অনুভবে আজো তুমি🍁🍁 পর্ব-২৩

0
1433

#অনুভবে_আজো_তুমি🍁🍁
পর্ব-২৩
ফাবিহা নওশীন

ফায়াজ মেহেরের দিকে চেয়ে হেসে হেসে বললো,
–ডাকাত এসেছিলো,,,হাত কেটে দিয়ে চলে গেছে।
মিহু উত্তেজিত হয়ে বললো, ডাকাত!!
মেহের ফায়াজের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে মিহুকে বললো,
মিথ্যে বলছে।তুইও কি বোকা।

–তাহলে কিভাবে?

ফায়াজ আবারো শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,
–দুজনে ঝগড়া করে কোপাকুপি করেছি।

মিহু বললো,আবারো মিথ্যা।আপি আর ঝগড়া নো ওয়ে।আমি ছোটবেলা থেকে অনেক ট্রাই করেছি আপির সাথে ঝগড়া করার।কিন্তু কাজ হয়নি।এখন সত্যি সত্যি বলুন কি হয়েছে??আপনার হাত তো সিরিয়াস মনে হচ্ছে।আপির হাতে কম দেখা যাচ্ছে।
(মেহেরের কাটা জায়গা অতটা গভীর না হওয়ায় তাড়াতাড়ি শুকিয়ে গেছে।তাই দুটো ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগানো)

–আসলে আমি রাতের বেলায় অফিস থেকে বাসায় ফিরছিলাম অন্ধকারে দেখতে না পেয়ে গ্লাস,জগের উপর পড়ে যাই।আর তোমার আপু শব্দ পেয়ে আমাকে উদ্ধার করতে এসে আহত হয়।

–আচ্ছা।

ফায়াজ বললো,
–এসব বাদ দেও।তোমাদের কথা বলো।তা আহিল তুমি কি করো?তোমার ফ্যামিলিতে কে কে আছে?

–জ্বী ভাইয়া মাস্টার্স শেষ করে বাবার ব্যবসায় দেখছি।বড় আপু ম্যারিড।আমি আম্মু,আব্বু এই আমার পরিবার।

–মিহুর বাবা এ সম্পর্কে রাজি না হলে তুমি কি করবে?

–ভাইয়া এসব বলবেন না।এমনিতে অনেক ভয়ে আছি।আপনারাই এখন আমার আশা ভরসা।আমি আপনাদের এটা বলতে পারি আমি মিহুকে অনেক সুখে রাখবো।আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো।আমি ওকে অনেক ভালোবাসি।

–তোমাকে আমাদের পছন্দ হয়েছে।আমরা তোমাদের পাশে আছি।আগামীকাল মিহুদের বাসায় গিয়ে বাবার সাথে কথা বলবো।দেখি ওনি কি বলেন।

মেহের বললো,
–হ্যা,তোমরা চিন্তা করোনা।বাবা যদি রাজি হয় ভালো না হলে অন্য ব্যবস্থা করবো।

পরেরদিন ফায়াজ আর মেহের ওদের বাড়িতে উপস্থিত।বিয়ের পর এই প্রথম বার ও বাড়িতে গেলো মেহের।যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো না কিন্তু মিহুর জন্য যেতে হলো।
মেহেরের মা জামাইয়ের আপ্যায়নে ব্যস্ত।আর মেহেরের দম বন্ধ হয়ে আসছে কখন বাবার সাথে কথা বলে নিজের বাসায় ফিরবে।আজ কেন জানি ওর অতীতের স্মৃতিগুলো বারবার চোখের কোনে ভেসে উঠছে।মনে হচ্ছে এ চার দেয়াল আবারো মেহেরকে আটকে রাখবে।

