#হৃদমাঝারে পর্ব-৬
#দেবারতি_ধাড়া
মাঝে কেটে গেছে একটা মাস। এখন মাঝে মাঝেই জিয়া আর আয়ান ওই ক্যাফেটায় দেখা করে। এছাড়াও জিয়া যেখানে যেখানে ফটোগ্রাফির জন্য যায়, সেখানে সেখানে আয়ানও যায় ওর সাথে। কখনও পাহাড়ের, কখনও ঝর্নার, কখনও প্রকৃতি, আবার কখনও বা সুন্দর সুন্দর পাখির ছবি তোলে জিয়া। কখনও কখনও আবার আয়ানেরও ছবি তোলে দু-একটা। আজও সেরকমই একটা জায়গায় ফটোগ্রাফি করতে গিয়েছিলো জিয়া। সাথে আয়ানও ছিলো। তাই ফেরার সময় জিয়া আয়ানকে ওর ফ্ল্যাটের সামনে নামিয়ে দিয়ে গেলো। ফ্ল্যাটে ঢোকার সময়ই আয়ানের ফোনে ওর মায়ের কল এলো। ফোনটা পকেট থেকে বের করে মায়ের নাম্বার দেখে দরজার বাইরে দাঁড়িয়েই কলটা রিসিভ করে কানে দিয়ে আয়ান বললো,
-হ্যাঁ মা বলো? তুমি হঠাৎ এইসময় কল করলে? কিছু হয়েছে নাকি?
-তোর কলেজ কবে ছুটি পড়বে রে বাবান?
-কেন মা? হঠাৎ আমার কলেজের ছুটির কথা জিজ্ঞেস করছো যে?
-আরে বাবা, তুই বলনা?!
-এই তো আর দু-একদিন পরেই ছুটি পড়ে যাবে হয়তো। কিন্তু কেন? শোনোনা মা, বলছি যে এবারের কলেজের ছুটিতে আমি বাড়িতে ফিরতে পারবো না।
-সেকী! ফিরতে পারবি না মানে?! তোকে তো এবারে কলকাতায় ফিরতেই হবে বাবান! আর বেশ কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়ে ফিরতে হবে!
-বললাম তো, এবারে আমি ফিরতে পারবো না। এখানে আমার অনেক কাজ আছে! আর তাছাড়া এখন ছুটি নেওয়া তো কোনোভাবেই সম্ভব নয়! কলেজ খোলার পর সামনেই স্টুডেন্টদের এক্সাম আছে।
-তোকে তো এবারে আসতেই হবে বাবান! এখানে একটা জরুরী কাজ আছে। আর তাছাড়া আমার শরীরটাও কদিন ধরে একদম ভালো যাচ্ছে না।
-কেন মা? কী হয়েছে তোমার? কী অসুবিধা হচ্ছে তোমার শরীরে? বলো আমায়?
-তোকে আর কী বলবো? তোর তো আমার কাছে আসার জন্য হাতে কোনো সময়ই নেই! তোর কাছে তো তোর কাজটাই আগে! ছাড়! বাদ দে তুই। আমার কথা আর তোকে ভাবতে হবে না। শুধু আমার যদি কিছু হয়ে যায়, তখন অন্তত একটিবারের জন্য হলেও আসিস। রিমলি তো আর একা হাতে সবটা সামলাতে পারবে না! রাখলাম আমি!
-এসব কী বলছো তুমি? মা শোনো.. আমার কথাটা তো একটু শোনো… হ্যলো মা! হ্যালো…
ততোক্ষণে ওপার থেকে কলটা কেটে দিয়েছেন বাসন্তীদেবী। আয়ান ফোনটা হাতে নিয়েই ফ্ল্যাটের চাবিটা পকেট থেকে বের করে দরজাটা খুলে ভিতরে ঢুকলো। ঘরে ঢোকার পর দু-তিনবার ধরে মাকে কলও করলো আয়ান, কিন্তু বাসন্তীদেবী আর কল রিসিভ করলেন না। উনি ফোনটা কেটে দিয়েই হেসে গড়িয়ে পড়ে রিমলিকে বললেন,
-এবার মনে হচ্ছে কাজটা হয়েই যাবে, বুঝলি রিমলি?
-তোমাকে তো আমি বললামই মা। তুমি শুধু দাদাকে একটু ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করো। তারপর দেখবে, দাদা আসবে না তো ওর ঘাড় আসবে!
