#সিঁদুর শুদ্ধি
নাফিসা মুনতাহা পরী
পর্বঃ ৪৪
.
সর্প আসনে বিদ্যাকে দেখে মনে হচ্ছে কোন সর্পদেবী তার আসনে বসে রাজত্ব পরিচালনা করছে।
লালপ্রভাকে দেখার মত ছিল। ভয়ে কণ্ঠনালী অবদি শুকিয়ে গেল। কারন ২৫ বছর আগে এদের মা-মেয়ের তান্ডপ ও নিজ চোখে দেখেছে। ঐ ছোট্ট বয়সে বিদ্যা যে খেলা দেখাইছিল, আজও সেই কথা ভুলতে পারেনি সে। আর আজতো নিজ শক্তি ফিরে পেয়েছে। আজ বুঝি রক্ষা আর নেই। কারন ও নিজেই যমদেবীর মেয়ে। যার মা একের পর এক পিশাচ শিকার করতো। আর নিজের শক্তি বাড়াইতো।
বিদ্যা এক দৃষ্টিতে লালপ্রভা সহ ঐ ভয়ংকর নারীদের দিকে চেয়ে আছে। বিদ্যার শরীরের পোষাক আর রুপ পরিবর্তন হতে শুরু করে দিয়েছে। পা দু’টি দুমড়ে উল্টা দিকে চলে গেল। চুলগুলো আরও বড় এবং কোকড়ানো হয়ে মাটি পর্যন্ত বিছিয়ে গেল। চোখ দু’টি আয়তকার হালকা লাল হয়ে গেল। শরীরে অলংকারে ভরে গেল। চেহারার রুপ যেন আরও বেড়ে গেল। গভীর থেকে গভীরতর অন্ধকারে বিদ্যার রুপ যেন পূর্নিমার চন্দ্রের চেয়েও পরিপূর্নতায় বিরাজ করছে। সমুদ্রতট যেন উজ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে গেল। অন্ধকার জগতের একদম অল্পবয়স্ক যুবতী অধিশ্বরী তার মহিমা ছড়াতে যেন বড্ড ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।
এমন সময় লালপ্রভা তার জিবন বাঁচানোর জন্য শেষ চেষ্টা করলো। সে এখানে বন্দী হলে কি হবে! এখনো তার মা আর ধীরাজ রয়েছে। নিশ্চয় তারা লালপ্রভাকে রক্ষা করার জন্য ছুটে আসবে। সেই স্বপ্ন মনে লালন করে লালপ্রভা তার স্বামী আর মাকে আহ্ববান করে। হ্যা, আহ্ববানে এবার যেন কাজ হল। একবৃদ্ধা মহিলা আর ধীরাজ উপস্থিত হল সুমুদ্র কিনারে। লালপ্রভাকে এমন অবস্থায় দেখে বৃদ্ধা মহিলাটি আশেপাশের পরিবেশ কাঁপিয়ে এক বিশাল আকৃতির নেকড়ের রুপ ধারন করলো। তারপর বিদ্যার দিকে তাকিয়েই যেন আবিভূত হয়ে গেল। মুখ দিয়ে অনিচ্ছায় আসল কথাটি বলেই ফেলল,
—” ইনি তো স্বীয় রূপলাবণ্যেয় তার আশে-পাশের পরিবেশ মোহিত করতে পারেন। গৌরবর্ণা বিচিত্র বস্ত্রবিধারিনী বিচিত্র অলঙ্কারে বিভূষিতা নর্ত্তকীর বেশধারিণী’। এ যে, দেবী বিশুদ্ধ স্ফটিকের ন্যায় শুভ্রবর্ণা ও নানাবিধ অলংকারে সুশোভিতা এবং নূপুর হার, কেয়ূর ও রত্ননির্ম্মিত কুণ্ডলে পড়িমণ্ডিতা। এ কোন সাধারন পিশাচ নয়, এ নিশ্চয় কোন শক্তিশালী দেবী।”
