#স্নিগ্ধ_চাহনি
#পর্বঃ২
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত
মুগ্ধ হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষন মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষনেই বিস্ময় ভাব কাটিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়। আবারও হাঁটা শুরু করে। মৃন্ময়ী তার পাশের মানুষটার দিকে দৃষ্টি দিয়ে ক্ষীণস্বরে জিজ্ঞেস করল-
‘আপনার নাম!’
মুগ্ধ অপ্রস্তুত হয়ে পরলো। খানিক্ষন সময় নিয়ে নিম্ন স্বরে থেমে থেমে বলল-
‘মুগ্ধ। আমার নাম মুগ্ধ। এত রাত করে বাসায় ফিরছেন আপনার বাসার কেউ চিন্তা করবে না!’
মৃন্ময়ীর মনে ক্ষীন সন্দেহ ছিল লোকটা হয়তো তাকে চেনে। কিন্তু এই প্রশ্ন শুনে নিমিষেই তার সন্দেহ কেটে গেছে।
‘আমি একাই থাকি। আমার বাবা-মা নেই।’
মৃন্ময়ীর সহজ ভঙ্গিতে বলা এই ছোট কথাটা শুনেই মুগ্ধ’র বুক ধক করে কেঁপে উঠল। কিন্তু মৃন্ময়ীর বলার ভঙ্গিতে তেমন কোনো খারাপ লাগার চিহ্ন দেখা গেল না। মনে হচ্ছে সে এই বিষয়টা খুব সহজে মেনে নিয়েছে। হয়তো এইসব প্রশ্ন শুনে আর উত্তর দিয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।
‘এই তো আমার বাসা। আমি আসছি। ভালো থাকবেন। আর হ্যাঁ আবারও ধন্যবাদ।’
মৃন্ময়ী কথা গুলো বলেই আবারও সরু চোখে আশেপাশে তাকাল। এবারও কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করছে। পরমুহূর্তেই ডান পাশের দোতলা বাড়ির ভেতরে চলে যায় মৃন্ময়ী। মুগ্ধ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাড়িটার দিকে। গেইটের ডান পাশে বড় একটা নেইম-প্লেট লাগানো। তাতে খুব সুন্দর করে বাংলা বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘মৃন্ময়ীর ইচ্ছে তরূ’। কেন যেন মনে হচ্ছে এই নাম রাখার পেছনে কোনো উদ্দেশ্য কিংবা কারণ আছে। মুগ্ধ নির্বিকার ভঙ্গিতে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে নিজের বাসার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। আর দশ-বিশ মিনিট হাঁটলেই হয়তো তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাবে।
মৃন্ময়ী সিড়ি বেয়ে দোতলায় আসলো। সব সময়ের মতো আজও দরজার কাছে খাবারের পার্সেল রাখা। মৃন্ময়ী তপ্ত শ্বাস ফেলে। খাবারের পার্সেল গুলো হাতে নিয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। নির্লিপ্ত চোখে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজের ক্লান্ত শরীরটা এক নজর দেখে নেয়। অলস ভঙ্গিতে ওয়াশরুমে গিয়ে ঝর্ণা চালু করে। ঝর্নার পানিতে তার সকল সাজগোজ ধুয়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে। গায়ে জড়ানো লাল শাড়িটা খুলে ছুড়ে ফেলে দিল অন্য পাশে। ঝর্নার নিচে বসে দু হাটুতে মুখ গুজে অঝোর কান্না করতে লাগলো। দু’হাতে মুখ চেপে ধরে আর্তনাদ করছে। একজন মানুষকে খুব করে কাছে চাইছে এই মুহুর্তে। কিন্তু সেই মানুষটা এখন তার পাশে নেই। এই মুহুর্তে তাকে আগলে নেওয়ার মতো কেউ নেই। তাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলানোর মানুষটা তার কাছে নেই। আবারও কষ্টের তালিকায় আরেক ধাপ এগিয়ে গেল সে। কষ্টে পরিমাণ কমার বদলে যেন দফা দফায় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দশটা বেজে পাঁচ মিনিট। বাগানের ঠিক মাঝখানের দোলনায় বসে আছে মৃন্ময়ী। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। কান্নার ফলে চোখ মুখ ফুলে স্নিগ্ধতায় মোড়ানো এক মোহনীয় রূপ এসেছে তার চেহারায়। উন্মুক্ত চুল গুলো থেকে টপটপ করে বৃষ্টির মতো পানি ঝরে পরছে। দোতলায় ছোটখাটো একটা ফ্ল্যাট, আর বাকি খালি জায়গাটুকুতে বিশাল এক বাগান করা। হলদেটে বাতির আলোতে রাতের আঁধার যেন স্পর্শ করতে পারছে না মৃন্ময়ীকে। সে এই বাগানটার নাম দিয়েছে ‘দুঃখবিলাসী’। তার একাকী জীবনের বিশাল এক জায়গা জুড়ে আছে দুঃখবিলাসী বাগান।
আচমকাই নিচ থেকে কিছু একটা পরে যাওয়ার শব্দ আসল। মৃন্ময়ী বেরিয়ে আসল তার ভাবনার জগৎ থেকে। রেলিঙের কাছে এসে ঝুঁকে নিচে শব্দে উৎসটা খুজতে চেষ্টা করল৷ কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। মৃন্ময়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। গলা খেকরিয়ে কন্ঠস্বর পরিষ্কার করে স্পষ্ট গলায় বলল-
‘আমি জানি তুমি এখানেই আছো। চুপচাপ উপরে চলে আসো।’
মৃন্ময়ী কথাটা বলেই আগের জায়গায় এসে বসল। তার ঠিক দু মিনিটের মাঝেই ছাদে এসে উপস্থিত হলো ঝাকড়া চুলের এক সুদর্শন যুবক। তার ফর্সা উজ্জ্বল ত্বকে খয়েরী রঙের ফতুয়াটা দৃষ্টি কাড়ার মতো ফুটে আছে। ছেলেটা ডান হাতে তার ঝাকড়া চুল গুলো গুছিয়ে নেয়। আঁকাবাঁকা দাঁত গুলো বের করে বোকা বোকা কন্ঠে বলল-
‘আপনি কেমনে জানলেন আমি নিচে আছি!’
মৃন্ময়ী চোখ ছোট ছোট করে তাকাল রঞ্জনের দিকে। শক্ত গলায় বলল-
‘তোমার ধ্রুব ভাইজানকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। আর তুমি তো তার-ই কথায় নেচে বেড়াও সারাক্ষণ।’
রঞ্জন দাঁত কেলিয়ে হাসলো। মৃন্ময়ী হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে ক্লান্ত গলায় বলল-
‘ভেতর থেকে টেবিল নিয়ে এসে বসো এখানে।’
রঞ্জন মৃন্ময়ীর কথা মতো ভেতর থেকে একটা টেবিল এনে বসলো।
‘কখন থেকে লেগেছো আমার পিছু?’
‘হারামজাদা বদমাশটায় যখন আপনার পথ আটকাইছে তার কিছুক্ষন আগেই।’
‘তোমার ভাইজানকে নিশ্চয়ই ফোন করে সব বলে দিয়েছ!’
রঞ্জন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। মৃন্ময়ী ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে। এই ছেলে ঝড়ের গতিতে চলে তা তার আগে থেকেই জানা।
‘পড়তে বসেছিলে আজ?’
রঞ্জন উপর নিচে মাথা দুলাল। মৃন্ময়ী এবার ক্ষিপ্ত হয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল-
‘সামনে এইচএসসি এক্সাম। টেস্টের রেজাল্টে যদি কোনো উনিশ বিশ দেখি তাহলে তোকে আর তোর ভাইজানকে পিটিয়ে পিঠে ছাল তুলব মনে রাখিস।’
‘আচ্ছা মনে থাকবে।’
রঞ্জন আবারও দাঁত কেলিয়ে হাসলো। কিছুটা সময় চুপ থেকে মিহি কন্ঠে জিজ্ঞেস করল-
‘আপু আপনার কি মন খারাপ?’
