#হৃদমাঝারে অন্তিম_পর্ব_১
#দেবারতি_ধাড়া
#অন্তিম_পর্ব_১
কাল শিয়া আর আয়ানের শুভ পরিণয়। সমস্ত আয়োজন খুব ভালো করেই করা হয়েছে। শিয়া তো ভীষণই আনন্দিত। সারাক্ষণ শুধু জিয়ার সাথে হাসি মজা করেই চলেছে ও। শিয়াকে এতো হাসিখুশী আর আনন্দিত দেখে জিয়ারও খুব আনন্দ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মন থেকে যেন ওদের বিয়েটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না জিয়া। সবকিছুর মধ্যেও কেমন যেন একটা চাপা কষ্ট ওকে ঘিরে রেখেছে সারাক্ষণ। যার কারণটা এখন জিয়া ভালোই বোঝে। ও এখন এটা বোঝে যে, আয়ানের মতো জিয়া নিজেও ভীষণভাবে ভালোবেসে ফেলেছে আয়ানকে। কিন্তু এই বিয়েটা নিয়ে শিয়া এতোটাই খুশি যে, এই বিয়েটা ভেঙে দিয়ে আয়ানকে নিজের করে পাওয়ার মতো কোনো প্রশ্নই ওঠে না ওর কাছে। আশীর্বাদের দিনের পর থেকে শিয়া যেন আরও প্রাণবন্ত আর প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠেছে। মুখে বেশ ঔজ্জ্বল্যও এসেছে শিয়ার। জিয়া অনেকের মুখেই শুনেছে, যে বিয়ের জল গায়ে পড়লে নাকি সব মেয়েকেই দেখতে সুন্দর হয়ে যায়। তাই শিয়ার ক্ষেত্রেও বোধহয় তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। এই কদিন শিয়া এক মুহূর্তের জন্যেও কাছ ছাড়া করেনি জিয়াকে। সব সময় জিয়াকে নিজের পাশেপাশে রেখেছে ও। প্রতিটা কাজেই কোনো না কোনোভাবে জিয়ার সাহায্য নিয়েছে শিয়া। কাল শিয়ার হাতের কনুই পর্যন্ত মেহেন্দী পরানোর সাথে সাথে, ওর কথামতো জিয়ার হাতেও কনুই পর্যন্ত মেহেন্দী পরিয়ে দিয়েছেন মেহেন্দী আর্টিস্ট। যদিও নিজের হাতে মেহেন্দী পরা নিয়ে ঘোরতর আপত্তি ছিলো জিয়ার। কিন্তু শিয়া সেই আপত্তির কোনো গ্রাহ্যই করেনি। জিয়ার অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওর দুই হাত ভর্তি মেহেন্দী পরতে হয়েছে ওকে। ওদের দুই বোনের মেহেন্দীর সুগন্ধ মাতিয়ে রেখেছে সারা ঘরময়। শিয়ার হাতের মেহেন্দীর থেকেও যেন জিয়ার হাতের মেহেন্দীর রংটা আরও গাঢ় আর সুন্দর এসেছে। তাই দেখে তো কয়েকজন আত্মীয়া ইয়ার্কি করে বলেই ফেললেন, “জিয়া তোর হাতের মেহেন্দীর রংটা যা গাঢ় হয়েছে, দেখে বোঝাই যাচ্ছে, তোর বিয়ের পর তোকে তোর বর খুব ভালোবাসবে বুঝলি! মেহেন্দীর রং দেখলেই কার বর কাকে কতোটা ভালোবাসে, সেটা বোঝা যায়।” তাদের কথা শুনে তখন জিয়া রেগেমেগে ওখান থেকে