কিন্তু ধীরাজ থামলোনা। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে লালপ্রভাকে মুক্ত করার চেষ্টা করলো। লালপ্রভার শরীরে হাত দিতেই লালপ্রভা আগুনে জ্বলে পুরে ছাড়খার হয়ে গেল। এবার বিদ্যা খিটখিট করে হেঁসে উঠে বলল,
—” নিজ স্ত্রীকে তাহলে এভাবেই নিজের হাতে মেরে ফেললি? জিবনে যত পাপ কাজ তোরা দু’জন মিলে করেছিস, আজ তার ফলটুকু দেওয়ার সময় হয়েছে। তৈরি হয়ে নে, আমার দেওয়া ভয়ংকর যন্ত্রনা আস্বাদন করার জন্য। এতদিন অন্যকে কষ্ট দিয়েছিস। এবার আজ বুঝবি, শাস্তির ফলাফল কিরুপ হতে পারে।”
বিদ্যার কথা শুনে লালপ্রভার মা পালানোর চেষ্টা করতেই কনিষ্ঠ সর্প এক নিমিষেই বিদ্যার পায়ের নিচে এনে আছাড় মারলো। বিদ্যা সরাসরি ঐ বৃদ্ধার বুকের উপর পা তুলে দিয়ে বলল,
—” নিজ কন্যা এত এত এত অপরাধ করেছে তবুও তুই তাকে শাসন করিসনি। বরং তুই তাকে আরো বেশি খারাপ কাজ করার জন্য ইন্ধন জুগিয়েছিস। সে একা কেন শাস্তি ভোগ করবে! তুই তোর মেয়ের আসল পরিকল্পনা দাতা। তোরতো আরও বেশি শাস্তি পাওয়া উচিত। আমি ভাবছি, তোর রক্ত পান করেই আমি আমার পিশাচ জিবন শুরু করবো।”
বিদ্যার সেই চিরচেনা পদ্ধতি আজ সে কাজে লাগালো। যেটা সে মায়ের কাছ থেকে শিখেছিল। হ্যাঁ এই বৃদ্ধাটি অনেক পুরনো, তাই এর শক্তি হরন করলে সেটা শক্তি বৃদ্ধিকে কাজে দিবে। বিদ্যা আগে বৃদ্ধার শরীর থেকে সমস্ত শক্তি সুষে নিল তারপর মন শান্তি করে বৃদ্ধার রক্ত পান করলো। বৃদ্ধা নেতিয়ে পড়তেই বিদ্যা ওর শরীর দুরে ছুড়ে মারলো। তারপর ধীরাজের দিকে চাইলো।
বিদ্যার এহেন নৃশংসতায় ধীরাজের কথা বলা বা মায়া প্রয়োগ করা, কোনটাই ওর বোধগম্য হলোনা। নিজের সামনে সাক্ষাৎ মৃত্যর দেবীকে যেন সে দেখছে। বিদ্যার অশরী শরীরের সাথে সবচেয়ে খারাপ ব্যবহার করেছে এই ধীরাজ। এখন তার সব কিছু মনে পড়ছে। এক অদৃশ্য টানে ধীরাজ শামিল হল ঐ ভয়ংকর নারীদের মধ্য। সেই একই শক্তি এসে ধীরাজের আঙ্গুলের গিড়া অবদি কেটে দিল। সাথে সাথে ফিকনি দিয়ে রক্ত ঝড়তে লাগলো আগুনের উপর। ধীরাজ চিৎকার দিয়ে ছটফটাতে লাগলো।
এটা তোদের ইচ্ছা মৃত্যু। যা তোরা নিজেরাই নিজের জন্য তৈরি করেছিস। এভাবেই তোদের বিনাশ অবধারিত। আমি তোদের এই অবস্থায় ছেড়ে যাচ্ছি। তোরা আস্তে আস্তে মৃত্যুমুখে পতিত হবি। যদি কেউ তোদের এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে আসে তাহলে শোন, তোদের যদি কেউ স্পর্শ বা মায়ার আশ্রয় নিয়ে সাহার্য্য করে তাহলে সাথে সাথে তোদের শরীরে আগুন ধরে যাবে। ঠিক লালপ্রভার মত। একটা নির্দিষ্ট সময় পরেই তোরা সকলে মৃত্যুর সাক্ষাত লাভ করবি।
