সিঁদুর শুদ্ধি নাফিসা মুনতাহা পরী পর্বঃ৪২

0
886

#সিঁদুর শুদ্ধি
নাফিসা মুনতাহা পরী
পর্বঃ৪২
.

এ যেন এক সন্তানের জন্য দুই মায়ের জমজমাট লড়াই। কেউ কাউকে চুল পরিমান ছাড় দিতে রাজি নয়। জুলিয়া ভৌমিক আবার স্মরন করে দিল দেবকীকে, আমি নিরাপরাধ প্রানীকে কখনো হত্যা করিনা। যদি সে বাড়াবাড়ি করে, তাহলে সে বাধ্য হবে দেবকীকে হত্যা করতে।

দেবকীও কম নয়। ও চিৎকার দিয়ে বলল,

—” অভির আমাকে খুব প্রয়োজন। তাই আমাদের পথে যেন সে না আসে। সেও পছন্দ করেনা, অকারনে কেউ মারা যাক।”

এদের মধ্য লড়াই না করার কোন অবিশিষ্ট থাকলোনা। দেবকী চোখ বন্ধ করতেই ওর কপাল থেকে ছাই মিশ্রীত ধোয়া এসে জুলিয়াকে আঘাত করতেই ওর হাত থেকে অভির বোতলটা পড়ে গেল এবং সেটা দেবকীর কাছে চলে এল। তারপর দেবকী অদৃশ্য হতেই কোথা থেকে একটা শক্তি এসে ওকে পেঁচিয়ে ধরে বালুরাশির উপর আছড়ে মারলো। এবার জুলিয়া এসে দেবকীর চারদিকে বনবন করে ঘুরতে লাগল। তারপর দেবকীর সামনে থেমে ওর গলা চেঁপে ধরে বলল,

—” আমি থাকতে তুই আমার ছেলেকে বন্দী করিস? ও আমার কষ্টের ভালোবাসার ফসল, অভিকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাচ্ছিস? আমি থাকতে ওর গা ছুয়ে দেখা! তুই কেন? পুরো পৃথিবীর মধ্য কেউ যদি আমার ছেলেকে আমার সামনে আঘাত করে তো তার আর বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। আর তুই কিনা আমার ছেলের গায়ে হাত দেওয়ার দুঃসাহস দেখাস?”

দেবকী জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তবে স্নেসলেস হয়ে যাওয়ার আগে একটা কথায় বলে যায়। আর তা হলো, অভিকে আমার খুব প্রয়োজন।

দেবকীর কথা কানে না নিয়ে অভির মা ওকে শেষবার আঘাত করার প্রস্ততি নিতেই দেবকীর কপাল থেকে এক আলো বের হয়েই ধাম করে দেবকী অদৃশ্য হয়ে যায়। জুলিয়া দেবকীর অবস্থান জানার জন্য চোখ বন্ধ করেই দেখতে পেল, হাজার হাজার জ্বীনের ছোট ছোট বাচ্চারা দেবকীকে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে চলেছে। জুলিয়ার একটু দয়া হল দেবকীর উপর। সে নিশ্চয় কোন ভালো যুগনী ছিল। না হলে এত জ্বীনদের বাচ্চার সাথে ওর সখ্যতা গড়ে উঠতোনা। কিন্তু অভিকে কেন সে বন্ধী করলো? এতে ওর কি স্বার্থ? না আমি আমার ছেলেকে কোন বিপদের মধ্য রাখতে পারবোনা। জুলিয়া অভিকে নিয়ে প্রকৃতির মাঝে মিশে গেল।