চলে এলেও, সবার অলক্ষ্যে এবং অজান্তে চোখ থেকে জল ফেলে গেছে অবিরত। অন্যদিকে শিয়ার আনন্দ, প্রাণোচ্ছলতা পূর্ণ আচরণ জিয়ার আনন্দের সাথে সাথে যেন কষ্টেরও কারণ বলে মনে হচ্ছে। কাল রাতে যেমন শিয়ার মেহেন্দী পরার প্রতিটা মুহূর্ত জিয়া ক্যামেরা বন্দী করেছে, তেমনি শিয়ার কথা মতো ওখানে উপস্থিত বাকিরা জিয়ার মেহেন্দী পরার মুহূর্ত গুলোকে ক্যামেরা বন্দী করেছে। কখনও জিয়া মুখ ভার করে বসে আছে, তো আবার কখনও শিয়ার দিকে তাকিয়ে এক গাল হাসছে। আজ সকাল থেকেই বাড়িতে হইহই কান্ড শুরু হয়ে গেছে। শিয়ার আইবুড়ো ভাতের জন্য সকাল থেকেই ভালো ভালো রান্নার পদ তৈরী করা শুরু হয়ে গিয়েছিলো। এতোক্ষণে হয়তো সব রান্নাবান্না শেষও হয়ে এসেছে। এখন জিয়া শিয়াকে সাজাতেই ব্যস্ত। শিয়াকে কানের দুলটা পরাতে গিয়ে দুলটা হাতে নিয়ে জিয়া বলে উঠলো,
-দিদিয়া তোকে খুব সুন্দর লাগছে রে! একদম নতুন বউ বউ দেখতে লাগছে। বাহ! এই দুলটা তো বেশ সুন্দর দেখতে… এটা কবে কিনলি রে?
-এটা তোর পছন্দ? তাহলে এটা তুই-ই পর জিয়া.. আমি নাহয় অন্য কোনো কানের দুল পরে নিচ্ছি..
-এই না না! আমি কেন পরতে যাবো? এটা তোকেই মানাবে রে দিদিয়া। আর তাছাড়া আমার এসব দুল-টুল পরতে একদম ভালো লাগে না! তুই তো জানিসই এইসব সাজগোজ আমার ভালোলাগে না..
-তাতে কী হয়েছে? আজ নাহয় আমার ইচ্ছেতেই পরলি এই দুলটা.. আয় আমি তোকে পরিয়ে দিচ্ছি…
-না দিদিয়া.. আমি পরবো না বলছি তো!
-পরবি না তো? তুই তোর দিদিয়ার কথা শুনবি না তো জিয়া?
-কিন্তু..
-উঁহু! আর কোনো কিন্তু নয় বোন। আয় এবার আমি তোকে সাজিয়ে দিই..
-আমি আবার কী সাজবো! সেজেই তো আছি।
-আজ তুই আমার পাশে বসে আমার সাথেই ভাত খাবি। তাই তোকেও আমার মতো করেই সাজতে হবে জিয়া।
-আমি কেন তোর পাশে বসে খাবো? আজ তো তোর আইবুড়ো ভাত দিদিয়া। তুই যখন খেতে বসবি, তখন তো আমি তোর ভালো ভালো কয়েকটা ছবি তুলবো!
-ছবি তোলার জন্য অন্য অনেক লোক আছে জিয়া। কিন্তু তোকে আজ আমার সাথে বসেই খেতে হবে ব্যাস! আমি আর কিচ্ছু জানতে চাই না!
শিয়া ওই কানের দুলটা নিজের হাতে জিয়াকে পরিয়ে দিলো। তারপর সুন্দর একটা শাড়ি পরিয়ে খুব সুন্দর করে ওকেও সাজিয়ে দিলো। তখনই গায়েত্রীদেবী ঘরে এসে বললেন,
-কীরে? তোদের দুই বোনের এখনও সাজা শেষ হলো না? খাওয়ার শুভ সময় তো পেরিয়ে যাবে এবার! তাড়াতাড়ি চল…
-চল চল জিয়া, তাড়াতাড়ি খাবি চল!
