#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___৭
হাত সরিয়ে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে পিছনে ঘুরে তাকালো চৈত্রিকা। কি আশ্চর্য!পিছনে কেউ নেই। কয়েকটা ছেলে পাশে এসে দাঁড়াল। মনটা কু-ডাকছে তার। যা বুঝার বুঝে গেল। চক্ষু জোড়া থেকে কার্ণিশ ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা জল। তা হাতের পিঠে মুছে নিল চৈত্রিকা। অধর যুগল চেপে চেষ্টা করল মনের ব্যাথা টুকু সহ্য করে নেবার। ওড়না টা ঠিকমতো টেনে পিঠ,ঘাড়,চুল ঢেকে নিল। কাপুরুষ গুলো এতো মানুষের মাঝেও সুযোগ পেয়ে নিজের থাবা বসিয়ে দিল নারী দেহের উপর। চৈত্রিকার ভিতর টা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে ছেলেগুলো কে কষিয়ে থাপ্পড় লাগাতে। হিতে বিপরীত হতে পারে ভেবে নিজেকে গুটিয়ে নিল সে। ওষুধ গুলো নিয়ে একপাশে সরে এলো। রাস্তা পেরিয়ে ডান পাশে এসে খেয়াল করল ছেলেগুলো পিছন পিছন চলে এসেছে। বিপদের আঁচ করতে পেরে তৎক্ষনাৎ পা দুটো থামিয়ে দিল। সামনের দিকটায় মানুষের আনাগোনা কম। চৈত্রিকা আর এক পাও না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিল। দাঁড়িয়ে রইল ঠাঁই। ছেলেগুলোও দাড়িয়ে আছে কিছুদূরে। আঁড়চোখে বার বার নোংরা দৃষ্টি ফেলছে চৈত্রিকার দেহে। তা চক্ষে বিধঁতেই পুরো শরীর ঠান্ডা হতে শুরু করল চৈত্রিকার।
সাদা ড্রেস পড়ে গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়েকে দেখে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো দিহান। মুখশ্রীতে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। চোখ জোড়ায় ফুটে আছে অসহায়ত্ব। মেয়েটাকে চিনতে সময় নিল না দিহান। উঁচানো স্বরে বলে উঠল,
‘ সাফারাত ওই দেখ চৈত্রিকা।’
সাথে সাথেই গাড়ি থেমে গেল। দিহান কিছু বুঝে উঠার আগেই সাফারাত দরজা মেলে বেরিয়ে পড়েছে।
নিজের নরম হাতের ভাঁজে শক্ত একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করল চৈত্রিকা। ধরাস করে কেঁপে উঠল হৃদপিণ্ড। পাশ ফিরে তাকাতেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া থেমে গেল ক্ষীণ সময়ের জন্য। সাফারাত দাঁড়িয়ে আছে অতি কাছে। খুবই ঘনিষ্ঠে। তার বলিষ্ঠ হাতের ভাঁজে চৈত্রিকার কোমল হাত বন্দী। ল্যামপোস্টের জ্বলন্ত ছটা হালকা ভাবে বিচরণ করছে সাফারাতের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি যুক্ত ফর্সা চেহারায়। চৈত্রিকার গলা শুকিয়ে আসছে। অকস্মাৎ সাফারাতের ঘনিষ্ঠ স্পর্শে কেঁপে কেঁপে উঠছে দেহের সর্বাঙ্গ। হাত টা ছুটিয়ে আনার চেষ্টা করল। বহুতর চেষ্টা। কিন্তু পেরে উঠছে না সাফারাতের শক্তির সাথে। হাতের বাঁধন আরো দৃঢ় করল সাফারাত। প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকাল চৈত্রিকার মুখের দিকে।
চৈত্রিকা হকচকালো,থমকালো। কিছু সেকেন্ড অপলক,অনিমেষ চেয়ে রইল প্রগাঢ় সেই চাহনিতে। একটা সময় নিজেকে আবিষ্কার করল সাফারাতের অতীব কাছে। যতটুকু ছিল দূরত্ব, তা ঘুচিয়ে নিয়েছে সাফারাত। চৈত্রিকা কে নিজের কাছে আঁকড়ে ধরে তীক্ষ্ণ নজর ফেলল দূরে দাঁড়ানো ছেলেগুলোর দিক। ছেলেগুলা ভড়কে গেল নিমেষে। কিন্তু নড়ল না। সাফারাত চৈত্রিকার হাত টা টেনে গাড়ির কাছে নিয়ে এলো। এতো সময় পর হিতাহিত জ্ঞান ফিরে পেল চৈত্রিকা। প্রতিবাদী কন্ঠে বললো,
‘ কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?’