-তোদের মতো কী আর অতশত আমি বুঝি বাপু? তোরা সব আজকালকার ছেলেমেয়ে! এইসব টেকনিক আমরা বুঝি না। এই দেখ রিমলি, তোর দাদা আবার ফোন করছে! দাঁড়া একবার ফোনটা ধরেই নাহয় দেখি কী বলতে চাইছে…
-এই না না মা! তুমি এখন একদম কলটা রিসিভ করবে না। আগে দাদাকে একটু চিন্তা করতে দাও তোমার জন্য, তারপর কল রিসিভ করবে। সেরকম হলে আজ আর তুমি কল রিসিভই করবে না। ফোনটা সুইচ অফ করে রেখে দেবে!
-ফোনটা ধরেই নিই না রে রিমলি? বেচারা ছেলেটা এতোবার ধরে ফোন করছে!
-একদম না মা! তোমাকে ফোনে না পেয়ে এক্ষুণি দাদা আমাকে কল করবে তোমার কথা জানার জন্য। তখন আমি ওকে আরেকটু কথা শুনিয়ে দেবো। তারপর দেখবে, ওর কলেজের ছুটি পড়ার আগেই কলকাতায় ছুটে আসছে।
-না না রিমলি, তুই আবার বেশি কিছু বলতে যাস না যেন! এমনিতেই ছেলেটা ওখানে একা একা থাকে। আবার আমার জন্য এসব চিন্তা করলে কোথায় কী শরীর-টরীর খারাপ করবে! তুই বেশি কিছু বলবি না কিন্তু! আমি এখন রান্নাঘরে যাচ্ছি…
বাসন্তীদেবী রান্নাঘরে চলে যাওয়ার পরেই রিমলির ফোনে আয়ানের কল এলো। রিমলি কলটা রিসিভ করে বললো,
-কী হয়েছে বল দাদা?
-এই রিমলি মা কোথায় রে? মা আমার কলটা রিসিভ করছে না কেন?
-কেন রিসিভ করবে বলতো? তুই কী মাকে একটুও ভালোবাসিস? নাকি মায়ের কথা একটুও শুনিস?
-আরে রিমলি তুই একটু বোঝার চেষ্টা কর না বোন আমার! আসলে এখানে আমার একটু কাজের চাপ আছে, তাই এবারে ছুটিতে কলকাতায় যেতে পারবো না বলছিলাম। কিন্তু মা তো আমার কোনো কথাই শুনতে চাইলো না!
-ঠিক আছে দাদা ছাড়! তোকে আসতে হবে না। কিন্তু মায়ের ভালো-মন্দ কিছু হয়ে গেলে তখন যেন আমাকে দোষ দিতে আসিস না!
-এসব কী বলছিস তুই রিমলি? কী হবে মায়ের?
-কী আবার বলছি? দেখ দাদা, মায়ের শরীর কিন্তু খুব একটা ভালো নেই। তোকে আসতে বলছে যখন, তখন নিশ্চয়ই এমন কিছু দরকার আছে তোর সাথে! তুই না এলে কিন্তু মা খুব কষ্ট পাবে। আর তুই কী চাস মা তোর জন্য কষ্ট পাক বা অসুস্থ হয়ে পড়ুক?
-না রিমলি, আমি কখনোই সেটা চাই না! আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে, আমার কলেজের ছুটিটা পড়লেই আমি কলকাতায় ফিরবো। তুই প্লিজ মাকে একটু আমার সাথে কথা বলতে বল বোন…
-ঠিক আছে, মা তো এখন রান্নাঘরে আছে। মা এলেই আমি তোকে কল করতে বলছি!
-ঠিক আছে। আর শোন?
-কী বল?
-মাকে কিন্তু আমার ওপর আর রাগ করে থাকতে বারণ করবি। আমি বলছি তো আমি যাবো কলকাতায়।
-ঠিক আছে, ঠিক আছে! এই দাদা শোন, আমি এখন রাখছি কেমন? আমার টিউশন আছে।
রিমলি কলটা কেটে দিয়ে ওর টিউশনের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। তারপর রান্নাঘরের কাছে গিয়ে দরজা থেকে উঁকি মেরে বাসন্তীদেবীকে বললো,
-মা আমি দাদার সাথে কথা বলে নিয়েছি। দাদার কলেজের ছুটি পড়লেই ও এখানে আসবে বলেছে। এবার দাদা কল করলে তুমি রিসিভ করে নিও। আর নয়তো, রান্না হয়ে গেলে তুমিই একবার দাদাকে কল করে নিও কেমন?
-তুই বাবানকে কী এমন বললি, যে তোর দাদা আসতে রাজী হয়ে গেলো?