সকাল গড়িয়ে বেলা বাড়তে লাগলো। দেবকি বা অভি কেউই বাসায় আর ফিরে আসলোনা। অঞ্জনা দেবীর এবার আর সব কিছু স্বাভাবিক মনে হলোনা। এখন সে এই পরদেশে কার কাছে সাহার্য্য চাইবে। এদিকে বিদ্যার অবস্থা আরও খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে। অঞ্জনা দেবী সব মনে করে বিদ্যার পাশে বসে ডুকরে কাঁদতে লাগলো। তুই সত্যিই একটা অভাগী মেয়ে। সদ্য বিয়ে হওয়ার পরও তোর কপালে কোন সুখ সহ্য হলোনা। যাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাস তাকেই নিজের কাছ থেকে হারিয়ে ফেলেসি।
অঞ্জনা দেবী এমন বসে থাকতে থাকতে দুপুরও গড়িয়ে গেল। এমন সময় বিদ্ধস্ত অবস্থায় দেবকী বাসায় ফিরলো। ছোট বোনকে এমন চেহারায় দেখে অঞ্জনা দেবী ওকে ধরে বলল,

—” দেবকী, অপু ঠিক আছে তো! আর তোর কি হয়েছে! তুইতো অপুকে নিতে গেছিলি। অপু এলোনা যে?”

—“দিদি আমার হাতে সময় নেই। বিদ্যার কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। তানাহলে সব শেষ হয়ে যাবে। আমাদের আগে বিদ্যাকে বাঁচাতে হবে। যাই হয়ে যাকনা কেন বিদ্যার রেসপন্স আমাদের ফিরে আনতেই হবে। অভিকে ওর মা নিয়ে গেছে। আমি তাকে আটকাতে পারিনি। তুমি আজই ইন্ডিয়াতে ফিরে যাও। গিয়ে মধুর সাথে যোগাযোগ করে দিও। ওকে আমার খুব দরকার।”

—“না আমি ওকে এভাবে ছেড়ে যাবোনা। যা হয় হোক তবুও ওর পাশে আমি থাকবো।”

—” দিদি, বোঝার চেষ্টা করো। তাছাড়া বিদ্যার বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে। তুমি শুধু মধুর সাথে আমাকে যোগাযোগ করে দাও।”

সময় বিপরীত দিকে তার যাত্রা শুরু করেছে। এখন করার কিছু নেই। অঞ্জনা দেবী না খেয়েই তৎক্ষনাত রেডী হয়ে ইয়ারপোর্টে চলে গেল। দেবকী রমেশকে কল করে সব কিছু জানিয়ে দিল। মা পৌছে গেলে যেন ওকে ফোন দিয়ে জানানো হয়। সেদিনই অঞ্জনা দেবী ইন্ডিয়ার উদ্দেশ্য রওনা দিল। দেবকী অনেকটা কৌশলেই বড় দিদিকে সরিয়ে দিয়েছে। কারন দেবকীর মনে হচ্ছে বিদ্যার অতীত খুব একটা ভালো নয়। সেটা কারো জানা উচিত নয়। কিছুতো একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা বিদ্যার সাথে জড়িয়ে আছে। এখন শ্যামল বাবুই একমাত্র তার ভরসা। দেবকী অপেক্ষা করতে লাগলো শ্যামল বাবুর জন্য।

সন্ধ্যার কিছুক্ষন পর শ্যামল বাবু এসে গেলেন। বাসার মালিক বিদ্যাদের রুম পর্যন্ত ওনাকে এগিয়ে দিয়ে গেলেন। কিন্তু শ্যামল বাবু এতকিছু দেখার জন্য মোটেও প্রস্তত ছিলেন না। তিনি যেন শোকে পাথর হয়ে গেলেন। বিদ্যা, বিদ্যা বলে কয়েকবার ঝাকালো কিন্তু বিদ্যা আর উঠলোনা। দেবকী দেবী শ্যামলের কাছে এসে বলল,

—” দাদা, বিদ্যাকে আমি কিছুটা ঠিক করতে পারবো। কিন্তু আপনার সাহার্য্য ছাড়া আমি কিছুই করতে পারবোনা। আপনি আমাকে বিদ্যার অতীত সম্পর্কে জানান। কোন তথ্য লুকাবেননা।”