‘ আপনি যেখানে যেতে চান।’
‘ আমি আপনার সাথে কোথাও যেতে চাই না।’
‘ আপনি আমাকে ছাড়া এখান থেকে এক পাও নাড়াতে পারবেন না চৈত্র। ‘
চৈত্রিকা টলমল আঁখিজোড়া সাফারাতের দিকে নিক্ষেপ করল। এতগুলো বছর পর প্রিয় মানুষটার মুখ থেকে এই ডাকটা শুনতে পেয়ে এক প্রকান্ড ঝড় বয়তে শুরু করল হৃদয়পটে। বড্ড আবেগি হয়ে পড়ছে মন। মেয়েরা বোধ হয় এমনি। একটা মানুষ যতই আঘাত করুক তবুও তার একটু মধুর ডাকই যেন সেই আঘাত ভুলে মনটা গলতে শুরু করে মোমের ন্যায়। চৈত্রিকা জানে সাফারাত তাকে চেনে,তবে সেদিন অস্বীকার করার কারণ টা তার অজানা। চৈত্রিকা কথা বাড়াল না। উল্টো ঘুরে হাঁটা ধরল। সঙ্গে সঙ্গে হাত ধরে নিজের কাছে টেনে আনল সাফারাত। চৈত্রিকা কিছু বলার আগেই টেনে এনে গাড়ির পেছনের দরজা মেলে বসিয়ে দিল তাকে।
নিজে পাশে বসে দিহানের উদ্দেশ্যে গম্ভীর স্বরে বললো,
‘ তুই ড্রাইভ কর দিহান।’
দিহান অসহায় চোখে তাকালো। কেমন করে এক মুহুর্তে তাকে ড্রাইভার বানিয়ে দিচ্ছে সাফারাত। নেমে ড্রাইভিং সিটে বসে চৈত্রিকার দিকে চেয়ে বললো,
‘ কোথায় যাবো?’
চৈত্রিকা করুন দৃষ্টি নিবদ্ধ করল দিহানের পানে। কন্ঠে তেজ এঁটে বললো,
‘ সামনের হসপিটালে।’
‘ হসপিটালে কেন?’
দিহান এমন ভান করল যেন চৈত্রিকা না বুঝে। নিষ্প্রাণ স্বরে প্রতুত্তর করে চৈত্রিকা,
‘ বাবার এক্সিডেন্ট হয়েছে।’
‘ ওহ। এখন ঠিক আছেন আংকেল? ‘
‘ কিছুটা।’
দিহান আর কথা বাড়ালো না। চৈত্রিকা সাফারাত থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বসল। কিন্তু সাফারাত হাত ছাড়ছে না কোনো ক্রমেই। গাড়িতে উঠেও হাত টা আঁকড়ে ধরে রেখেছে। হুট করে চৈত্রিকা অনুভব করল ভীষণ ঠান্ডা লাগছে তার। দ্রিমদ্রিম শব্দ হচ্ছে বক্ষস্থল জুড়ে। আচমকা সাফারাতের অন্য একটা রূপ মানতে কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। ছোট্ট করে নিচু স্বরে বললো,
‘ হাত টা ছাড়ুন।’
সাফারাত ছাড়ল না বরং কাছে এগিয়ে এলো। ক্ষীণ আওয়াজে বললো,
‘ দুঃখিত আমি চৈত্র মাস। ভীষণ দুঃখিত। সেদিনের ব্যবহার টা একদমই ইচ্ছাকৃত ছিল না। ‘
চৈত্রিকার নয়নজোড়া বিস্ফোরিত হয়ে উঠল। সাফারাতের সহজ স্বীকারোক্তি তার অন্তরে বিঁধছে প্রখরভাবে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে অভিমান নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,
‘ আর এতগুলো বছর? সেদিন না বলে চলে যাওয়া?’