-ও আমি ঠিক ম্যানেজ করে নিয়েছি। আর শোনো মা, তুমি যখন দাদার সাথে ফোনে কথা বলবে, তখন কিন্তু একটু অসুস্থ অসুস্থ গলা করে কথা বলবে। কেমন?
-আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। তুই সাবধানে যাস কিন্তু.. আর তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস…
-হ্যাঁ মা আসছি আমি! টাটা!
রিমলি একটা উড়ন্ত চুমু মায়ের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেলো টিউশনের উদ্দেশ্যে…
“কী ব্যাপার প্রফেসর সাহেব? আজ খুব বিজি নাকি? সারাদিন একটাও টেক্সট, কল কিছুই নেই যে!”-এই মেসেজটা লিখে জিয়া সেন্ট করে দিলো আয়ানের নাম্বারে। মেসেজটা পাওয়ার সাথে সাথেই আয়ান জিয়াকে কল করলো। জিয়া কলটা রিসিভ করতেই আয়ান বললো,
-তুমি এখনও জেগে আছো? আমি তো ভাবলাম ঘুমিয়েই পড়েছো হয়তো! আসলে আজ সারাদিন আমি একটু বিজি ছিলাম। তাই টেক্সট বা কল কোনোটাই করতে পারিনি!
-না, অফিসের কয়েকটা পেন্ডিং কাজ কমপ্লিট করছিলাম। কাল সাবমিট করতে হবে তাই! তা কীসে এতো বিজি শুনি? ছাত্রীরা পড়া বুঝতে পারছে না নাকি? তাই ছাত্রীদের পড়াতে বিজি ছিলে?
-না আসলে কাল থেকে আমার কলেজের ছুটি পড়ে যাচ্ছে। আর পড়শু আমি কলকাতা যাচ্ছি। তাই টিকিট পাওয়ার জন্য এদিক-ওদিক যেতে হচ্ছিলো।
-তুমি যে সেদিন বললে এবারের ছুটিতে তুমি কলকাতা যাবে না?
-যাবো না-ই তো ভেবেছিলাম। কিন্তু বোন বলছিলো কদিন ধরে নাকি মায়ের শরীরটা খুব খারাপ যাচ্ছে। আর মা বারবার যেতেও বলছে অনেকদিন আমাকে দেখেনি বলে। তাই ভাবলাম কয়েকদিনের জন্য একটু নাহয় ঘুরেই আসি কলকাতা থেকে!
-হুম, ভালোই করেছো! পড়শু কখন ট্রেন তোমার?
-ভোর পাঁচটায়!
পড়শু দিন একটা ফটোগ্রাফি এক্সিবিশন আছে। আয়ানকে সেটা বলার জন্যই আরও এতো রাত পর্যন্ত জেগে ছিলো জিয়া। কিন্তু ও যখন জানতে পারলো যে, কলকাতায় যাওয়ার জন্য আয়ানের টিকিট কনফার্ম হয়ে গেছে, তখন আর ওকে এক্সিবিশনটার কথা বলতে পারলো না জিয়া। মনে মনে ঠিক করলো সেদিন ও একাই যাবে।
ট্রেন থেকে নেমে স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি বুক করে তাতে নিজের সব লাগেজ গুলো তুলে দিয়ে নিজেও ট্যাক্সিতে উঠে বসলো আয়ান। এদিকে বাসন্তীদেবী ওকে বারবার কল করেই চলেছেন। ট্রেন থেকে নামার সময় ওর হাতে লাগেজ গুলো থাকার কারণে কলটা রিসিভ করতে পারেনি আয়ান। তাই অনেকবার ধরে বেজে বেজে কলটা কেটেই গেছে। ট্যাক্সিতে উঠে বসার পর বাসন্তীদেবীর নাম্বারটা ডায়াল করলো ও। কলটা রিসিভ করেই উনি বললেন,
-কীরে বাবান? তোর ব্যাপারটা কী শুনি? কখন থেকে তোকে ফোনে ট্রাই করছি! চিন্তা হয় তো নাকি আমার?
-আমি ট্রেন থেকে নামছিলাম মা। হাতে লাগেজ গুলো ছিলো, তাই কল রিসিভ করতে পারিনি!
-এখন কোথায় আছিস তুই?
-এই জাস্ট ট্যাক্সিতে উঠলাম, তুমি চিন্তা কোরো না। মা আমি বাড়ি পৌঁছে তোমার সাথে কথা বলছি। এখন রাখছি কেমন?
-আচ্ছা আচ্ছা, সাবধানে আয় বাবা..