-আমি খাবো মানে? খেতে তো তুই বসবি দিদিয়া!
-হ্যাঁ আমি তো খেতে বসবোই.. কিন্তু আমার সাথে তুইও খেতে বসবি চল!
-না দিদিয়া, আমি এখন খাবো না! আমার এখন খিদে পায়নি! আমি তোর ছবি তুলবো…
-আচ্ছা, আজ আমি তোর ছবি তুলবো আর তুই আমার। এবার ঠিক আছে তো?
-আর কোনো কিন্তু নয়। চল এবার… মণি? তুমি আমার খাবারের থালার পাশে জিয়ার জন্য আরও একটা থালা সাজাও। জিয়াও আমার সাথে এখনই খেতে বসবে।
-আচ্ছা ঠিক আছে, আমি এক্ষুণি খাবার সাজাতে বলছি। এমনিতেই তো দিদির আইবুড়ো ভাত খাওয়ার সময় বোনেদেরকে পাশে বসতেই হয়। তাই জিয়াও নাহয় আজ তোর পাশে বসেই খাবে। কিন্তু তোরা আগে রেডী হয়ে তাড়াতাড়ি বাইরে তো আয়!
-হ্যাঁ মণি, তুমি যাও। আমরা এক্ষুণি আসছি…
আইবুড়ো ভাতের পর্ব মিটে যাওয়ার পরে বিকেলে যখন শিয়া শাঁখা পরতে গেলো, তখনও জিয়াকে সাথে করেই নিয়ে গিয়েছিলো ও। শিয়ার দুই হাতে শাঁখা আর পলা পরানো হয়ে যাওয়ার পর ওকে দেখে এক প্রকার কেঁদে ফেলেই শিয়াকে জড়িয়ে ধরলো জিয়া। ওকে রাস্তার মধ্যেই এভাবে কাঁদতে দেখে শিয়া বললো,
-কী হলো জিয়া? তুই কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে তোর?
-কিছু না দিদিয়া। শাঁখা আর পলা পরে তোর হাত গুলো কি সুন্দর লাগছে রে.. আর কয়েক ঘন্টা পরেই তো তোর বিয়ে হয়ে যাবে। আর তুই আমাদের পর হয়ে যাবি। তাই সেটা ভেবে একটু কষ্ট হচ্ছিলো! এবার তাড়াতাড়ি বাড়ি চল। সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে!
-হ্যাঁ চল…
সারারাত একটুও ঘুম হয়নি জিয়ার। ওর মনের ভিতরে যেন এখনও কেমন একটা চাপা কষ্ট হয়েই চলেছে। মনে হচ্ছে ওর বুকের ভিতরে কোনো একটা ভারী পাথর চেপে বসে আছে। আর যতোই শিয়ার বিয়ের সময়টা এগিয়ে আসছে, ওই পাথরটা যেন ততোই চেপে বসছে ওর বুকের ওপর। কিন্তু কেন যে এমন হচ্ছে, তার কারণটা ও বুঝতে পারছে না। আয়ানকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে, নাকি শিয়া পর হয়ে যাওয়ার ভয়ে, সেটা বোঝার চেষ্টা করতে গেলেই ওর মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়ে যাচ্ছে। ভোর হতেই সবাই ওদের ঘরে ডাকতে এসেছে জল সইতে যাওয়ার জন্য। সারারাত জেগে থাকার পরে এই কিছুক্ষণ আগেই জিয়া একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলো। তাই বাইরে থেকে কেউ দরজা ধাক্কা দিচ্ছে শুনতে পেয়ে শিয়া-ই উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলো। তারপর বিছানায় ফিরে এসে জিয়াকে ঠেলে ঠেলে ডাকতে লাগলো,
-এই জিয়া ওঠ! ভোর হয়ে গেছে তো। সবাই জল সইতে যাওয়ায় জন্য ডাকতে এসে গেছে আমাদের।
ঘুমের ঘোরেই জড়ানো গলায় জিয়া বললো,
-তুই চলে যা দিদিয়া, আমি যাবো না! আমার খুব ঘুম পাচ্ছে…
-না জিয়া, তোকে আমার সাথে যেতেই হবে। ওঠ বলছি..
