#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব ১

0
2034

#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব ১
#ফারহানা ইয়াসমিন

“টেরাকোটা” কফিশপের দরজাটা খুলে যেতেই রুহি নিজের বুকের ধুকপুকানিটা টের পেলো। হৃৎস্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে উঠছে তার। আরেকবার নিজের চোখের আয়নায় নিজেকে দেখে নিলো ভালোভাবে। সারাদিনের অফিস করা ক্লান্ত শরীর একটু অবসন্ন লাগছে এখন। এতোটা পথ জার্নি করে এসে ক্লান্ত লাগারই কথা। তবুও আসতে হলো। ছোট একটা চিরকুটের এতোই জোর যে সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে রুহিকে মিরপুর টু গুলশান দুইয়ের বিরক্তিকর জ্যামের রাস্তা ঠেলে আসতে হলো। রুহি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে কফিশপের চারিদিকে একটু নজর বুলিয়ে নিয়ে আবার নিজের পোশাকের দিকে তাকালো।
আজ কালোরঙের সালোয়ার কামিজ পরেই বেরিয়েছিলো সকালে। এখানে আসার প্রস্তুতি বলতে অফিস শেষে শুধু মুখটা ভালো ভাবে ধুয়ে একটু ক্রীম আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক লাগিয়েছে। চুলগুলো ইচ্ছে করেই এটে বেধে একটা লম্বা বিনুনি করেছে। আনমনে কানের ছোট্ট সোনার ঝুমকায় হাত বুলিয়ে নিলো রুহি। এটাও সবসময়ই কানে থাকে। গুলশান দুইয়ে নতুন চালু হওয়া এই কফিশপটা বেশ পশ। কফিশপে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই প্রশ্ন উঠলো, সে কি একটু বেশি নরমাল সাজে চলে এসেছে এখানে? বেমানান দেখাচ্ছে না তো তাকে? থাকগে, দেখালেই বা কি? মনে মনে নাক ওল্টায় রুহি। বেমানান লাগলেই বরং ভালো, সে তো তাই চায়। তাই চায় বলেই তো এতো নরমাজ সাজপোশাকে চলে এসেছে। ভাবনা বাদ দিয়ে রুহি কাঁধের ব্যাগটা আরো একটু ভালোমতো কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে ঘড়ি দেখলো। রাত আটটা, গুলশানে এটা কেবল সন্ধ্যা। যত রাত বাড়ে এসব এলাকা তত জমাটি হয়।
“ইয়েস ম্যাম।”
কফিশপের বেয়ারার আগমনে রুহির চিন্তার জাল ছিন্ন হয়। রুহি মৃদুস্বরে উচ্চারণ করে-
“রুমানা আনজুম। আম হ্যাভ আ রিজার্ভেশন।”
বেয়ারা ব্যস্ত হয়ে পড়লো-
“ম্যাম প্লিজ ফলো মি। স্যার ইজ ওয়েটিং ফর ইউ ফর লং টাইম।”
রুহি অবাক হয়ে বেয়ারার দেখানো পথ অনুসরণ করলো। ছেলেটা নাম শুনে তাকে চিনে ফেললো কি করে? আলোআঁধারির মাঝে বেশ দোটানায় থাকল রুহি। বড়সড় কফিশপের অনেকটা পথ পেরিয়ে বেয়ারা রুহিকে নিয়ে এলো একেবারে কোনার দিকে। থাইগ্লাসের ওপারে রাস্তা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। রাতের লাল নীল বাতিতে রাস্তাটা রহস্যময় দেখাচ্ছে। রুহি অনেকটা মোহময় হয়ে বেয়ারা টেনে দেওয়া চেয়ারে বসলো।
“হ্যালো রুহি। থ্যাংকস ফর কামিং।”
রুহি ঘাড় ফিরিয়ে সামনে বসে থাকা মানুষটাকে দেখলো। চেহারায় একটা বিগলিত হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে। রুহি অবশ্য পাল্টা হাসি দিলো না। বেশ বিরক্তি নিয়ে পাল্টা উত্তর দিলো-
“হ্যালো রাযীন।”
“আসতে খুব কষ্ট হলো তাই না?”
“কষ্ট তো হলোই। মোহাম্মদপুর টু গুলশান অনেকটা ঢাকা টু চিটাগং এর যাত্রার মতো। ঢাকার জ্যামে জীবন ত্রাহি অবস্থা।”
