#হৃদমাঝারে পর্ব-১৩
#দেবারতি_ধাড়া
-এই প্রফেসর! তোমার মাথা খারাপ নাকি? এখন কী করে তোমার সাথে দেখা করবো আমি? আর তাছাড়া এখন দেখাই বা করবো কেন? ও আচ্ছা.. এবার বুঝেছি! তুমি আমার দিদিয়ার সাথে দেখা করতে চাও তাই তো?! মানে আমি যাতে তোমার কাছে দিদিয়াকে নিয়ে যাই, তুমি সেটাই চাইছো, তাইতো?
-না জিয়া! না.. তুমি ভুল ভাবছো.. আমি তোমার দিদিয়ার সাথে না, তোমার সাথেই দেখা করতে চাই। প্লিজ একটিবারের জন্য তুমি আমার সাথে দেখা করো জিয়া.. প্লিজ!
-সেটা কিছুতেই পসিবল নয় প্রফেসর। আমি এখন তোমার সাথে দেখা করতে পারবো না!
-তাই? তুমি দেখা করবে না তাইতো? ঠিক আছে। তোমাকে দেখা করতে হবে না আমার সাথে! তুমি শুধু এটা শুনে রাখো জিয়া, আমার পক্ষে শিয়াকে মানে তোমার দিদিয়াকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। আর আমি কালই শিলিগুড়ি ফিরে যাবো। তাহলে তোমার সাথে আমার শিলিগুড়িতেই আবার দেখা হবে!
-হোয়াট! তুমি শিলিগুড়িতে ফিরে যাবে মানে কী? আর আমার দিদিয়াকে বিয়ে করবে না মানেটা কী হ্যাঁ?! আমার পিমণির বাড়িতে দিদিয়ার বিয়ের সব আয়োজন শুরু হয়ে গেছে! দিদিয়াও তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে প্রফেসর! আর এখন তুমি বিয়ে করবে না মানে?!
-আমি তো তোমাকে বললামই জিয়া! আমি বিয়ে করতে পারবো না! আমি শিয়ার ছবিটা দেখে তুমি ভেবেছিলাম জিয়া। আর সেই জন্যই আমি এই বিয়েতে রাজী হয়েছিলাম। ট্রাস্ট মী জিয়া.. আমি তোমাকে…
কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারলো না আয়ান। ও ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো ফোনের অপর প্রান্তে। ওর কান্নার শব্দ পেয়ে জিয়ার চোখ দুটোও কেমন জ্বালা করে উঠলো যেন। হাওয়ায় উড়ে এসে চোখে কিছু পড়েছে ভেবে জিয়া নিজের হাতের আঙুল দিয়ে চোখ গুলো হালকাভাবে একটু রগড়ে নিলো। তারপর ও বললো,
-আমি সিবিটি বাস স্টপের কাছে ওয়েট করছি। তুমি তাড়াতাড়ি এসো প্রফেসর! আমারও তোমার সাথে ভীষণ দরকার আছে।
-আমি আসছি জিয়া। আমি এক্ষুণি আসছি! তুমি একটু অপেক্ষা করো আমার জন্য…
আয়ান বাড়িতে একটা ঢলঢলে টিশার্ট আর একটা ট্রাউজার পরেছিলো। সেই মুহূর্তে আর পোশাক বদলানোর মতো মানসিক অবস্থা ছিলো না আয়ানের। তাই বাড়ির পোশাক পরেই বাড়ির গ্যারেজ থেকে ওর বহু পুরোনো রয়্যাল এনফিল্ড বাইকটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো আয়ান। নিমেষের মধ্যে বাইক প্রায় এক প্রকার উড়িয়েই ও পৌঁছে গেলো জিয়ার কথামতো সিবিটি বাস স্টপের কাছে। আয়ান এতোটাই জোরে বাইক চালাচ্ছিলো যে জিয়াকে দেখতে পেয়ে খুব জোরে ব্রেক কষলেও বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে তবেই ওর বাইকটা থামলো। আয়ানকে দেখে জিয়া দৌড়ে এসে বললো,
-তুমি কী পাগল হয়ে গেছো নাকি প্রফেসর?!! এভাবে কেউ বাইক চালায়! আর একটু হলেই তো ওই ল্যাম্পপোস্টটাতে ঠুকে দিচ্ছিলে! যদি কোনো একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যেতো, তাহলে কী হতো তখন?