শ্যামল বাবু দেখলো, সব কিছু খুলে বলা ছাড়া কোন রাস্তা নেই তার সামনে। তাই সে আস্তে আস্তে সব কিছু খুলে বলল। বিদ্যা একজন পিশাচ দেবীর সন্তান। আমার ছোট ভাই সাজিত আর বৃন্দার সন্তান বিদ্যা। আমি যখন বিদ্যার বিয়ে দেই অপুর সাথে তখন আমি বৃন্দাকে আহ্ববান করি। বৃন্দার কাছে বিদ্যার মতই দেখতে এক অশরী ছিল। যে কিনা বিদ্যার শক্তির একটা বড় অংশ। আমার কথা শুনে বৃন্দা বিদ্যার কাছে চলে যায়। তারপর তার কয়েকমাস পর একটা অশরী পাখির মাধ্যমে জানতে পারি, বৃন্দা মারা গেছে। তারপর কি ঘটেছে আমার জানা নেই।

শ্যামল বাবুর কথা শুনে দেবকী আৎকে উঠলো। তাদের সাধু সমাজে এক পিশাচ দেবীর উদাহরন প্রায় দেওয়া হত, যে কিনা নিজে পিশাচ হয়ে অন্য পিশাচদের শিকার করতো। কিন্তু তার কন্যা যে বেঁচে আছে সেটা কারো জানা ছিলোনা। সে নিজে কোনদিনও ভাবেনি সেই পিশাচ সন্তান তার নিজেরই পুত্রবধু। কিন্তু এত ক্ষমতাশালী পিশাচ হয়েও বিদ্যার কাছে কোন শক্তি নেই কেন? সে কেন সাধারন মানুষ হয়ে জিবন-যাপন করছে। সে চাইলেতো নিমিষেই সব কিছু করতে পারতো। হ্যাঁ, এগুলো সব প্রশ্নের জবাব তাকে পেতে হবে। তার আগে বিদ্যাকে বেঁচে থাকতে হবে। দেবকী আসন পেতে বসে ধর মারণ, উচাটন, বশীকরণ, বিদ্বেষণ, বগলামুখী, বগলা প্রত্যঙ্গিরা, শ্মশানকালীর কবচ ইত্যাদির সাহায্যে বিদ্যার জন্য একটা কালো পদ্মর কবচ তৈরি করে। কালো পদ্মটি ধীরে ধীরে বিদ্যার মাথার উপর দাড়িয়ে যায়। দাড়াতেই পদ্ম থেকে ফোটা ফোটা কালো পদ্মরস বিদ্যার কপালে পড়তে লাগলো। এটা যতক্ষন বিদ্যার কাছে থাকবে ততক্ষন পর্যন্ত বিদ্যার বাঁচার আশা বেঁচে থাকবে। এদিকের কাজ করে দেবকী শ্যামল বাবুকে বলল,

—” আমি বিদ্যাকে রক্ষা করার একটা উপায় জানি। তবে সেটা খুব কঠিন। সেদিন রাতে কি কি ঘটেছে তা আমাদের সব কিছু জানতে হবে। অভি থাকলে কাজটা সহজ হতে পারতো কিন্তু ও নেই। জানিনা আমি কতটুকু কাজ করতে পারবো। আপনি এখন যান। বাঁকিটা আমি সময় নিয়ে কাজগুলো করবো।”

শ্যামল বাবু অনুরোধ সুরে বললেন,

—” দেবকী! আমার মায়ের কিছু হবেনা তো? মা আমার ঠিক হয়ে যাবে তো? আমার মায়ের কিছু হলে আমি আর বাঁচবোনা।”

দাদা, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো বিদ্যাকে ঠিক করার জন্য বাঁকিটা উপর ওয়ালার মর্জি। শ্যামল বাবু সেদিন একটা হোটলে থেকে পরেরদিন ঢাকায় ব্যাক করলো। এদিকে দেবকী তার মত করে চেষ্টা করতে লাগলো।