রুহির শুকনো কথায় রাযীনের ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেলো-
“ওহহহ। সরি কষ্ট দেওয়ার জন্য। আসলে তোমার এতোটা কষ্ট হবে ভাবিনি। আজ আমার এদিকে একটা জরুরি কাজ ছিলো। না হলে আমিই যেতাম তোমার কাছে।”
রুহির আর পাল্টা কিছু বলার ইচ্ছে হলোনা। এমনিতেই আজ সারাদিন ব্যাংকে প্রচুর প্রেশারে ছিলো। আজ মাসের শুরু বলে গ্রাহকের চাপ এই দিনগুলোতে অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশি ছিলো। আজ সারাদিন নিজের সিট থেকে উঠতে পারেনি রুহি। তারপর তিনঘণ্টা জ্যাম ঠেলে এতোদূর এই মানুষটার সাথে দেখা করতে আসার কোনো ইচ্ছে ছিলোনা রুহির। তাই চিরকুটটা হাতে পাওয়া মাত্রই দুমড়ে মুচড়ে ঝুড়িতে ফেলে দিয়েছিলো। কিন্তু মনটা খটখট করছিলো। হঠাৎ করে ভোলবাজির মতো জীবন থেকে হারিয়ে গিয়ে আবার হঠাৎ কি মনে করে ফেরত এলো লোকটা? প্রশ্নটা ঘুরে ফিরে আসছে তার মাথায়। জীবনে অনেকটা পথ এগিয়ে গেছে সে। অনেক কষ্টের পর নিজেকে একটু গুছিয়ে নিতে পেরেছে জীবনটাকে একটা পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে। এই মানুষটাকে পেছনে ফেলে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে। আজ হঠাৎ কি মনে করে আবার তার উদয় হলো? রুহি চাইলেও প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতে পারে না। কারন অনেকটা পথ পেরিয়ে এলোও যাত্রা শুরুর পথটাতেই যেন সে দাঁড়িয়ে আছে। তাই উত্তরের খোঁজে রুহিকে আসতেই হলো।
অবশ্য রুহির নিজের একান্ত ব্যক্তিগত একটা কারনও আছে। এতোদিন পরে সুযোগ যখন পাওয়া গেছে সেটা কাজে লাগাবে ভেবেই এতোকষ্ট করে আসা। সে কথা ভেবে রুহি রাযীনের দিকে তাকিয়ে শুকনো একটা হাসি দিলো।
“কি খাবে বলো। অফিস থেকে এলে খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই?”
রাযীনের আন্তরিকতা রুহিকে বেতাল করলো না। ওর বরং মনে বিরক্তি এলো। লোকটার সাথে এমন সামনা সামনি কথা এই প্রথমবার তবুও এমনভাবে কথা বলছে যেন অনেকদিনের চেনা কেউ। রুহির শরীরে জ্বালা ধরে রাযীনের এমন সম্বোধনে।
“শুধুমাত্র এককাপ কফি আর কিছু না।”
রুহির কাটকাট কথায় রাযীন কথা বাড়ায় না। বেয়ারা ডেকে দু’টো কাপুচিনো অর্ডার করলো। কফি আসা পর্যন্ত রুহি আবার রাস্তায় দৃষ্টিপাত করলো আর রাযীন রুহিতে। অনেক দিন পরে দেখা অথবা বলা যায় প্রথম মুখোমুখি দেখা। এই মেয়েকে এতো হ্যাপা পুহিয়ে খুঁজে বের করতে হবে এটাই কোনোদিন ভাবেনি রাযীন। অথচ পাঁচ বছর পরে দেশে এসে এটাই করতে হলো তার। নিয়তিও মাঝে মাঝে বেশ খেলা দেখায়। রাযীন চোরা হাসি দিলো, মেয়ের ভাগ্য বটে। দা গ্রেট রাশিদ শাহরিয়ার রাযীনকে গত পনেরো দিন ধরে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছে। রাযীন মন দিয়ে রুহিকে দেখলো। খুব আহামরি সুন্দরী না। গায়ের রং একটু ফর্সা বটে তবে চেহারা চলনসই। বোঁচা নাক আর ছোট ছোট ইদুরের মতো চোখ। রাযীনের মনে হলো, পাঁচ বছর আগে সে একদম সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। এই মেয়েকে মানায় তার পাশে? বাবা এই মেয়ের মধ্যে কি দেখে যে তার বউ করেছিলো? বাবার সিদ্ধান্তে নতুন করে বিরক্ত হলো রাযীন।