কথাগুলো বলেই বিদ্যা মাটিতে পা নামিয়ে দিলো। মাটিতে পা পড়ার সাথে সাথেই প্রকৃতির শক্তি আর তার নিজ শক্তির ঘর্ষনে যেন আলোর ঝলকানি বেরিয়ে এল পা থেকে। সে আজ থেকে মুক্ত। কোন পিছুটান তার নেই। সে তার বৃন্দা মাকে বড্ড ভালোবাসে। সেই মায়ের শেষ ভালোবাসা বুকে নিয়ে সে সারাজিবন বেঁচে থাকতে চায়। বিদ্যা মনের খুঁশিতে সাগর পাড়ে ছোটাছুটি করতে লাগলো। নিজের ইচ্ছা মত শক্তিগুলোকে পরখ করতে লাগলো। সাগরে মনে হয় ঝড় উঠেছে। জলরাশির ঢেউগুলো একের পর এক পাড়ে এসে আছড়ে পড়ছে। বিদ্যা সেই ঢেউ গুলো দেখেই সেদিকে অগ্রসর হল। কি আশ্চর্য, বিদ্যা যতই এগুতে থাকে ততই জলরাশি সরে গিয়ে বিদ্যার হাটার জন্য জায়গা করে দিচ্ছে। এ এক অপরূপ দৃশ্য। বিদ্যা নিজেও অবাক হয়ে গেল। বিদ্যা সাগরের একটু গভীরে যেতেই পানির বিশাল বিশাল পাহাড় সৃষ্টি হয়ে পথ থেকে সরে দাড়াচ্ছে। বিশাল একটা ঢেউয়ের ধাক্কায় কিছু জল বিদ্যার শরীরে পড়তেই জলকনাগুলো বাবুলের মত উড়ে গিয়ে আবার জলের সাথে মিশে গেল। এক অনবদ্য খেলায় মেতে উঠলো বিদ্যা। ওখানে দাড়িয়ে থেকেই উচ্চস্বরে একটা চিৎকার দিল। যতদুর চিৎকারের ধ্বনি ছড়িয়ে পড়লো ততদুর পর্যন্ত সুমুদ্রের পানি সরে গিয়ে বড়সড় একটা খেলার মাঠের মত তৈরি হয়ে গেল।
সাগর পাড়ে দাড়িয়ে পঞ্চ সর্প ভাইগন তাদের মায়ের এত খুঁশি মুগ্ধ নয়নে দর্শন করছে। হঠাৎ তাদের মনে হল, তাদের মায়ের জানা নেই শক্তি কতটুকু আর কিভাবে ব্যবহার করতে হয়। এভাবে শক্তির অপচয় ঘটলে বিপদ আসন্ন হয়ে পড়বে মায়ের জন্য। তাই ১ম সর্পটি তার বিশাল লেজ বাড়িয়ে দিল বিদ্যার দিকে। নিমিষেই লেজটি বিদ্যার কোমড় জড়িয়েই দ্রুত বিদ্যাকে পাড়ে নিয়ে আসলো। বিদ্যা পাড়ে আসতেই পানির পাহাড় ভেঙ্গে একসাথে বিশাল ঢেউ হয়ে সাগরেই আছড়ে পড়ল।
কাজে ব্যাঘাত ঘটার কারনে বিদ্যা রেগে গিয়ে সাপদের দিকে তাকাতেই সাপদ্বয় শ্রদ্ধায় মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইল। এমন সময় কনিষ্ট সাপ ১ম সাপকে লেজ দিয়ে টোকা দিয়ে ইশারা করলো, মায়ের শরীর থেকে যেন তার লেজটা সরায়। না হলে আজ তার লেজই কাটা পড়বে। তাহলে সারা জিবন খোড়া সাপ হয়েই কাটাতে হবে।
কনিষ্ঠ ভাইয়ের গুতা খেয়ে সে তার লেজ সঙ্গে সঙ্গে গুটিয়ে নিল। এদের এহেন কান্ডে বিদ্যা ভ্রু কু্ঞ্চিত করে বলল,
—” তোমাদের সমস্যা কি হ্যাঁ! আমাকে কেন বাঁধা দিচ্ছো? আমি যদি রেগে যাই তাহলে তার ভয়াভয়তা কিরুপ হতে পারে সেটা তোমরা জানোনা?”