ফায়াজ একাই শ্বশুর মশাইয়ের সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ফায়াজ আর মেহেরের বাবা একসাথে বসে কফি খাচ্ছে।ফায়াজ কিভাবে কথাটা তুলবে বুঝতে পারছেনা।
–বাবা আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই।
মাহমুদ জামান হাসি মুখে বললো,
–হ্যা,বাবা বলো কি বলতে চাও?
(তার ফায়াজকে খুব পছন্দ।পছন্দের অনেক কারণ আছে তার মধ্যে অন্যতম অবিবাহিত,সুন্দর,স্মার্ট,শিক্ষিত ছেলে তার বিধবা মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে।আর দ্বিতীয়ত ছেলে খুবি অবস্থাশালী)
–মিহুকে নিয়ে।শুনেছি আপনি ওর জন্য ছেলে দেখছেন?
–হ্যা,আমার বিজনেস পার্টানের ছেলে।
এখনো ফাইনাল করি নি তাই তোমাকে বলা হয়নি।
–সেটা কোনো সমস্যা না।আপনি নিশ্চয়ই ওর খারাপ চাইবেন না।কিন্তু আমি মিহুর ইচ্ছে নিয়ে কিছু বলতে চাই।ও আমার ছোট বোন।ওর উপর আমার অধিকার আছে।
মাহমুদ জামান কিছুটা চিন্তিত ভংগীতে ফায়াজের দিকে তাকিয়ে আছে।
–বাবা বুঝলাম না।
–মিহু একটা ছেলেকে পছন্দ করে।আমি চাইছিলাম ওর পছন্দটা আপনি একবার যাচাই করে দেখুন।তারপর সিদ্ধান্ত নিন।মেয়ে যদি তার পছন্দের জায়গায় সুখি থাকে তবে আমাদের আপত্তি থাকার কথা নয়।
মাহমুদ জামান মেয়ের জামাইয়ের মুখ রাখতে জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
–আচ্ছা,আমি ভেবে দেখবো।তারপর তোমাদের জানাবো।

মেহের অধিক আগ্রহের সঙ্গে ফায়াজের জন্য নিজের রুমে অপেক্ষা করছে।ফায়াজকে দেখে হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
–কি হলো?আব্বু কি বললো?
–তোমার আব্বুর ভাবসাব ভালো মনে হলো না।বললো পরে ভেবে জানাবে।
–জানতাম বাবা মানবেনা।তারপর আপনার সোর্স কি বলে?আহিল কেমন?
–ফার্স্টক্লাস ছেলে।কোনো খারাপ রেকর্ড নেই।
–তাহলে আব্বুর কথা বাদ দিয়ে প্ল্যান বি এক্সিকিউট করি।
–কাল পর্যন্ত দেখি।
মেহের আর কিছু বললো না।ফায়াজ মেহেরের বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো।বারান্দা দিয়ে চোখ গেলো সোজা রাস্তায়।যেখানে ফায়াজ এসে মেহেরকে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো।ভার্সিটি অফ থাকলে ফায়াজ মেহেরকে দেখার জন্য চলে আসতো।এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ফায়াজ।
ওরা বিকেলে খেয়ে বাসায় ফিরে গেলো।না এখানে থাকার ইচ্ছে ফায়াজের আছে না মেহেরের।

রাতেরবেলা-
ফায়াজ ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছে।
–শুনোন।
–হুম।
–আমি আগামীকাল আহিলের ফ্যামিলির সাথে কথা বলতে যাবো।
ফায়াজ ল্যাপটপ বন্ধ করে মেহেরের দিকে চেয়ে বললো,
–তুমি মানে?আমি,,
–আমি এসবের মধ্যে আপনাকে জড়াতে চাই না।
–আমাকে জড়াতে চাওনা মানে,,আমি কেউ না?মিহু আমাকে,,
মেহের নরম গলায় বললো,
–আপনি যা ভাবছেন তেমন নয়,আপনাকে আব্বু খুব পছন্দ করে।আমি চাইনা আমাদের দুবোনের জন্য আব্বু আপনাকে ভুল বুঝুক।আপনার সাথে আব্বুর সম্পর্ক খারাপ হোক।আমরা যে কাজ করতে চাইছি তাতে আমার আর মিহুর উপর বাবা প্রচন্ড অসন্তুষ্ট হবে।আপনার উপর ও যদি হয়,,তাহলে আব্বু পুরো শূন্য হয়ে যাবে।আর আমিও আপনাকে আব্বুর চোখে দোষী হতে দিতে চাইনা।প্লিজ।

ফায়াজ না চাওয়া স্বত্তেও মেহেরের কথা বিবেচনা করে বললো,ঠিক আছে যেমনটা ভালো মনে করো।