সাফারাত তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে মায়াময় দৃষ্টি স্থির করল চৈত্রিকার দিকে। তার একটা হাত ঠেকল চৈত্রিকার নরম গালে। মেয়েটার রক্তিম আভায় সিক্ত মুখশ্রী তে পূর্ণ দৃষ্টি বুলালো সে। বললো,
‘ মাঝে মাঝে জীবনের সমীকরণ গুলো মেলানো বেশ জটিল হয়ে যায় চৈত্র। আপনজন যখন শত্রু হয়ে দাঁড়ায় বেঁচে থাকা টা মুশকিল হয়ে পড়ে। আপনাকে কখনও মিস করি নি আমি। একদমই মিস করি নি জটিল এই জীবনে। কারণ আপনি সবসময় আমার মনে বাস করতেন এবং করবেন।’
চৈত্রিকা কাঁদল না। তবে আবেগি হয়ে পড়ল ক্ষণিকের জন্য। নরম স্বরে বলে উঠল,
‘ আমি আপনাকে খুঁজেছি সাফারাত। অনেক খুঁজেছি। ‘
সাফারাতের হৃদপিন্ডে শীতল স্রোত বয়ে গেল। স্থির দৃষ্টি ফেলে মাথার পিছনে হাত গলিয়ে বুকে চৈত্রিকার মাথা টা চেপে ধরল। নিমিষেই চৈত্রিকার শিরা উপশিরায় কাঁপুনি ধরে গেল। তীব্র থেকে তীব্র সুখ অনুভূত হলো। সুখের নেশায় কাতর চৈত্রিকা চক্ষু মুদে শুনল সাফারাতের হৃদস্পন্দন। সাফারাত কতটা নিঃসংকোচ ভাবে আগলে নিল তাকে। কিসের টানে এতোটা কাছাকাছি? চৈত্রিকা সরে এলো। আড়ষ্ট হয়ে পড়ল লজ্জায়। কর্ণে এলো সাফারাতের নির্বিকার কন্ঠ,
‘ আমরা তুমি থেকে আপনি হয়ে গেলাম চৈত্র।’
চৈত্রিকা সময় নিল না। প্রতিউত্তরে বলতে চাইল,
‘ আপনি টা-ই এখন ভীষণ প্রিয় মনে হচ্ছে। ‘
কিন্তু অভিমান চেপে রেখে মনের কথাটা ব্যক্ত করল না। সাফারাত সেদিন যেই কারণেই তাকে অস্বীকার করুক না কেন তবুও মেনে নিতে পারছে না সে। মানতে পারছে না সেই কলেজ জীবনে না জানিয়ে সাফারাতের হুট করে গায়েব হয়ে যাওয়া।
দিহান লুকিং গ্লাসে সবটা দেখল। স্মিত হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটে। পিছনে বসে থাকা মানুষ দু’টো আদৌ বুজছে কি-না সে জানেনা,তবে সে উপলব্ধি করে ফেলেছে দু’টো মনের অব্যক্ত প্রেম,অনুরাগ,অনুভূতি।
____________
হসপিটালের সামনে গাড়ি থামতেই চৈত্রিকা নেমে পড়ল। দিহান কে ধন্যবাদ জানিয়ে সোজা হাঁটতে শুরু করে। উদ্দেশ্য সাফারাত কে উপেক্ষা করে চলে যাওয়া। শোধ নিবে সে। সেদিনের ফিরিয়ে দেবার শোধ। কিন্তু পারল কই!মুহুর্তেই কর্ণগোচর হলো সাফারাতের ভরাট,গাম্ভীর্যের স্বর।
‘ দাঁড়ান চৈত্র। উপেক্ষা করার সাহস করলেন কিভাবে?’
