কল না চৈত্র। স্যারের কল। ‘
কর্ণকুহরে মিহিতার স্বর হুড়মুড় করে প্রবেশ করতেই চৈত্রিকার হৃদস্পন্দন যেন থমকে গেল। মিহিতার দিকে না তাকিয়েই মোবাইলটা হাতে তুলে নেয়। স্ক্রিণে সাফারাতের নাম জ্বলজ্বল করছে। রিসিভ করে কানে দিতেই শুনতে পেল চেনা পরিচিত সেই গম্ভীর স্বর। চোখের পলকে থমকে যাওয়া স্পন্দন স্পন্দিত হতে লাগল দ্বিগুণ হারে।
‘ নিচে আসুন। ‘
‘ আমি মিহিতাদের বাসায়।’
‘ ওদের বাসার নিচেই দাঁড়িয়ে আছি আমি। জলদি আসুন।’
এক প্রকার আদেশ দিয়েই কলটা কেটে দিল সাফারাত। চৈত্রিকাকে একটা শব্দ উচ্চারণের সুযোগ টুকুও দেয় নি। মিহিতা প্রশ্নসূচক দৃষ্টি মেলে ধরতেই চৈত্রিকা ব্যাগ টা হাতে তুলে নিল। পা বাড়াতে বাড়াতে তাড়াহুড়োয় বললো,
‘ নিচে সাফারাত অপেক্ষা করছেন। আমার যেতে হবে মিহি।’
‘ তুই স্যারের ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারিস না। তাই না চৈত্র? ‘
চৈত্রিকা থামল। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। নিজের দুর্বলতা স্বীকার করে বলে,
‘ একদমই থাকতে পারি না। আসি এখন।’
‘ তুই কি জানিস তুই পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলেছিস স্যার কে?তোর এই কান্নার কারণ ওই মেয়ের অপমান নয় বরং স্যার কে আবারো হারিয়ে ফেলার ভয়ে কাঁদছিস তুই। ‘
মিহিতার শেষের কথাগুলো শুনল না চৈত্র। সে তো বেরিয়ে গেছে, ছুটে গেছে সাফারাত নামক মানুষটার ভালোবাসার টানে।
_____________
গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাফারাত। চৈত্রিকা তড়িৎ বেগে ছুটে এসে উপস্থিত হলো তার সামনে। জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে। চোখ দুটো ফুলেফেঁপে একাকার। কান্নার ফলে এমন অবস্থা হয়েছে তা বুঝতে বাকি নেই। চেহারায় বিধস্ত ভাব। সাফারাতের বক্ষস্থলে কিছু একটা বিঁধছে প্রখরভাবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছু টা দূরত্বে অবস্থিত চৈত্রিকার দু-হাত আঁকড়ে ধরে শক্ত করে। কিছু বুঝে উঠার আগেই টেনে নিয়ে এলো একদম কাছে,অতি নিকটে। মাঝে কোনো দূরত্ব নেই। কিঞ্চিৎ ফাঁক নেই। চৈত্রিকা হকচকিয়ে উঠল। ঘাবড়ে গেল। সাফারাতের বাহুতে আবদ্ধ তার নরম দেহখানি।
আকস্মিকতায় শিরশির করছে সমস্ত শরীর। দূরে থাকলে যন্ত্রণা, কাছে থাকলে ভিতরের এলোমেলো অনুভূতি ভীষণ পীড়া দেয় তাকে। তবুও দূরত্বের যন্ত্রণার চেয়ে সাফারাতের উষ্ণতায় যেন অঢেল শান্তি খুঁজে পায় চৈত্রিকা। ছাব্বিশ বছরের চৈত্রিকা তখন আবেগে ভেসে যায়। খুব বেশি করে চায় সাফারাত কে। মিশে যাওয়ার বাসনা,স্পৃহা জাগে শক্তপোক্ত প্রশস্ত এই বুকে। সাফারাত পিঠে আলতো করে হাত রেখে মলিন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ কাঁদলেন কেন আপনি চৈত্র? আমি এই ক’দিনে যতটুকু জানলাম আপনি খুব স্ট্রং। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আপনি বাচ্চা। বাচ্চাদের মতো কাঁদেন খারাপ মানুষদের খারাপ কটুক্তিতে।’
কথাটা যেন চৈত্রিকার আত্মসম্মানে বিঁধল। কটাক্ষ করে বললো,
‘ আমি তো কারো কটুক্তি তে কান্না করি নি। কারো কটুক্তিতে কাঁদার মতো মন মানসিকতা এখন আর নেই। সহ্য করতে করতে এসব সয়ে গেছে। আমি তো আপনার,
টনক নড়ে উঠল চৈত্রিকার। আবেগে,ক্ষোভের তাড়নায় কি বলতে যাচ্ছিল সে?সাফারাত কি বলবে তাকে?আর এভাবে বেহায়ার মতো কেন পড়ে আছে সে সাফারাতের বুকে?তখন টানে তাল সামলাতে না পেরে বুকে আছড়ে পড়েছে। সাথে সাথে সরে আসা তো যেত!চৈত্রিকা সরে আসার চেষ্টা করল। কিন্তু সাফারাত বাঁধন শক্ত করে ফেলে। দৃষ্টি তার অনিমেষ, অটল। সামান্য ঝুঁকে কপালে কপাল ঠেকিয়ে অসম্পূর্ণ বাক্য টা সম্পূর্ণ করে দেয়,
‘ আপনি আমার বিয়ের কথা শুনে কাঁদছিলেন তাই তো?আর আপনি যে অন্য কারো বাগদত্তা হয়ে গেলেন?’
#চলবে,,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)