‘নাহ আমি ঠিক আছি। তুমি বাসায় চলে যাও। দারোয়ান আংকেল আছে আর নিচের ফ্ল্যাটেও মানুষ আছে তাই আমাকে নিচে চিন্তা করতে হবে না। আমি একা থাকতে পারবো। তোমার ধ্রুব ভাইজান ফোন করলে বলবা আমি বলেছি তোমাকে চলে যেতে। আর আমি ঠিক আছি।’
রঞ্জন এখনো বসেই আছে। মৃন্ময়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-
‘আমি ঠিক আছি রঞ্জন। তুমি বাসায় যাও। বাসায় যেয়ে একঘন্টা পড়বে তারপর ঘুমাবে মনে থাকে যেন।’
রঞ্জন উঠে দাঁড়ালো। বিনীত ভঙ্গিতে বলল-
‘আচ্ছা ঠিক আছে যাচ্ছি। আপনি সাবধানে থাকবেন। আর কোনো দরকার হলে সাথে সাথেই আমাকে কল দিয়েন।’
মৃন্ময়ী হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। রঞ্জন কিছুক্ষন মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে চলে যায়।
———————
‘খালা আফনান ভাইকে নিয়ে কানাডা ফিরে গেছে। গতকাল বিকেলের ফ্লাইটে চলে গেছে।’
মৃন্ময়ী বই থেকে দৃষ্টি তুলে অর্পির দিকে তাকাল। অর্পিকে বেশ উত্তেজিত লাগছে। চোখেমুখে ভয়াবহ উত্তেজনা। তার চেয়েও বেশি দুঃখী দুঃখী গলায় বলল-
‘আমি ভাবতেও পারিনি খালা এমনটা করবে।’
মৃন্ময়ী কিছু বলল না। আবারও বইয়ের মাঝে মুখ গুজালো। অর্পি এবার খানিকটা বিরক্ত হলো। চোখমুখ কুচকে তাকিয়ে আছে মৃন্ময়ীর দিকে। ছোঁ মেরে মৃন্ময়ীর হাত থেকে বইটা নিয়ে নেয়। বিরক্তিমাখা কন্ঠে বলল-
‘তুই চুপ করে আছিস কেন! আর কাল থেকে তোর ফোন অফ কেন! জানিস কতটা চিন্তায় ছিলাম আমি। ভাইয়া আর খালা যাওয়ার আগে আমাদের বাসায় এসেছিলেন। তখনই ভাইয়া সুযোগ বুঝে আমাকে সব বলেছে। ভাইয়া নাকি কাল তোকে বিয়ে করবে বলেছিল। কিভাবে যেন খালা জেনে গিয়েছিল বিয়ের কথা। তাই ভাইয়াকে নানান ভাবে কথা বলে মাথা হাত রেখে কসম কাটিয়ে কানাডা যাওয়ার জন্য ভাইয়াকে রাজি করায়। আর খালা তো যাওয়ার সময় আমাকে একপ্রকার হুমকি দিয়ে গেছেন আমি যেন ভাইয়ার সাথে তোর বিষয়ে কোনো প্রকার কথা না বলি। আম্মুর কাছেও আমার নামে বিচার দিয়ে গেছে। জানিস আম্মুও কত করে খালাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু খালা তো নাছড়বান্দা কারও কথাই শুনতে রাজি না। আস্তো এক ঘাড়ত্যাড়া মহিলা।’
(মৃন্ময়ীর বেস্ট ফ্রেন্ড অর্পি। আফনান! সম্পর্কে অর্পির খালাতো ভাই। আজ থেকে এক বছর আগে অর্পির বার্থডে’তে প্রথম দেখা হয়েছিল আফনানের সাথে। মৃন্ময়ীকে প্রথম দেখেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিল আফনান। যাকে বলে প্রথম দর্শনেই ভালোবাসা। মৃন্ময়ী বরাবরই চুপচাপ শান্তশিষ্ট স্বভাবের মেয়ে ছিল। প্রেম ভালোবাসার প্রতি কোনো আগ্রহ না থাকলেও দিন দিন আফনানের