-আমার কিচ্ছু হবে না জিয়া! কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হবে না আমার। আমি যতোক্ষণ না তোমাকে আমার মনের কথা গুলো বলতে পারছি, ততোক্ষণ আমার কিচ্ছু হতেই পারে না!
-মানে? তোমার মনের কথা বলতে? কী তোমার মনের কথা?
-আই লাভ ইউ জিয়া! ট্রাস্ট মী.. আই রিয়েলি লাভ ইউ! আমি জানি, এই কথাটা তোমাকে আমার অনেক আগেই বলে দেওয়া উচিৎ ছিলো। কিন্তু আমি বলার সুযোগ পাইনি। আর শুধু সুযোগ কেন? আমি কথাটা তোমাকে কীভাবে বলবো, কখন বলবো সেটাই বুঝে উঠতে পারিনি। আসলে তুমি তো জানোই জিয়া, আমি তোমাকে কতোটা ভয় পাই! তার ওপর তোমার কাছে বহুবার শুনেছি, তুমি নাকি আবার এসব বিয়ে, বন্ধন কিছুই পছন্দ করো না। তাই তোমাকে ভালোবাসার বা বিয়ের কথা বলার মতো এতো সাহস পাইনি আমি। আর সেই জন্যই তোমাকে বারবার বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করেছি আমি। তারপর তুমি যখন একদিন বললে যে, তোমার মনের মতো যদি কাউকে পাও, যে তোমাকে আর তোমার ইচ্ছে গুলোকে সম্মান করবে, তোমাকে সাপোর্ট করবে, তাকে তুমি বিয়ে করতে রাজী হবে। তখনই আমি মনে একটু জোর পেয়েছিলাম। আর তুমি তো জানোই জিয়া, আমি তোমাকে আর তোমার ইচ্ছে গুলোকে কতোটা সম্মান করি…
-এসব তুমি কী বলছো প্রফেসর!! তুমি কী পাগল হয়ে গেছো নাকি হ্যাঁ?! আর কিছুদিনের মধ্যেই আমার দিদিয়ার সাথে তোমার বিয়ে। আর তুমি এখন আমাকে এইসব কথা বলছো? আর তাছাড়া তুমি ভাবলে কী করে যে আমি তোমাকে বিয়ে করতে রাজী হবো? তোমাকে তো আমি আগেই বলেছি যে, আমি এইসব বিয়ে, সম্পর্ক কিছুতেই বিশ্বাস করি না! কোনো একজন মানুষের সাথে সারাটা জীবন কাটানোর কথা তো আমি ভাবতেই পারি না। ভাবতে গেলেও দম বন্ধ হয়ে আসে আমার! আর তাছাড়া ওই ছবিটা দেখে তোমার বোঝা উচিৎ ছিলো যে, ওটা আমার ছবি নয়! আমার আর আমার দিদিয়ার মধ্যে বেসিক ডিফারেন্সটা তো ওই ছবির মধ্যে যথেষ্ট পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে। আমার কী দিদিয়ার মতো বড়ো চুল? নাকি আমাকে কোনো দিন শাড়ি পড়তে দেখেছো তুমি? নাকি আমি কোনো দিন চশমা ছাড়া ছবি তুলেছি? ছবিটা দেখে তোমার কী করে মনে হলো ওটা আমি বলে?!