২য় সাপ দুঃখ ভরাক্রান্তে মুখটা একটু ফুলিয়ে বলল,
—” মায়েরা বুঝি সন্তানের সাথে এমন ব্যবহার করে! আপনিতো আপনার শক্তির সম্পর্কে এখনো অবগত হননি। শক্তির অপচয় যাতে না হয় তাই আপনাকে নিয়ে আসা হল।”
ওদের কথা শুনে বিদ্যা তব্দা খেয়ে গেল। আমাদের আবার বাচ্চা কবে হল! অপুদা তো সেই কবে মারা গেছে। তারপর থেকে আমার সাথে কি হয়েছে আমি জানিনা। বাচ্চা আবার কবে পয়দা করলাম? তাও আবার ডাশাডাশা এমন কুচকুচে সাপ! এ আমার কি হল! আমিতো কিছুই মনে করতে পারছিনা।
কনিষ্ঠ সাপ কারো কথার তোয়াক্কা না করে বিদ্যার একদম কাছে গিয়ে নিজের মাথাটা বিদ্যার গালের সাথে পরম মমতায় ছুয়ে দিল। কনিষ্ঠ জনকে এমন কাজ করা দেখে বাঁকিরা গিয়ে ওর সাথে একই কাজ করতে মত্ত হলো।
এমন সময় বিপদের আশাংকা দেখেই ৫ভাই বিদ্যাকে ছেড়ে দিয়েই এক সাপে পড়িনিত হয়েই বিদ্যাকে আগলে ধরে দেয়াল হয়ে দাড়াতেই বুঝতে পারলো ততক্ষনে তাদের অনেক দেরী হয়ে গেছে। কারন ইতিমধ্য বিদ্যার গলায় দেবকি অপুর বুকের ছোট্ট একটুকরো হার গেঁথে দিয়েছে। হারটি বিদ্যার রক্তের সাধ পেতেই আস্তে আস্তে সে লাল বর্ন ধারন করতে লাগলো। লাল বর্ন থেকে আলোর দ্যুতি ছড়াতেই সাপদ্বয় দুরে ছিটকে পড়ে গেল। সাপগুলো দুরে গিয়ে পড়তেই তারা আবার এক হয়ে গিয়ে দেবকির দিকে হামলা করার প্রস্তুতি নিতেই দেবকী হুংকার দিয়ে সাবধান করে দিল, যদি তারা এমনটা করে তাহলে তারাতো মরবেই সাথে তাদের মাকেও সারা জিবনের জন্য হারাবে।
দেবকীর যাদুর প্রখরতা অত্যান্ত ভয়াভয় দেখে সাপদ্বয় ওখানে দাড়িয়েই তর্জনগর্জন করতে লাগলো। কনিষ্ঠ সাপ কিছুতেই মেনে নিলোনা। তাই সে দ্রুত এগুতেই পাথরে পরিনিত হয়ে গেল।
দেবকি আফসুস সুরে বলল,
—” আমি নিষেধ করেছি, কেন শুনলেনা? আমি শেষ বার তোমাদের সাবধান করছি, তোমরা এখান থেকে তোমাদের এই আধামৃত ভাইকে নিয়ে গিয়ে সুস্থ করে তুলে নিজেদের রাজ্যতে ফিরে যাও। আমি নিরীহ কোন প্রানী হত্যা করিনা। কিন্তু যদি তোমরা আমার কথার অমান্য করো তাহলে এখুনি তাকে শেষ করে দিব। তোমরা নিশ্চিত থাকো, আমি তোমাদের মায়ের কোন ক্ষতি করবোনা। সময় হলে আবার তার সাথে দেখা করতে পারবে। স্মরন করো বিদ্যা এতদিন কোথায় ছিল! নিশ্চয় তার একটা পরিবার আছে। আমি সেই পরিবারের একজন। তাই তোমরা চলে যাও আর নিদিষ্ট সময়ের জন্য অপেক্ষা করো। কারন তোমরা হাজার চেষ্টা করলেও তোমাদের মাকে বন্ধন মুক্ত করতে পারবেনা।”
