#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব ১৩

0
716

#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব ১৩
#ফারহানা ইয়াসমিন

“বড়পা, তুমি কেমন মানুষ বলোতো? সেই যে ফোন বন্ধ করেছো আর খবর নেই। শুভ ভাইয়া রোজ মন খারাপ করে ফোন দেয় আমায়। মানুষটা তোমাকে কি ভালোই না বাসে আর তুমি কিনা এই বড় বাড়িতে এসে তাকে ভুলে বসে আছো। তাহলে কি তুমিও অন্য সকলের মতো হয়ে গেলা? যারা টাকা দেখলে চোখ উল্টে ফেলে তেমন?”
রুমির কথা শুনে রুহির মনটা হুহু করে উঠলো। সব দিক দিয়ে সেই কেন দোষী হচ্ছে বুঝতে পারছে না। এদিকে বাবা বলে বিয়েকে একটা সুযোগ দাও ওদিকে শুভটা কষ্ট পাচ্ছে। এসে পড়েছে এক সার্কাসে যেখানে এখনো সবকিছু ধোয়াসা। রুহির ভীষণ হাসফাস লাগে। কি করবে না করবে মাথা কাজ করছে না।
“আরে রুমি, তোরও যা কথা? এতো আলিশান বাড়ি, এতো চাকচিক্যময় জীবনের লোভ কেউ কাটাতে পারে সহজে? শুভভাই কি এসব দিতে পারবে? সে বড়জোর একটা তিন বেডরুমের ফ্ল্যাটে রাখতে পারবে আপুকে। কোথায় শুভ কোথায় রাজ ভাইয়া। আপু বুদ্ধিমতী তাই বুঝে গেছে আগেই। আমিও তাই করতাম। তুই তোর শুভ ভাইয়ার গল্প বাদ দে।”
রুনির কথায় মেজাজ প্রচন্ড খিঁচে গেলেও শশুর বাড়িতে কোন সিনক্রিয়েট চায়না বলে চুপ করে রইল রুহি। রুমি অবশ্য চুপ থাকলোনা-
“ছোটপা, তুমি নিজে যেমন সবাইকে তা ভাবলে তো হবে না। বড়পা মোটেও তেমন নয় তা তুমিও ভালো মতোই জানো। উল্টো পাল্টা বলে রাগিয়ে দিয় না।”
“তোর বড়পাকে রাগিয়ে দিতে আমার বয়েই গেছে।”
বলেই রুনি ঠোঁট উল্টে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। রুমি বোনের কাছে এসে বসলো-
“বড়পা, প্লিজ ভাইয়ার সাথে কথা বলো। মানুষটা পাগল মতো হয়ে আছে।”
“এখন না রুমি। অনুষ্ঠান শেষ হোক তারপর বলবো।”
“ঠিক আছে তুমি যেমন ভালো বোঝো।”
রুমি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। বাবামাকে ঢুকতে দেখে আর কথা না বাড়িয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।
“মারে, আমার উপর এখনো রাগ করে আছিস নাকি?”
ইয়াকুব আলী মেয়েকে কাছে ডেকে নিজের পাশে বসালেন। রুহির মায়ের সাথে চোখাচোখি হলো।দিলারা মেয়ের মুখপানে চেয়ে আছেন। ইয়াকুব আলী জবাব না পেয়ে রুহির মাথায় হাত রাখেন-
“বন্ধু মানুষ, তার এই অবস্থা শুনে সহ্য হয় নাই। এখন নিজের চোখে দেখে মনে হলো তোকে পাঠিয়ে ঠিক করেছি। মানুষটার জায়গায় আমিও থাকতে পারতাম। কতোদিন বা বাঁচবে লোকটা? ততদিন না হয় তুই কষ্ট করে থাক? না থাকলে আমার বলার কিছু নেই। তারপর যেমনটা তোর মর্জি হবে করিস।”