-আমি ভেবেছিলাম ওটা হয়তো তোমার অনেক আগেকার ছবি। তুমি একটু মনে করো জিয়া, আমি যখন তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, তোমার মা-বাবা যদি তোমাকে না জানিয়ে কখনও তোমার বিয়ের ঠিক করে, তাহলে তুমি কী করবে? তুমি কিন্তু উত্তরে আমাকে এটাই বলেছিলে, যে তোমার বাবা নাকি মাঝে মাঝেই তোমাকে বলতেন যে হঠাৎ করেই একদিন তোমার বিয়ের ঠিক করে তোমাকে না জানিয়েই কলকাতায় ডেকে পাঠাবেন। এই সবকিছু ভেবে চিন্তেই আমি মনে করেছিলাম সত্যি সত্যিই হয়তো তোমার মা-বাবা তোমার বিয়ের সম্বন্ধ দেখা শুরু করেছেন তোমার জন্য। আর সেজন্যই তো আমি শিয়ার ছবি দেখে তুমি বলে ভেবেছিলাম।
-তোমার সব ভাবনা-চিন্তা যে সবসময় ঠিক হবে, এমন তো কোনো মানে নেই প্রফেসর! আমাদের ভাবনা-চিন্তা অনুযায়ী তো সবসময় সবকিছু হয় না। আমার দিদিয়া যদি এই সবটা শোনে, তাহলে হয়তো আমি আর আমার দিদিয়াকে সামলে রাখতে পারবো না! এমনিতেই আমার দিদিয়ার মানসিক অবস্থা খুবই খারাপ। আমার দিদিয়া হয়তো মনে মনে তোমাকে নিজের স্বামীর জায়গায় বসাতে শুরু করেছে। হয়তো কী! আমার দিদিয়া তো সত্যি সত্যিই তোমাকে নিজের স্বামীর জায়গায় বসাতে শুরু করেছে। ওর উপন্যাসের সেই কাল্পনিক পুরুষ চরিত্রের মতো তোমাকেও ও নিজের করে পেতে চায়.. আমি চাই না, এই সবকিছু জেনে গিয়ে, বা কোনোভাবে বিয়েটা ভেঙে গিয়ে আমার দিদিয়া আর কোনোরকম কষ্ট পাক! আর সেই জন্য তোমাকে আমার দিদিয়াকে বিয়েটা করতেই হবে প্রফেসর!
-সেটা কখনোই সম্ভব নয় জিয়া। আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। তাই আমার পক্ষে তোমাকে ছাড়া আর অন্য কাউকে বিয়ে করা কখনোই সম্ভব নয়! একজনকে ভালোবেসে, অন্যজনকে বিয়ে করে তার সাথে সংসার করতে আর সারাজীবন কাটাতে আমি কোনোভাবেই পারবো না…
-এখন তো আর কিছু করার নেই প্রফেসর! আমার দিদি মনে মনে তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। আর আমার দিদিয়ার কষ্ট আর আমি দেখতে পারবো না। এমনিতেই আমার দিদিয়া এতো গুলো বছরে অনেক কষ্ট পেয়েছে!
-আর এদিকে যে আমি কষ্ট পাচ্ছি, সেটা তোমার চোখে পড়ছে না। আমার ভেতরটা যে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে, সেটা তুমি বুঝতে পারছো না! তাইনা জিয়া?
-আমি অতশত বুঝি না! তোমাকে আমার দিদিয়াকে বিয়ে করতে হবে ব্যাস্! আমি আর আমার দিদিয়া তো একই দেখতে। তাই আমাকে বিয়ে করা যা, আর আমার দিদিয়াকে বিয়ে করাও তো একই ব্যাপার! আর তাছাড়া আমি তো তোমাকে শুধুমাত্র একজন ভালো বন্ধুই মনে করি। আমি তোমাকে কোনো দিন ভালোও বাসিনি, আর তোমাকে বিয়ের কথা ভাবা তো অনেক দূরের কথা! আমি তো একটা উড়নচন্ডী, ছটফটে অশান্ত মেয়ে! রান্না করা, শ্বশুর বাড়ির লোকের সেবা যত্ন করা, সংসার সামলানো, বাচ্চা সামলানো কিছুই আমার দ্বারা হবে না! আমার সাথে তুমি কোনোদিনই সুখী হতে পারবে না! আমার কোনো যোগ্যতাই নেই তোমার বউ হওয়ার মতো। আমার থেকে আমার দিদিয়া অনেক গুনে ভালো গো প্রফেসর! আমার দিদিয়া খুব ভালো রান্না করতে পারে, সংসারও সামলাতে একদম নিপুণ। জানো প্রফেসর, আমার দিদিয়া পড়াশোনাতেও খুব ভালো.. ও কিন্তু ম্যাথস্ও খুব ভালো পারে। ছোটোবেলায় তো আমি ওর কাছেই অংক করতাম! আর এখন আমি আমার দিদিয়ার অন্য একটা গুণ আবিষ্কার করেছি। আমার দিদিয়া খুব ভালো লেখেও.. আমি তো এতোদিন জানতেই পারিনি যে আমার দিদিয়া এতো ভালো লিখতে পারে বলে! আমার দিদিয়াকে বিয়ে করলে তুমি সত্যিই খুব সুখী হবে প্রফেসর..
