#তোর_শহরে_ভালোবাসা 💜
পর্ব-২৩
ফাবিহা নওশীন
🌺🌺
“সামু তুই কি হ্যাপি?”
মায়ের এমন প্রশ্নে সামু অবাক হয়ে গেলো।কি বলে এসব।ও প্রেগন্যান্ট।ও মা হতে চলেছে,,ছোট্ট একটা বাচ্চা আসবে।ওকে মা বলে ডাকবে,,আর ও খুশি হবেনা?
সামু উল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো।
–কেন আম্মু আমার সময় তুমি আমাকে নিয়ে হ্যাপি ছিলেনা?
মেয়ের এমন প্রশ্নে সামুর মা সামুর বাবার দিকে চাইলো।সামুর বাবা বললো,
–তুই হ্যাপি থাকলেই আমরা হ্যাপি,,তবে ওদের এ নিউসটা দেওয়া দরকার?
–কাদের?
–তোর শ্বশুর বাড়ি,, ওদের বাচ্চা ওরা জানবে না?,
সামান্তা অবাক হয়ে বললো,
–ওদের বাচ্চা?ওদের বাচ্চা নয়,,এটা আমার বাচ্চা,,আমার বেবির ভাগ আমি কাউকে দেবোনা,,ও শুধু আমার থাকবে।আমার বেচে থাকার অবলম্বন ও।আদি আমাকে ঘৃণা করে।ও আমাকে ডিভোর্স দিয়ে গেছে।ও যদি জানতে পারে বেবির কথা যদি আমার কাছে থেকে নিয়ে যায়?তখন আমি কি করবো?কিভাবে বাচবো আব্বু?আমি মরে যাবো।আমার কাছে এই বেবি ছাড়া আর কিছু নেই।আদি বিয়ে করতে পারবে,ও বেবি হবে ফ্যামিলি হবে,,আমার কি থাকবে?আমার উপর একটু দয়া করো,,রহম করো আব্বু।(কাদতে কাদতে)
–সামু তুই কাদছিস কেন?কাদিস না,,আমরা তো বেবির কথা ভেবেই বলেছি।
–আমার কথা কেন ভাবছো না,,বেবিকে ওরা কিছুতেই এখানে রাখতে চাইবেনা।আর আমি না ওখানে যেতে পারবো।আমি আমার বেবিকে নিয়ে বাচতে চাই।ওকে আমি মানুষ করবো।ও বড় হলে,যখন বুঝের হবে তখন যদি ওর বাবার কাছে যেতে চায় তাহলে আমি মানা করবোনা।কিন্তু ওকে এখন আমার চাই।আমি বড্ড একা আম্মু।
শুধু মাত্র তিনটা বছর আমার আর বেবির দায়িত্ব নেও,,আমার গ্রাজুয়েশন শেষ হলেই আমি জব নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবো।
সামুর বাবা অবাক হয়ে বললো,
–সামু কি বলছিস এসব?আমি সারাজীবন তোর আর বেবির দায়িত্ব নিবো।তুই এসব কেন ভাবছিস।আমি কি দায়িত্ব নিতে ভয় পাই?বাবা আমি তোর।তুই আমার কলিজার টুকরো।তোর জন্য সব করতে পারবো আমি।
–আমার কসম লাগে আব্বু,,কেউ যেন না জানে।
–আচ্ছা,আচ্ছা কেউ জানবেনা।তুই উত্তেজিত হোস না।রিলেক্স।
কেউ জানতে পারেনি বেবির কথা।তবে সামুর প্রেগন্যান্সি আর ডিভোর্সের খবর শুনে পাড়াপড়শিরা নিজ পয়সা খরচ করে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে একজন থেকে আরেকজনকে নানা কথা বলে বেড়াচ্ছে।পাড়া পড়শিদেশের যা কাজ আর কি।ইনিয়ে বিনিয়ে নানান কথা বলা বলা।
