#না চাহিলে যারে পাওয়া যায় পর্ব-২
#ফারহানা ইয়াসমিন
রাগে ব্রাক্ষতালু জ্বলছে রুহির। নিজেরই নিজেকে চাবুক পেটা করতে মন চাইছে। সে কেন গেলো লোকটার সাথে দেখা করতে? তার বোঝা উচিত ছিলো, এতোদিন পর তাকে খুঁজে বের করে দেখা করতে চাইছে নিশ্চয়ই কোন মহৎ উদ্দেশ্য হবেনা। আর যার সাথে সম্পর্কই মানে না তার ডাকে কেন সারা দিলো? রুহির রাগে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। মাথা ঠান্ডা করতে তাই বাসায় ফিরেই হুড়োহুড়ি করে গোসলে ঢুকে গেলো। বাথরুম থেকে বেরুতেই সামনে মাকে দেখে রুহি চমকে গেলো। এই মুহূর্তে মাকে কিছু জানাবে কি? রুহির মনে দ্বিধা, বাবার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। এতো চাপ বাবা নিতে পারবেনা। রুহি নিজেকে সামলে নিতে চুল মোছায় মন দিলো। দিলারা মেয়েকে তীক্ষ্ণ চোখে জরিপ করছেন। রুহি ফিরেছে রাত এগারোটায়, এসেই আবার গোসলে ঢুকলো। এখন দেখছে চোখ লাল, নির্ঘাত বাথরুমে কেঁদেছে। এদিকে শুভটা সন্ধ্যা থেকে বাসায় এসে বসেছিলো। রুহি গেছিলো কোথায় আজ?
“তোর ফিরতে এতো রাত হলো যে? শুভর সাথে কথা হয়নি আজ? সন্ধ্যা থেকে তোর জন্য অপেক্ষা করছিলো।”
রুহি মাকে এড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে চুল ঝাড়লো। আয়নায় নিজেকে দেখে নিয়ে মায়ের পানে চাইলো-
“আমাকে কি কষ্ট করে এককাপ চা বানিয়ে দেবে মা? ভীষণ মাথা ধরেছে আমার।”
“খাবি না? আজ এতো রাত করে ফিরলি, আমরা খেয়ে নিয়েছি সবাই। তোর খাবার বেড়ে রেখেছি। গরম করে দেবো?”
রুহি মাথা নাড়ে-
“না মা খেতে ইচ্ছে করছে না। ভাত থাক, তুমি বরং চা দাও। পরে ভালো লাগলে না হয় ভাত খাবো।”
দিলারা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চা বানাতে গেলো। চুলোয় জল চাপিয়ে ভাবলেন রুহির কিছু একটা হয়েছে। নইলে অফিস থেকে ফিরে ভাত না খেয়ে চা খাবে কেন? শুভর কথা শুনেও কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। অফিসে কিছু হয়েছে কি? দিলারা আনমনে চায়ের পটে আদা কুচি ছেড়ে দেয়। রুহিকে সরাসরি প্রশ্ন করবেন সে সাহস হয় না কেন যেন। আজকাল রুহি খুব পাল্টে গেছে। কেমন গম্ভীর হয়ে থাকে সারাক্ষণ। আগের সেই হাসিখুশি চটপটে ভাবটা আর নেই। কি যেন ভাবে সারাক্ষণ। দিলারার মনটা খারাপ হলো। একটা ভুল সিদ্ধান্ত তার মেয়েটার জীবন অর্ধেক শেষ করে দিলো। শুধু তাই না তার বাকী দুই মেয়ে, তাদের সাজানো গোছানো সংসার সব নিঃশেষ করছে। কিভাবে কি করবেন কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। রুহির বাবার সাথে আলাপ করবেন তাও