সাপদ্বয় সব কথা শুনে বিদ্যার দিকে চাইলো। বিদ্যা তখন শূণ্যতে অচেতন অবস্থায় ভাঁসছে। আর তার শরীর এক রশ্মির দড়ি দারা বাঁধা আছে। সেই রশ্মির দড়িটা ঐ মহিলাটি আয়ত্ব করছে। কোন উপায় না দেখে তারা তাদের কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে নিয়েই সুমুদ্রের পানিতে ডুব দিল। সাপগুলো চলে যেতেই দেবকি হাফ ছেড়ে বাঁচলো। শুধু মাত্র বিদ্যার দোহাই দিয়ে তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া ওদের সাথে পেড়ে ওঠা এত সহজ হতোনা।
দেবকী সেই রশ্মি টেনেই অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর তারা বাসায় পৌছেই বিদ্যা খাটে এসে ধপ করে পড়ে গেলে। তারপর বিদ্যার বাঁধন মুক্ত করে দিল। বিদ্যা চোখ খুলেই দেবকীর দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। সাথে সাথে দেবকী তা প্রতিহত করেই রাগী কন্ঠে বলে উঠলো,
—” যে মূর্খ সেই মাত্র শক্তির দাম্ভিকতা করে। তুমি ভুলে যেওনা তুমি একজন পিশাচ আর আমি একজন মানুষ। মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্টতম জীব। তুমি কোন অংশেই আমাকে হারাতে পারবেনা। তোমরা ছলনা করে মানুষদের আঘাত করো তাই তোমরা জিতে যাও। কিন্তু আমি একজন যোগিনী তাই আমাকে তোমার শক্তির দম্ভ দেখাতে আসবেনা।”
বিদ্যার মনমানুষিকতা একদম হিংস্র হয়ে গেছে। তাই সে দেবকীর কোন কথায় মানতে নারাজ। সেটা দেবকী বুঝতে পেরেই বিদ্যাকে আবার বন্দী করলো। তারপর বিদ্যার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
—” তোমাকে বেশিক্ষণ বেঁধে রাখার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু আমি নিঃশ্চিত তুমি কখনোই অপুকে অসম্মান করবেনা। আর আমিতো অপুর গর্ভধারিণী মা। এখন ভাবো তুমি আমার সাথে কেমন ব্যবহার করবে? তুমি তোমার শক্তিকে কাজে লাগাও আর দেখ, তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? তুমি একজন মানব সন্তানও। তাই একটু ভাব, তোমার অতিত কি ছিল!”
অপুর কথা বলাতেই বিদ্যা একদম শান্ত হয়ে গেল। দেবকী এবার বন্ধন মুক্ত করে দিয়ে বলল,
—” তুমিতো আর এমনি এমনি বড় হওনি। অবশ্যই কোন একটা কাহিনী আছে, যা তোমার স্মরনে নেই। নিজের শক্তিগুলোকে কাজে লাগাও।”
বিদ্যা এবার বেশ দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেল। গলার হাফ ইঞ্চি অপুর দেহ কাঠিতে হাত দিয়েই চোখ বন্ধ করলো। হ্যাঁ, সে সব কিছু দেখতে পেল, মানে সব কিছু। একজায়গায় সে থমকে দাড়ালো অভিকে দেখে। বিদ্যা চোখ খুলতে উদ্যত হতেই দেবকী নিষেধ করলো, চোখ খোলা যাবেনা। দেখ তাকে, সে কে? কেন সে তোমার জিবনে এসেছে।
অভির সাথে সময় কাটানো সহ বিয়ে করা সব কিছু মনে পড়তে লাগলো বিদ্যার। অভি বলেই কেঁদে উঠে চোখ খুলল বিদ্যা। ওর চোখ দিয়ে জল ঝড়ছে। সাথে সাথে দেবকীর দিকে চেয়ে বলল,
—” মা, আমার অভি কোথায়?”