-জিয়া! অ্যাকচুয়ালি কী বলোতো? তুমি আসলে ভালোবাসার মানেই বোঝো না! ভালোবাসার আসল মানে কী, সেটা যদি তুমি বুঝতে, তাহলে অন্তত এই কথাটা তুমি বলতে পারতে না! সত্যিই তুমি এখনও ভীষণ ইমম্যাচুয়র্ড জিয়া! তাই আমাকে শেখাচ্ছ আমি কীসে সুখী হবো আর কীসে সুখী হবো না.. তাহলে একটা কথা শুনে রাখো জিয়া, আমি মাকে বলে দিয়েছি, যে আমি শিয়াকে বিয়ে করতে পারবো না। আর আমি কালই শিলিগুড়ি ফিরে যাবো। আমি জানি এটা শোনার পর মা খুব খুব কষ্ট পেয়েছে, খুব অসুস্থও হয়ে পড়েছে। হয়তো আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বে। এমনকি আমার মা হয়তো আমাকে ত্যাজ্যপূত্রও করতে পারে। কিন্তু ট্রাস্ট মী জিয়া, তাতে আমার একটুও খারাপ লাগা থাকবে না, আমি একটুও কষ্ট পাবো না। কারণ আমি যেমন এই মিথ্যে বিয়েটা করে শিয়াকে ঠকাতে পারবো না, তেমনই নিজেকেও ঠকাতে পারবো না। তোমাকে ভালোবেসে শিয়াকে বিয়ে করলে শুধু শিয়াকে নয়, আমার নিজেকে নিজেই ঠকানো হবে। কারণ তুমি যদি আমায় ভালো নাও বাসো, তবুও আমি তো জানি আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর আমি আমার ভালোবাসার মানুষটাকে দূর থেকে ভালোবেসেই সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারবো। তার জন্য তোমাকে আমার বিয়ে করার কোনো প্রয়োজন হবে না। কারণ আমি এটা জেনে বুঝেই তোমাকে ভালোবেসেছি যে, তুমি এইসব বিয়ে, সম্পর্ক কিছুতেই বিশ্বাস করো না। কিন্তু আমি শুধু তোমার বন্ধু হয়ে সারাজীবন তোমার পাশে থাকতে পারবো, সেটা ভেবেই তোমাকে ভালোবেসেছিলাম জিয়া। আর আমি সত্যিই কাল শিলিগুড়ি চলে যাচ্ছি। আর কখনও কলকাতায় ফিরবো না আমি…
জিয়া কোনোভাবেই আয়ানকে বিয়েতে রাজী করাতে না পেরে আয়ানের দিকে এগিয়ে এসে ওর হাতটা টেনে নিয়ে নিজের মাথায় রেখে বললো,
-তোমাকে আমার মাথার দিব্যি প্রফেসর! তুমি যদি আমাকে কোনো দিনের জন্যেও একটু হলেও ভালোবেসে থাকো, তাহলে আমার দিদিয়াকে তুমি বিয়ে করতে রাজী হবে। তা নাহলে কিন্তু তুমি আমার মরা মুখ দেখবে!
-জিয়া!! তুমি কী বলছো তুমি জানো?! না জিয়া। আমি পারবো না এটা.. আমি কী করে করবো জিয়া?
-প্লিজ প্রফেসর! তুমি আমার এই একটা কথা অন্তত রাখো.. আমাকে যদি সত্যিই ভালবেসে থাকো, তাহলে আমার জন্য এই সামান্য একটা ব্যাপারে আমার কথা রাখতে পারছো না?