সামনে কেউ বলতে পারেনা কেননা ওই এলাকায় সামুর বাবার যথেষ্ট নামডাক আছে।
কিন্তু অগোচরে বলে বেড়ায়।
লোভে পড়ে বড়লোকের ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছে।সেই ছেলে দুদিন ফূর্তি করে প্রেগন্যান্ট করে ছেড়ে দিয়েছে।
এসব কথার ১০টা উত্তর সামুর কাছে আছে কিন্তু বলতে ইচ্ছে করেনা।বাড়িতে আত্মীয় স্বজনরা এসে সহানুভূতি দেখাতে আসে।
এসব আর সহ্য হয়না সামুর।ও ওর পড়াশোনা, বেবির যত্ন নিয়ে বিজি থাকে।আর অবসরে পেটে হাত দিয়ে বেবির সাথে সুখ-দুঃখের কথা বলে কাটায়।
🌿🌿🌿
দেখতে দেখতে আদি আর সামান্তার বিচ্ছেদের ৫বছর কেটে গেছে।সামু কক্সবাজারে জব করছে প্রায় ২বছর।সেখানে ওর বড় মামা বড় মাপের একজন ব্যবসায়ী।অনেক নামিদামি মানুষের সাথে উঠাবসা।তাই সেখানে ভালো একটা চাকরির জন্য বেশি কষ্ট করতে হয়নি।ভালো বেতনে চাকরি,অফিস থেকে থাকার জন্য একটা বাংলো,গাড়ি পেয়েছে।সেখানেই তার সানসাইনকে নিয়ে থাকে।জরিনা খালা সামুর অনুপস্থিতিতে সামুর মেয়ের দেখাশোনা করে।যে কিনা সামুদের বাসায় কাজ করতো।তার ছেলে মেয়ে কেউ নেই।তিনি ২বছর আগে কক্সবাজারে সামুর সাথে এসেছে।সামিরও বড় হয়ে গেছে।ভার্সিটিতে পড়ে।মাসের বেশিরভাগ সময় সামুর ওখানে থাকে।সব মিলিয়ে সামু বেশ ভালো আছে।ও চেয়েছিলো নিজের চেনা শহর থেকে দূরে থাকতে তাই হয়েছে।সামুর বাবা-মা ও বাধা দেয়নি।তারাও চান তাদের মেয়ে,নাতনি ভালো থাকুক।
সামু মেয়েকে তিনমাস হলো স্কুলে ভর্তি করেছে।মেয়ের বয়স ৪বছর হলেও কথাবার্তা,চালচলন ৭বছরের বাচ্চাদের মতো।সামু ওকে ওভাবেই তৈরি করেছে।বেশ দুষ্ট হয়েছে।দেখতে হবে তো মেয়েটা কার।
দুই বজ্জাতের সামু আর আদির।
রাতের বেলা সামু মেয়েকে পড়াতে বসেছে।
–বাবুই বলো তো হুয়াট ইস ইউর নেম?
–প্রিন্সেস,,সানসাইন,,বাবুই,,আদু,,(ঝুটি নাড়িয়ে)
সামুর কপালে হাত।
হায়রে মেয়ে,,কি বলে।নিজেকে সামলে মেয়েকে বলে,,
–নাম জিজ্ঞেস করলে এসব বললে মিস তোমাকে রসগোল্লা দিবে বুঝেছো?
–হিহি,,তাহলে তো ভালো হবে মাম্মা।আমি খেয়ে ফেলবো।
–উফফ,,ঠিক করে বলবে,,নয়তো মার খাবে।আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি।
মাথা ঝুলিয়ে সায় জানালো।
–মাই নেম ইজ আদিবা সাজান্তা চৌধুরী।
–এই তো গুড গার্ল।হুয়াট ইজ ইউর মাদার নেম?
–মাই মাদার নেইম ইজ সামান্তা সেহনুজ।
–হুয়াট ইজ ইউর ফাদার নেম?