পরেরদিন মেহের আহিলের বাবা-মার সাথে কথা বলে ওনাদের সম্মতি নেয়।তারপর মেহের,আহিল,মিহু মিলে প্ল্যান করে কিভাবে কি করবে।
বাসায় ফিরে ফায়াজকে জানায়।ফায়াজ অতি আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করছিলো কি হচ্ছে জানার জন্য।মেহের আসতেই ওর সামনে গিয়ে দাড়ালো।
–কি হলো।
–আহিলের বাবা-মা রাজি হয়েছেন।যদিও প্রথমে ওনারা এভাবে বিয়ের জন্য রাজি হন নি।আমি পরিস্থিতির কথা বলতেই ছেলের খুশির জন্য রাজি হয়ে যায়।আগামীকাল মিহু ভার্সিটির জন্য বেরিয়ে যাওয়ার সময় একবারেই চলে আসবে।ও, আহিল আর ওর বান্ধবীরা মিলে বিয়ের সপিং করে আমাদের বাসায় চলে আসবে।তারপর আহিলের কয়েকজন বন্ধু কাজি নিয়ে চলে আসবে।আমি খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেছি।আপনি শুধু বাসায় থাকবেন।আপনার সমস্যা হবে না তো?

–না,,কিন্তু আমার কেমন জানি লাগছে।কাজটা কি ঠিক হচ্ছে?তোমার আব্বু তোমার উপর রেগে যাবেন।যতটা না রাগ মিহুর উপর করবে তার চেয়ে বেশি তোমার উপর,,,

–করুক,তাতে আমার কিছু আসে যায়না।আমার কাছে আমার বোনের ভালো থাকাই যথেষ্ট।আব্বু আমাকে তার ফাইনাল ডিসিশন জানিয়ে দিয়েছে তার বিজনেস পার্টনারের ছেলের সাথেই মিহুর বিয়ের কথা পাকা করবে।তাই কিছু করার নেই।আব্বু হয়তো এখন রাগ করে থাকবে কিন্তু একদিন না একদিন ওদের মেনে নিবে।

–আর তুমি,,,

–আমাকে,,ক্ষমা করলেও খুশি না করলেও খুশি।

–তুমি তোমার আব্বুকে এতো অপছন্দ করো কেন?

মেহের একটু হেসে জবাব দিলো,
–কি বলো কোনো মেয়ে তার বাবাকে অপছন্দ করে।আমি শুধুমাত্র এখন মিহুর কথা ভাবছি।আমি জানি অন্যায় করছি।আব্বুর কাছে আমি এর জন্য ক্ষমা চেয়ে নিবো।

–তুমি যাই বলো আমার মনে হয় তোমার আব্বুর উপর তোমার কোনো ক্ষোভ আছে।আমার সাথে বিয়ে দিয়েছে তাই?

মেহের চট করে বললো, না,,তা হবে কেন?
এসব আপনার মনের ভুল।
বলেই মেহের ফ্রেশ হতে চলে গেলো।
ফায়াজ আজকাল মেহেরের প্রতিটি কথার পেছনে হাজারো অভিযোগ আর অভিমান খোজে পায়।

মিহু বান্ধবীদের নিয়ে চলে এসেছে।এসেই মেহেরকে জড়িয়ে কান্না।
–এই পাগল মেয়ে কাদছিস কেন?
–আপি আমি জানি আমি ঠিক করছিনা কিন্তু তুমি তো আব্বুকে চিনো।আমার কিছুই করার নেই।আব্বু অনেক কষ্ট পাবে,তোমার উপর ও রাগ করবে।তবে প্রমিস আমি সব ঠিক করে দিবো।
–মিহু,তোকে এখন এসব ভাবতে হবেনা।আব্বু ঠিক মেনে নিবে।তুই এখন ফ্রেশ হয়ে খাওয়া শেষ করে বস।মেকাপ আর্টিস্ট চলে আসবে।

মেহের মিহু,মিহুর বন্ধুদের আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।আহিলের কিছু বন্ধু চলে এসেছে।বাকিরা কাজি নিয়ে আসবে।সবাইকে আপ্যায়ন করছে।মিহু সাজতে বসে গেছে।ওর বান্ধবীরাও সেখানেই সাজগোছ করবে।মিহু মেহের কেউ বলেছে সাজতে কিন্তু মেহেরের এক কথা ও ভূত সাজবে না।