-আমি বললাম তো দিদিয়া, তুই চলে যা প্লিজ.. আমি সত্যিই উঠতে পারছি না এখন! চোখ গুলো খুলতেই পারছি না।
-তুই না গেলে কিন্তু আমিও যাবো না বোন… এই আমি তোর পাশে আবারও শুয়ে পড়লাম!
শিয়া আবার বিছানায় শুয়ে পড়ার সাথে সাথেই ধরফরিয়ে উঠে বসলো জিয়া। তারপর শিয়াকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-এই দিদিয়া, দেখ আমি উঠেছি! এবার তো তুই ওঠ.. আমি তোর সাথে জল সইতে যাবো। এবার তুই যাবি তো? তুই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে প্লিজ। আমিও এক্ষুণি ফ্রেস হয়ে আসছি!
জিয়া বিছানা থেকে নেমে গিয়ে বাথরুমে ঢোকার পর শিয়াও তৈরী হয়ে নিলো জল সইতে যাওয়ার জন্য। ওখান থেকে ফিরে এসে দধি মঙ্গলের পর্ব শেষ করে আবার শিয়াকে গায়ে হলুদের জন্য তৈরী করে দিলেন মেকআপ আর্টিস্ট। আজ জিয়া নিজের ইচ্ছেতেই একটা হলুদ রঙের শাড়ি পরেছে। অনেক কষ্টে ও নিজের মনকে বুঝিয়ে নিয়েছে এটা ভেবে যে, যেটা হচ্ছে, সেটা ওর দিদিয়ার ভালোর জন্যই হচ্ছে। এর থেকে বেশি কিছু ও আর ভাববে না। ও নিজের মনকে বোঝালো, আজ আর আয়ানকে সামনে থেকে দেখে ও কিছুতেই ভেঙে পড়বে না। যে করেই হোক সবার সামনে নিজেকে কাঠিন্যের মোড়কে মুড়িয়ে রাখবে আর সবার সামনে খুব হাসিখুশী থাকবে। ঠিক যেমনটা ও আগে ছিলো, সেরকমই প্রাণোচ্ছল থাকবে বলে ঠিক করলো। সেই মতো ভেবেই আজকের সকালটা শুরু করেছে জিয়া। শিয়াও সকাল থেকে বেশ হাসিখুশী রয়েছে। আগের থেকে ও নিজেকে অনেকটা স্বাভাবিক করে তুলেছে অনসূয়াদেবী এবং সুখময়বাবুর সামনে। ওনারাও শিয়ার এরকম পরিবর্তন দেখে বেশ খুশী হতে শুরু করেছেন। ধীরে ধীরে নিজেদের মেয়ের সাথে ওনাদের মানসিক দূরত্বটা যেন একটু একটু করে ঘুচে যেতে শুরু করেছে।
আয়ানের শরীরটা যেন একটা যন্ত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। সকাল থেকে ও যেন যন্ত্র চালিতের মতো নিজের শরীরটাকে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে বয়ে নিয়ে চলেছে আর বাড়ির বড়োদের কথা মতো একের পর এক সব নিয়মকানুন পালন করে চলেছে। রিমলি সেদিনের পর থেকে আর একটাও কথা বলেনি আয়ানের সাথে। আয়ান অনেকবার রিমলিকে সবটা খুলে বলার জন্য ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু রিমলি বারবার এড়িয়ে গেছে আয়ানকে। রিমলির এই বিয়েতে থাকার মতো কোনো ইচ্ছাই ছিলো না। শুধু এটা ভেবেই রয়েছে যে, আজ বাড়িতে ভর্তি আত্মীয়স্বজনরা রয়েছেন। তাই রিমলি যদি আজ আয়ানের বিয়েতে উপস্থিত না থাকে, তাহলে সবাই সন্দেহ করবেন। তাছাড়া আয়ান, বাসন্তীদেবী