#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব ৫
#ফারহানা ইয়াসমিন
“আপনার বউ অন্য কাউকে ভালোবাসে, সে এখন শরীর আর মনের দিক দিয়ে সম্পূর্ণরুপে অন্যকারো এটা জানার পরও কি আপনার একই রকম আগ্রহ থাকবে মিস্টার রাযীন?”
রুহির চেহারার কাঠিন্য দেখে রাযীন মুচকি হাসলো-
“আমি তো তোমার সাথে থাকতে আসিনি রুহি। বললামই তো ডিভোর্স এর জন্য তোমাকে যেতে হবে আমার সাথে। এছাড়া তুমি কার সাথে থাকবে, শোবে এটা তোমার একান্ত ব্যাক্তিগত ইচ্ছে।”
রুহি রাগ নিবৃত্তির চেষ্টায় দাঁতে দাঁত চাপে-
“বাহ, এতো ভালো? আপনি যে মিথ্যে বলছেন সেটা সেদিনই বুঝেছিলাম। আপনি আসলে কি জন্য এসেছেন আমার কাছে বলুন তো? ডিভোর্স চাইতে নয় এটা ভালো মতোই জানি। কাজেই এই মিথ্যে ঢোল আর পেটাবেন না দয়া করে।”
রাযীন হো হো করে হাসলো অনেকক্ষণ যেন রুহি হাসির জোকস বলছে কোন। রুহির মন চাইছে রাযীনের ফর্সা গাল চড় মেড়ে লাল করতে। বেয়াদব একটা লোক।
“তুমি বুদ্ধিমতী এটা বুঝতে পেরেছিলাম তবে এতোটা বুদ্ধিমতী তা বুঝিনি। আমার কষ্ট অনেক কমে গেলো। এখন যেহেতু বুঝেই গেছো তোমায় আমি ফেরত নিতে চাই তাহলে আর কথা বাড়িয়ে লাভ কি? তুমি হ্যা বললে আমি জনাকয়েক আত্মীয় নিয়ে আসবো, তোমার আনুষ্ঠানিক ভাবে শশুরবাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য।”
“একবার নিয়ে গিয়ে অপমানের ষোল কলা পূরণ হয়নি বুঝি? তাই আবার ফিরিয়ে নিতে এসেছেন? এবার ঘড়া পূরন করে তবেই ছাড়বেন?”
রুহি বরফশীতল দৃষ্টি হেনে রাযীনকে জমিয়ে দিতে চাইলো কিন্তু রাযীন সে দৃষ্টি পাত্তা দিলো না মোটেও। সে মনে মনে হাসলো, এসব ছোটখাটো চোখ রাঙানিতে ভয় পেতে রাযীনের বয়েই গেছে? রুহির যেন আর সহ্য হলোনা রাযীনের এই উদ্ধৃত আচরণ। সে চেচিয়ে উঠলো-
“জোকার লাগে আমাকে? নাকি চাবি দেওয়া কলের পুতুল? ইচ্ছে হলো বিয়ে করলেন তারপর ইচ্ছে হলো বউ ফেলে পালিয়ে গেলেন। পাঁচ বছর ছায়া পর্যন্ত দেখা গেলোনা আর এখন যখন আমি নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছি তখন আপনি আবার ফিরে এসে আমার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন? আমাকে ফুটবল খেলার বলের মতো এদিক সেদিক ছুড়বেন?”
রাযীন এবার একটু অপ্রতিভ হলো। ছোটখাটো মাঝারি মানের রেস্টুরেন্ট, আশেপাশের লোকজন আড়েঠাড়ে ওদের দেখছে বুঝতে পেরে রাযীনের স্বর নরম হলো-
“রুহি, প্লিজ ডোন্ট ক্রিয়েট আ সিন। আমরা আরাম মতো বসে কথা বলতে পারি তো?”