বিদ্যার সব মনে পড়েছে। সেটা বুঝতে পেরে দেবকি যেন সস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিন্তু বিদ্যা ওকে মা ডাকছে কেন? এসব ভাবতেই বিদ্যা মুচকি হেঁসে বলল,
—” মা, আমাকে ক্ষমা করে দেন। আমি আপনার মনের সকল কথা পড়তে পারছি। এখন আমাকে সাহার্য্য করুন। আমি অভিকে পাবো কিভাবে?”
দেবকী কিছুক্ষন বিদ্যার দিকে চেয়ে রইলো। তারপর বিষন্নতায় মন একদিকে রেখে জলভরা চোখে মিনমিন
স্বরে বলে উঠলো,
—” আমায় মা বলে ডাকছো? কিন্তু মা হওয়ারতো কোন যোগ্যতায় আমার নেই। আমার মত নিষ্ঠুর মা হয়ত পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় টি নেই।”
বিদ্যা দেবকীর হাত দু’টো নিজের কোলের উপর রেখে পরম আদরের কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো,
—” মা, আমি অভিকে কিভাবে কাছে পাব? ওকে পাওয়ার পথ যে আমার জানা নেই মা! আমি কি করবো এখন?”
নিশ্চয় কোন একটা পথ পেয়ে যাব। তুমি চিন্তা করোনা। একটা কথা ছিল, তুমি যে পিশাচ সেটা কি অভি জানতো?
বিদ্যা মাথা নিচু করে মুখ কাচুমাচু করে বলল,
—” আমিতো নিজেই জানতামনা, আমি একজন পিশাচ। তাহলে ও কিভাবে জানবে আমি কে? আচ্ছা অভি কি আমায় মেনে নিবে?”
দেবকী মুচকী হেঁসে বলল,
—” না মেনে নিলে তুমি কি করবে? আমার ছেলেটাকে কি হত্যা করবে?”
—” কি বলেন মা, না মেনে নিলে না নিবে! এতে আমার কিছু যায় আসেনা।”
—” সত্যিই তোমার কিছু যায় আসেনা?”
—” নাহ্, একদম যায় আসেনা। ওকে শুধু একবার পেয়ে নেই না! তারপর দেখি ও কিভাবে আমার কাছ থেকে চলে যায়। এত মায়া যদি কাজে নাই লাগাতে পারি, তাহলে আমি মায়াবিনী হলাম কেন?”
অনেক কথা বলেছ। এখন যা বলি মনযোগ দিয়ে শোন। আজই তোমার বাবার সাথে কথা বলে নিবে। আর দিদি মানে অঞ্জনা দিদির সাথে কথা বলবে। তারপর আগামী কাল থেকে আমাদের অভিযান শুরু। আর তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। যে তোমাকে অভি অবদি পৌছে দিবে। আমি আর তোমার সাথে চলতে পারবোনা। আমি আজই দেশে ফিরে যাচ্ছি। আমার হাতে অনেক কাজ মা। তুমি ছেলেটাকে নিয়ে খুঁশি হও বলে দেবকী একটা বোতল বের করলো। তারপর ছিপ খুলতেই সেখান থেকে একটা অবয়ব বের হল। দেবকী কিছু একটা ভেবে বলল,
—” মা, যাওতো দরজাটা খুলে দাও। কেউ একজন তোমার খোঁজে এসেছে।”
বিদ্যা কিছুটা অবাক হয়ে দরজা খুলতে চলে যেতেই দেবকী বলল,
—” এখন থেকে আপনার কাজ শুরু। আশাকরি, মেয়েটাকে সঠিক পথ দেখাবেন।”
কথাগুলো বলেই দেবকী অদৃশ্য হয়ে চলে গেলেন। এদিকে দরজা খুলেই টুইংকেলকে দেখে বিদ্যার বিশ্ময় যেন আকাশচুম্বী হলো। আন্টি আপনি?