এমনকী রিমলিকেও বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। আর রিমলি চায় না যে, আয়ানের ব্যাপারে বা আয়ানের এই মিথ্যে বিয়েটা নিয়ে আর কোনো কথা বলতে। তাই রিমলি নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও আয়ানের বিয়ের সমস্ত আয়োজনে উপস্থিত আছে। বাসন্তীদেবীকে এবং বাকি অন্যান্য আত্মীয়স্বজনদের কাজকর্মে আর নিয়মকানুন পালনে সাহায্যও করছে। আয়ানের গায়ে হলুদের পর ওর গায়ে ছোঁয়ানো সেই হলুদ নিয়ে আয়ানের বাড়ির বেশ কিছু লোকজন শিয়াদের বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে। গায়েত্রীদেবী, অনসূয়াদেবীসহ বাড়ির সবাই নতুন কুটুমদের আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আত্মীয়স্বজনদের জোরাজুরিতে রিমলিকেও আসতে হয়েছে এখানে। কিন্তু এসে থেকেই রিমলি ভীষণ চুপচাপ হয়ে সোফার এক কোণে বসে রয়েছে। সেটা দেখে জিয়া ওর দিকে এগিয়ে এসে বললো,
-একি রিমলি? তুমি এখানে এভাবে একা একা বসে আছো কেন? তোমাদের বাড়ির সবাই তো ওদিকে দিদিয়ার সাথে দেখা করতে গেলো। তুমি যাবে না?
জিয়াকে দেখেই রিমলির চোখের সামনে ভেসে এলো আশীর্বাদের দিনের সন্ধ্যেবেলার ওই ঘটনাটা। ঘটনাটা মনে পড়ে যাওয়ায় এবং আজ জিয়াকে সেই সবকিছুর পরেও এতোটা স্বাভাবিক থাকতে দেখে, আর জিয়া নিজের দিদিকে ঠকাচ্ছে ভেবে জিয়ার প্রতি খুব রাগ হলো রিমলির। তাই জিয়ার প্রশ্নের উত্তরে একটু রাগে রাগেই ও বললো,
-না! আমি এখানেই ঠিক আছি। তুমি এতো ভেবো না।
-কিন্তু কেন রিমলি? তোমার কী কিছু হয়েছে? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে কোনো কারণে হয়তো তোমার মুড অফ… কী হয়েছে বলোনা আমায়?
-না গো! কিচ্ছু হয়নি আমার। তুমি যাও, ওদিকে গিয়ে সবার সাথে এনজয় করো!
কথাটা বলেই রিমলি মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো। ওর এরকম রূঢ় ব্যবহারে জিয়া খুব অবাক হলো। কিন্তু হঠাৎ করে রিমলির এরকম ব্যবহারের কোনো কারণ খুঁজে পেলো না জিয়া। ও এটাই ভাবলো যে, সেদিন এসে তো রিমলি বেশ ভালোই ব্যবহার করেছিলো ওর আর শিয়ার সাথে। ঘরে বসে বেশ কিছুক্ষণ গল্পও করেছিলো সবার সাথে। কিন্তু হঠাৎ করে কী এমন হলো, যে আজ রিমলি জিয়াকে এরকম এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো। আর সাত-পাঁচ কিছু না ভেবে রিমলিকে আর ঘাঁটালো না জিয়া। মুখে একটু হাসি টেনে ও ওখান থেকে সরে গেলো। দূর থেকে রিমলিকে একা একা বসে থাকতে দেখে শিয়া এগিয়ে এলো ওর দিকে। শিয়াকে দেখতে পেয়ে শান্ত স্বরে রিমলি নিজেই ডাকলো,
-আরুশি দি?