চামচের টুংটাং শুনে রুহি দৃষ্টি ফিরায়। রাযীন তার দিকে কফির কাপটা এগিয়ে দিলো-
“এবার কি আমরা কথা শুরু করতে পারি?”
রুহি এই প্রথম রাযীনের দিকে তাকিয়ে হাসলো-
“অবশ্যই। আপনার কথা শুনবো বলেই তো এলাম। এতোদিন পর হঠাৎ আপনার আমার সাথে কি জরুরি কথা থাকতে পারে সেটাই শুনতে চাইছি। বলুন কি বলতে চান।”
রুহির কথাগুলোতে প্রচ্ছন্ন খোঁচা টের পেয়ে রাযীন একটু থমকালো। কিছু একটা বলতে গিয়ে থামলো। মেয়েটা রেগে আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। রেগে থাকলে তার সাথে কথা বলা বৃথা। মেয়েটা কিছু মানতে চাইবে বলে মনে হয় না। রা্যীন চিন্তিত হয়ে কফির মগে চুমুক দিয়ে মুখ পুড়িয়ে ফেললো। রুহি ওর অবস্থা দেখে মুচকি হাসলো-
“এতো না ভেবে বলে ফেলুন। আর কিছুক্ষণ পর হয়তো আমার উঠতে হবে। আমি অনন্তকাল এখানে বসে থাকতে পারবোনা।”
এবারেও রুহির খোঁচা নীরবে হজম করলো রাযীন। এই প্রথম মনেহচ্ছে যতটা সহজ ভেবেছিলো কাজটা ততটা সহজ না। মেয়েটা কেমন যেন কাঠিন্যের ইমেজ নিয়ে আছে। অথচ বিয়ের সময় বাবা বলেছিলো সহজ সরল শান্ত মেয়ে। কোনকিছুই যেন মিলছে না। রাযীন ঘামতে লাগলো। মনেহচ্ছে জীবনের সবচেয়ে বড় কঠিন পরীক্ষায় সে বসেছে। রুহি এবার বেশ কৌতূহল নিয়ে তাকে দেখছে। চোখ নাচিয়ে জানতে চাইলো-ঘটনা কি? রাযীন অনেকটা সাহস একত্র করে লম্বা শ্বাস নিলো তারপর একনিশ্বাসে বললো-
“আই ওয়ান্ট ইউ গেট ব্যাক ইন মাই লাইফ।”
কথাটা শেষ হওয়া মাত্রই রুহির মুখের মধ্যে থাকা কফি ছলতে পড়লো রাযীনের মুখে। অবাক রাযীন বোকা দৃষ্টিতে রুহির দিকে তাকিয়ে আর রুহির দৃষ্টিতে বিস্ময়, কেবলই বিস্ময়।

চলবে—
©Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here