সম্ভব না। লোকটা এখন কেমন যেন গা ছাড়া ভাবে চলাচল করে। কিছু বললেই বলে তোমরা যা ভালো বোঝো কর। আমি কি ঠিক ভুল ধরতে পারি না আমার সে ক্ষমতা আছে? এই কথার পরে আর কিছু বলতে পারে না দিলারা। একটা মানুষ কতোটা মনোকষ্ট থেকে এমন কিছু বলতে পারে তা সাদা চোখে কেউ বুঝবেও না। দিলারা স্ত্রী হিসেবে মেয়ের মা হিসাবে জানে, মেয়ের জীবনের জন্য নেওয়া ভালো সিদ্ধান্ত যখন সবচেয়ে খারাপ প্রমানিত হয় তখন বাবার মনে কি চলে। বাবার মনের সব সাহস ফুৎকারে উবে যায়। ভাবতে ভাবতে দিলারার শরীরে ঘাম ছোটে। এই এক মেয়ের জন্য নিজের শেকড় উপরে ঢাকায় চলে এলেন খুব কি লাভ হয়েছে? সুখ সাচ্ছন্দ্যের সাথে আড়ি পাতায় সবার মধ্যেই সুক্ষ অস্থিরতা। সেও তো পাঁচ বছর হতে চললো। এই খরুচে জীবনে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে তবুও মানিয়ে নিতে পারলো কই? পরিচিত গন্ডিতে ফেরার জন্য মনের হাসফাসও বেশ টের পায়। রুহির বাবা আজকাল ঘনঘন অসুস্থ হচ্ছে কি কারনে সেটা তো দুধের শিশুও বুঝবে। দিলারা গভীর শ্বাস ফেলে চায়ের কাপে চা ঢেলে মেয়ের ঘরের দিকে এগুলেন।
রুহি চুপচাপ শুয়েছিলো চোখের উপর হাতরেখে। মাথা ব্যাথায় টনটন করছে। বারবার রাযীনের কথাগুলো কানে বাজছে। লোকটার চোখে মুখে কোন অনুশোচনা দেখেনি রুহি। উল্টো এতোদিন পর এসে এমন ভাব করছে যেন রুহি তার খুব আদরের পুরনো বউ। আশ্চর্য! একটা মানুষ এতোটা নির্লজ্জ বেহায়া আর বেয়াদব হয় কি করে? প্রস্তাবটা শুনে রুহির মুখে রা কাড়েনি। সেই অবস্থায় ব্যাগ কাঁধে বেড়িয়ে পড়েছিলো। পুরো রাস্তা একটা ঘোরে আঁটকে ছিলো। মাথা কাজ করছিলো না একদম। কি হচ্ছে তার জীবনে সেটা বোঝার জন্য যতই সব গুছিয়ে চিন্তা করতে বসছে ততই সব ভাবনা আরো জট পাকিয়ে যাচ্ছে। চার বছর ধরে পেছনে পড়ে থাকার পর এই তো সেদিন শুভর প্রস্তাবে হ্যা বলবে বলে মনস্থির করলো। আর আজই অতীত সামনে চলে এলো। জীবনটা কোন দিকে যাচ্ছে কোন কিছু বুঝতে পারছে না। এই যে এতোগুলা দিন কষ্ট করে একজনকে ভোলার চেষ্টা করলো তারপর সব ভুলে যখন সামনে এগিয়েছে তখনই আবার নিজেকে সেই অতীতের বাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেলো। কেমন লাগবে এমন অবস্থায়?
“তোর চা।”
দিলারা মেয়ের পাশে বসলেন, মাথায় হাত দিয়ে জ্বর দেখলেন। নাহ গা ঠান্ডা একদম। রুহি উঠে বসলো মায়ের কাছে। হাত বাড়িয়ে কাপ নিয়ে চায়ে চুমুক দিলো। দিলারা উসখুস করে বলেই ফেলেন-
“তোর কি হয়েছে রুহি? কোন সমস্যা থাকলে আমায় বলতে পারিস। ক’দিন ধরে দেখছি তুই বেশ চিন্তায় আছিস।”
“বাবা কি ঘুমিয়েছে মা?”