পাগলামিতে তার মায়ায় জড়িয়ে যায়। খুব ভালোই চলছিল তাদের প্রেম। কিন্তু একদন হঠাৎ করেই আফনানের মা তাদের সম্পর্কের কথা জেনে যায়। তিনি এই সম্পর্কের বিরুদ্ধে ঘোর আপত্তি জানান। তার একমাত্র কারণ হলো মৃন্ময়ীর বাবা-মা নেই। বাবা মা নেই এরকম ফ্যামিলির মেয়েকে তিনি কিছুতেই নিজের পুত্রবধূ করতে রাজি নন। ঠিক তার কিছুদিন পরেই আফনান মৃন্ময়ীকে বিয়ে জন্য রাজি করাতে উঠে পরে লাগে। মৃন্ময়ী কোনো মতেই বড়দের অমতে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিল না। তবুও আফনানের আকুতিভরা কথায় রাজি হয়ে যায়। বিয়ে নিয়ে একটা বড়সড় ঝামেলা হবে মৃন্ময়ী এই বিষয়ে কিছুটা হলেও অবাগত ছিল।)
‘অদ্ভুত তো! তুই কথা বলছিস না কেন! আসার পর থেকেই চুপ করে বসে আছিস। আমি বুঝতে পারছি তোর পরিস্থিতি কিন্তু তাই বলে কি কথা বলবি না আমার সাথে?’
অর্পির ঝাঁঝালো কণ্ঠে মৃন্ময়ী মলিন হাসলো। নরম গলায় বলল-
‘এসব কথা শুনতে ভালো লাগছে না অর্পি। প্লিজ.. ‘
অর্পি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। উদাসীন ভঙ্গিতে বলল-
‘আচ্ছা আচ্ছা আর বলবো না এসব। কিন্তু দয়া করে চুপ করে থকিস না। আমার সাথে অন্তত কথা বল।’
‘ওকে, কিন্তু এখন চুপ থাক। টিচার আসবে।’
মৃন্ময়ীর কথা মতো অর্পি চুপ করে বসে রইল। মৃন্ময়ীর এমন নিস্তব্ধতা তার কাছে মোটেও ভালো লাগছে না। আহত দৃষ্টিতে মৃন্ময়ীর দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে গোমড়া মুখে ক্লাসের দরজার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। টিচার আসার অপেক্ষা করা ছাড়া এই মুহুর্তে আর কোনো কাজ তার নেই। আজ যেন সময় একদমই যাচ্ছে না।
অর্পি তার গাড়ি নিয়ে চলে আছে। মৃন্ময়ী একা একা অলস ভঙ্গিতে হেঁটে ভার্সিটির গেইট থেকে বের হলো। কোনো কিছুতেই যেন তার মন টিকছে না। শুধু শুধুই কান্না করতে ইচ্ছে করছে। আফনানের জন্য এমনটা হচ্ছে কিনা তা সে জানে না। তবে তার কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
‘তরূ..’
খুব কাছের, খুব চেনা একজন মানুষের কন্ঠ। মানুষটার দেওয়া ভালোবাসার নাম তরূ। মৃন্ময়ী ঝাপসা চোখে পেছন ফিরে তাকাল। হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে মানুষটা। ঠোঁটের কোণে অমায়িক হাসি। মানুষটাকে দেখেই মৃন্ময়ীর চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পরল নোনাজল। দু’হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকছে মৃন্ময়ীকে।
চলবে…
[অল্প পর্বের ছোট গল্প হবে এটা। জানি না কেমন হচ্ছে। তবে আশা করি ভালো লাগলে রেসপন্স করবেন। সবাইকে ধন্যবাদ আর ভালোবাসা।]