–মাই ফাদার নেম ইজ আদিল চৌধুরী।
সামান্তা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।ওর পড়াতে ভালো লাগছে না।তারপর বললো,
–বেবি তোমার ছুটি চলো কার্টুন দেখবে।
মেয়েকে কার্টুন ছেড়ে দিয়ে আলমারি থেকে ডিভোর্স পেপার বের করলো।আর সেই চিঠি।চিঠিটা আরেকবার পড়লো।এত বছরে কতবার পড়েছে হিসেব নেই।
পেন হাতে নিলো সাইন করার জন্য।পেন বসানোর সাথে সাথেই হাতটা কেপে উঠলো।
তারপর পেন ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলছে,
–হুয়াই?হুয়াই?এতবার চেষ্টা করেও কেন সামান্য একটা সাইন করতে পারি না।কেন পারিনা?কেন আমি আমার জীবন থেকে তোমাকে বাদ দিতে পারিনা।তুমি তো পেরেছো,,তবে আমি কেন পারছিনা আদি।টেল মি..
রাতে আদিবাকে ঘুম পাড়িয়ে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো।আকাশে দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।আকাশে চাদ নেই।তারারা ঝিকঝিক করছে।আকাশে কোনো মেঘ নেই।শুভ্র সুন্দর আকাশ।
🥀🥀🥀
সত্যিই আদি আমাকে তোমার মনে পড়েনা?হয়তো পড়েনা,,নয়তো এত বছরেও কেন তুমি দেশে ফিরলে না।বাবা-মায়ের জন্য ও তো ফিরতে পারতে।নিশ্চয়ই কোনো বিদেশীনিকে বিয়ে করে সুখে আছো।আমিও আছি।সুখে আছি।রোজ রোজ নিজেকে স্টং প্রুফ করার জন্য লড়াই করি।
আমার লাইফের সানসাইনকে নিয়ে ভালো আছি।তবে কি জানো তোমাকে আজো ভুলতে পারি না।সারাদিনের ব্যস্ততায় তোমাকে ভুলে থাকার চেষ্টায় সফল হলেও এই একাকিত্ব রাতে তোমাকে বেশ মনে পড়ে।তাতে কি!!
সামান্তা অভিমানী মুখ করে ঘরে গিয়ে আদিবাকে জড়িয়ে শুয়ে পরলো।
সিডনি 🏣🏣
আদি কিচেনে থেকে কফি বানিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো।তারপর কফিতে চুমুক দিয়ে ফোন বের করে।ফোনের লক খোলে স্কিনের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।সেখানে সামান্তার হাস্যোজ্জ্বল একটা ছবি।ফোনের স্কিনে আলতো করে ঠোঁট ছোয়ালো।
“কেমন আছো সামু?নিশ্চয়ই ভালো।আমি চাই তুমি ভালো থাকো।আমি প্রতি প্রার্থনায় সে দোয়াই করি।কি করছো?ও এখন তো ওখানে গভীর রাত।নিশ্চয়ই কারো বুকে শান্তিতে ঘুমাচ্ছো?কিন্তু কি জানো?আমার ঘুম হয়না।একটা রাতও ঘুমাতে পারি না।তুমি বলতে না আমি বড্ড ঘুমকাতুরে।কিন্তু এখন আমার ঘুম দেখলে নির্ঘাত হার্ট এটাক করতে।মদেও নেশা হয়না তাই মদ ছেড়ে দিয়েছি বহুকাল আগে।কেমন যেন হয়ে গেছি।দেখলে অবাক হতে।
নিশির কাছে শুনেছি তুমি তোমার লাইফে ভালো আছো,খুশি আছো।পড়াশোনা শেষ করে জব করছো।আমার শহরের সাথে সাথে নিজ শহরও নাকি ছেড়ে দিয়েছো।যাক ভালো থাকো।ভালো থাকাই তুমি ডিজার্ভ করো।
আমিও আছি আমার মতো।প্রতিদিন কল্পনায় তুমি এসে আমার সাথে কথা বলো।জানো আজো সেই স্বপ্ন দেখি।একটা মেয়ে ছাদের নিচের দিকে ঝুকে আছে।তার ফেস দেখা যাচ্ছেনা।পিঠের উপর আঁকাবাঁকা লালচে চুল।একভাগ নিচের দিকে ঝুকে পড়েছে।ফর্সা হাতে মেহেদী দেওয়া।আমি আজো তার চেহারা দেখার জন্য আকুবাকু করি।সে আমার দিকে ঘুরে ঘৃণার দৃষ্টি দেয় যা আমি সহ্য করতে পারিনা।আচ্ছা তুমি কি আমাকে ঘৃণা করো?আমাকে কি তোমার মনে পড়ে না?আমিও না কি বলছি,,তোমার কি সে সময় আছে।নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত আছো হয়তো।
আমি ভেবেছিলাম আমি তোমাকে ঘৃণা করে আজীবন বাচতে পারবো কিন্তু কি জানো সে ঘৃণার মেয়াদ বছরখানেক ছিলো।তারপর….