এই বয়সে এত জার্নি করার ফলে শ্যামল বাবু কিছুটা অসুস্থ হয়ে গেলেন। বাসায় ফিরে এসে কারো সাথে কোন কথা না বলে বিদ্যার রুমে গিয়ে দরজা এঁটে দিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। বাবা হয়ে চোখের সামনে মেয়েকে এমন পড়ে থাকতে দেখতে কোন বাবার ভালো লাগবে! কলিজাটা মনে হচ্ছে পুরে ছাই হয়ে গেছে। চোখের পানি কিছুতেই বাঁধ মানছেনা। পুরুষ মানুষ সহজে কাঁদেনা। কিন্তু আজ শ্যামল বাবু নিজেকে থামতেই পারছেনা। হুহু করে কাঁদতেই থাকলো। সাধনা দেবী দৌড়ে এসে দরজাতে থাবা দিয়েই বলল,

—” তুমি কাঁদছো কেন? কি হয়েছে তোমার? গত দু’দিন তুমি কোথায় ছিলে? আমাকে বলো কি হয়েছে?”

মায়ের চিৎকার চেঁচামেচিতে সব ছেলেরা এসে দরজা ধাক্কাতে লাগলো। বাসার পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয়ে গেল। এদিকে সাজিত এসেও প্রানপনে দরজা ধাক্কাতে লাগলো। বুকের ভিতর অজানা ভয়ে কুকড়ে উঠছে বারবার। এতসব কাহিনীর মধ্য শ্যামল বাবু কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি অতি কষ্টে নিজেকে থামিয়ে চোখের জল মুছে দরজা খুলে বের হয়ে এলেন। এবং একটি কথা, মাত্র একটি কথায় সকলের মুখ বন্ধ করে দিলেন। সেটা হল, বিদ্যা মারা গেছে। তোমরা যা চেয়েছ তাই হয়েছে। তোমাদের মনের প্রার্থনা কবুল হয়েছে। আর কাউকে বাবা বলে পরিচয় দিতে হবেনা। আর কাউকে নিজের মা বলে অনাথ মেয়েকে সন্তানের পরিচয় দিতে হবেনা। কাউকে বলতে হবেনা বিদ্যা তাদের আদরের বোন। সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে সে চলে গেছে। তোমরা সবাই খুঁশি তো! আমার তো মনে হয় তোমরা আজ বেজায় খুঁশি। নাও সবাই মনের আনন্দে ধেই ধেই করে নাচো।

সাজিত এসে ওর দাদার হাতটা ধরে চোখ লাল করে অসহায়ের মত চেয়ে বলল,

—” দাদা, কেন মিথ্যা কথা বলছো? আমি নিঃশ্চিত, বিদ্যা ভালো আছে।”

সাজিতের কথা আর সহ্য করতে পারলেন না শ্যামল বাবু। স্বশব্দে ঠাস করে থাপ্পড় মারলো সাজিতে গালে। তুই নিঃশ্চিত! তুই কতটা নিঃশ্চিত? তুই কেমন বাবা, সন্তান মৃত্যুর পথযাত্রী ছিল কিন্তু তোর মন টানেনি। তোর মনের বিবেকটা একবারও বলেনি! আমার সন্তান ভালো নেই। কোন অধিকারে আমাকে প্রশ্ন করার সাহস পাস? সব তোর জন্য হয়েছে। যদি তুই নিজের জায়গায় স্থির থাকতি তাহলে ঐ মেয়েটার দায়িত্ব ওর আপন মা নিজেই নিত। সেও চলে গেছে পরোপারে, আজ মেয়েটাও সেই একই পথ ধরে বিদায় নিয়েছে তোকে মুক্তি দিয়ে। শ্যামল বাবু আর কথা বলতে পারলোনা। ঠাস্ করে মেঝেতে পড়ে গেল এবং সেন্সলেস হয়ে যান। সবাই ধরাধরি করে তাকে রুমে নিয়ে গিয়ে ডাক্তারকে কল দিল। যে যার মত চেষ্টা করছে জ্ঞান ফিরানোর জন্য। সাজিত আর দাদার কাছে গেলোনা। রুমে এসে চুপ করে বসে রইলো। দুনিয়া যেন তার কাছে নিঃস্তব্ধতায় ডুবে গেছে। বৃন্দ মারা গেছে কথাটি ভাবতেই চোখ জলে ভরে গেল। আজ মেয়েটাও আমাকে ছেড়ে চলে গেল? সাজিতের কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো। তার একটা ভুলে সব শেষ হয়ে গেল। সে নিজেকে কিভাবে মাফ করবে? আমার মেয়েটাই বা আমাকে মাফ করবে কেন? নানা কথায় আজ সাজিতের মন ছিন্নভিন্ন হতে লাগলো। মনে হচ্ছে সে রক্তাক্ত সাগরের মাঝে হাবুডুবু খাচ্ছে। যেখান থেকে সে কোনদিনও উঠতে পারবেনা।