কলটা কেটে দিয়ে জিয়াকেও একটা কল করে কলকাতায় পৌঁছনোর কথাটা জানিয়ে দিলো আয়ান। রিমলি রান্নাঘরে বাসন্তীদেবীকে হাতে হাতে রান্নায় সাহায্য করছিলো। রান্নাঘরের জানলা দিয়ে আয়ানকে ওদের বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থেকে নামতে দেখেই রিমলি চেঁচিয়ে উঠলো,
-ও মা.. ওইতো দাদা এসেগেছে! মা আমি দরজা খুলতে যাচ্ছি। তুমি বাইরে এসো তাড়াতাড়ি…
আয়ান ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে লাগেজ সামলে দরজার সামনে এসে বেল বাজানোর আগেই রিমলি ঝট করে মেইন দরজাটা খুলে দিলো। দরজাটা খুলে দেওয়ার পরেই রিমলি বলে উঠলো,
-কীরে দাদা? তোর এতো দেরী হলো কেন? ট্রেন কী লেট ছিলো নাকি? আর আমি তোকে যা যা আনতে বলেছিলাম সব লিস্ট মিলিয়ে ঠিকঠাক করে এনেছিস তো? আমার কিন্তু গ্রিনটী শেষ হয়ে গেছে! আর দার্জিলিং টী-এর সব ফ্লেভার গুলো এনেছিস তো? আর আমার জ্যাকেট, সোয়েটার?
-হ্যাঁ হ্যাঁ সব এনেছি.. এখন আগে আমাকে বাড়িতে ঢুকতে তো দে!
আয়ানকে রিমলি ওভাবে ঘিরে ধরেছে দেখে বাসন্তীদেবী রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন,
-আরে বাবা, ছেলেটাকে আগে বাড়ির ভিতরে ঢুকতে দিবি তো নাকি? ছেলেটা এখনও বাড়ির ভিতরে পা-ই রাখলো না, আর এখনই ওর লিস্ট করে দেওয়া জিনিসপত্র এনেছে কিনা সেসব জিজ্ঞেস করে মাথা খারাপ করে দিচ্ছিস! সর বলছি বাবানের সামনে থেকে! ওর হাত থেকে ব্যাগ গুলো নিয়ে গিয়ে ঘরে রেখে আয় যা!
বাসন্তীদেবীর ধমক শুনে মুখ নীচু করে আয়ানের সামনে থেকে সরে গেলো রিমলি। রিমলিকে ওভাবে মুখ ভাড় করতে দেখে আয়ান বললো,
-ছাড়ো না মা! ওকে এভাবে বকছো কেন? বাচ্চা মেয়ে.. ও একটু আবদার করবে না তো কে করবে? এইনে রিমলি এই ব্যাগটায় তোর সব জিনিসপত্র আছে। যা ঘরে নিয়ে গিয়ে খুলে দেখ সব পছন্দ হয়েছে কিনা আর তোর ফ্লেভারড টী গুলো ঠিক আছে কিনা! তোমার শরীর এখন কেমন আছে মা? তুমি ঠিক আছো তো?
আয়ান রিমলির হাতে ব্যাগ গুলো ধরিয়ে দিতেই রিমলি সেগুলো নিয়ে ভিতরের ঘরে রাখতে চলে গেলো। রিমলি ঘরে চলে যাওয়ার পর বাসন্তীদেবী বললেন,
-কেন শুধু শুধু মেয়েটাকে এতো প্রশ্রয় দিচ্ছিস বাবান? যখন যা চাইছে, তখনই সেটা এনে দেওয়ার কী দরকার বলতো তোর? আসকারা পেয়ে যাচ্ছে তো মেয়েটা! যখন যা চাইবে, তখন সেটা দিতেই হবে তার কী মানে আছে?
-এভাবে কেন বলছো মা? আমার তো একটাই বোন বলো? ওর এই সামান্য আবদার গুলো আমি মেটাবো না?
-ও কিন্তু প্রশ্রয় পেয়ে যাচ্ছে! আবার দেখবি কি না কি চাইবে!