তারপর বুঝতে পারলাম আমি কি করেছি।নিজের জীবন নিজের হাতে ধ্বংস করে দিয়েছি।নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছি।তোমাকে কষ্ট দিতে গিয়ে নিজেকে খুন করেছি।তোমাকে কয়েকশো টুকরো করতে গিয়ে নিজেই কয়েক লাখ টুকরো হয়েছি।কিন্তু যখন বুঝতে পেরেছি তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।তোমার সামনে দাড়ানোর মতো সাহস আমার নেই।কিভাবে দাড়াবো?তোমার সাথে আমি অনেক অন্যায় করেছি,,
তোমার বলা কথাগুলো আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছিলো সামু,,আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিলো।তুমি হয়তো তা দেখতে পাওনি,,”
আদির চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।হাতের তালু দিয়ে মুছে নিলো।তারপর আবার বললো,
“তুমি ভালো থেকো কিন্তু এজীবনে আমার আর ভালো থাকা হবেনা।কারণ আমার ভালো থাকার জন্য যে তোমাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন।ভালোবাসি তোমাকে খুব ভালোবাসি।আজীবন বাসবো।”
ফোনটা পকেটে রেখে দিলো।তারপর মেঝেতে হাটু গেড়ে বসে পড়ল।চিতকার করে বললো, ভালোবাসি সামু,,,
~~~~
আদির ফোন বেজেই চলেছে।নিশি ফোন করেছে।নিশি কখনো ফোন করে না।আদি এত বছরে কারো সাথে যোগাযোগ রাখেনি।মাঝেমধ্যে নিশিকে ফোন করে বাড়ির খবর নেয়।কিন্তু নিশি নিজ থেকে কখনো ফোন করে না।হয়তো অভিমানে।আদি যখন ফোন করে তখন বোন হিসেবে ভাইকে অস্বীকার না করতে পেরে ফোন রিসিভ করে।নিশির বিয়ে হয়েছে ২বছরের একটা ছেলে আছে।
“ভাইয়া বাবা আবারো হার্ট এটাক করেছে।বিছানায় পড়ে আছে।জানিনা কি হবে?এ নিয়ে ৩বার হয়ে গেছে।যদি দেখতে ইচ্ছে করে,,বাবার প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসা, দায়িত্ব বোধ থাকে তবে আসিস।নয়তো তুই তোর মতোই থাক।”
বলেই ফোন কেটে দিলো।
এর আগেও অনেক বার নিশি যেতে বলেছে কিন্তু আদির এক কথা ওখানে আর ফিরবে না।
আদি জোরে শ্বাস ফেলে কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো,
“আদি ব্যাক করবে তার বাবার জন্য।অনেক হয়েছে।”
চলবে…🐼