দেবকী বিভিন্ন গাছগাছড়া দিয়ে ঔষুধ তৈরি করে বিদ্যাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু প্রতিবারই বিফল হচ্ছে। বিদ্যার শরীর থেকে অভির প্রয়োগকরা মায়া এখনো কাটাতে পারেনি। বিদ্যার বেঁচে থাকা ক্ষীন হয়ে আসছে। চোখ-মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। অজানা বিপদে দেবকীর সমস্ত শরীর কেঁপেই চলছে। ওদিকে অঞ্জনা দেবী ওখানে পৌছেই দেবকীকে ভিডিও কল দিয়ে বিদ্যাকে দেখে চোখের পানি ফেলতে লাগলো। সে বাসায় না গিয়ে দেবকীর কুটিরে গিয়েছে। মধুকে ফোনটা দিয়ে বলল,

—” মধু, দেবকী তোমায় কি যেন বলতে চায়।”

মধু ফোনটা নিয়ে দেবকীকে প্রণাম জানিয়ে বলল,

—” মা, কেমন আছেন আপনি! আমায় কি করতে হবে বলেন।”

—“মধু, রাতে অপুর কবরে গিয়ে একটা পূজার ব্যবস্থা করবে। আমি আসছি।”

—” ঠিক আছে মা।”

ফোনটা কেটে দিয়ে বিদ্যার পাশে বসতেই বিদ্যা অত্যান্ত করুন কণ্ঠে মা বলে একটা চিৎকার দিল। বিদ্যার এমন আর্তনাদে দেবকী অস্থির হয়ে গেল। কারন বিদ্যা অচেতন অবস্থায় মা বলে কষ্টে চিৎকার দিচ্ছে। তারমানে যাদুর প্রভাব ধীরে ধীরে বাড়ছে। এভাবে বাড়তে থাকলে দেবকীর কোন চেষ্টায় সফল পাবেনা। দেবকী বিচলিত হয়ে বিদ্যার শরীরে একের পর একে মায়া চালান দিচ্ছে কিন্তু কোন মায়ায় শরীরে প্রবেশ করতে পারছেনা। কোন মায়া ওর শরীরে নিজেদের জায়গা করে নিতে পারছেনা। বিদ্যার শরীরে যতই ক্ষতের গভীরতা বাড়ছে ততই ও ছটপটিয়ে মা,মা বলে ডাকতে লাগলো। বিদ্যা মুখ দিয়ে বিড়বিড় করে ভুল বকেই চলছে। সে যেন তার ছোটবেলায় ফিরে গেছে। তার সামনে অপুদাদা দাড়িয়ে আছে। বিদ্যা হাত বাড়িয়ে অপুদাদাকে ধরার চেষ্টা করছে। কিন্তু ধরতে পারছেনা। বিদ্যা অপুদা, অপুদা বলে চিৎকার দিয়ে কাছে ডাকতে লাগলো। তবুও অপুদা তার কাছে আসছেনা। শেষে বিদ্যা ধুলাময় উঠানে হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে জোড়ে জোড়ে কাঁদতে লাগলো। দাদা তুমি আমায় শুধু কষ্ট দাও। আমি সত্যিই কিন্তু চলে যাব। তোমাকে ছাড়া আমার কিছু ভালো লাগেনা। কেউ আমাকে তোমার মত ভালোবাসেনা। কেউ আমার কষ্ট বোঝেনা। তুমিও আমায় ছেড়ে চলে গেছ।
অপু এবার ধীরে ধীরে বিদ্যার কাছে এসে পরম আদুরে গলায় বলল,

—” আমার সাথে যাবি বিদ্যা!”