-হ্যাঁ বলো, তুমি কেমন আছো রিমলি? এখানে এভাবে একা একা বসে আছো যে?
-ওই ভালোই আছি বলতে পারো! আজ আমার নিজের দাদার বিয়ে বলে কথা। আমি কী আর খারাপ থাকতে পারি বলো?
শিয়ার উদ্দেশ্যে কথাটা বলেই মুখটা নামিয়ে নিলো রিমলি। কারণ কথাটা বলতে গিয়ে আর শিয়ার মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে করুণায় ওর চোখটা ভিজে উঠেছে। অশ্রু লুকানোর জন্যই মুখটা নামিয়ে নিলো ও। রিমলির কথা শুনে মিষ্টি করে একটু হেসে ওর পাশে বসলো শিয়া। তারপর বললো,
-হ্যাঁ সেতো নিশ্চয়ই। তোমার দাদার বিয়েতে তোমার আনন্দ তো হবেই। তারপর বলো, ওদিকে সব ঠিকঠাক আছে তো? আর তোমার দাদার স্নান হয়ে গেছে?
-হ্যাঁ সব ঠিক আছে গো আরুশি দি! এতক্ষণে হয়তো দাদার স্নানও হয়ে গেছে।
-একী, তুমি তো দেখছি কিছুই খাওনি। তাড়াতাড়ি এগুলো খেয়ে নাও প্লিজ।
-না। আমি জলখাবার খেয়েই এসেছি আরুশি দি। এখন আর এই লুচি তরকারি আমি খেতে পারবো না। গা গুলিয়ে উঠবে আমার!
-ওহ্, তাহলে অন্তত একটা মিষ্টি খাও। নাহলে কিন্তু আমার খুব খারাপ লাগবে। তুমি তোমার দাদার হবু শ্বশুর বাড়িতে এসেছো, কিছু না খেয়ে যে এভাবে খালি মুখে চলে যেতে নেই রিমলি.. এই নাও একটা মিষ্টি খাও… হাঁ করো বলছি…
শিয়া সামনে মিষ্টি আর জল খাবার সাজিয়ে রাখা প্লেট থেকে একটা মিষ্টি তুলে নিজের হাতে রিমলিকে খাইয়ে দিলো। রিমলি কোনোরকমে মিষ্টিটা মুখে নিয়ে চিবাতে লাগলো। শিয়ার মুখের দিকে তাকালে রিমলির এতোটাই কষ্ট হচ্ছে যে, এতো রসালো সুন্দর একটা মিষ্টির স্বাদও যেন কেমন তিক্ত হয়ে উঠেছে ওর কাছে। এর মধ্যেই গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার জন্য শিয়ার ডাক পড়লো। তাই রিমলির দিকে জল ভর্তি কাঁচের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে শিয়া বললো,
-গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য আমাকে ডাকছে। তাই এখন এই একটা মিষ্টি খাইয়েই তোমাকে ছেড়ে দিলাম রিমলি। রাতে কিন্তু তোমাকে সবকিছু একদম নিজের হাতে পেট পুড়ে খাইয়ে তবেই আমি ছাড়বো!
শিয়ার কথা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়িয়ে মিষ্টি করে হাসলো রিমলি। শিয়া সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চলে যাওয়ার সময় বললো,
-তুমিও এসো আমার সাথে.. আর হ্যাঁ শোনো, গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের পর তুমি যেন আবার হঠাৎ করে বাড়ি চলে যেও না রিমলি। তোমার সাথে আমার একটু দরকার আছে। আমার সাথে দেখা করে, কথা বলে তবেই বাড়ি ফিরো, কেমন?
-আচ্ছা!