“আপনার মতো ইবলিশের সাথে আরাম মতো বসে কথা বলা সম্ভব? প্লিজ, আমাকে দয়া করুন। আপনাকে আমি স্বামী হিসেবে স্বীকার করি না আর। এখন অন্য একজনকে মনে প্রানে স্বামী ভাবতে চাইছি। দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন। যা ক্ষতি করেছেন তা কোনমতে সামলে উঠেছি আর কোন ক্ষতি করবেননা প্লিজ।”
রুহি দু’হাত করজোড়ে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বললো।
“আজই আপনার সাথে আমার শেষ দেখা। আমি চাই না আর আমাদের দেখা হোক। আপনাকে আমি বাজে দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাবো। ভালো থাকবেন।”
রাযীনকে আর একটা কথা বলারও সুযোগ না দিয়ে রুহি হাঁটা ধরলো। রাযীন পেছন থেকে রুহির দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো-
“তোমাকে আমার কাছেই ফিরতে হবে রুহি। সহজ উপায়ে না ফিরলে আঙুল বাঁকা করবো। তবুও তোমার ফিরতে হবে আমার কাছে। আমি কিছুতেই তোমায় ছাড়তে পারবোনা। তুমি যে আমার সোনার ডিম দেওয়া হাঁস।”
★★★
“আপু, কি করছো?”
রুমি উঁকি দিতেই গাল ভরে হাসলো রুহি-
“তুই! আজ কি পড়া নেই তোর? সিলেবাস কমপ্লিট হয়ে গেছে বুঝি?”
রুমি লজ্জিত হয়ে ঘরে ঢুকলো, বোনের পাশে এসে পা তুলে আরাম করে বসলো-
“সিলেবাস তো কবেই শেষ। আজ তোমার সাথে গল্প দিবস। পড়তে পড়তে মাথা হ্যাং হয়ে গেছে। ভাবছি দু’দিন বই হাতে নেবো না। তাতে যদি হ্যাংওভার কাটে।”
রুমি মিষ্টি করে হাসলো। রুহি মুগ্ধ হয়ে বোনকে দেখলো। রুহির মন খারাপ ভাবটা কমতে শুরু করেছে। রুহিরা তিনবোনের মাঝে রুমি সবার ছোট। সে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থি। সবসময় ক্লাসে প্রথম হওয়া রুমি পড়ালেখায় ভীষণ সিরিয়াস। পড়ালেখা ছাড়া ওর আরেকটা গুন হলো দারুণ মজা করে গল্প বলতে পারে। তাই রুমির গল্প করতে আসা মানে মনের সব ভার পলকেই উবে যাওয়া। রুমি রুহির মুগ্ধ হয়ে তাকানো দেখে খানিকটা শরম পেলো-
“বড়পা, এতো অবাক হয়ে দেখার কি আছে বলোতো? আমাকে তো তুমি প্রায় প্রতিদিনই দেখছো।”
“আরে প্রতিদিন কোথায় দেখলাম? তুই যেদিন দেখা দিস সেদিনই দেখি। তুই যে আমাবস্যার চাঁদ, তোর দেখা পাওয়া ভাগ্য সেখানে তুই সেধে আমার কাছে এসেছিস গল্প করতে।”
রুমি লজ্জায় লালচে হচ্ছে আর রুহি মিটিমিটি হাসছে।
“ধ্যাৎ বড়পা, কি যে বলোনা। আচ্ছা ওসব বাদ দাও, আজ কি হয়েছে শোন, দাদী আজ মায়ের সাথে ঝগড়া করে ঘরে ইয়ে করে দিয়েছে। কি একটা অবস্থা বোঝো? এসব দেখে আমার আজ পড়ায় মন বসেনি। খুব আনহাইজিনিক লাগছে নিজেকে।”
রুহি ফিক করে হেসে দিলো-
“তোর কেন আনহাইজিনিক লাগবে? তুই কি দাদীর ইয়ে পরিস্কার করেছিস নাকি?”