-এটা তোমার কাছে সামান্য ব্যাপার হতে পারে জিয়া। কিন্তু আমার কাছে এটা একটা সামান্য ব্যাপার নয়.. আমার কাছে এটা সারাজীবনের একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তাই আমি কিছুতেই এই বিয়ে করতে পারবো না! আমি কী করে নিজেকে ঠকাবো জিয়া? তোমার জায়গায় যে আমি আর অন্য কাউকে কোনো দিনের জন্য বসাতে পারবো না…
-ঠিক পারবে! আমি আমার মায়ের কাছে শুনেছি প্রফেসর, এমন অনেক স্বামী-স্ত্রী আছে, যারা বিয়ের আগে একে অপরকে চিনতো না পর্যন্ত। বা বিয়ের আগে হয়তো অন্য কাউকে ভালোবাসতো। কিন্তু বিয়ের পর একসাথে থাকতে থাকতে তারা দুজন দুজনকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে। এবং এখন তার খুব সুখে সংসারও করছে। তাদের মধ্যে আর কোনো দূরত্ব বা ফাঁক নেই। তোমাদের মধ্যেও নাহয় ঠিক তেমনটা হবে। বিয়ের পরেই নাহয় তোমরা একে অপরকে জেনে বুঝে নিও.. কিন্তু তুমি এই বিয়েটা করো প্রফেসর। এই বিয়েটা না করলে কিন্তু আমি সবকিছু ছেড়ে, সবাইকে ছেড়ে চলে যাবো। আর কোনো দিন ফিরবো না… আর যেটা আমার সব থেকে প্রিয়, আমার ফটোগ্রাফি। আমি সেটাও ছেড়ে দেবো! আর এতোদিনে আমি যা যা ছবি তুলেছি, সব নষ্ট করে ফেলবো! জ্বালিয়ে দেবো সব এক্সিবিশনের ছবি গুলো!
-না জিয়া! এসব তুমি কী বলছো? সবাইকে ছেড়ে তুমি কোথায় চলে যাবে?! আর তাছাড়া তুমি ফটোগ্রাফি ছেড়ে দেবে মানে?! এই ফটোগ্রাফি নিয়ে তোমার কতো শখ.. তুমি সারা পৃথিবী ঘুরে ফটোগ্রাফি করতে চাও, সেটা তোমার স্বপ্ন.. আর সেই তুমি কিনা বলছো ফটোগ্রাফি ছেড়ে দেবে?!! তুমি জানো জিয়া? তোমার মতোই আমিও প্রতিটা দিন স্বপ্ন দেখি যে, তোমার সাথে আমিও সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াবো। আর তোমার ফটোগ্রাফি করাতে তোমাকে হেল্প করবো। সেসব ভেবেই তো আমি এই বিয়েটার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু মাঝখান থেকে কতো কিছু ঘটে গেলো! আমি মরে যাচ্ছি.. আমাকে সাথে নেবেনা জিয়া? বলোনা? তুমি তোমার স্বপ্ন পূরণের এই জার্নিতে আমাকে তোমার সাথে নেবেনা জিয়া? বলোনা গো প্লিজ…
আয়ান রাস্তার মধ্যেই কাঁদতে কাঁদতে জিয়ার পায়ের কাছে বসে পড়ে ওর পা দুটো জড়িয়ে ধরলো। পাগলের মতো করতে লাগলো ও। ওকে এরকমভাবে রাস্তার মধ্যেই পায়ের কাছে বসে পা জড়িয়ে কাঁদতে দেখে জিয়া ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। বাস স্ট্যান্ডে ধীরে ধীরে যাত্রীদের আগমন ঘটতে শুরু করেছে। কিছু যাত্রী বাসে উঠে নিজেদের গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে ছুটে চললেন। তারা এতোটাই ব্যস্ত যে জিয়া আর আয়ানের এমন কার্যকলাপের দিকে নজর দেওয়ার মতো কোনো সময়ই তাদের নেই। আবার কিছু জন যাত্রী নিজেদের প্রয়োজনীয় বাস পাওয়ার আশায় বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকার দরুন ওদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন একভাবে। আবার কিছু পথযাত্রীও হেঁটে অথবা সাইকেল কিংবা বাইকে যেতে যেতে ওদের দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছেন। কিন্তু দুজন পরিণত নারী-পুরুষের একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠ কথোপকথনের মাঝে ঢুকে পড়ার মতো ইচ্ছে প্রকাশ না করে পাশ কাটিয়ে নিজেদের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলেছেন। এমতাবস্থায় জিয়া কী করবে ভেবে না পেয়ে পায়ের কাছে নিচু হয়ে আয়ানের দুই কাঁধে হাত চেপে ধরে ওকে তোলার চেষ্টা করতে করতে বললো,
-কী করছো টা কী তুমি? রাস্তার মধ্যে এভাবে পা ধরে কান্নাকাটি করছো কেন? সব লোক তো আমাদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে! কী ভাবছে বলোতো সবাই?!