গায়ে হলুদ পর্ব মিটে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর শিয়াকে সাজানোর জন্য মেকআপ আর্টিস্ট এসে যাওয়ায় শিয়া আর জিয়া মিলে ঘরে সাজতে বসে গেলো। দধি মঙ্গলের পর সেই সকাল থেকে শিয়া কিছু খায়নি বলে জিয়াও আর কিচ্ছুটি দাঁতে কাটেনি। তাই অনসূয়াদেবী একটা প্লেটে করে কয়েকটা মিষ্টি আর শরবত নিয়ে এসে ওদের দুজনকেই খাইয়ে দিলেন। তারপরই শাড়ি পরানোর জন্য ঘরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হলো।
-বাবান তোর মাকে প্রণাম করে বল যে, “মা, তোমার জন্য দাসী আনতে যাচ্ছি!”
আয়ানের মাসি এই কথাটা বলায় পাশ থেকে বাসন্তীদেবী বললেন,
-নারে বাবান, তোকে এইসব কিচ্ছু বলতে হবে না! তুই শুধু কাল সকালে সাবধানে বৌমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসিস, তাহলেই হবে। আর ওইসব দাসী আনতে যাচ্ছি, এই আনতে যাচ্ছি, ওসব এখন আর কেউ বলে না। আর আমি চাইও না তুই এসব বলিস। তুই বরং আমার জন্য আর একটা মেয়ে নিয়ে আসিস বাবান। আর দেরী করিস না! তোরা এবার সাবধানে রওনা দে..
বাসন্তীদেবীর কথা শেষ হতে, ওনাকে প্রণাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বরের জন্য সাজানো গাড়িটায় চেপে শিয়ার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো আয়ান। তার পিছনে বর যাত্রীদের জন্য ভাড়া করা অন্য গাড়িটায় চেপে বাকিরাও রওনা হলো বিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে।
-এই বর এসেগেছে! বর এসেগেছে!
বাড়ির বাইরে একটা ফুলের সাজানো বরের গাড়ি থামতে দেখে কেউ একজন চিৎকার করতে করতে বাড়ির ভিতরে ঢুকলো। সঙ্গে সঙ্গে হইহই পড়ে গেলো সারা বাড়িতে। অনসূয়াদেবীর কথামতো গায়েত্রীদেবীকেই শিয়ার বরকে বরণ করতে হবে। কারণ অনসূয়াদেবী শিয়াকে পেটে জন্ম দিলেও, এতো গুলো বছর ধরে ওকে গায়েত্রীদেবী-ই সন্তান স্নেহে বড়ো করে তুলেছেন। তাই শিয়ার যাবতীয় বিষয়ে অনসূয়াদেবীর আগে গায়েত্রীদেবীরই অধিকার। আয়ানের সাথে ওর দূর সম্পর্কের দুই ভাই বোন এসেছে। বাকি বর যাত্রীরা এখনও এসে পৌঁছয়নি। আয়ান বরবেশে গাড়ি থেকে নামতেই ওকে বরণডালা হাতে নিয়ে বরণ করে নিলেন গায়েত্রীদেবী। বরণ শেষে ওর মুখে তুলে দিলেন মিষ্টি আর জল। দূরের এক কোণে আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা এক নারীর দুই চোখ তখন অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছে। কেউ দেখার আগেই চোখ থেকে চশমাটা খুলে নামিয়ে এনে সে চোখের জলটা মুছে নিলো চুপিসারে। তারপর ওখান থেকে সরে গেলো সবার চোখের আড়ালে…