টুইংকেল ভিতরে ঢুকে বলল,
—” দরজা বন্ধ করো।”
বিদ্যা দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিয়ে দেবকীকে ডাকতে এল। কিন্তু দেবকীকে দেখতে পেলোনা। মা মা বলে কয়েকবার ডাকলো কিন্তু দেখা পেলোনা তাকে। শেষে বিদ্যা কাঁদতে লাগলো। আপনি আমাকে না বলে চলে গেলেন?
টুইংকেল এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
—” যার যাবার সে চলে গেছে। তুমি যদি রেডী থাকো তাহলে আজই আমরা অভির কাছে রওনা দিব।”
বিদ্যা চোখের জল মুছে বলল,
—” মা যে বলল, কাল যাবেন।”
উনি পরিস্থিতি বুঝতে পারেনি। আজ রওনা দিলে পরে ভালো একটা অবস্থান নিতে পারবো। বিদ্যা আর কিছু না বলে টুইংকেলকে ভরসা করে ওর সাথে পাড়ি জমালো অভির দেশে।
তিনদিন সময় নিয়ে টুইংকেল বিদ্যাকে নিয়ে প্রথমে তার বাসায় গেল। বাসায় গিয়েই ইনাকে দেখতে পেল। টুইংকেলতো অবাক হয়ে গেল। ইনা তুমি এখানে?
ইনা দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
—” মম, তুমি কোথায় ছিলে? আমি অভিকে জিঙ্গাসা করেছিলাম কিন্তু ও কিছু বলেনি। শুধু বলেছে জলদি আসবেন।”
টুইংকেল মনে মনে বলল,
—” সত্যই অভি না থাকলে হয়ত আমি এখানে থাকতামনা। ওর ঋন আমি কোনদিনও শোধ করতে পারবোনা।”
ইনা এবার বিদ্যার দিকে চেয়ে হাই বলে বলল,
—” মম, বিদ্যাকে কেন এনেছ? অভির মা যদি জানতে পারে তাহলে আমাদের অবস্থা খারাপ করে ছাড়বে।”
সেটা পরে দেখা যাবে। আগে ওর রেস্টের প্রয়োজন। ওর খাবারের ব্যবস্থা করো।
ওকে মম বলে ইনা ওকে ভিতরে নিয়ে গেল। এরা অনেক অভিজাত। বিদ্যার পরিবারও অনেক বড়লোক। কিন্তু এদের সাথে তুলনা করলে একদম ফিকে হয়ে যাবে। সেদিনের মত রাত কাটালো। তারপরের দিনও অলস অবস্থায় কাটলো। আন্টিকে কিছু বললেই বলে এখনো সময় আসেনি। দুর বাবা, কখন তার সময় হবে। সময় যেন তার কাটছেইনা। মন শুধু বারবার বলছে, অভি যাব।
গভীর রাত, বিদ্যা ঘুমিয়ে ছিল ইনার পাশে। এমন সময় টুইংকেল বিদ্যাকে ঝাকিয়ে উঠালো। বিদ্যা ঘুমচোখে বলল,
—” এত রাত্রে কেউ কারো ঘুম ভাঙ্গায়!”
—“বরের কাছে যাবেনা?”
এবার বিদ্যার হুশ যেন ফিরলো। লাফ দিয়ে উঠে টুইংকেলকে চেঁপে ধরে বলল,
—” আমরা এখন অভি যাব?”
টুইংকেল শুধু ঘাড় নাড়িয়ে সায় দিল। ব্যাস হয়ে গেল। বিদ্যা দ্রুত সব কিছু পাকিং করতে লাগলো। টুইংকেল অবাক হয়ে গেল, বিদ্যার এমন কাজে। কোমড়ে হাত বেঁধে বিদ্যাকে প্রশ্ন করলো! এত জিনিস প্যাক করার কারন?