★★★

সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে রাযীন যখন এ্যাশ কালার স্যুট পরে রুহির পাশে এসে দাঁড়ালো রুহির যেন চোখ ঝলসে গেলো। সবসময় রেগে থাকার কারনে রাযীনকে সেভাবে দেখা হয়নি কখনো। এই ছেলে দেখা যায় মারাত্মক হ্যান্ডসাম। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামা, একটু বড় বড় চুলগুলো ঘাড় অবধি এসে আছে। সেগুলো জেল দিয়ে সেট করা। ফিট বডিতে আঁটো পোশাক ওর সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছে। রুহি পাক্কা একমিনিট তাকিয়ে রইলো।
“এই মেয়ে, এভাবে কি দেখছো?”
“নট ব্যাড। আপনার স্প্যানীশ গার্লফ্রেন্ড এখন দেখলে ফিদা হয়ে যেতো।”
রুহি ভ্রু নাচায়।
“তাই? তুমি হয়েছো?”
রুহি ভ্যাবাচ্যাকা খায়-
“কি?”
“ফিদা হয়েছো? তোমার সেই প্রেমিক সুন্দর না আমি?”
“এ আবার কেমন প্রশ্ম? কারো সাথে কারো তুলনা হয়? তাছাড়া যাকে ভালোবাসি তার জায়গা অনেক উপরে।”
“বাব্বাহ। বেশ কথা জানো দেখছি।”
“সে জানি।”
রুহি প্রফুল্ল চিত্তে উত্তর দেয়। রাযীন মুখ টিপে হাসে। মেয়েটা মাঝে মাঝে নরমাল কথা যখন বলে তখন ভালোই লাগে।
“তোমরা জামাই বউ এতো গুটুর গুটুর করে কি গল্প করছো বলোতো? দূর থেকে দেখতে বেশ লাগছে। সবাই বলছে তোমাদের দুটিতে বেশ মানিয়েছে।”
বেনু এসে আলাপ জুড়ে দিলো। রুহি বেশ লজ্জা পেয়ে গেলো। আসলেই কি সে গল্প জুড়ে দিয়েছে?
“আরে লজ্জা পাচ্ছ কেন? চালিয়ে যাও। আচ্ছা শোন, আমি এলাম একটা খবর দিতে। ফুপুমারা এসেছে। বড়মা তাদের নিয়ে আসছে। রুহি ভাবি, তোমায় কিন্তু পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে হবে। কোন ভুল যেন না হয়।”
রুহির কোমড়ে অলরেডি প্রচন্ড ব্যাথা। তবুও সে রুহি মাথা নাড়লো।
“বউ তো মাশাল্লাহ রোজী। দু’জনকেই ভালো মানিয়েছে। এবার যদি তোমার ছেলে ঘরে বসে। নাকি আবার পালাবে?”
“রোজীরও কপাল। দূর্ভাগ্য না হলে কি আর এমন হয়? কতো সুন্দর সাজানো গোছানো সংসারটা এখন এলোমেলো হয়ে গেছে। বেচারি একা একা কতোদিন সামলাবে?”
“ভাই সাহেব ছেলেদের দূরে রেখে রেখে বাজে অভ্যাস করে ফেলেছে। তাদের বাবার ব্যবসা কিংবা সংসারে কোনো টান হয়নি।”
টুকরো টুকরো মন্তব্য কানে আসছিলো রুহির। অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে এসবই ভাবছিলো। রাযীনকে কয়েকটা প্রশ্ন করার ছিলো তার। প্রশ্নের উপর জানা জরুরি। কিন্তু রাযীন তার পুরনো বন্ধুদের পেয়ে হাওয়া হয়ে গেছে।