বিদ্যা খুঁশিতে আত্ত্বহারা হয়ে দু’হাতের পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে বলল,

—” আমি তোমার কাছে যাবই যাবো। আমায় নিয়ে যাও দাদা।”

বিদ্যার মুখে অপুর সাথে যাওয়ার কথা শুনে দেবকীর চোখে জল চলে এল। ঈশ্বর, মেয়েটাকে এত বড় শাস্তি দিওনা। ওর স্বামী আছে। বিদ্যা তুমিই একমাত্র তোমাকে সাহার্য্য করতে পারো। তোমার জন্য অভি আছে। অপু তোমার অতীত। অপুই অভি হয়ে তোমার কাছে ফিরে এসেছে। তোমার অভিকে কষ্ট দেওয়ার কোন হক নেই। তুমি ফিরে আসো মা। কথাগুলো বলে দেবকী কালোপদ্মর দিকে তাকালো। পদ্মরসের ফোঁটাগুলো ছোট হয়ে আসছে। তার মানে বিদ্যার সময় কি শেষ? এ হতে পারেনা। সময় থেমে দেওয়ার মত শক্তি আমার নেই , কিন্তু সময়ের আগে আমার কিছু করার মত শক্তি রয়েছে। দেবকী সাথে সাথে ভ্যানিস হয়ে অপুর কবরের কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়। মধু সব কিছু গুছিয়ে রেখেছে। দেবকী সময় নষ্ট না করে সেখানে বসে পড়লো। মধু বিভিন্ন মন্ত্র যপ করতে লাগলো। একে একে অসংখ্য প্রেতশক্তি সেখানে ভিড় করতে লাগলো। এতে দেবকীর কাজে কিছুটা বিঘ্ন ঘটলো। তবুও চোখ বন্ধ করে অপুর অতীত দেখার চেষ্টা করতে লাগলো। দেবকী কি দেখলো না দেখলো বোঝা গেলোনা। দেবকী হঠাৎ চোখ খুলেই দাড়িয়ে গেল। তারপর দু’হাত এক করতেই সব কিছু আবার আগের মত হয়ে গেল। দেবকী বান-বিদ্যা প্রয়োগ করতে লাগলো অপুর কবরের উপর। অপুর কবর যেন মাটির সাথে মিশে গেল। এখানে যে কোন কবর ছিল তা কেউ বুঝতেই পারবেনা। আজকের পর থেকে অপুর কবর নিয়ে কোন তান্ত্রিক তাদের তন্ত্র সাধনা করতে পারবেনা। মধুকে চলে যেতে বলে দেবকী অপুর রুমের পিছে সেই বাঁশঝাড়ের কাছে গিয়ে হাজির হলো। দেবকীর চোখের সামনে যেন সব কিছু ভেঁসে উঠলো। কোথায় কোথায় কি কাজ করা হয়েছিল। দেবকী এবার চিৎকার দিয়ে বলল,

—” কেউ কি নেই, যারা বিদ্যার মৃত্যুর পথযাত্রা আটকাতে পারে? বিদ্যাকে দ্বারা কি কারো কোনদিনও উপকার হয়নি? মেয়েটা মারা যাচ্ছে উত্তম চিকিৎসার অভাবে। আমাকে দ্বারা হচ্ছেনা। কেউ কি শক্তিশালী অশরী নেই যে বিদ্যাকে তার বিপদ থেকে রক্ষা করবে?”