এদিকে কনেকে সাজানোও প্রায় শেষের দিকেই। কনের মাথায় লাল রঙের ওড়নাটা চাপিয়ে দিয়ে মেকআপ আর্টিস্ট কনে সাজানো সম্পূর্ণ করলেন। তারপর তিনি নিজের তৈরী পেজের দর্শকদের নিজের হাতের কাজের নিপুণতা দেখানোর জন্য বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিলেন ব্রাইডের। তারপরই বাকি থাকা পেমেন্টটা বুঝে নিয়ে বিয়ে বাড়ি ছাড়লেন তিনি।
সুখময় বাবু আর অনসূয়াদেবীর কথা মতো আজ শিয়াকে অমলেন্দু বাবু-ই সম্প্রদান করবেন। পুরোহিতের আদেশানুযায়ী আয়ান এবং অমলেন্দু বাবু মন্ত্রপাঠ করছিলেন এতোক্ষণ। পুরোহিত মশাই কিছুক্ষণ মন্ত্র পাঠ করার পর এবার পাত্রীকে নিয়ে আসার জন্য অনুমতি প্রদান করলেন। তখনই পান পাতায় মুখ ঢেকে কাঠের পিঁড়িতে বসিয়ে পাত্রীকে নিয়ে হাজির হলো কয়েকজন কম বয়সী ভাইয়েরা মিলে। আয়ানের চারপাশে সাতপাক ঘোরানো হলো পাত্রীকে। সাত পাক ঘোরা সম্পূর্ণ হওয়ার পর আয়ানের সামনে নিয়ে এসে পিঁড়ি ধরে দাঁড়ালো ছেলেরা। তখনও কনের মুখ পান পাতায় ঢাকা। পাশ থেকে সব আত্মীয়স্বজনরা চেঁচিয়ে পান পাতা সরিয়ে বরের মুখ দেখার জন্য জোর করছে শিয়াকে। আয়ান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে তখনও। তাই আয়ানের আত্মীয়স্বজনরাও ওকে শিয়ার দিকে মুখ তুলে তাকানোর জন্য বলে চলেছে। আয়ানের পাশেই ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে জিয়া। ও কোনো কথা না বলে চুপচাপ ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওখানে উপস্থিত বাকি সবার জোরাজুরিতে শিয়া মুখ থেকে পান পাতাটা সরালো। আর আয়ান সেই মুহূর্তেই ওর দিকে মুখ তুলে তাকালো। আয়ান মুখ তুলে অপর প্রান্তে তাকানোর সাথে সাথেই কনের বেশে শিয়া অন্য সবার অলক্ষ্যে একটা চোখ বন্ধ করে চোখ মেরে বসলো আয়ানকে। চমকে উঠে বিষম খেয়ে গেলো আয়ান। ওর কাশি আর থামতেই চাইছিলো না কিছুতেই। ওখানে উপস্থিত কোনো একজন ব্যক্তি একটা জলের গ্লাস নিয়ে এসে আয়ানের হাতে ধরিয়ে দিতে এক নিমেষের মধ্যে ও ঢকঢক করে পুরো জলটাই শেষ করে ফেললো। তখনও হালকা কাশির রেশ রয়েই গেছে ওর মধ্যে। আয়ান মনে মনে এটাই ভাবলো যে, এই কদিনে শিয়াকে ও যতো দূর চিনেছে, এবং দুদিন সামনে থেকে দেখে আর জিয়ার মুখে ওর সমস্ত কথা শুনে যতোটা বুঝেছে, তা থেকে এটুকু নিশ্চিত হওয়া যায় যে, শিয়া এইভাবে, বিশেষ করে সবার সামনে চোখ মারার মতো মেয়েই নয়। আয়ান নিজের চোখকেই কোনোভাবে বিশ্বাস করতে পারছে না এখনও পর্যন্ত। ততোক্ষণে বিয়ের কনেকে ওর ভাই-দাদারা পিঁড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছে। কারণ এতোক্ষণ সময় ধরে ওর পিঁড়ি ধরে থাকতে পারছে না দেখে, কনে নিজেই বলেছে ওকে পিঁড়ি থেকে নিচে নামিয়ে দিতে।
ক্রমশ…
অন্তিম পর্ব ২-এর লিংক-
https://www.facebook.com/101048758811830/posts/293328759583828/