#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব ৪
#ফারহানা ইয়াসমিন
শুভর জীবনে কোন উদ্দেশ্য ছিলো না। খাওয়া ঘুম পড়ালেখার মাঝে জীবন আঁটকে ছিলো। জীবনে এমন কোন ব্যাপার ছিলোনা যাতে বেঁচে থাকাটা আনন্দদায়ক মনেহয়। দুই ভাই দুইবোনের মধ্যে শুভ সবার ছোট হওয়ায় বাবা মায়ের মনোযোগ কম ছিলো। তাছাড়া শুভ লক্ষী ছেলে, কখনো কোন ব্যাপারে শুভকে দুবার বলতে হয়নি। নিজের কাজটা নিজ গরজে করে ফেলা তার স্বভাবসিদ্ধ। তাই তার বাবা মায়ের ও আলাদা করে শুভর কথা ভাবতে হয়নি। মোটকথা একজন আদর্শ ভদ্র ছেলের গুণাবলি সম্বলিত সবগুন শুভর মধ্যে ছিলো। সেই শুভ ভার্সিটিতে পড়তে এসে হঠৎ রুহিকে দেখে দুম করে প্রেমে পড়লো। প্রথমটায় ভেবেছে এটা হয়তো ক্ষনিকের ভালোলাগা। কিছুদিন গেলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু যতদিন গেছে রুহির প্রতি চুম্বকের মতো আকৃষ্ট হয়েছে। রুহি খুব চুপচাপ মেয়ে, কম বয়সে একটা ধাক্কা খেয়ে হাসতে ভুলে গেছে। নিজের চারপাশে গাম্ভীর্যের দেয়াল তুলে দিয়ে একাকি থাকে। ছোট ছোট চোখদুটো দিয়ে চুপচাপ কেবল চারপাশে ঘটমান ঘটনা প্রত্যক্ষ করে। ওর যেন কোন বিষয়ে কিছু বলার নেই এমন মুখচোখ করে ঘুরে বেড়ায়। শুভ দূর থেকে রুহিকে দেখে প্রতিক্ষন। ভালো লাগে দেখতে, রুহির বোঁচা নাক আর ছোট ছোট মায়া কাড়া চোখদুটো শুভর আকর্ষনের কেন্দ্রে। এই আকর্ষনেই চারবছর ধৈর্য্য ধরে ঘুরেছে রুহির পেছনে। ক্লাসমেট থেকে বন্ধু তারপর যখন আরো একধাপ এগিয়ে ভাবতে গেছে তখন রুহির সারা পায়নি একদম। রুহি বিবাহিত মেয়ে জেনেও কেন তার পেছনে ঘুরঘুর করছে সেটা নিয়ে বিস্তর সন্দেহ ছিলো রুহির। এজন্য অবশ্য শুভর মনে কখনো খারাপ লাগা আসেনি। কারণ ও জানে রুহি একবার ঠকেছে বলে ওর বিশ্বাসের ভীতটা নড়বড়ে। সহসাই কাউকে বিশ্বাস করাটা ওর জন্য ভীষণ কঠিন ব্যাপার। কাজেই ও ধৈর্য্য ধরে রুহির বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা করে গেছে। অবশেষে চারবছর পরে রুহির মনে ঠাই মিলিছে। একজন বিবাহিত মেয়ের পেছনে ঘোরার কারনটা রুহিকে কখনো স্পষ্ট করে বলা হয়ে ওঠেনি। রুহি বিশ্বাস করবে কিনা তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে শুভর। ওর মনে হয়েছে রুহি একবার ঠকেছে কাজেই ও কখনো কাউকে ঠকাবে না। এই মেয়েগুলো পরের স্বামীর সাথে খুব লয়াল থাকে। আর এই লয়ালটিটা শুভর জন্য খুব দরকার। একবার ঠকে যাওয়া রুহির জীবনের সবটা জুড়ে কেবল সেই থাকবে এমন ভাবনা বেশ আনন্দ দেয় শুভকে। এই পৃথিবীতে কেউ একজন তো পুরোপুরি তার হবে এমন ভাবনা আনন্দ দিতো শুভকে।
রুহি কখনোই নিজের বিয়ের ব্যাপারে আলোচনা পচ্ছন্দ করতোনা। এ প্রসঙ্গ উঠলেই সেদিন ভীষণ গুমোট হয়ে থাকতো রুহি। সেই থেকে শুভও আর জানতে চায়নি কখনো। যে বিয়েতে বর বিয়ের রাতে বউ ফেলে ভেগে যায় সে বিয়ে নিয়ে আলোচনা করে কি লাভ? ওটা কোন বিয়ের পর্যায়ে পড়ে না ভেবে সব চিন্তা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। অথচ আজ মনেহচ্ছে সব ভাবনাই ভুল ছিলো৷ এতোদিন যেটা কোনো ব্যাপার মনে হয়নি এখন দেখছে এটাই বড় ব্যাপার। শুভ বিরক্ত হয়ে আশপাশ দেখছে রুহির দিকে তাকাচ্ছে না। রুহি আজ আসার পর থেকে আনমনা। চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে না, কেবল কাপে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ শুভর কাছে জানতে চাইলো-
“কি করবো বল তো? আমার মাথায় কিচ্ছু ঢুকছে না।”
রুহির অসহায় কন্ঠ শোনা গেল।
“কি করবি আবার? ডিভোর্স দিবি? এতে কোন সন্দেহ আছে নাকি?”
“সে তো দেবোই বাট ভাবছি যে সাথে যাওয়াটা কি জরুরি?”
শুভ প্রায় চেচিয়ে উঠলো-
“যাবি কেন? কেন যাবি তুই? আশ্চর্য! এতোদিন পর কেউ একজন এসে তোকে কোথাও নিয়ে যেতে চাইবে আর তুই ঢ্যাংঢ্যাং করে চলে যাবি? ওই লোকটাকে তুই চিনিস? কেমন না কেমন লোক?”