ফায়াজ আহিল আর ওর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে।মেহের নিজে নিজেই রেডি হচ্ছে।ডার্ক গ্রিন শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে অলংকার,খোপা করা চুল,হালকা মেকাপ,কাজল,লিপস্টিক আর কপালে টিপ।টিপ পড়া যদিও মেহেরের পছন্দ না তবে ফায়াজের অনেক পছন্দ তাই পড়ছে।মেহেরের এখন আর আগের মতো সাজতে ভয় লাগেনা।বরং অনেক ভালোলাগে।রেডি হয়ে তাড়াতাড়ি করে রুম থেকে বের হতে গিয়ে শাড়িতে বেজে গেলো।নিচে পড়ে যাবে তখনই মনে হচ্ছে কেউ ধরে ফেলেছে।

–আরে,আরে,,বোনের বিয়ের খুশিতে হাত-পা,কোমড় ভেঙে ফেললে চলবে?তখন আমাদের কে দেখবে?এমনিতেই আমার এক হাত অচল।
কথাগুলো বলেই ফায়াজ মেহেরকে সোজা করে দাড় করালো।তারপর নিজের কাটা হাত চেপে ধরলো।মেহের বুঝতে পারলো ফায়াজ ওকে ধরতে গিয়ে হাতে ব্যথা পেয়েছে।
মেহের ফায়াজের হাত ধরে বললো,
–ব্যথা পেয়েছেন?
ফায়াজ কেমন একটা স্মেল পাচ্ছে।চোখ তুলে মেহেরের দিকে চাইলো।মেহেরকে দেখে বড়সড় ধাক্কা খেলো।মেহেরকে এতক্ষণ ভালো করে দেখেই নি।মনে হচ্ছে ওর হার্টবিট কয়েকটা মিস হয়ে গেলো।ফায়াজ হ্যাংলার মতো মেহেরকে দেখছে।মেহের ফায়াজের সাড়া না পেয়ে ওর দিকে তাকালো।ফায়াজ অপলক দৃষ্টিতে মেহেরের দিকে চেয়ে আছে।এমন দৃষ্টি মেহেরের ভিতরে ধুকধুকানি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ফায়াজ বা হাতে মেহেরের কোমড় টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।মেহেরের দুহাত ফায়াজের বুকে গিয়ে ঠেকলো।ফায়াজের কাটা ডান হাতের দু আংগুল দিয়ে মেহেরের কপালের ববি হেয়ারগুলো সরাচ্ছে।মেহের ফায়াজের স্পর্শে চোখ বন্ধ করে নিলো।ফায়াজ আচমকা মেহেরের ঠোঁটের নিচে তিলে শব্দ করে চুমু খেলো।
মেহের চোখ খোলে চোখ বড়বড় করে রাখলো।পলক নিতেও ভুলে গেছে।হাত-পাও নড়ছেনা।ফায়াজ বাকা হেসে মেহেরকে ছেড়ে দিলো কিন্তু মেহের নড়তেই পারছেনা।লজ্জায় কুকড়িয়ে যাচ্ছে।সেই প্রথম দিনের অনুভূতি।ভার্সিটিতে যেদিন মেহের প্রথম শাড়ী পড়ে সেজেগুজে গিয়েছিলো।ফায়াজ এভাবেই ওকে দেখে থমকে গিয়েছিলো।আর টুপ করে ঠোঁটের নিচে চুমু খেয়েছিলো।
মেহের তিলের উপর হাত রেখে নিচে যাচ্ছে।অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছে।কেননা ফায়াজের ছোয়ায় কোনো রাগ,ঘৃণা,হিংস্রতা ছিলো না।শুধু ভালোবাসা।
মেহের সবার সাথে বসে কথা বলছে কিন্তু ওর মন এখনো সেখানেই পড়ে আছে।হটাৎ ওর চোখ গেলো সিড়ির দিকে।ফায়াজ উপর থেকে নামছে।গায়ে মেরুন রঙের পাঞ্জাবি,বুকের দুটো বোতাম খোলা।চুলগুলো বরাবরের মতোই আছড়ে পড়ছে।হাতা ফোল্ড করতে করতে নামছে।মেহের আরেক দফা ক্রাশ খেলো।
মেহের আড়চোখে ফায়াজকে দেখছে আর ভাবছে,ভাগ্যিস এখানে তেমন কোনো মেয়ে নেই মিহুর দুই বান্ধবী ছাড়া নয়তো রমনীরা আমার বরকে দেখে ফিদা হয়ে সিধা পড়ে গড়াগড়ি খেতো।
তারপর ফায়াজ মেহেরের পাশে এসে বসে পড়ল।এতে মেহেরের ধুকধুকানি আরো বেড়ে গেলো।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here