-ভাবতে দাও জিয়া। যাকে যা খুশি ভাবতে দাও! কে কী ভাবলো তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না! কিন্তু তবুও আমি তোমার পা ছাড়বো না! আমাকে এতো বড়ো শাস্তি দিওনা জিয়া! আমাকে এতো বড়ো শাস্তিটা প্লিজ দিওনা! কিছু দিন আগে পর্যন্তও আমি তোমাকে চিনতাম না, জানতাম না। ভালোবাসার মানে কী সেটাও বুঝতাম না! কাউকে যে এভাবে নিজের মন প্রাণ সবটুকু দিয়ে ভালোবেসে ফেলবো সেটাও ভাবিনি কখনও… কিন্তু তুমি আমার জীবনে আসার পর আমি বুঝেছি ভালোবাসা কাকে বলে। আমি আগে বুঝিনি যে, ভালোবাসায় এতো কষ্ট, এতো যন্ত্রণা! কাউকে ভালোবেসে যে মানুষ এতোটা নিঃস্ব হয়ে যেতে পারে, সেটা আমি তোমাকে ভালোবাসার পরে বুঝেছি জিয়া! আমি যে আমার সবটুকু দিয়ে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি! আমার নিজের কাছে যে অন্য কাউকে দেওয়ার মতো আর কিচ্ছু নেই… তোমার কথামতো কী করে আমি অন্য কাউকে তোমার জায়গায় বসাবো জিয়া? আমি যে নিঃস্ব হয়ে গেছি… তুমি আমাকে ছেড়ে দূরে চলে গেলে যে আমি পাগল হয়ে যাবো.. প্লিজ আমাকে ছেড়ে কোথাও যেওনা… আচ্ছা আচ্ছা আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি তুমি যা বলবে, আমি সেটাই শুনবো। কিন্তু তুমি শুধু আমার চোখের সামনে থেকো… আমি তোমাকে চোখের সামনে থেকে হারাতে চাই না জিয়া.. আমি তোমাকে সবসময় আমার চোখের সামনে রাখতে চাই! একটুকুও চোখের আড়াল করতে চাইনা…
আয়ান জিয়ার পা ধরে কাঁদতে কাঁদতে গোঙাতে শুরু করলো। ও এভাবে কোনো দিনও কাঁদেনি, বড়ো হওয়ার পর থেকে তো একদিনও নয়। আয়ান ছোট থেকেই কাঁদতে পারে না একদম। কাঁদলেই দম আটকে হাঁপিয়ে গিয়ে ওর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। আজও এভাবে কাঁদতে গিয়ে দম আটকে গিয়ে হাঁপাতে শুরু করলো ও। জিয়া কোনোরকমে ওকে তুলে ধরে বাস স্ট্যান্ডের যাত্রীদের বসার জন্য যে সরু লোহার রেলিং দিয়ে তৈরী জায়গাটা রয়েছে, ওখানে নিয়ে গিয়ে বসালো। আয়ানের এরকম অবস্থা দেখে একজন ভদ্রমহিলা তার ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে নিয়ে এসে এগিয়ে দিলো জিয়ার দিকে। জিয়া জলের বোতলটা হাতে নিয়ে ওনাকে একটা ধন্যবাদ জানিয়েই আয়ানের সারা মুখে আর মাথায় জল ছিটিয়ে দিতে লাগলো। তারপর ওকে হাঁ করতে বলে ওর মুখের মধ্যে একটু জল ঢেলে দিলো। আয়ান কোনোরকমে জলটা গিলে নিয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে জিয়াকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকের কাছে মুখ গুঁজে দিলো। আয়ান একটু শান্ত হতে ওকে উদ্দেশ্য করে জিয়া বললো,
-চলো, বাইকে ওঠো..