“রুহি, শেষ পর্যন্ত ফোনটা খুললি? আজ যদি তুই কথা না বলতি আমি কি করতাম জানি না।”
শুভর কাতর কন্ঠ শোনা গেলো। রুহি দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরে-
“এসব কি কথা শুভ? এমনকি কথা হয়েছিল?”
“কথার গুল্লি মারি। আমি কিছু শুনবো না আর। এভাবে চলতে পারে না রুহি হয় তুই আমার কাছে আয় নয়তো আমাকে আসতে বল।”
“অসম্ভব কথা বলছিস শুভ। আমাকে ভালোবাসলে বিশ্বাস করতে হবে ভরসা করতে হবে অপেক্ষা করতে হবে শুভ।”
“অপেক্ষা! কতোদিন অপেক্ষা করতে হবে? অনন্তকাল?”
“যদি বলি তাই?”
“এভাবে বলিস না রুহি। এভাবে জীবন চলবে না। অনিশ্চিত পথে কি যাত্রা করা যায়? তোকে ভালোবাসি, এতোগুলো দিন একসাথে কাটিয়েছি। ভীষণ কষ্ট হয় তোকে না দেখে থাকতে। তুই যদি এমন করে বলিস তাহলে ভাববো এসব বলে আমায় ঝেড়ে ফেলতে চাস?”
শুভর কথায় স্পষ্ট ক্ষোভের আভাস। রুহি নিশ্চুপ রইলো কিছু সময়। তারপর গভীর শ্বাস ফেলে বললো-
“আমার শশুর ক্যান্সারে আক্রান্ত, প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। তার শেষ ইচ্ছে এ বাড়িতে আমার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। আমি তার ইচ্ছেকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বেড়িয়ে পড়তে পারি এ বাড়ি থেকে। কিন্তু তুইই বল এটা কি ভালো দেখায়? একজন মৃতপ্রায় মানুষকে এভাবে আঘাত দেওয়া কি মানুষের কাজ হবে?”
শুভ নিশ্চুপ শুনলো তারপর কিছু না বলে ফোন কেটে দিলো।

★★★

সকালে বাবা মাকে বিদায় জানিয়ে দোতলায় নিজের ঘরে ফিরতে ফিরতে অদ্ভুত একটা ব্যাপার আবিষ্কার করলো রুহি। গত কয়েকদিনে ব্যাপারটা নজরে এলেও প্রশ্ন আসেনি। আজ ভালোমতো লক্ষ করে বেশ অবাক হলো। ব্যাপারটা কেমন যেন অস্বাভাবিক। এইরকম একটা পরিবারের সাথে খুবই বেমানান ব্যাপার। রুহি সকালে নাস্তার টেবিলে ভরা মজলিসে প্রশ্নটা করেই ফেললো-
“আচ্ছা, আপনাদের কোন পারিবারিক ছবি নেই কেন? এই যে দেয়ালজুড়ে এতো এতো সম্মাননা, সার্টিফিকেটের ফ্রেম ঝুলছে কিন্তু কোথাও পরিবারের সকলে মিলে একসাথে ছবি দেখলাম না।”
পুরো টেবিল জুড়ে পিনপতন নিরবতা নেমে এলো। সবাই একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো কিন্তু কেউই মুখ খুললো না। অবশেষে খুকু বললো-
“তোমার শশুর পচ্ছন্দ করে ছবি দেওয়ালে ঝুলানো। তবে সবার নিজের নিজের পচ্ছন্দ মতো ছবি আছে তাদের নিজেদের ঘরে। সব জায়গায় ছবি রেখে ঘরকে ফটো এগজিবিশন সেন্টার বানানোর দরকার কি?”
রোজী অত্যন্ত বিরক্ত রুহির উপর সেটা টেবিল ছেড়ে প্রমান করে দিলেন। ছেলেরা অফিসের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেলো এক রাযীন ছাড়া। শিখা অবশ্য ফোড়ন কাটতে ভুললো না-
“তোমার কৌতূহল অনেক বেশি বৌমা। এতো কৌতুহল কিন্তু ভালো না। খামোখাই বিপদ ডেকে আনে।”
বলে আর দাঁড়ায় না শিখা। রুহি বোকা চাহুনি দিয়ে বসে থাকে। সে কি এমন কিছু জানতে চেয়েছে যেটা জানলে পাপ হবে? নরমাল একটা প্রশ্ন অথচ এমন ভাব করলো সবাই যেন কাউকে খুন করার কথা বলেছে। আজব!
“শোন, তোমার কিছু জানার ইচ্ছে হলে আমাকে প্রশ্ন করবে। এভাবে সবার সামনে জানতে চাইবে না।”
রুহি জানতে চাইলো সে কি এমন বলেছে যে এমন রিয়্যাকশন করলো সবাই? কিন্তু রাযীন সে সুযোগ দিলো না। সে কথা শেষ করেই গটগটিয়ে হেঁটে চলে গেলো।

চলবে—
© Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here