দিলারা বুঝলো রুহি কিছু বলতে চায় না তাই বাবার কথা জানতে চেয়ে কথা ঘুড়িয়ে নিলো। দিলারা হতাশ হয়ে উঠে দাঁড়ালো-
“আমি ঘুমালাম তাহলে। শুভর সাথে একবার কথা বলিস। ছেলেটা অস্থির হয়ে ছিলো ভীষণ। তুই ফোন না দিলে হয়তো সারারাত ঘুমাবে না।”
রুহি চুপ করে চায়ে চুমুক দিলো। ওর কিছু ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করছে সব ভেঙে চুরে শেষ করছে। হাতে ধরা চায়ের কাপ দিয়ে ভাঙচুর শুরু করতে ইচ্ছে করলেও অনেক কষ্টে রুহি নিজের ইচ্ছেকে সংযত করলো। এসব কিছুই সে করতে পারবেনা। ওঘরে তার বাবা ঘুমাচ্ছে, পাশের রুমে দুই বোন। শুধু শুধু রাতের বেলা এতো সিন করলে কি লাভ হবে? তার মনের ঝড় তো কমবেনা। রুহি দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলো। দিলারা চলে যেতেই রুহি অনিচ্ছায় ফোন ওপেন করলো। শুভকে একটা ফোন করা উচিত। সত্যটা সবার আগে মনেহয় ওরই জানা দরকার।
“হ্যালো। কোথায় ছিলি সারাদিন? বিকেল থেকে ফোন বন্ধ পাচ্ছি। তোর অফিসে গিয়ে শুনলাম তুই নাকি বেড়িয়ে গেছিস। তারপর বাসায় থাকবি ভেবে এলাম দেখি তাও নাই। আমি দশটা পর্যন্ত বাসায় বসে রইলাম তবুও তোর দেখা পেলাম না। কোথায় গেছিলি রু?”
রুহির গভীর শ্বাস টানার আওয়াজ পেয়ে শুভ চুপ করে যায়। ভয়ার্ত গলায় জানতে চাইলো-
“রু, কি হয়েছে বল তো? সিরিয়াস কিছু?”
“তুই আমাকে ভালোবাসিস তো শুভ?”
“সে তো বাসিই। আজ কি নতুন জানছিস?”
“কতটা বাসিস?”
“এ আবার কেমন প্রশ্ন রু? ভালোবাসা কি পরিমাপ করা যায়?”
শুভর গলায় অসন্তোষ। রুহি শব্দ করে হাসলো-
“ভালোবেসে কি কি করতে পারবি আমার জন্য?”
“সব করতে পারবো রু। হঠাৎ এসব বলছিস কেন? কি হয়েছে খুলে বল রু। এতো সাসপেন্স ভালো লাগছে না।”
শুভ চঞ্চল হয়ে জিজ্ঞেস করে। রুহি ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে-
“রাযীন ফিরে আসতে চায় আমার জীবনে। যে আমাকে অবহেলা ভরে ফেলে চলে গেছিলো সেই আমাকেই এখন সে স্বসম্মানে নিজের জীবনে ফেরত নিতে চায়।”
“রাযীন কে রু? কে রাযীন?”
শুভ ভীষণ জোরে চেচিয়ে ওঠে। রুহি টের পেলো না শুভর হাত পা কি পরিমান কাঁপছে। রুহি একহাতে কপাল চেপে ধরে বললো-
“আমার কাগজে স্বামী। আমি এখনো লিখিতভাবে যার বউ।”
ওপাশে পিনপতন নিরবতা। শুভ যেন শ্বাস নিতে ভুলে গেছে। দু’জনের কানে ফোন অথচ কথা নেই কোনো। কেবল ঘড়ির কাটার টিকটিক। হঠাৎ ঘড়ির কাটার টং আওয়াজ জানান দিলো রাত বারোটা বাজছে। একটা নতুন দিনের শুরু, হতে পারে জীবনেরও।
চলবে—
©Farhana_Yesmin