পা দুটো আপনাআপনি থমকে গেল। ঘাড় কাত করে চাইল চৈত্রিকা। সাফারাত দ্রুত গতিতে এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়াল। রাগ সংযত করে বললো,
‘ চলুন’
‘ আপনি কোথায় যাবেন?’
চমকিত কন্ঠে প্রশ্ন করল চৈত্রিকা। এতেই যেন বেশ বিরক্ত হলো সাফারাত। চেহারায় রুষ্ট ভাব। কাঠ কাঠ গলায় বললো,
‘ আপনার বাবা কে দেখতে। ‘
‘কিন্তু?’
‘কি?কিশোরী থাকতে তো পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করালেন না। আজও কি করাবেন না?ঠিক আছে মানবতার খাতিরে নাহয় আপনার বাবা কে এক পলক দেখব।’
চৈত্রিকা চুপ মেরে হাঁটতে লাগল। পাশে হাঁটছে সাফারাত পায়ে পা মিলিয়ে। কেমন ঠেস মেরে বাক্যগুলো উচ্চারিত করল সাফারাত। কয়েক বছর আগে বাবার প্রতি ভয়টা একটু বেশিই ছিল চৈত্রিকার। ভয়ে কোনোদিন নিজের বাড়ির সীমানায়ও সহ্য করতে পারত না সাফারাত কে।
লিফটে উঠার সময় চৈত্রিকা কে আগে উঠতে জায়গা করে দিল সাফারাত। আকস্মিক তার নজর গিয়ে পড়ল পাতলা সাদা ওড়না ভেদ করে ফর্সা কাঁধে। নিমেষে সাফারাতের অক্ষি যুগল জ্বালা করে উঠল ভীষণ। লিফটে উঠে পিছন থেকে চৈত্রিকার ওড়না টা সরিয়ে দিল একপাশে। চৈত্রিকা হতভম্ব, হতবাক। পুরো লিফটে ওরা দু’জন। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো সাফারাতের দিকে। চোয়াল শক্ত সাফারাতের। নেত্রদ্বয় টকটকে লাল। চৈত্রিকা আমতা আমতা করে বললো,
‘ কি করছেন?’
‘ আপনার কাঁধে নখের আঁচড় কেন চৈত্র?’
‘ কিছু না। দূরে সরুন প্লিজ।’
‘ মিথ্যে বলতে বলতে মিথ্যাবাদী তে পরিণত হয়েছেন। বলতে হবে না আপনার।’
সাফারাতের আক্রোশ ভরা কন্ঠে চৈত্রিকা অবাক হলো প্রচন্ড। ফোন বের করে সাফারাত দিহান কে কল দিল। কন্ঠে তার অতিশয় রাগ। বললো,
‘ আমি জানি তোর মেমোরি অনেক ভালো। ছেলেগুলোকে দেখেছিস নিশ্চয়! উপরে আসার প্রয়োজন নেই। যতক্ষণ না ওই জানোয়ার গুলোকে খুঁজে বের করতে পারবি আমার সামনে আসার প্রয়োজন নেই। ‘
চৈত্রিকা বিস্ময়ে জড়ীভূত হয়ে গেল। বন্ধুকে কেন এমন করে থ্রেট দিল এই লোক!চৈত্রিকা কোনোভাবেই এই লোকের মাঝে কিশোর বয়সের সেই সাফারাত কে খুঁজে পাচ্ছে না। এ যেন নতুন কেউ!
পকেটে ফোন ঢুকিয়ে চৈত্রিকার আহত স্থানে হাত রাখতে গিয়েও সরিয়ে আনল সাফারাত। রাগে মাথা ব্যাথা ধরেছে খুব। চৈত্রিকা নড়ছে না বিন্দুমাত্র। দাঁড়িয়ে আছে স্থির,অটল। লিফটের দরজা ওপেন হতে না হতেই সাফারাত এমন এক কান্ড করে বসল,যার ফলে শিরশির করে উঠল চৈত্রিকার সমগ্র কায়া,অন্তর,মন।
#চলবে,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)
পিক ক্রেডিট ঃরুবি🖤