রুমি আঁতকে উঠলো-
“ইসস, কি যে বলোনা বড়পা। আমি ওই ঘরে থাকিনা? আমার সামনে দাদী মায়ের সাথে ঝগড়া করতে করতে কাজটা করে দিলো। তুমি ভাবতে পারো ঘটনাটা? দাদী কি ভয়ঙ্কর মানুষ বুঝেছো?”
“আজ কি ঝামেলা হলো মা আর দাদীর?”
“কি নিয়ে আবার তোমাকে নিয়ে। আসলে হয়েছে কি, রুনিপু দাদীকে বলেছে কিছু তোমাকে নিয়ে। সেই নিয়ে ঝগড়া।”
“রুনি কি বলবে?”
রুহি অবাক কন্ঠে জানতে চায়।
“আরে বড়পা, তুমি আসলেও বোকা আছো। একদম আলাভোলা গোবিন্দ। শোন তোমাকে একটা কথা বলি, রুনিপুটা তো পড়ালেখায় গাধী। যারা পড়ালেখায় গাধী হয় তারা কিন্তু হিংসুটে হয় জানো তো?”
রুহি মাথা না বোধক মাথা নাড়ে, রুমি গড়গড়িয়ে বলে-
“রুনিপু খুব হিংসে করে তোমাকে আর আমাকে। দাদী সারাদিন বকবক করে বলে আমার পড়ালেখায় অসুবিধে হয়। আমি তাই ওকে বলেছিলাম ওর ঘরে পড়বো। ও আমাকে কি বলেছে জানো?”
রুহি আবারও না বোধক মাথা নাড়লো।
“বলেছে তোর মতো বিদ্যার জাহাজকে আমি আশ্রয় দিয়ে মরবো নাকি? তুই বরং তোর পেয়ারের বড় আপার কাছে যা। দুই বিদ্যাবতী একসাথে গা ডলাডলি কর। দেখবি তোরও বড়পার মতো তাড়াতাড়ি বিয়ে হবে, তারপর অনন্তকাল বাবার বাড়িতে থাকতে পারবি। তুমি ভাবতে পারছো ওর হিংসার লেবেলটা কি?”
রুহির মনটা খারাপ হলেও রুমিকে বুঝতে দিলো না-
“আরে এতে হিংসার কি হলো? কথা একদম খারাপ বলেনি রুনি। শোন, দাদীর সাথে থাকতে বেশি সমস্যা হলে আমার সাথে থাক কোনো সমস্যা নেই।”
“আরে না, তুমি সারাদিন অফিস করে আসো। রাতে না ঘুমাতে পারলে শরীর খারাপ করবে। আর আমি তো রাত জেগে পড়ি। দাদী তো রাতে খুব একটা ঘুমায় না। জেগে থাকে, একা একা বকবক করে।”
“তাহলে তুই পড়িস কি করে?”
রুনি হাসলো-
“এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। উল্টো দেখা যাবে এখন দাদীর বকবক না শুনলেই পড়া হবেনা। জানো না মানুষ অভ্যাষের দাস?”
দুইবোন হাসলো খুব। সেই সময় রুহির বাবা ইয়াকুব আলীকে দেখা গেলো-
“মারে, আসবো একটু? তোর সাথে কথা ছিলো।”
রুহি রুমি দাঁড়িয়ে গেলো-
“হ্যা বাবা, অবশ্যই আসবে। পারমিশন কেন নিচ্ছ?”
রুহির কথায় ইয়াকুব আলী মকিন হাসলো। ভেতরে ঢুকে রুমির দিকে তাকালো-
“ছোটমা, তুমি কি একটু মাকে যেয়ে বলবে আমাদের দু’কাপ চা দিতে?”
রুমি মাথা দুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। রুহি মনে মনে ঘাবড়ে গেলো। বাবা কি এমন বলবে যে রুমিকে ভাগিয়ে দিলো? অনেকদিন পরে এমন করে কথা বলতে এলো বাবা। সেই যে বিয়ে করার আর্জি নিয়ে এলো এরপর আজ। অজানা আশঙ্কায় রুহির বুক কেঁপে উঠলো।
চলবে—
©Farhana_Yesmin