বারে, আমি অভির কাছে যাবোনা! দেশ থেকে আসার সময় ওর জন্য এগুলো এনেছিলাম। সেগুলো ওকে দিবোনা?
অভি তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করলেতো দিবে? তাছাড়া এত পাহারার মধ্য ওদের বাসায় ঢোকায় মুশকিল। কথাগুলো মনে মনে বলে বিদ্যার হাত থেকে সব কিছু নিয়ে বিদ্যাকে একটা হুডিওয়ালা মোটা কম্বল পড়ে দিয়ে রাতের আধারে বেরিয়ে পড়ল টুইংকেল। গাড়ী থেকে নেমে অনেক দুরে অবস্থান নিল তারা। টুইংকেল দুর থেকে দেখিয়ে দিল অভিদের বাসা। এত বড় বাসা? মাথায় হাত পড়লো বিদ্যার। এটা বাসা না প্রাসাধ! এত বড় বাসার ছেলে হয়ে ও আমাদের বাসায় সিম্পল জিবন-যাপন করতো! স্ট্রেঞ্জ…….!
টুইংকেল বিদ্যার হাতে পুরো বাসার নকশা দিয়ে দেখিয়ে দিল, কোথায় কি আছে? আর অভি কোন রুমে থাকে।
বিদ্যা খপ করে নকশাটা নিয়ে টুইংকেলকে বলল,
—” আন্টি, এবার আপনি বাড়ী যান। আমি সবকিছু এখন নিজে করতে পারবো।”
এদিকে টুইংকেলও জানেনা বিদ্যা একজন শক্তিশালী পিশাচ। অন্য দিকে বিদ্যাও জানেনা টুইংকেলও কোন সাধারন মানুষ নয়। তারা নিজেরা নিজেদের শক্তি কাজে লাগাতে পারছেনা। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে টুইংকেল বিদ্যাকে নিয়ে একদম বাসার কাছে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দিল ওটা অভির রুম। আনুমানিক ৪তলা হবে। এতটা উঁচুতে অভির রুম। বিদ্যার আর তর সইলোনা। টুইংকেল যখন আশেপাশের গার্ডদের উপর নজর রাখতে ব্যাস্ত তখনই বিদ্যা নিমিষেই অভির ব্যালকুনিতে পা রাখলো। তারপর আস্তে আস্তে পা টিপে অভির জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে, অভি ঘুমাচ্ছে। আহ্ কতদিন পর দেখলো তাকে। বিদ্যা কোন কিছু না ভেবেই অভির রুমে ঢুকে পড়লো। অভিকে চমকে দিতে যাবে এমন সময় অভির রুমে একটা কি যেন ধোঁয়াশার সৃষ্টি হতে লাগলো। বিদ্যা বুঝে গেল কারো আগমন ঘটছে। এখানেও এসব মায়ার কারবার? আমি থাকতে তোমার কোন ভয় নেই অভি বলেই বিদ্যার চোখ ধীরে ধীরে লাল হতে লাগলো।
বিদ্যা কেবল ওর মায়া জাগাতে শুরু করেছে অমনি অভি বিছানা থেকে উঠেই বিদ্যার মুখ চেঁপে ধরে একদম পর্দার আড়ালে চলে গেল। বিদ্যা চোখ খুলতেই ওর শক্তি গিয়ে অভিকে আঘাত করলো। অভি সাথে সাথে বিদ্যাকে বুকের ভিতর চেঁপে ধরলো। আর মুখে আঙ্গুল পুরে দিয়ে বলল,
—“শশশশপ।”
[ চলবে……..]
বিদ্রঃ রিভিশন দেওয়া হয়নি। ভুলক্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।আগামী পার্ট ৬ তারিখে আসবে।
ওয়েবসাইট থেকে সরাসরি পড়তে পারেনঃ https://nafisarkolom.com/2020/12/sidur-suddhi-44/