শুভর কথায় রুহি রেগে গেলো-
“কেউ কারো সাথে যেতে চাইছে না শুভ। আমরা যদি আমাদের সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চাই তাহলে ডিভোর্সটা জরুরি তুইও জানিস।”
“হ্যা, কিন্তু এজন্য যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। একপক্ষ ডিভোর্স ফাইল করলে অন্যপক্ষ অনুপস্থিত থাকলেই হয়। তিনমাস পরে অটো ডিভোর্স কার্যকর হবে। তোর প্রাক্তনকে বলে দিস।”
শুভর কন্ঠ নরম হলো একটু।
“আচ্ছা! এটা তো জানতাম না। যাক ভালোই হলো তাহলে। আমার আর যেতে হবে না। আমি আসলে কিছুতেই বাবাকে জানাতে চাই না। এমনিতেই বাবা একটু অসুস্থ, তাছাড়া ওই লোকটার বাবা আব্বার বন্ধু মানুষ। বাবা শুনলে কষ্ট পাবে।”
রুহি একটু আনমনা হলো। শুভ অবশ্য রুহির আনমনা ভাব খেয়াল করে না। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে-
“তোর বাবার কারনেই তো তোর এই অবস্থা। এখনো তার কথা ভাবছিস কেন?”
রুহি অদূরে চড়ুই পাখির কিচির মিচির শুনে। শুভর কথায় ফিরে তাকালো-
“সেজন্য বাবা অনুতপ্ত ভীষণ। আমার জন্যই নিজের জন্মস্হান ছেড়ে এসেছেন। আমার জীবন গড়ার লক্ষ্যে কাজ করেছেন। তাই তার উপর আর কোন রাগ নেই আমার। কপালে ছিলো এটাই মেনে নিয়েছি।”
“বেশ। আমাদের বিয়ের তাহলে কতো দেরি? ডিভোর্স এর তিনমাস হলে ফেব্রুয়ারীতে বিয়ে করতে পারবো কি বলিস?”
রুহি অদ্ভুত একটা হাসি দিলো যে হাসির মানে শুভর পক্ষে বোঝা অসম্ভব। শুভ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকলো-
“তুই কি ভাবছিস বলতো?”
“ঠিক জানি না কি ভাবছি। তবে কেন যেন মনেহচ্ছে, এই লোক ফেরত এসেছে কোন একটা ঝামেলা পাকাবে বলে। নিজেদের পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে ঢাকা শহরে থিতু হতে হয়েছি এটা এই লোকের জানার কথা না। এমনকি এদের পরিবারের কারও জানার কথা না। এমন পরিস্থিতিতে দেশে এসে এই লোক আমাকে খুঁজে বের করেছে। তোর কি মনেহয় শুধু ডিভোর্স দেবে এই কারনে?”
“তাহলে?”
শুভ বিস্ফোরিত নেত্রে তাকিয়ে আছে রুহির দিকে। রুহি মিষ্টি হাসলো-
“ডিভোর্স তো কতো আগে দিতে চেয়েছি অথচ দেখ হয়নি। হাজার হোক মধ্যবিত্ত বাবা তো, মেয়ের ডিভোর্স মন থেকে মেনে নিতে পারে না। আমাকে নানা কিছু বুঝিছে ডিভোর্স থেকে বিরত রেখেছে। এখন এর কমপেনসেশন তো দিতে হবে?”
“তুই অযথাই বেশি ভাবছিস। যত যাইহোক, তুই না গেলেই হবে। শোন আমরা বরং বিয়ের প্রস্তুতি নেই।”
শুভ মরিয়া হলো।
“শোন শুভ, বিয়ে করতে চাইলে এখনই করা যাবে কিন্তু কথা হইলো তুই আজ পর্যন্ত বলে আসতেছিস তোর বাবামা কেউ নেই। তাহলে আর কিসের প্রস্তুতি? করে ফেলবো একদিন।”
“সেই একদিন কবে আসবে?”
“এ প্রশ্নের উত্তর স্বয়ং ইশ্বর জানেন। আমরা তার আজ্ঞাবহ দাস মাত্র।”
দু’জনের মাঝে অদ্ভুত নিরবতা নেমে আসলো। শুভর মনে ভীষণ অসস্তি হচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই। রুহিটা আজ বারবার অন্যমনস্ক হয়ে আছে। এই রুহিতে পেতে কত কিছু করতে হয়েছে এ জীবনে এখন কি তীরে এসে তরী ডুবলো? কতো মিথ্যে কত ছলচাতুরী তবুও বুঝি শেষ রক্ষা হলোনা। মেয়েটা আজ পর্যন্ত ‘ভালোবাসি’ কথাটাই বলেনি। রুহি কি আদৌও ভালোবাসে শুভকে? নাকি শুধু শুভর জোরাজোরিতে টিকে আছে এ সম্পর্ক? শুভর মনে আবার সেই পুরনো অনুভুতিটা ফেরত এলো। কারো জীবনে সে কিছু হয়ে উঠতে পারলোনা এ জীবনে। বাবা মায়ের আশা পূরণে বড় ভাইয়া, বোনদের নির্ভরতা বড় ভাইয়া। তাকে কেউ খোঁজে না কেউ চায় না। শুভ থাকলেও চলে না থাকলেও চলে এমন বোধ থেকেই পরিবার থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে এনেছে। এখন রুহির জীবনেও কি তার স্থান এমন হবে? এতোগুলো বছর ছায়ার মতো থেকেও কি রুহির মনে ঠাই হয়নি তার?
চলবে—
©Farhana_ Yesmin