আয়ান জিয়ার দিকে ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,
-আমি পারবো না জিয়া। আমার এখন বাইক চালানোর মতো আর ক্ষমতা নেই! তুমি বাড়ি চলে যাও। আমি ঠিক সময়মতো বাড়ি চলে যাবো! আর হ্যাঁ, একটা কথা.. তোমাকে কাউকে ছেড়ে কোথাও যেতে হবে না। আমি তোমার কথা রাখবো। আমি শিয়া মানে তোমার দিদিয়াকেই বিয়ে করবো। তুমি প্লিজ ফটোগ্রাফিটা কখনও ছেড়ে দিও না! আর ওই প্রাণের চেয়েও প্রিয় ছবি গুলোকে নষ্টও কোরো না.. আমার এই কথাটা অন্তত রেখো… প্লিজ!
-আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি প্রফেসর, তুমি যদি আমার দিদিয়াকে বিয়ে করতে রাজী হয়ে যাও, তাহলে আমি আর কোথাও যাবোও না, আর ফটোগ্রাফিও ছাড়বো না! তুমি যখন দিদিয়াকে বিয়ে করতে রাজীই হয়ে গেছো, তখন আমার তো আর কোথাও যাওয়ারও কোনো প্রশ্নই নেই। আর ফটোগ্রাফি ছাড়ারও কোনো ব্যপার নেই! থ্যাংক ইউ প্রফেসর! থ্যাংক ইউ সো মাচ! আমি জানতাম তুমি ঠিক আমার কথা রাখবে। আমি তো জানি তুমি আমার কোনো কথা ফেলতেই পারবে না! আর আমি এটাও জানি, যে তুমি এখন বাইক চালানোর মতো অবস্থায় নেই। আমি তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ওখান থেকে একটা ক্যাব নিয়ে পিমণির বাড়ি চলে যাবো। আজ আমি খুব হ্যাপি প্রফেসর… আর সেটা তোমার জন্যই সম্ভব হয়েছে। চলো চলো ওঠো এবার… এখনও বসে আছো কেন তুমি? এসো এসো.. ওঠো…
জিয়া আয়ানকে গায়ের জোর দিয়ে টেনে তুলে বাইকের পিছনে নিয়ে গিয়ে বসালো। তারপর নিজেও বাইকে উঠে স্টার্ট দিয়ে দিলো বাইকের। তারপর বললো,
-এই হ্যাঁ প্রফেসর! তোমাকে তো বলাই হয়নি। জানো, আমার দিদিয়া ছোটো থেকেই আমার পিমণির বাড়িতে থাকে। তুমি সেদিন যেখানে দিদিয়াকে দেখতে গেলে, ওটা তো আমার পিমণি আর পিসানেরই বাড়ি! আমি যদিও এতোদিন দিদিয়ার পিমণির বাড়িতে থাকার সঠিক কারণটা জানতাম না, তবে এখন জেনে গেছি! আর দিদিয়ার কষ্টের কারণটাও বুঝে গেছি। সেই জন্যই তো তোমাকে এই বিয়েটাতে রাজী করালাম। জানো প্রফেসর…
জিয়া বকেই চললো নিজের মনে। কথা গুলো আদতে আয়ানকে উদ্দেশ্য করে বললেও, আর আয়ান সেগুলো শুনতে পেলেও, জিয়ার গলার স্বরটা শুনতে ভালো লাগলেও, সেই কথা গুলোর দিকে আয়ানের কোনো মনই ছিলো না। ও বাইকে জিয়ার পিছনে বসে ওকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে একমনে রাস্তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো আর জিয়াকে মাঝেমাঝে ওর বাড়ির পথ বলে দিচ্ছিলো। অন্য সময় জিয়াকে এতো কথা বলতে দেখলে, হাসিখুশি থাকতে দেখলে আয়ানেরও খুব ভালো লাগতো, আনন্দ হতো। কিন্তু আজ যেন জিয়াকে এতো হাসিখুশি দেখেও আয়ানের মনের ভিতরটা কেমন জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যেতে লাগলো…
ক্রমশ…
পড়লেন? কষ্ট হচ্ছে? কার জন্য? জিয়া, আয়ান নাকি শিয়ার জন্য?
চতুর্দশ পর্বের লিংক-
https://www.facebook.com/101048758811830/posts/270673268516044/