-আমি তো তবু অনেকদিন বাবার আদর, যত্ন, ভালোবাসা, এসব পেয়েছি.. কিন্তু বোন আর বাবাকে কতোদিনই বা কাছে পেয়েছে বলো? আমি তো আমার সব আবদার বাবার কাছে করতাম, বাবা আমার সব আবদার আর চাহিদা গুলো পূরণ করতো। কিন্তু বোন কাকে ওর প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো চাইবে বলো মা? ওকে যদি এই সামান্য জিনিস গুলো না দিই, তাহলে তো ও খুব কষ্ট পাবে। আমি আমার বোনটাকে কোনো কষ্ট দিতে চাই না! প্লিজ মা তুমি আর এটা নিয়ে আপত্তি, বা রাগারাগী কোরো না…
বাসন্তীদেবী আয়ানের কাছে এগিয়ে এসে ওর গালে একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
-এই কয়েক বছরেই তুই কতো বড়ো হয়ে গেলি রে বাবান! সেই যে তোর বাবা একদিন হঠাৎ করেই বুকে যন্ত্রণা নিয়ে অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এসে ছটফট করতে শুরু করলেন, আর হসপিটালে নিয়ে যেতে যেতে অ্যাম্বুলেন্সেই আমাদের সবাইকে ছেড়ে চিরকালের মতো কতদূরে চলে গেলেন, তারপর থেকে তো এই সংসারের সব দায়িত্ব আমার ওপরেই এসে পড়েছিলো। রিমলিটাও তখন কতো ছোটো ছিলো। একদিকে সংসার আর একদিকে রিমলিকে সামলাতে গিয়ে তোর দিকে তখন আমি আর একদম লক্ষ্যই দিতে পারতাম না। তোর সব কাজ, পড়াশোনা, খাওয়া, স্নান করা, স্কুলে যাওয়ার সময় জুতোর ফিতে বাঁধা সব তুই নিজে নিজেই করতে শিখে গেলি। আর সেই ফাঁকে কবে যে তুই এতো বড়ো হয়ে গেলি, সেটা বুঝতেই পারলাম না! আর এতোটাই বড়ো হয়ে গেলি যে, সংসারের কোনটায় ভালো কোনটায় মন্দ, কীসে আনন্দ, কীসে দুঃখ-কষ্ট সেগুলোও বুঝতে শিখে গেলি!
কথা গুলো বলতে বলতে কান্নায় গলা বুজে আসছিলো বাসন্তীদেবীর। চোখের জল লুকোতে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলেন উনি। আয়ান সেটা বুঝতে পেরে বাসন্তিদেবীর দুই কাঁধে হাত রেখে ওনাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ওনার চোখের জলটা মুছিয়ে দিয়ে ওনাকে জড়িয়ে ধরলো নিজের বুকের মধ্যে। তারপর ও বললো,
-তুমি কাঁদছো কেন মা? একদম কাঁদবে না তুমি! বাবা মারা যাওয়ার পর তো তুমিই আমাকে আর বোনকে নিজের হাতে মানুষ করেছো। তখন তো এক ফোঁটাও চোখের জল ফেলোনি তুমি। অনেক কঠিন মুহূর্তেও নিজেকে শক্ত রেখেছো, আর আমাদেরকেও শক্ত থাকতে বলেছো সবসময়। তাহলে এখন কেন নিজেই চোখের জল ফেলছো? এখন তো আমি আর বোন দুজনেই বড়ো হয়ে গেছি! এখন তো আর তোমার চিন্তার কোনো কারণ নেই। এবার একটু হাসো প্লিজ? তোমার চোখে জল দেখলে আমার খুব কষ্ট হয় মা। আমি সবসময় তোমার মুখে হাসি দেখতে চাই… তোমাকে খুশি দেখতে চাই.. হাসো বলছি… নাহলে কিন্তু খুব বকবো!
আয়ানের বুক থেকে মুখ তুলে একটু হেসে বাসন্তীদেবী বললেন,
-হ্যাঁ সেই তো! এখন তো তোরাই আমার অভিভাবক হয়ে গেছিস! যা, ঘরে যা… আর পাকা পাকা কথা বলতে হবে না! এভাবে তুই তোর ছাত্রছাত্রীদেরকে পড়া বোঝাবি, আর বকাবকি করবিখন। এখন যা, নিজের ঘরে গিয়ে মুখ হাত পা ধুয়ে ফ্রেস হয়ে নে। আমি তোর জন্য খাবার নিয়ে আসছি। আর শোন বাবান?
-বলো মা?
-আচ্ছা না থাক, পরেই বলবো নাহয়! যা তুই এখন ঘরে যা!
-ঠিক আছে!
মায়ের সাথে কথা বলার পর আয়ান নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। ভীষণ কষ্টের মাঝেও ছেলেকে সঠিকভাবে মানুষ করতে পেরেছেন দেখে বাসন্তীদেবীর চোখ ভিজে এলো। নিজের চোখ থেকে গড়িয়ে আসা আনন্দাশ্রুর বিন্দু গুলো শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে নিয়ে রান্না ঘরের কাজে মন দিতে লাগলেন উনি…
ক্রমশ…
সপ্তম পর্বের লিংক-
https://www.facebook.com/101048758811830/posts/258977939685577/