দেবকীর হঠাৎ মনে পড়লো, সেদিন রাতে এখানে একদল জ্বীনের আর্বিভাব হয়েছিল। তাদের আহ্ববান করে দেখি। কথাগুলো বলেতেই দেবকী সেই সব জ্বীনদের একসাথে আহ্ববান করলো। পরপর কয়েকবার আহ্ববান করতেই জঙ্গলে আলোর জোনাকি পোকার মত অসংখ্য আলোর ছিটা এক হয়ে এক শক্তিশালী জ্বীনের আর্বিভাব হল। জ্বীনটি এসেই দেবকীকে সালাম জানিয়ে বলল,

—” হে বোন, আপনি কেন আমাকে স্মরন করেছেন? আমিতো আপনাকে চিনিনা।”

আশার আলো দেখা পেয়ে দেবকী চোখের জল মুছে বলল,

—” আমাকে চিনেননা কিন্তু বৃন্দা কন্যা বিদ্যাকে তো জানেন! তার আজ খুব বিপদ। সে আজ মৃত্যুর সাথে লড়ছে। আপনার শরীর বন্ধ করার মায়া বলের জন্য কোন শক্তিই কাজ করছেনা। তাকে সাহার্য্য করুন।”

আমাকে নিয়ে চলেন বলতেই দেবকী আর জ্বীন গালিব অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তারা কয়েক মুহুত্তের মধ্যই বিদ্যার কাছে হাজির হয়ে গেল। বিদ্যার অবস্থা তখন সংকটময়। গালিব জ্বীন নারী জ্বীন তাহেরাকে আহ্ববান করতেই তাহেরা এসে উপস্থিত হল। গালিব নির্দেশ দিলেন বিদ্যাকে পরোখ করতে।

সব পরোখ করে নারী জ্বীনটা গালিবকে কিছু বলল। এতে গালীব মাথা নিচু করে বলল,

—” বোন, বিদ্যার শরীর যদি মুক্ত করে দেই তাহলে একদল শয়তান জ্বীনদল তাদের কাজে জয়লাভ করবে। যাদের কাছে বিদ্যার শক্তি বন্দী আছে তারা নিমিষেই বিদ্যার এই মানব শরীর দখল করবে। তখন আরো হিতে বিপরীত হবে। আমাদের আগে সেই শক্তিকে খুঁজে বের করতে হবে। তাহলে আমরা সফল হব।”

দেরী হয়ে গেলে যে বিদ্যাকে আর বাঁচানো যাবেনা কথাগুলো দেবকী বলতেই একটা পঞ্চমুখী কালো কিশকিশে সাপ এসে বিদ্যার উপর ঝাঁপ দিল। বিদ্যার সারা শরীর লেজ দিয়ে পেঁচিয়ে নিয়েই হা করে বিদ্যার শরীরে বার বার আগুন বর্ষন করতে লাগলো। নিমিষেই বিদ্যার শরীরে আগুন ধরে গেল। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে লাগলো বিদ্যা শরীরে।

দেবকীর শেষ আশাটাও যেন মাটি হয়ে গেল। দেবকী পাগলপ্রায় হয়ে আগুন নিভাতে ব্যস্ত হয়ে গেল। কিন্তু তার আগেই তাহেরা দেবকীকে চেঁপে ধরলো। কারন এমন প্রখর আগুনে দেবকী পুরে ছাড়খাড় হয়ে যাবে। যেমনটা বিদ্যা জ্বলছে।

[ চলবে…….]

বিদ্রঃ আগামী পার্ট ৩০ তারিখে দেওয়া হবে। রিভিশন দেওয়া হয়নি। এমনি দেরি হয়ে গেছে। ভুলক্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

………………………………..
লেখিকা, নাফিসা মুনতাহা পরী
———————————
© কপিরাইট: উক্ত কন্টেন্টটি লেখিকার সম্পদ। লেখিকার নাম এবং পেজ এর ঠিকানা না দিয়ে কপি করে নিজের নামে চালিয়ে অন্য কোথাও পোষ্ট করা আইনত দন্ডনীয়।

সরাসরি ওয়েবসাইট এ পড়ুন: https://nafisarkolom.com/2020/10/sidur-suddhi-16/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here